Showing posts with label নভেলেট. Show all posts
Showing posts with label নভেলেট. Show all posts

Monday, August 30, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

 ডারউইনের চিঠি 
পর্ব~২৩ (শেষ অংশ)
অরিজিৎ চক্রবর্তী

" A mathematician is a blind man in a dark room looking for a black cat which isn't there."----- 
                                                                                         Charles Darwin

অথচ আর ফেরা হয়না। ফেরাগুলো না ফেরার অন্ধকারে হারিয়ে যায়! শিকড় তার শাখাপ্রশাখা নিয়ে মাটির মধ্যে গভীর ভাবে গাছটাকে বাঁধে। বদ্ধমূল মানুষ নিজের মাটি, ঘর-গৃহস্থলি, প্রতিবেশী, পরিচিত দিগন্ত, আকাশ ছাড়তে চায় না।

সম্মোহ নিজেও কি ছাড়তে চায়? প্রয়োজনে দিন দুয়েকের জন্য বাইরে কোথাও গেলেও মনটা এখানেই যেন আটকে থাকে। সুতানের এই নির্জনতা! রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঁঝিঁর ডাক এগুলোর বাইরে সম্মোহ আজকাল কেমন যেন অসহায়! জীবনের অঙ্ক যে কখনো মেলে না এবং তা অমীমাংসিত সেটা বুঝে গেছে সম্মোহ! আজকাল মনে হয় এই অমীমাংসিত অধ্যায়টাই জীবনের ধ্রুবক !

চলার পথের প্রতিটি বাঁকে একটা অদ্ভূত জিজ্ঞাসা সেমিকোলনের মতো আচরণ করে। আজকাল কেমন যেন নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয়। বড্ড অচেনা লাগে।  সম্মোহ ভাবে সে সম্মোহ নয়! সে অন্য কেউ। তার আত্ম অনুভবের অনটন যতই চরমে উঠেছে, মন ততই ফিরে যেতে চেয়েছে আত্মজিজ্ঞাসার বিস্ময়ের দিকে? ঘটেছে বিপর্যয়! বেঁচেবর্তে থাকার ন্যূনতম শূন্যস্থান যখন কমে এসেছে আরো দ্রুত---স্বপ্নগুলো ততই আঁকড়ে ধরেছে তার পৃথিবীকে।

অনেক কথাই মনে পড়ে। আবার অনেক কথাই ভুলে যায় সন্মোহ। মনে পড়ে সেই থমকানো স্তব্ধ মেঘভর্তি বিকেলের কথা। গুপ্তঘাতকের মতো নৈঃশব্দ্যকে সঙ্গে নিয়ে সে এলো! ব্যাথামিশ্রিত গলায় লঘু স্বরে কিছু বলল। আবার চলেও গেল। 
এরপর থেকেই একটা অলীক ভয় সম্মোহকে তাড়া করে ফিরত সর্বদা, সর্বত্র। 

জীবনের উত্তরহীন প্রশ্নই বেশি। তাই,  কেন? 
কি কারণে?   কিভাবে?  এইসব জিজ্ঞাসার বাইরে দাঁড়িয়ে সম্মোহ যখন আকাশের দিকে তাকালো... ভাবল এই জীবনটাই বৃথা, এই জীবনটাই ধোঁকা , ঠিক তখনই একঝাঁক বক উড়ে চলে গেল সোজাসুজি দিকচক্রবালে।

 খেলা ভাঙার খেলায় শ্রম ও সঙ্গীতের মতো লীমা ঢুকে পড়ল জীবনের গণিতে। শ্রমের অপরিহার্যতা স্পষ্ট, সঙ্গীতেরও। কিন্তু গণিত? এ যে এক ধরনের চূড়ান্ত বিমূর্ততা। স্বতঃসিদ্ধ একটি পাঠের মতো -একটি সরলরেখার বাইরের কোনো বিন্দু থেকে ঐ সরলরেখার সমান্তরাল করে ঐ তলে একটিমাত্র সরলরেখাই আঁকা যাবে। এরকম একটি বক্তব্যকে ইউক্লিডের অন্যান্য স্বতঃসিদ্ধ থেকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত অথবা অপ্রমাণিত করার প্রকল্প গ্ৰহণের কি মূল্য থাকতে পারে ব‍্যাক্তিজীবনে অথবা সমগ্ৰ মানব জীবনে? অথচ ঘটেছে এমনটিই। অনেক সময় মনে হয়ছে শ্রম বা সঙ্গীতের মতো বিমূর্তকরণের দিকে মানুষের টান স্বভাবজ।

----" ফর গডস সেক সম্মোহ, সে সামথিং" সম্মোহ প্রায় চিৎকার করে উঠল! আবার ভয়টা সামনে এসে দাঁড়ালো। সম্মোহ ক্ষণিকের মধ্যে ঘেমে উঠলো। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আবার একটা ঝড়ো হাওয়া সমস্তটাই জুড়িয়ে দিল।

"...এখন আমি এমন একটা পর্যায়ের মধ্যো দিয়ে চলেছি যখন ভাবনার ধারা বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর পথে বইয়ে দেওয়া সম্ভব। মাথার উপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। শুধু ক্ষণকাল চিরকালের সঙ্গে পার্থিব বাস্তবতার অবাস্তব সঙ্গী হয়ে উঠেছে কেউ। আবেগ স্থির নয়,বিভাজ‍্যও নয়। মুহূর্ত চালিত 'point of time' দ্বারাই আমি আমার অবস্থান কেন্দ্রিক..."

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। লালুকাকা চা নিয়ে এলো। বলল, " বাবু দুপুরে ভাত-তড়কারি ঢাকাই পড়ে আছে। খেলেনি?"

---- "না! খেতে ইচ্ছে করেনি। রাতে খেয়ে নেব।"

----" কেন গো! শরীর খারাপ হলো নাকি?"

----" না গো! এমনিই ইচ্ছে করল না।"

লালুকাকা চলে গেল। বুঝল তার বাবুর মুডটা ঠিক নেই।

টেবিলের ওপর বিয়ের কার্ডটা তখন প্রজাপতির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে! কি দরকার ছিল এটা পাঠানোর। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া ছাড়া এর মধ্যে কোনো আবেগ খুঁজে পাচ্ছে না সম্মোহ। সম্মোহ ঠিক করতে পারছে না কি করবে? এই আমন্ত্রণে সেকি সাড়া দেবে? নাকি একটা কিছু উপহার কিনে পাঠিয়ে দেবে। সকাল থেকেই এই একটা বিয়ের কার্ড সম্মোহকে বড্ড বেশি এলোমেলো করে দিয়েছে। কিছুতেই যেন মনটাকে স্থির করতে পারছে না।

জীবনের দুই প্রান্তে পরস্পরকে পছন্দ করা দুজন মানুষ কিভাবে আলাদা হয়ে যায়, কিভাবে তারা একে অপরের প্রতি দূরত্বের দায় নিয়ে বেঁচে থাকে, এটাই যেন সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার! তবু জীবন এগিয়ে যায়। কেউ অন্যকোন প্রিয়জনকে খুঁজে নেয়। ফেলে আসা মানুষটির প্রতি  কখনো কখনো অনুকম্পা থাকে। তার থেকে বেশি কিছু নয়।সম্মোহ দেখে কার্ভের মধ্যে একটা ফোন নম্বর দেওয়া আছে। একবার ভাবে ফোন করবে। ফোন করে খানিকটা ঝগড়া করবে। গালিগালাজ করবে। কিন্তু ইচ্ছে করে না।কারণ ইচ্ছের অধিকার থেকে সে সে এখন বহুদূরে। 

রাতের জ্যোৎস্নালোকিত জঙ্গলে হাঁটতে বেরোয় সম্মোহ। তার হাঁটা পথের রিক্ততায় জঙ্গল যেন হো হো করে হেসে ওঠে। দূর থেকে ভেসে আসা মাদলের শব্দ যেন হেরে যাওয়ার সুর হয়ে কানে বাজে। কেউ নেই। চারপাশে কেউ নেই। শুধু এই জঙ্গলের অবারিত আশ্রয় আছে। একটা কুকুর পিছু পিছু আসছে থাকে। সম্মোহ অন্যমনস্কতার মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করে কালু আসছে তাকে অনুসরণ করে।

কালো কুকুরকে ভয়ঙ্কর ভৈরবের পুনর্জন্ম বলেও অভিহিত করা হয়। মহাভারতে যুধিষ্টির অনুরোধ করেছিলেন ধর্মরূপী যে কুকুরটি তার মহাপ্রস্থানের পথে সঙ্গী ছিল তাকেও যেন স্বর্গলাভের সুযোগ দেয়া হয় । যম জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠিরের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য এই রূপটি নিয়েছিলেন। হয়তো এই  বিশ্বস্ততম পৃথিবীর আদিম সঙ্গীটিই আজ সম্মোহকে পৌঁছে দেবে কোনো অতীন্দ্রিয় একাগ্ৰতায়! সেখানে লীমা নেই, বিকাশ নেই, লালুকাকা নেই, সাধন নেই, কেউ নেই। শুধু একটা বিবর্ণ টেবিলের উপর জ্বলে থাকা টেবিলল্যাম্পের নিচে এলোমেলো অক্ষরে লেখা একটা চিঠি আছে...


Sunday, August 22, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র   ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২২

সন্মোহ দেখল তাকে।

খুব নিচু স্বরে বলল, তোমার ভাবনাগুলোকে আমি এনডোর্স করছি না। তবে এখন যা ভাবার আমি ভাবব। যা বলার আমি বলব। তুমি চুপ করে শুনবে। প্রতিবাদ করবে না। প্রতিরোধ করবে না। মেঘে ঢাকা তারার ভেতর থেকে এগিয়ে আসবে চাঁদের মতো।পাটভাঙা দুধে আলতা শাড়িতে খোলাচুলে তুমি হয়ে উঠবে সিন্ডারেলা!

আচমকা উচ্চকিত হাসিতে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একদলা ঘৃণা ছড়িয়ে কেউ বলে ওঠে, ছিঃ! প্রতারক! স্বার্থপর! অমানুষ!

সন্মোহ চেঁচিয়ে উঠলো, " তুমি আসলে কেউ নও! তুমি প্যারানইয়া! সন্দেহবাতিকগ্ৰস্থ রুগি! 

---- ঠিক বলেছ। একজন সুস্থ মানুষকে রুগি বলে চালিয়ে দেওয়ার সহজ প্রতিহিংসা তোমার মধ্যে ছাড়া আর কার মধ্যে থাকবে!

"মুহূর্তের নির্বাপন চাইছি আর দশবার চটজলদি
"গীতা"উচ্চারণ করছি... তুমি শুনছ "ত্যাগ"

অরিজিতের লেখা কবিতার দুছত্র মনে পড়ে যায় সম্মোহের। মনে পড়ে যায় আরও অনেক কিছু। 

মহাদেবের কথায় ব্রক্ষ্মা লজ্জা পেলেন এবং একই সঙ্গে অনলের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, " কাম যেমন আপনার সন্মুখে আমাকে শরাঘাত করল, তার ফল সে পাবে। এই কন্দর্প অহঙ্কারে মত্ত হয়ে অতি দুষ্কর কাজ করতে গিয়ে আপনার নয়নানলে ভষ্মীভূত হবে।"

এই শাপ শুনে ভীত কাম ব্রক্ষ্মাকে বললেন, " আমার কি দোষ প্রভু? আপনিই বলেছিলেন যে, "আপনি, বিষ্ণু এবং মাহেশ্বরও আমার বশবর্তী হবেন। আমি তো তারই পরীক্ষা করছিলাম। আমি নিরপরাধ। আমার শাপ মোচন করুন।"

ব্রক্ষ্মা বললেন," তুমি মহাদেবের নয়নাজলে ভষ্মীভূত হয়ে আবার তারই অনুগ্ৰহে শরীর ফিরে পাবে।"

---- গাঁড় মারানোর কেত্তন!" সম্মোহ অস্ফূটে বলে উঠলো। আজ যেন চিন্তার কোন মাথামুন্ডু নেই।"

একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ট্রু-কলারে ভেসে উঠলো, অলিভিয়া দত্ত।

---- "হ্যালো!"

---- "হ্যাঁ হ্যালো, আমি অলিভিয়া দত্ত বলছি ব্যারাকপুর থেকে। আপনার ওখানে আগামী শুক্রবার রুম পাওয়া যাবে?"

---- "হ্যাঁ, পাওয়া যাবে। কটা রুম লাগবে?"

----- "একটাই ডবল বেড। আমি আর আমার মা যাব। সঙ্গে জিল। পেট অ্যালাও তো!"

---- "না না, হবে না।"

-----" জিল খুব ভালো। সহবত জানে। আপনাদের কোন অসুবিধে করবে না। প্লিজ না বলবেন না।"

----" আচ্ছা ঠিক আছে। দায়িত্ব আপনার। কাউকে আবার যেন কামড়ে-টামড়ে না দেয়!"

---- " আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কিছু এ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিচ্ছি।"

-----" লাগবে না। চলে আসুন। এটা কি আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নং?"

-----" হ্যাঁ, এটাই।"

 -----"আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।"

----" ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আর একটা কথা, সঙ্গে ড্রাইভার থাকবে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করবেন প্লিজ।"

-----" শুনুন রুম চার্জ পনেরো শো। এখানে এসির কোনো ব্যবস্থা নেই। ড্রাইভার রুম পাঁচশো। খাওয়াদাওয়া আলাদা। আপনার জিল বিড়াল কিংবা কুকুর যাইহোক ও যদি আপনাদের সঙ্গে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা চাদর বালিশের ওয়্যার প্রোভাইড করবো না। আপনাদের করে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, বড় সমস্যা হয় এদের নিয়ে। দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে দেয়।"

---- না না, আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না। ও খুব জেন্টল!"

-----"সে হোক। তাও ওগুলো সঙ্গে নিয়েই আসবেন। ঠিক আছে। রাখি তাহলে,  ভালো থাকবেন।

সম্মোহ ফোনটা রেখে আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকল! যেন চারপাশে একটা ঘোর লেগে আছে। আকাশের তারা গুলোকে কেমন যেন সেলাই করা সারি সারি বিস্ময়চিহ্নের মতো লাগছিল! জীবনের বিস্তারিত আয়োজনে কোথায় যে কী অভিজ্ঞতা বা অনুষঙ্গ সমাহৃত হয়ে থাকে তা আগে থেকে বোঝা যায় না।

মজার ব্যাপার এই, আমাদের আচরণের মূল নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। আরো বিশদ ভাবে বলতে হয় মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র। মানসিক অস্থিরতার গভীরে ডুবে থেকেও কী করে যে নিজেকে সৃজনশীলতার শীর্ষে নিয়ে বসাতেন ভ্যান গখ, সে এক বিস্ময়। এক অস্থির মুহূর্তে নিজের কান কেটে তিনি পাঠিয়ে দেন জনৈকা নগরকন্যাকে। তারপর আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন!

আজ কি এমন হলো সম্মোহের! ঘুরে ফিরে বিভিন্ন ভাবনা আর কথার মিথোস্ত্রিয়া ঘটে চলেছে মনে, মনের গভীরে। সেখানে হয়তো মন কিংবা  মন্তব্য নেই। কেবল একটা অস্থিরতা আছে।কিছুতেই যেন নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। তবে কি এবার একজন মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে সম্মোহকে!

ফেসবুকে একটা নটিফিকেশনের শব্দ হলো টিং। সম্মোহ খুলে দেখল অনলাইন কাগজ গুলোর সেই একই ঝালমুড়ির গল্প!

বলিউডের প্রথমসারিতে ইতিমধ্যেই নিজের নাম পাকিয়ে নিয়েছেন বঙ্গতনয়া শ্রেয়া। যার হট মুভসের আভায় মুগ্ধ সাইবারবাসী। এককথায় বলিউড মাতিয়ে রেখেছেন বাঙালি কন্যা। সম্প্রতি পছন্দের ডেস্টিনেশন মলদ্বীপ গিয়ে একগুচ্ছ ছবি শেয়ার করেছেন। ব্রালেট-মিনিস্কার্টে খোলামেলা শরীরে ঝড় তুললেও পোশাকের উপর স্পষ্ট শরীরের হাড়। মৌনির এই সুপারহট ছবি দেখেই কটাক্ষ করেছেন সাইবারবাসী।

বিষয়টা পড়তে পড়তে শ্রেয়ার শেয়ার করা ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছে করে সম্মোহের। নারীর এই শরীরী ভঙ্গিমা শিল্পীর চেতনায় কত ধরনের মোটিভ রচনা করে! সম্মোহ হাতের কাছে একটা কাগজে কয়েকটা লাইন ড্রইং- এর আঁকিবুকি কেটে নেয়। তারপর অদ্ভূত ভাবে খানিকটা শান্ত হয়ে যায়। অনেক দিন বাদে আবার ছবির কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ছবি আঁকাটাই এক সময় জীবনের প্যাশন ছিল! আজ সবটাই অতীত।

ছবি ঘুমন্ত। অথবা সে নিদমহল। ঘুমন্ত বাক স্বয়ং।তার মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে উপস্থিত এই যে প্রচ্ছন্ন অনাদি রূপটি-- সদাসর্বদা সে অপেক্ষমান গা-ঝাড়া দিয়ে সজীব ও সক্রিয় হয়ে উঠবার জন্য!  তাই চিত্রকলা সান্দ্র অনচ্ছ ছায়াঘন। আমাদের দৃষ্টিপাত তাতে, মাত্র তাতেই, সংলগ্ন হয়ে যায়! 

একজন শিল্পীর ন্যুডস্টাডি করার সময় এই দেখা গুলোই অনপেক্ষ এবং সাপেক্ষ। অর্থাৎ পার্থিবে বিরাজমান দ্রষ্টব্যগুলি হল অনুকার্য, আর অনুকারক হল অনুকৃতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ রূপসাদৃশ্যের ন্যায় মেনে সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন চিত্র-ভাস্কর্য এবং সাহিত্য-কর্ম।

রবীন স্যারের কথাগুলো আজও মনের মধ্যে গেঁথে আছে সম্মোহের। আজকাল ছবি আঁকার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেললেও ভেতরের উজ্জীবনটা রয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তো আজও কয়েকটা আঁচড়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে সম্মোহের অনায়াস লাইন ড্রইং।
মাঝেমধ্যে সে সব ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সম্মোহ। অনেক প্রশংসা পায়। পুরনো বন্ধুরা দু-একজন যারা ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, তারা সম্মোহকে আবার ছবি আঁকায় ফিরতে বলে।




Thursday, August 12, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২১

গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, ‘‘চরিত্রগুলোকে পাঠক সব সময়,  তাঁরা নিজেরা যেমন চান, সে ভাবে দেখতে পছন্দ করেন, নিজেদের পিসি মাসি ঠাকুরদার মতো করে। যে মুহূর্তে চরিত্রগুলো সিনেমার পর্দায় চলে আসে, পাঠকদের কল্পনাটাও সীমায় ঠেকে যায়।’’ এই কথাটাও আমার কাছে একটা ‘শক্’ ছিল, বুঝতে পেরেছিলাম কেন এত সিনেমা-প্রীতি সত্ত্বেও কোনও প্রিয় উপন্যাস থেকে বানানো ছবি আমি সহজাত প্রবৃত্তি-বশেই এড়িয়ে চলি। আসলে ভয় পাই যে আমার মনের মধ্যে যে ছবিটা, সেটা বড্ড সহজে পর্দায় ফুটে উঠে ছোট হয়ে যাবে।

১৯৪৭ সালে আন্তোন্যাঁ আর্তো লিখেছিলেন, ভ্যান গঘের ছবিতে কোনও ভূত নেই, কোনও বৃহৎ‌-এর স্বপ্ন নেই, কোনও ভ্রমকল্পনা নেই। আছে কেবল বেলা দুটোর সূর্যের সেই প্রখর তাপদাহ। জন্মপূর্ব যন্ত্রণার স্মৃতি। আছে পবিত্র, উলঙ্গ পৃথিবী। আমরা তার আরও কাছে যাওয়ার মতো জ্ঞান অর্জন করলেই যে প্রকৃতি নিজেকে লুপ্ত করে ফেলে।” গার্সিয়া মার্কেসকে ভাবতে গেলেও এই কথাটাই মনে আসে আমার।

সম্মোহ ওয়াচ টাওয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এরকম অনেক এলোমেলো ভাবনায় নিজেকে ভাবিয়ে তোলে । ভাবতে থাকে। ভাবনার কোনো পরাধীনতা নেই। সে যে বড্ড স্বাধীন! সম্মোহ তার ভাবনার মতোই স্বাধীন। দুঃখ আছে শোক আছে আবার আনন্দও আছে। আর ফেসবুকের চন্ডীমন্ডপ। পিএনপিসি। 

শিক্ষক ছাত্রীর যৌনতা। অডিও। স্কিনশর্ট। কমেন্টস। উপযুক্ত শাস্তি হোক। বিচার চাই। ছিঃ ছিঃ ভাবা যায় না। শিক্ষকের আড়ালে শয়তান। মরে যাওয়া উচিত। সবাই বয়কট করুন। সঙ্গে ফেসবুক গ্ৰুপ যাচাই- অভিযানের অন্তর তদন্ত। আরো কত কি! মজা ফূর্তি নিশিগন্ধা... ম্যাজিক রিয়েলিজিম...

এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ জীবনের জাদু-বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেন এভাবে, একদিন আমি আর আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে ছিলাম। এর মধ্যে শুনতে পেলাম কলিংবেলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে! দ্রুত আমি দরজা খুললাম এবং একজন মানুষ জানালো সে ইলেক্ট্রিক আয়রন মেশিন ঠিক করতে এসেছে! আমার স্ত্রী বেডরুম থেকেই জানালো, আমাদের আয়রন মেশিনে কোনো সমস্যা হয়নি।তারপর আগুন্তক জানতে চাইলো, "এটা কি এপার্টমেন্ট নাম্বার দুই?" আমি তাকে জানালাম, "না, নাম্বার দুই উপরের তলায়।" এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী কাপড় আয়রন করতে গিয়ে সুইচ অন করার সাথে সাথেই আয়রনের তারটি শর্ট সার্কিটে পুড়ে গেল!

দেখুন এটাই অন্যরকম কিছু! আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জানার আগেই সে এসেছিল সমস্যাটি ঠিক করতে! আমাদের জীবনে প্রায়ই এমন হয়! যদিও আমার স্ত্রী হয়তো ঘটনাটি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে।

 বিকাশ চলে যাওয়ার পর ক'দিন মনটা একেবারেই ভালো ছিল না সম্মোহের। মনে হয়েছিল বিকাশকে এখানে রেখে দিলেই হত।বিকাশেরও আরো ক'দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে এতদিন বাইরে থাকার অভ্যাস একেবারেই নেই বললে চলে। তাই বাড়ির দিকেও বিকাশের মনটা চলে যাচ্ছিল।
শেফালির কথা বলছিল বারেবারে। একদিন সকালে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিকাশ সম্মোহকে বলল, " আমার ট্রেনের টিকিটটা এবার কেটে ফেল। বাড়ি ফিরতে হবে! বদ্ধ ঘরে শেফালির দম বন্ধ হয়ে আসছে! এবার আমাকে যেতে হবে!"

সম্মোহ বিস্মিত হয়ে বিকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে টিকিট কেটে দিয়েছিল। শুধু সম্মোহের মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল, "বদ্ধ ঘরে শেফালির দম হয়ে আসছে!" এও কি এক ধরনের জাদু বাস্তবতা? 

শেফালি চলে যাওয়ার পর বিকাশ একেবারে একলা হয়ে গেছে। খুব বুড়ো হয়ে যায় নি। এই বয়সে জীবনসঙ্গীর চলে যাওয়া বড় বেদনার। কারণ প্রতিটি দাম্পত্যের এই বয়সটাই প্রকৃত মধুচন্দ্রিমার সময়! সম্পর্কের গভীরতার সময়। অনুভবের সময়। 

আর সম্মোহ এগুলোর থেকে দূরে। তার একাকিত্বের একাকারে গাছ পাখি মানুষের যাওয়া আসা। ফলে সম্মোহের ক্ষেত্রে একজন পঞ্চতপা কর্মযোগির জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

বাস্তব সমাজটা গার্সিয়া মার্কেসের মতোই সম্মোহের কাছে কাছে বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে জাদু তৈরি করত বাস্তবের ফাঁকে ফাঁকে নীরবতা ও প্রকাশের মাঝে, ক্ষমতা ও সংশয়ের মাঝে, আড়ম্বরহীনতা ও চোখ-ধাঁধানো অসামান্যের মাঝে। এবং সম্মোহ  গল্প বলতে পারত। সম্মোহ কখনো একটা গল্প বলত না। বরং একটা দুনিয়া তৈরি করে ফেলত , একটা জাতিকে বুনে দিত , সৃষ্টি করত একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহা-আলেখ্য। কী নেই সেখানে, স্মৃতি, কল্পনা, ইচ্ছে, মৃত্যু, স্বপ্ন, জীবনযাপন। অসংখ্য পরস্পর-সংযুক্ত গল্পের দুনিয়া খুলে দিত তার উপস্থিতি।

প্রথম প্রথম সুতানে আসার পর একটা ভয় কাজ করত। মৃত্যু ভয়! একদিন ভয় অতিক্রম করে অভয় এসে হাত ধরল সম্মোহের। মনে হল এই সম্পূর্ণ এলাকাটায় একজন ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান। সমস্ত অশুভ শক্তিকে আটকে দেন তিনি। মাঝরাতে মাঝে মাঝে নুপূরের শব্দ শোনা যায়। কেউ হেঁটে চলার শব্দ! তিনি কি দেবী! তাঁকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সম্মোহ সব সময় তার অস্তিত্ব অনুভব করে। সেই যেন সম্মোহকে আগলে রেখেছে।

একদিন কেউ নেই। লালুকাকা নেই, বুলির মা নেই, সম্মোহ একা! মেঘ করেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ইলেকট্রিক নেই। জেনারেটরে তেল নেই। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। অতি ক্ষীণ আলোর লন্ঠন জ্বালিয়ে সম্মোহ বসে আছে। কানে আসছে কারো হেঁটে চলার শব্দ! কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু অনুভব করা যাচ্ছে। 

                     ----- কে তুমি?

                     ------ ম্যাজিক রিয়েলিজম!

                     ------ কোথায় থাকো?

                    ------- তোমার ভেতরে!

                    -------- প্রমাণ কি?

                    --------- অনুভব করা ছাড়া এর কোনো                                 প্রমাণ হয় না!!




Sunday, August 8, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২০

-----" তুই এখনো ফুলটো হয়ে আছিস লীমার জন্য! চোরাস্রোত বয় কেবলই চেতনাময়... হাহাহা..."

---" দাঁত না কেলিয়ে মালটা শেষ কর! শোন বর্তমানে আমার কোনো স্রোতটোত নেই ওর জন্য। সামান্য করুণা আছে। ওর কথা ভাবলে কষ্ট হয়। রাগ হয়! গালি দিতে ইচ্ছে করে। আমি এই বেশ আছি।‌নিজের মতো স্বাধীন!"

----" আহা! রাগ করিস কেন!"

---" শোন বাল, নেশাটা চটকাশ না! অন্য কথা বল।"

বিকাশ সম্মোহকে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, " মুরগির ঝোলটা বেশ ভালো রেঁধেছে। জমে গেছে বন্ধু! আমি আর মহুয়া নেব না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।"

----" ঠিক আছে। তাড়াহুড়ো করিস না। মাংস ভালো লাগলে মাংসটাই খা। একটু ভাত দিতে বলি!"

----" তা বলতে পারিস। খিদেও পাচ্ছে বেশ।"

----" ধলু, ধলু রে..." সম্মোহ ধলুকে ডাকে।

----" কত্তা বলেন।"

----" ওকে একটু ভাত আর মাংস দে।"

---" ঠিক আছে কত্তা এখুনি দিচ্ছি।"

---"বিকাশ, তুই কখনো প্রেমে পড়েছিস কারোর!"

----" হ্যাঁ, তোর প্রেমে পড়েছি বারবার!"

----" দুশশশ শালা! নায়িকাদের কথা বল। তোর কৈশোর কালের কিংবা যৌবন কালের কোনো নায়িকা! যে এখনো তোর স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে!"

---- আছে তো! আলেয়া সেন! জীবনানন্দের বনলতা সেন আর আমার আলেয়া সেন!"

----" বিকাশ আপনি নেশা করেছেন? বিকাশ, তাকে কোথায় খুঁজিয়া পেলেন!" 

--- " উনি স্বপ্নে এলেন গেলেন... "

----" বিকাশ আপনি ইহা দেখে শুধু বালগুলো ছিঁড়লেন!" 

সম্মোহ আর বিকাশ একসঙ্গে হোহোহোহো... শব্দে হেসে উঠলো। সেই হাসি যেন থামতেই চায় না!

তারপর কখন যে খাওয়াদাওয়া শেষ করে সিগারেটে সুখটান দিয়ে খুনসুটি করে দুজনে তালাইয়ের উপর শুয়ে পড়েছে, তা আর কারো হুঁসে নেই। আর হুঁসে থাকার দরকারটাই বা কি! বরং জীবনে মাঝেমধ্যে এরকম বেহুঁশ হওয়াটাই সঙ্গত! এ্যাতো হুঁশে থেকেই বা কি হলো বিকাশের! 

অন্ধকার প্রথমে পাতলা ফিনফিনে হয়ে আছে। আসলে তা সম্মোহের ঘুম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে বুঝতে পারছিল না যে চেষ্টাকৃত স্বপ্নভঙ্গ, না কোনও বাহ্যিক কারণে তার ঘুম ভেঙে আসছে।সে কি কিছু শুনেছে? কোনও শব্দ? কান্না? নিশ্চিত হতে না হতে আবার চোখ বুজে আসে অবসন্ন অবশিষ্ট ঘুমে।স্বপ্নের বাকিটুকু তখন সে দেখতে থাকে।

ব্লাউজের হুক খুলতেই শেখনি এখনো!

--- শিখিনি তো! তুমি শিখিয়ে দাও!

----অত শেখাতে টেখাতে পারব না! নাও খুলে দিলাম!

সম্মোহ বুকের ভেতর মুখটা গুঁজে দেয়। তারপর মুখের ভেতর মাংসল পিন্ডটা ঢুকিয়ে বাচ্চা ছেলের মতন চুষতে থাকে! লীমা নিজেকে আরো আলগা করে দেয়! তারপর ধীরে ধীরে নাভিতে একটা হালকা কামড় দিয়ে যোনিমুখ চুষতে থাকে। আর ঠিক তখনই লীমা নিজেকে আর সামলাতে পারে না! ... ওওও বেবী...ইইইই... লীমার এই কামোদ্দীপক উচ্চারণে সম্মোহ নিজেকে আরো ঘনীভূত করার চেষ্টা করে! আবার ভয় হয়! অতি উত্তেজনায় যদি বীর্য বেরিয়ে যায়! তাহলেই সব শেষ! হেরে যাওয়া! সম্মোহ তাই নিজেকে সব কিছুর থেকে একটু দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে! ভাবনাকে পাল্টে ফেলতে চায়! তবু একসময়  নিরুপায় যৌনতার মতো আত্মসমর্পণ করতে হয়! ঘেমো পিঠের উপর লীমার হাত আঁকিবুকি কাটে। 

---কত্তা ও কত্তা ওঠেন এবার বেরোতে হবে। আমি সঙ্গে যাব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এরপর হাতির ভয় আছে! ওঠেন কত্তা! 

ধলুর ডাকে ঘুমটা আবার ভেঙে যায়। সম্মোহ চোখ খুলে অনুভব করে লিঙ্গটা শিলনোড়ার মতো শক্ত হয়ে আছে! কিঞ্চিৎ অস্বস্তি কাটিয়ে বিকাশকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে সম্মোহ। বিকাশ ঘুমে একেবারে অচেতন। 

ধলু বাইকে উঠে বসে। মাঝে ঘুমন্ত বিকাশকে বহুকষ্টে বসিয়ে দিয়ে, সম্মোহ ঠিক পেছনেই উঠে বসে। ধলু বাইক চালিয়ে সম্মোহের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাহাড়ি বাঁকের মতন আঁকাবাঁকা রাস্তায় ধলু ছাড়া বাড়ি ফেরা প্রায় অসম্ভব ছিল। মিনিট কুড়ির মধ্যে বহু বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। বিকাশ তখনও প্রায় অচেতন। 

বিকাশকে বিছানায় শুইয়ে সম্মোহ বুলির মাকে এক বোতল জল দিয়ে যেতে বলে। বুলির মা জল নিয়ে এলে, বিকাশের চোখেমুখে জলের ছিটে দেওয়া হয়।মাথা ধুইয়ে দেয় ধলু। 

----" আজ রাতে আমার বিকাশের রান্না করার দরকার নেই। শুধু ধলুর আর তোমাদের রান্না করো। ধলু রাতে এখানেই থাকবে। কাল সকালে বাড়ি যাবে। ওকে পাশের ঘরটা খুলে দাও। ওখানেই রাতে শুয়ে পড়বে। এখন একটু কড়া করে চা বানিয়ে আমাকে আর ধলুকে দাও।

সম্মোহের কথার বুলির মা মাথা নেড়ে চলে যায়।

---" কত্তা চিন্তা করবেন না। আপনার বন্ধুর ঘুমটা ঠিক মতো হলেই চাঙ্গা হয়ে যাবে। আসলে অভ্যাস নাই তো! তাই নেশাটা ধরে লিয়েছে।"

--- " যাই বল ধলু, মহুয়াটা কিন্তু একঘর ছিল! আমাকেও ধরে লিলো!"

----" কত্তার ভালো লেগেছে এতেই আনন্দ। যাইহোক অনেকদিন পর এলেন এদিকে।"

-----" ঠিকই বলেছিস, আজকাল আর তেমন যাওয়া হয়না তোদের ওদিকটায়। বিকাশের জন্যই যাওয়া। তবে জানিস অনেকদিন পর তোদের ওখানে গিয়ে ভালোই লাগল। যা চা খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম কর। আমার কাছে একটা বিলাতি আছে, তুই আর লালুকাকা দু'জনে খেয়ে নিস। ওই তাকের ভেতর আছে, নিয়ে যা।"

---- " লালুকাকাকে দেখছি নি! কই গো?"

----" আছে আশপাশে। চলে আসবে। "

সম্মোহ ধলুকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে নিজে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে ফ্রেস হয়। তারপর আলো নিভিয়ে বিকাশের পাশে শুয়ে পড়ে।‌ শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। আজকাল বয়সের ভার এই সব বেলেল্লাপনার ধকল নিতে পারে না।

তবু অনেকদিন পর আজ সম্মোহের আবার ডাইরি লিখতে ইচ্ছে করল। সেই চিরচেনা লালরঙের ডাইরি। সম্মোহ আজকাল কালেভদ্রে লেখে।‌আজ আবার লিখল...

একটা সময় ছিল যখন আমরা সকলে ছিলাম দারিদ্রের মহিমায় পঞ্চমুখ। দারিদ্রকে অভিশাপ মনে না করে আশির্বাদ বলেই মেনে নিতাম। যেমন কাজি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, "হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান।" পূর্বে ধারণা ছিল দারিদ্র মানুষকে গুণগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা তার অন্তর্নিহিত শক্তি পূর্ণ প্রকাশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠা এনে দিত। কিন্তু বর্তমান কালে সাধারণ ধারণা দারিদ্র্য মানুষকে অমানুষ করে তোলে এবং তাঁর অন্তর্নিহিত শক্তি অঙ্কুরেই বিনাশ করে। এই দারিদ্রের পঙ্কিল আবর্ত থেকে আজকালকার সমাজবিরোধী, উগ্ৰপন্থী ও পরস্বাপহারীদের উৎপত্তি। এক সময়কার দারিদ্রের সুফল আজ সমাজঘাতী কুফলে পরিণত।

এতদূর লেখার পর সম্মোহের মনে হলো এইসব জ্ঞান চুদিয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু নিজেকে বিজ্ঞ ভাবার গাম্ভীর্য আছে! হাসি পেল নিজের প্রতি। তারপর বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, " কমরেড বিকাশ এবার উঠে পড়। আমাদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।"

Monday, August 2, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||           

অরিজিৎ চক্রবর্তী

ডারউইনের চিঠি      পর্ব-২০

মহুয়ার কথা বলতে বলতে ধলু কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, " বাবু , মহুয়া আর দিশি মুরগি! আমি এখনই জিতেন সর্দারকে খবর করছি।"

সম্মোহ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল। 

ধলু চলে যাওয়ার পর বিকাশ বলল, " রানীবাঁধ থেকে সুতানের রাস্তাটা বড় অদ্ভুত লাগল! মনে হয় দার্জিলিং এর কোনো পাহাড়ি পথ। হেয়ারপিনের মতো তীক্ষ্ণ বাঁক। আর চারপাশে পাইনের বদলে শালের জঙ্গল।‌ফারাক এটুকুই।"

----" এই জন্যই তো এখানে থেকে গেলাম। মোট পঁচাশিটা পরিবার নিয়ে সুতান গ্ৰাম। তার মধ্যে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসে ছিয়াশি নম্বর পরিবার। বেশির ভাগ সাঁওতাল জনজাতি। মূলত চাষবাসই জীবিকা।"


 ---- " তোর নির্বাচনের তারিফ করতেই হচ্ছে! জায়গাটা সত্যিই সুন্দর রে। কিন্তু ভয় লাগে না তোর? জন্তু-জানোয়ার, সাপ-কোপের ভয়তো আছেই। সঙ্গে অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের ভয়!"

----" কোনো ভয়ই হয় না রে। এরা আমার সহচর। যাপনসঙ্গী! "

----"পশু-পাখিরা হয়তো দেকার্তের মতো ভাবতে পারে না? আই থিঙ্ক দেয়ারফোর আই একজিস্ট"। সে কারণে তারা নিশ্চয়ই মানুষের তুলনায় ' নিন্মচেতনাসম্পন্ন'?" বিকাশ বলল।

----" নিন্মচেতনাসম্পন্ন" কথাটায় ঘোর আপত্তি রাখছি! অথচ তাদের মধ্যে এমন এমন অনুভূতির সন্ধান পাওয়া যায় যা সহজেই আমাদের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বহু আলোচিত ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির কথা না হয় বাদই দিলাম।
সৌন্দর্যের বোধই কি মানুষের একচেটিয়া? ময়ূরী কে আকৃষ্ট করতে ময়ূর পেখম মেলে যে দৃশ্য সৃষ্টি করে তা মানুষের ভাষায় অপরূপ সুন্দর। অর্থাৎ'নিম্নচেতনাসম্পন্ন'প্রাণীর স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছে যে দৃশ্যে তা মানুষের মতো উচ্চচেতনাসম্পন্ন' প্রাণীর মনে সৌন্দর্যের সৃষ্টি করছে।ব্যাপারটা কি বিস্ময়ের নয়!"

----" ফাটাফাটি বন্ধু। তোকে একটু নেড়ে দেখলাম আগের মতো আছিস কিনা! পড়াশোনাটা করিস তাহলে এখনো?"

----" ছাড়, অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা হল। এবার মহুয়া-মাংসের আয়োজন কদ্দূর খোঁজটা নিই চল।" 

সম্মোহ বাইক স্টার্ট দিল। বিকাশ সম্মোহের পেছনে বসে পড়ল। আবার সেই আঁকাবাঁকা খাড়াই রাস্তা।

লেদাপুকুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পার করে কিছুটা এগিয়ে সম্মোহ বাইকটা থামাল। বাড়ির সামনে কতগুলো বাচ্চা নিজেদের মধ্যে খেলছে। কালো রঙের কাঠের দরজা। সম্মোহ দরজার মাথার শিকল ধরে নাড়া দিল। 

----" খুড়ো ও খুড়ো কই গেলে"!

কাঁচা-পাকা চুলের এক বুড়ো বেরিয়ে এসে, হাতজোড় করে বলল, আসেন বাবুরা আসেন।"

সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।  মাটির দালান ঘেরা উঠোন। একটা খাটিয়া আর চৌকি পাতা। মেঝেতে তালাই বেছানো। দূরে বালতিতে জল রাখা।

চারপাশে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার আভাস। বিকাশ বেশ অবাকই হচ্ছিল। 

---" চল ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিই। এবার দুই বন্ধু মিলে একসঙ্গে স্বর্গের সিঁড়িতে পা রাখব।"

----" সেটা আবার কেমন! রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি!"

----" পাবে পাবে আরো অনেক কিছু পাবে!"

দালানের ভেতরের ঘর থেকে ধলু বেরিয়ে এলো। হাতে একটা জামবাটি আর কচুপাতা।ধলু তালাই বেছানো মেঝের উপর পাশাপাশি দুটো কচুপাতা রেখে তার ওপর কাঁচা লঙ্কা জলজিরা আর কয়েকটা শসা কুচি দিয়ে সম্মোহকে ইশারায় ডাকল। 

সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে ওখানে  বসল। ততক্ষণে খুড়ো মহুয়ার বোতল সম্মোহের সামনে রেখেছে।

----" আমি কিন্তু চেক করবো, মালটা ঠিকঠাক কিনা! "

----" করো বাবু করো। দেখে লাও। জীবন সর্দারের মাল বটে।"

সম্মোহ বোতলের ছিপিতে সামান্য মহুয়া ঢালল। তারপর লাইটার বের করে জ্বালাল। ছিপির মহুয়া দপ করে জ্বলে উঠলো।

 ----" একদম ঠিক আছে ধলু। তাই তো তোদের কাছে আসা।"

সম্মোহ দুটো গ্লাসে মহুয়া ঢালল। তারপর তাতে খানিকটা জল মেশাল। 

----" নে এক চুমুকে মেরে দে। তারপর লঙ্কায় জলজিরা লাগিয়ে একটা কামড়। তারপর এককুচি শশা। আহা...!"

বিকাশ বলল, " পাগল! আমি তোর মতো দক্ষ মাতাল নই। আস্তে ধীরে নিচ্ছি।"

দ্বিতীয় পেগ ঢালতে ঢালতে একটা মাটির পাত্রে মাংস নিয়ে হাজির খুড়ো।

সম্মোহ খুড়োর হাতে মাংস দেখে যেন আরো খানিকটা এনার্জি পেল। বিকাশ তখনও আগের পেগটা শেষ করতে পারেনি। বিকাশের কাছে মহুয়ার গন্ধটা বেশ চড়া লাগছে।

সম্মোহ বিকাশকে বলল, " শোন পুরো মালটা এক নিঃশ্বাসে মেরে দিশি মাংসটা মুখে দে। দেখবি অতটা অসুবিধে হবে না। তারপর তিন পেগ হলেই মহুয়া তোর বন্ধু হয়ে যাবে।"


 ----" পাগল! আমি আর একটা নেব। তাও তোর জন্য। আমার এসবে আসক্তি বা অভ্যেস কোনোটাই নেই।"

-----" তা বললে হবে না বন্ধু! আমার সম্মান রাখাটা তোমার দায়িত্ব!"

----" শোন ঢলু তোরা ওইদিকটায় মহুয়া নিয়ে বসতে পারিস।" সম্মোহ বলল।

----" সে হবে। আগে বাবুরা ফূর্তি করুক।"

দালানের ভেতর ঠান্ডা হাওয়ার একটা আমেজ আসছিল। তাও সম্মোহের গরম লাগছে দেখে ঢলু একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিল। ফ্যানের হাওয়ায় নেশাটা টানটান হয়ে উঠল। 

---" মাথাটা ঝিমঝিম করছে রে। বেশ লাগছে! তুই মাইরি সত্যি খুব ভালো।"

বিকাশের কথায় সম্মোহ বেশ মজা পায়।বলে ," এই বার পথে এসো খোকা! প্রিয় বন্ধু বুড়ো খোকা!"

-----" আমি বুড়ো খোকা! আর তুই ছোটখোকা! ছোটখোকা বলে অ আ... হিহিহিহি হাহাহা..."

------" গাঁড় মেরেছে! এতেই ধরে গেল! "

----" এই শোন! লীমা কেমন আছে রে। ওর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?" বিকাশ বলল।

--- "কে লীমা?"

---- " কেন তোমার প্রেমিকা হবু বউ! "

----" হবু বউটউ বলে লাভ নেই। সেসব গতজন্মের রিংটোন। এখন ও  একটা সাংসারিক ছাগল! "

---- "বললি বটে সাংসারিক ছাগল!"

---" বলবো না! মা-ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কলুর বলদ হয়ে গেল! সংসারের ঘানি টানছে!"

----"ওকে একবার এখানে নিয়ে আয়। দেখবি তোদের মিল হয়ে যাবে।"

----" ও এখন অসম্ভব সাইকো! ওর আর কিছু হবে না।"

Sunday, July 25, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||    

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র

ডারউইনের চিঠি  পর্ব~১৯

যত রাতেই ঘুমোক পাঁচটা বাজলেই চোখ খুলে যায় সম্মোহের। তখন চুপচাপ বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে থাকতেও ভালো লাগে না। মনে হয় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার এটাই আসল সময়। তাই সম্মোহ মুখহাত ধুয়ে একটা ঢিলেঢালা পাজামা পরে বেরোনোর প্রস্তুতি নেয়। পাশের খাটে বিকাশ তখন ঘুমে অচেতন। ভাবে বিকাশকে ডেকে তুলবে! পরমুহূর্তেই মনে হয় , গতকাল অত রাত্রে ফিরে বিকাশ হয়তো বড্ড ক্লান্ত। ববং অন্যদিন বিকাশকে ভোর ভোর নিয়ে বেরোবে। এখানকার জঙ্গল দেখাবে। পাখি দেখাবে। আজ বরং থাক। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সম্মোহ সদোরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে হাঁটা দেয়। জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রঘুর চায়ের দোকানের সামনে এসে বাঁশের প্রশস্ত বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে চা দোকানে জড়ো হওয়া গ্ৰামের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে।

----" বাবু কবে ফিরলেন? "

----" গতকাল রাতে। "

----" এখন বেশি রাত করোনি। হাতির দল আইছে। "

---" তাই নাকি!"

----" হ , খুব লফরজফর করছে। ফকিরের ঘর ভেঙে দিয়েছে। ধান খেয়ে দিয়েছ। "

এই চায়ের দোকানে চা খেতে আসার এইটাই সবচেয়ে বড় সুবিধে , গ্ৰামের সমস্ত খবর একনিমেষে পাওয়া যায়! 

চা খাওয়া শেষ করে সম্মোহ হাঁটতে হাঁটতে পিচ রাস্তার দিকে এগিয়ে চলে। সকালে এই রাস্তাটায় বরাবরই হাঁটতে পছন্দ করে সম্মোহ। কত ধরনের পাখির ডাক! জঙ্গলের ঠান্ডা বুনো বাতাস। সম্মোহ মনে মনে ভাবে যদি লখা মাছ নিয়ে বসে তাহলে একটু মাছ কিনে বাড়ি ফিরবে। আর সকালের জলখাবারে বুলির মাকে লুচি করতে বলা আছে।

সম্মোহ যখন বাড়ি ফিরলো তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। বুলির মাকে মাছের থলেটা দিয়ে বলল, টাকটা মুরলা মাছ পেলাম, জমিয়ে রান্না করো। 

বুলির মা মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। এখন চা করবো? লুচির আলুভাজা করা হয়ে গেছে। ময়দা মেখে রেখেছি।"

---" ঠিক আছে। দাঁড়াও দেখি সে ঘুম থেকে উঠলো কিনা!"

সম্মোহ ঘরে ঢুকে দেখল, বিকাশ তখনও ঘুমোচ্ছে। এই ওঠ, ওঠ রে! এতো ঘুম ভালো নয়!

সম্মোহের ডাকে বিকাশের ঘুম ভাঙ্গলো। হুঁ, উঠছি। আমার বেডটি চাই।

সম্মোহ বুলির মাকে চেঁচিয়ে দু-কাপ লিকার চা করতে বললো। তারপর বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, " কিরে আরেকটু ঘুমোতি!"

--- " আরে না না! ভালো ঘুম হয়েছে। এবার চা খেয়ে পটি করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নেব। তারপর তোর সঙ্গে জায়গাটা ঘুরতে বেরোব। রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গল ছাড়া কিছুই বুঝলাম না!"

---" জঙ্গল ছাড়া এখানে কিছু নেই বন্ধু। "

----" কে বলেছে কিছু নেই! মায়া আছে! যে মায়ায় তুই কলকাতা ছাড়লি!"

সম্মোহ বিকাশের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, জঙ্গলে থাকি সামান্য বালক!"

---" কেয়া বাত! তা বালকের বাল কি পক্ক! "

---- " শালা কি দিচ্ছিস রে সকাল সকাল!"

লালুকাকা চা নিয়ে ঢুকল। সম্মোহ ইশারায় বিকাশের খাটের পাশে টেবিলে চায়ের ট্রে-টা রাখতে বলল।

---- "বিকাশ এই হলো লালুকাকা, আমার ম্যানেজার।"

---" ও আচ্ছা। লালুকাকা তোমার কথা সম্মোহের মুখে অনেকবার শুনেছি..."

লালুকাকা মিটিমিটি হাসে। তারপর রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

 --- " চায়ের ব্যাপারে তোর ফ্যাসিনেশনটা রয়েই গেল! নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে নিয়ে আসিস!"

----" হ্যাঁ, কলেজস্ট্রিটের দিকে গেলে সুবোধ ব্রাদার্স থেকে নিয়ে আসি। বিওপি। বার্ডস অরেঞ্জ পিকো। আমার পছন্দের চা।"

---" নে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ব্রেকফাস্ট সেরে ফুলঝোরের দিকে যাব।"

---" সেটা আবার কোথায়?" 


----- " সুতানের কাছের একটা গ্ৰাম। বাইকে যাব। জঙ্গলের রাস্তায় যেতে তোর ভালোই লাগবে।"

বুলির মা'র বানানো গরম গরম লুচি আলুভাজা খেয়ে সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। 

---- " হেব্বি চালাস তো! তুই একদম পালটে গেছিস। তোকে এভাবে দেখে বড় আনন্দ হচ্ছে রে।"

----" তোর ওরকম মনে হচ্ছে। একই রকম আছি রে। চারপাশের চেনা পরিবেশটা পাল্টেছে। তাই আমাকে তোর অন্যরকম লাগছে!"

----" হয়তো তাই! তবে নিজের চেনা শহুরে গন্ডীর বাইরে এসে বেশ লাগছে রে! থ্যাঙ্কস!"

---- " আবার থ্যাঙ্কস! বোকাচোদা। চল তোকে আজ মহুয়া খাওয়াবো। "

সম্মোহ ক্যানেলের পাড় ধরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছোটাতে থাকল।

বিকাশ মাঝে মধ্যেই সম্মোহের সঙ্গে কথপোকথন চালাচ্ছিল। মিনিট পনেরো বাদে সম্মোহ গাড়ি থামল ভাঙা অ্যাসভেসটারে ছাওয়া জীর্ণ একটা চা দোকানের সামনে। চা দোকানের পাশেই একটা কামারশাল। হাপরের মুখ দিয়ে গলগল করে হাওয়া বেরুচ্ছিল। কাঠ কয়লার মধ্যে ফোঁস ফোঁসানি শব্দ। খানিকটা কয়লা টকটকে লাল রঙ ধরেছে। তারমধ্যে কয়েকটা লোহার রড। কোনটা মোটা কোনটা সরু।আগুনে ঢোকানো দিকটা আর আগুনের রঙ থেকে আলাদা করা যায় না। প্রতিবার হাপর থেকে বেরুনো হাওয়া সাদা ছাই উড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের মধ্য থেকে। ধলু বাঁ হাতে একটা বড় সাঁড়াশি দিয়ে একটা লোহার রড টেনে বের করলো।পোড়া দিকটা বড় একটা লোহার পিন্ডের উপর চেপে ধরে অন্য হাতে হাতুড়ি উঁচিয়ে জোরে আঘাত করল।টং। মুখোমুখি নিশিকান্ত একটা কাঠের উঁচু পিঁড়ির উপর বসে দুদিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে দু'হাতে একটা ভারী হাতুড়ি উঁচিয়ে দড়াম করে মারল---টাং। টং টাং।হাতুড়ির ঘায়ে দেখতে দেখতে জ্বলন্ত পিন্ডটা সারস পাখির লম্বা ঠোঁটের মতো বাঁকা আকার নেয়।

--- ধলু, এটা কি বানাচ্ছো গো?"

------" বাবু গাঁইতি হবে! তা অনেকদিন পরে এলেন এদিকে ! তা একটু চা গান বাবু!"

----" চা খাবনা। মহুয়া চাই। আমার বন্ধু কলকাতা থেকে এসেছে। ওকে বুনো মহুয়া খাওয়াবো ভাবছি! ব্যাবস্থা হবে?"

----" তা আবার হবেনি! কি যে বলেন!"

Sunday, July 18, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      অরিজিৎ চক্রবর্তী 
 



ডারউইনের চিঠি ( পর্ব১৮ )


তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যৌথ চেতনা কি উন্নয়নের পথে এক বাধা? যে সমস্ত সমাজে যৌথ চেতনা প্রবল সেখানে কি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে অসুবিধা হয়? "গাছেরও খাবো আবার তলারও কুড়োব"---এই দুই দিক একসঙ্গে সামলানো যায় না বলে, মফস্বল আগের মতোই থাকবে আবার, আধুনিক নগোরোন্নয়ন প্রক্রিয়া গড়ে উঠবে--- তা একাধারে চাওয়া যেন ভাবের ঘরে চুরি করার মতোই।

ট্রেনে এরকম বিজ্ঞ মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। উল্টোদিকের ভদ্রলোক তার সামনের সিটে বসা মানুষটিকে এই কথাগুলো বলছিলেন। সম্মোহ পাশের সিটে বসে সেটা মন দিয়ে শুনছিল। এমন সময় ট্রেন ছাড়লো। ১৮নং প্লাটফর্ম থেকে হাওড়া-পুরুলিয়া এক্সপ্রেস।

পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে সম্মোহের সম্পর্ক বহুদিনের। আজ গন্তব্য বাঁকুড়া। ওখান থেকে প্রাইভেট কারে সুতান। গাড়িতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে। সত্যজিৎ স্টেশনে থাকবে ফলে রাত হলেও চিন্তার কিছু নেই।

---" চা গরম চা। ঝালমুড়ি।"একে একে হকাররা আসছে। বিকাশ চায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করতে সম্মোহ কানে কানে বলল," এখন নয়, একটু বাদেই ভালো চা আসবে। তখন খাবো"।

সম্মোহ পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের সমস্তটাই জানে। কে ভালো চা বানায়। কার ঝালমুড়ি ভালো। খড়্গপুর স্টেশনের সমস্ত চা জঘন্য! মেদিনীপুরে গাড়ি পৌঁছলে ট্রেনের দরজার বাইরে একজন চা নিয়ে আসে, যেটা খেলেই এনার্জি আসে।

সাঁতরাগাছি স্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন এগিয়ে চললো ঝড়ের গতিতে। সম্মোহ বিকাশকে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল," জল খা। চা আসবে।"

---" কি করে বুঝলি?"

---" সাঁতরাগাছি পেরোলেই চা নিয়ে উনি আসেন তাই!"

---"ইন্টারেস্টিং!"

---"বড়দা কেমন আছো? দুটো চা দাও?"

---" চলে যাচ্ছে গো। অনেকদিন পর!"

---" হ্যাঁ তা প্রায় মাসতিনেক পর। আগের মতো আর কলকাতায় আসা হয় না। বিকাশ চা- টা খেয়ে দেখ! চার্জ হয়ে যাবি।"

সম্মোহের কথা শুনে চা দাদা হাসল। পাশের সিটে বসা সহযাত্রী দুজন পরস্পরের মধ্যে হাসি বিনিময় করলো। জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আর সেই হাওয়ায় যেন ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। ডেলিপ্যাসেন্জারের চেনা মুখ হাত নেড়ে চলে যাচ্ছে পাশের বগিতে। কেউ দাঁড়িয়ে খানিক কুশল বিনিময় করছে সম্মোহের সঙ্গে। 

---" তুই তো একেবারে ট্রেনের পরিচিত মুখ। অনেকেই তোকে চেনে দেখছি।"

---" আরে না না, তেমন কিছু নয়। আগে মাঝে মধ্যেই যেতে হতো কলকাতায়। সেই যাওয়া আসার কারণে আলাপ পরিচয়। আর তুই তো জানিস আমি একটু টকেটিভ! বন্ধুত্ব হয়ে যায়।"

----"এটা তোর বরাবরের গুণ ! সেবার পুরী বেড়াতে যাওয়ার ঘটনাটা ভোলার নয় ! মোদের পন্ডা ওছি! অমরপন্ডা। পন্ডা বলে অমরপন্ডা ওছি। পন্ডাগুলো বিদায় হওয়ার পর সেকি হাসি আমাদের। সারা পুরী জুড়ে অমরপন্ডা চালু হয়ে গেল!"

কোলাঘাট ব্রিজের উপর ট্রেনটা আরো গমগম করে উঠলো। সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। বিকাশের বাকি কথাগুলো শোনা যাচ্ছিল না। থার্মাল প্ল্যান্টের নীল ধোঁয়া তখন সম্মোহকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কি অদ্ভূত মায়াময়! প্রতিবারই এখান দিয়ে ট্রেনটা গেলে সম্মোহ একটা ট্রেম্পারার মোটিফ খুঁজে পায়। ভাবে বাড়ি পৌঁছে আবার ক্যানভাসের সঙ্গে একাত্ম হবে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। ভাবনা গুলো কিভাবে যেন হারিয়ে যায়।

--- " কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি! কিছু মাথায় এলো! ছবি আঁকাটা আবার শুরু কর।"

---" নারে আর ভালো লাগে না। নিপুণ ধান্দাবাজ না হলে আজকাল ক্রিয়েটিভিটি করে কোন লাভ নেই।"

---"তোর নিজের জন্য তুই কাজ কর। ওসব ধান্দা ঝান্ডার দরকার নেই।"

--" দরকার নেই তো বুঝলাম। কিন্তু এই না দরকারটাও যে শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধিবিচিরা রেগে যায়। কারণ তারা চিরকালই তাঁবেদার হয়ে কোন না কোন পার্টির ছত্রছায়ায় থাকে। অর্থাৎ দাদা দাদা করো। মাঝে মধ্যে সেই দাদার বাড়িতে পৌঁছে যাও। মুখ দেখিয়ে আসো। তরুণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্ৰুপ তৈরি করো। ফেসবুক পোস্টে লাইক কমেন্ট দাও! দূর বাল এই মামেগাদের থেকে দূরে আছি ভালো আছি। বুঝলি।"

---" অবশ্যই তুই আমার থেকে এই বিষয়টা ভালো জানবি। বাইরে থেকে এতকিছু বোঝা যায় না।"

---" একারণেই এরা বুদ্ধিবিচি! তোর আমার কালো বিচি!"

---" হা হা হা হা! বললি বটে।"

বিকাশ সম্মোহের কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, " আস্তে বল, খিস্তি করছিস! পাশের লোকজন শুনছে।"

ট্রেনের দরজার পাশে দাঁড়ানো অল্প বয়েসী একটি ছেলে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, " সম্মোহদা ফড়িং আসছে ! ফড়িং!"

----" ডাক ডাক শালাকে! ছোট্ট করে পোঁদে লাগি!"

এমন সময় পাশের কামড়া থেকে কাটাবগি দিয়ে ফড়িং এলো।

---" ফলিং,  তি এনেছিস আজ!"

----" লয়নগরের লোয়া! "

---" উলে বাবা, এতটা খাওয়া দেখি। কেমন লোয়া তোর!"

---"খেলে তিতে হবে তুলো প্যাকেট!"

সম্মোহ ফড়িংয়ের কাছ থেকে একটা মোয়া নিল। একটা কামড় দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো," মাগো বাবাগো কি ঝাল!"

ব্যস, ফড়িং গেল ক্ষেপে। 

---" থাল নেই। তিথ্যা কথা বলছে। তোয়া কখনো থাল হয়! হালামি এ্যাতটা!"

---" ঝালকে মিষ্টি বলছিস! বিকাশ খেয়ে দেখ!"

----" না না আমি খাবো না। ঝাল লাগবে!"

বিকাশের কথা শুনে ফড়িং আরো ক্ষেপে গেল।

---" তোয়া কখনো থাল হয়! এটাও হালামি!"

সম্মোহ হো হো করে হাসছে। সঙ্গে অন্যরাও। সম্মোহ এবার ফড়িংকে আরেকটা মোয়া দিতে বলল।

---" তেব দা!"

---" শোন না দে দুটো মোয়া দে! "

----" থাল বললে মেলে মুখ থাতিয়ে দেব!"

সম্মোহ ফড়িংয়ের কাছ থেকে মোয়াটা নিয়ে মুখে পুরলো!

--- ওরে বাবারে রে! মরে গেলাম গো! মাথা ঘুরছে। বিকাশ জল দে!"

---" ফড়িং তোর মোয়া খেয়ে যদি দাদা মরে যায় তোকে পুলিশে দেব!"

---" তাতক করচে ছব! আমাল পয়সা দে। ত্যাপসা নত্ত করছে আমাল!"

পাশ থেকে অন্যজন বলল, " না না ফড়িংয়ের জেল হবে না। মোয়াগুলো তো আর ও বানায়নি!"

--- "কে বানিয়েছে?" একজন জিঞ্জেস করল।

---- " ওল শছুল বানিয়েছে!" পাশ থেকে একজন বলল।

----" থ্যামলা পয়সা দে, আমি তাই!

সম্মোহ হাসতে হাসতে পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে ফড়িংয়ের হাতে দিল। তারপর বললো," দে চার প্যাকেট ঝাল মোয়া দে।"

---" থাল নয় মিষ্টি!"

ফড়িং চারপ্যাকেট মোয়া সম্মোহের হাতে ধরিয়ে পাশের বগিতে চলে গেল।

----" পারিসও বটে! বুড়ো হয়ে গেলি তাও শিং ভেঙে বাছুরের দলে!"