রণজিৎ অধিকারী
প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রেম ও রাত্রির কবিতা", যদিও নিজস্ব কাব্যভাষা খুঁজে পেতে আরো দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সমাজ ও সময়কে একটা বিপরীত কোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি " আস্তাকুঁড়ের কবিতা" বইটিতে, ঠিক তার পরের বইতেই আরো বড়ো ব্রহ্মাণ্ড, তার অদৃশ্য জগৎকে বুঝে নেওয়ার অক্ষম চেষ্টা।
"উই পোকা ও নাক্ষত্র" থেকে পরের কাব্য "টেথিস সাগরের স্মৃতি" র কবিতার দূরত্ব অনেকখানি, ভাষা তার অভিমুখ বদলেছে। তারপর কখন অজান্তে বাইসন তার ভঙ্গি নিয়ে অরণ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, তাও কত লক্ষ বছর আগেকার, আমরা তার কত কত পরে একদিন সন্ধ্যার আগে বনে বাইসন দেখতে গেছি।টের পেয়েছি বাইসন তৈরি হওয়ার কত আগেই মস্তিষ্কের ভেতরে তার সম্ভাবনা প্রস্তুত হয়েছে ক্রমে ক্রমে।
একটি প্রতিবেদন
মেয়েটি ঈষৎ দুলতে দুলতে সেই ছন্দের ভেতরেই আর্তনাদ করে ওঠে,
শূন্য মনে হয় সব ; যেন আজ সব শালপাতা ঝরে পড়বে।
তাকে এই ছন্দ দিয়ে চলে পুরুষটি —এক মূঢ় বৃষের মতো।
...। এর কোনো অর্থ নেই তোমার মনে হবে। তুমি
পাশে দাঁড়িয়ে যদি অনুপুঙ্খ দেখ —মেয়েটির সমূহ লজ্জাস্থান ঢেকে
পুরুষটির দেহ।
তুমি যা দেখতে পাবেনা —কেন মেয়েটির এসময় খালি
নদীপাড় দিয়ে হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি মনে আসছে!
গা শিরশির করে ওঠে নদীর হাওয়ায় ; দর্শক তুমিও
তাদের শীৎকারে কেঁপে উঠবে।
ছলাৎছল ধ্বনির ধাক্কা পাড়ে এসে লাগছে।
পাড় কোথায়! — এই পায় যেন, এই হারায়।
তখন আসুরিক বলে পুরুষটি দু'হাতে পৃথিবীশুদ্ধ শূন্যে তুলে নেয়,...
দেওয়ালে ঠেসে ধরে...। একটা বড়ো গর্ত শুষে নিচ্ছে নাক্ষত্র তেজ।
মেয়েটি তখনো ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে... আর
ছন্দ কীভাবে সবকিছুকে নিঃশেষে ধ্বংস করে দেয়!
তুমি এবার অনুপুঙ্খ থেকে চোখ সরিয়ে লং-শটে রোদ ও নিসর্গ পেরিয়ে
আকাশ নক্ষত্রের দিকে চলে গেলে সব ঝাপসা হয়ে আসবে।
ঘড়ি, সময় মাপার যন্ত্রবিশেষ
ঘড়ির মতো এক কুৎসিত যন্ত্র যে কিনা দায়িত্ব পেল সময় মেপে দেবার!
কারুর মনেই হয়নি এইভাবে মাপজোখ
অন্য গ্রহেরা, দূর ছায়াপথের গ্রহেরা
ভালো ভাবেনেয় না।
যেমন আমরা কখন বের হচ্ছি গর্ভ থেকে, কখন
শেষতম নিঃশ্বাস ফেলছি ... ভূমিকম্প,
সমুদ্রের ফেঁপে ওঠার সময়কাল নিয়তি হিসেবে না-দেখে
ঘড়ির মেপে রাখা সময় লিখে রাখছি।
যেভাবে ঘড়ি প্রতি রাতেই এক নির্দিষ্ট সময়ে
পৃথিবীর বাচ্চাদের ঘুমোতে পাঠায়
বাবা মাদের আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য।
আমাদের জাহান্নামে নামার সময়সূচি,
স্বর্গারোহণ পর্ব ...
ঘড়ির মতো এক কুৎসিত যন্ত্র কী করে দায়িত্ব পায়
এত বড়ো গভীর সময়কে মাপার!
প্রণয়বিষয়ক
মেয়েটি দেখিয়ে দিতে চাইলে পুরুষটি বলল,
— কোনোকিছুই শিখতে চাইনা, আমি
প্রত্যেকবারই আনাড়ির মতো সবকিছু শুরু করতে চাই।
ভালোবাসা কোনো পেশাদারি কাণ্ড নয়।
কিন্তু মেয়েটি তার যৌবনের অহংকারে ঝামটা দিয়ে ওঠে
আর দাবি করে —পৃথিবীতে কিছু জিনিস
ঠিক সময়ে শিখে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন,
কড়াইটা ঠিকঠাক ধরতে পারা —হাতে তাপ না লাগে,
আঙুল কখন কতখানি বাঁকিয়ে নিতে হবে,
হলুদের পরিমাণ, ঠিক সময়ে রাতপোশাকের ফিতে
খুলতে পারার নৈপুণ্য... কখনোই কোনো
আনাড়ির কাজ নয় আর বারবার ভুলভাল করে ফেলা
প্রণয়কে দীর্ঘায়িত করেনা।
বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ আসা এক তাড়নায়
চুম্বন করতে গিয়ে অমসৃণ দেওয়ালে পুরুষটির
হাত ঘষে যায়... তখনই একটা পুড়ে যাওয়া গন্ধ ওঠে
বসানো রান্না থেকে। কিন্তু এসবকিছুকে অস্বীকার করে
পুরো ঘরটা তখন হাওয়ায় ভাসতে থাকে।
অসহায় যুবতী তখন হাতের কাছে এগিয়ে দেয় —
কীভাবে আর কোনটার পর কী... যদিও
পৃথিবীতে আজপর্যন্ত প্রেমিকেরা কিছুই শেখেনি বরং
তাড়াহুড়োয় গিঁট পড়ে যাওয়া রাত পোশাকের ফিতে
শেষমেশ খুলে দিতে হয় সঙ্গিনীকেই!
পৃথিবী, ঘুরতে ঘুরতে যখন জট পাকিয়ে যায় তার
নিজেরই সুতোয় যেন এক অদৃশ্য নারী এসে তাকে
উদ্ধার করে দেয় সমূহ বিশৃঙ্খলা থেকে।
কোথা থেকে শুরু
আমরা সঙ্গমের আগে রেখেছি পোশাক খোলার উৎসব।
—যেন এই এখান থেকেই শুরু ; যেভাবে একটা লোক
আঙুল দিয়ে দেখায় দূরের কোনো গ্রাম বা নদী। কিন্তু
আদপে তা ঠিক কোথা থেকে শুরু!
বেশিরভাগ লোক —যারা দ্রুতলয়কেই গান বোঝে, তারা
কখনোই টের পায়নি যন্ত্রগুলোর সুর বেঁধে নেওয়া,
আসরে সন্তর্পণে তাদের পোশাক খুলে রাখা থেকেই
হতে পারে প্রেমের শুরু।
তুমি যদি খুব তাড়াহুড়ো না করো তো আমাদের
পোশাক খুলে একটা সাদা পাথরের ওপর রাখো।
যদিও তাকাতে পারবে না আর তুমি কাঁপতে কাঁপতে
হয়তো লক্ষই করবে না —যে তখনই, ঠিক তখনই
স্তনবৃন্তেরা জেগে ওঠে এবং সুগন্ধি ছড়ানো শুরু করে।
পোশাকের মধ্যে যে ছিল ভেদ বোঝানোর চিহ্নমাত্র, সে
তখন হয়ে ওঠে এক অপরূপ আধফোটা ফুল —তার
ঠোঁটগুলো তখন শুধু কথা বলতে চায়!
আমরা যদি সত্যিই শুরু করতে চাই ধীর লয়ে তবে
দ্রুত তানকারির আগে বিলম্বিত ওঠানামা —তাকে
দীর্ঘায়িত করি এসো।
এখনো আমাদের জন্য আছে একটা খোলামেলা পৃথিবী
— আর কোথা থেকে প্রেমের শুরু!
সঙ্গমের আগে, পোশাক খোলারও আগে এসো খুঁজে নিই
পোশাক গুছিয়ে রাখার একটা সাদা পাথর।
দুপুরলিপি
এখানে অনেকটা দুপুর, আর বড়ো একটা নিমগাছ।
খাঁজকাটা নিমপাতার ভেতর দিয়ে তাকাতে
এত ভালো লাগে!
একেকটা পিঁপড়ে পৃথিবী মাথায় করে আনছে, তাদের রাস্তায়
একটা টগর ফুল... রাস্তা বেঁকে যায়।
অনেক বড়ো সময়কালের ভেতর এই দুপুর, পিঁপড়ের
সারির যেকোনো একটা পিঁপড়েরই মতো।
কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে!
দুপুর এখানে অনেকটা। কোনোদিন টুকরো টুকরো করে
কিছু কেটে রাখছিলাম পাশে —কাঠের টুকরো, সকাল,
বিকেল, সন্ধে ... দুপুরটা একটু বড়ো ;
নিজের হাতে কাটা তবু ছোটো বড়ো হয়ে যায় ফালি!
জানালা থেকে দেখা যায়, এই রৌদ্রে রাস্তায় ঝুঁকে
কাজ করা শ্রমিক —ওর নিজের কোনো দুপুর নেই,
ওর রাত্রিটা বড়ো করে কাটা।
উপমারা হারিয়ে গেছে, কিন্তু একটা শূন্যস্থান থেকে
আমাকে দেখছে কেউ —একটা হতে চাওয়া কবিতা!

No comments:
Post a Comment