চোখের আলোয় দেখেছিলেম
চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব যখন
আলোক নাহিরে---
রোদ্দুরের স্বরলিপি ঢুকে পড়েছে অভিমানের দপ্তরে।তিনি এখন ঘুম স্টেশনে অপেক্ষমান।আমি শুনছি ঘুমনৌকোর ছলাৎ...
কবি অলোকবিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে আমার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল যে প্রভাত চৌধুরী এর আগে বহুবার অসুস্থ হয়েছেন,আবার সেরেও উঠেছেন।এবারও সেরে উঠবেন,সেরে উঠে আবার আগের মতো বক্তৃতা দেবেন ।নিজের জন্মদিন পালন করবেন মহাসমারোহে ।তাই সবাই চিন্তা করো,কিন্তু দুশ্চিন্তা কোরো না।দুশ্চিন্তা
করলে প্রভাতদা ব্যথা পাবেন।
কিন্তু না,কষ্টের, দুর্ভোগের প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবারও ফিরে এলেন না প্রভাতদা ।সহসাই উত্তর বাতাস এসে থরথর কাঁপিয়ে গেল শীতজানালা ...দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ...খুলেই ঢুকে পড়ল কথাহীন ব্যথা --হাতে বিয়োগচিহ্নের সাদা পাতা,কাঁধে নীরবক্লান্তবিষাদ অত্যাশ্চর্য না-ফেরার দেশের ঠিকানা প্রভাতদা এখন অনন্তলোকে।নিনি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় একদা একান্তেই ভালোবেসে লিখেছিলেন---
নীলিমা-কে নিয়ে লেখা কবিতা//প্রভাত চৌধুরী
নীলিমাকে আমি পুতুল খেলতে দেখিনি,এই স্বীকারোক্তি থেকে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন--নীলিমার
পুতুল খেলার বয়স ছিল না '
এই তথ্যটিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি--তাহলে ভুল করবেন
আমি আমার সীমাবদ্ধ দ্যাখা কথাই লিখতে চাইছি
নীলিমা ভূত দেখে ভয় পায় কিনা তাও আমার জানা নেই
নীলিমা আদৌ কোনো ভূত দেখেছে কিনা তাও আমি জানি না
তাহলে কীভাবে ভূত এসে পড়ল অদ্ভুত ভাবে,তাও আবার পুতুল খেলার অনুষঙ্গে
পুতুলখেলার সঙ্গে ভূতেদের কোনো সহযোগিতা আছে এমন কথা ত্রৈলোক্যনাথও
লিখে যাননি
নীলিমার কি কোনো পোষা বিড়াল আছে, তাও আমার জানার পরিধির বাইরে
গোগোল তিতলি অদ্রিজার কাছে ম্যাও-এর মোবাইল নম্বর আছে,আজই আমাকে
জানিয়েছে,নম্বরটা বলেছিল
গড়গড় করে, সেটাও ভুলে গেছি
নীলিমা সম্পর্কে এত কিছু না জেনেও নীলিমাকে নিয়ে কবিতা লিখছি,তবে কথা দিচ্ছি নীলিমাকে পুতুলখেলা
ভূত এবং পোষাবিড়াল সম্পর্কিত তথ্যগুলি সংগ্রহ করার পর আবার নীলিমাকে
নিয়ে কবিতা লিখতে বসব,
বসলেই একটা টয়ট্রেন এগিয়ে আসবে, আমি সেই ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করলেও উঠতে পারব না,নীলিমা কি পারবে,তা নীলিমাই জানেতো,এই হচ্ছেন প্রভাতদা ,কবি প্রভাত চৌধুরী।আর তাঁর লেখনী-স্টাইল!কিভাবে কাব্যভাষায় অক্ষরমহিমা শব্দে শব্দে গড়ে তুলবে এক জাদু-বাস্তবতা ,বলা বাহুল্য যে তা কবিরই অনুপম দক্ষতা।এইভাবেই কবির কবিতার ঘর- ঘরনি এক ঘরানার আবিষ্কার করেছে যেখানে অনায়াস প্রবেশে পাঠকচিত্তের প্রাপ্তি চমকিত আমোদ...শব্দের মোহজালে তাঁর কবিতা খুব সহজেই পাঠক মনকে আকর্ষণ করতে পারে ।যেন টগরের ডালে ডালে দিগন্তের উপাচার সাজানো, যেখানে না-বলা সম্পর্কেরও ফুল তুলিতে ভুল হয় না।
তবু আকাশের মহাপয়ার, ছন্দপতনে সহসাই জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়ের চিহ্ন যে উড়ো এক উদাস বিষাদ সম্ভাষের কাপাসের আঁশ ১৯৪৪ সালে বাঁকুড়ার হাটকেষ্টনগরে প্রভাত চৌধুরীর জন্ম।শৈশবের বেশিটাই কেটেছে কালিঘাটে,কিছুটা বাঁকুড়ায়।পরবর্তীতে পেয়েছি পটলডাঙার ঘরে।ডানাভাঙা গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন জড়িয়ে ধরে অনুভবে যিনি এখনও অনুপ্রাণিত, তিনি সর্বংসহা সারদাময়ী যূথিকা বৌদি।তাঁর সঙ্গে আছে পুত্র পুত্রবধূ ও নাতির সাহচর্য ।
৬০এর দশকে কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে কবি প্রভাত চৌধুরীর আত্মপ্রকাশ ।১৯৬৬ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শুধু প্রেমিকার জন্য '।ভাবতে অবাক লাগে যে এরপর থেকেই একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ,বেশ কিছু পত্রিকার সম্পাদনা,নূতন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ--এত্তসব কাজ কীভাবে করে উঠতেন।যদিও পরবর্তীতে প্রায় দুই দশক নিরলস চর্চার পর আনুমানিক দশ বৎসর সাহিত্যগত থেকে
নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
পুনরায় নতুন উদ্যমে ১৯৯৩ সালে শুরু করলেন কবিতা পাক্ষিকের মতো পত্রিকা, যে পত্রিকা সকল পাঠক তথা লেখকের কাছে একটি মাইলফলক।পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ ।প্রকাশিত হয় 'সাদাখাতা',সাক্ষাত্কার, আবার সাক্ষাত্কার, নোটবই, উত্তরপর্বের কবিতা, এইসব,হল্লাগুল্লা,সুসমাচার, কুশল সংবাদ,এবং প্রভৃতি ।কিন্তু 'কবিতা পাক্ষিক '-এর মাধ্যমেই প্রভাত দা উত্তর আধুনিক প্রবণতাকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছেন বারেবার।অধুনান্ত কবি প্রভাত চৌধুরীর প্রচেষ্টা ছিল এবং চাইতেনও যে কবিতা সর্বদা আপডেট হোক।
বস্তুতপক্ষে উত্তর আধুনিক বা পোস্ট-মর্ডান বিশ্বসাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ বহুল আলোচিত একটি শব্দবন্ধ ।কবি প্রভাত চৌধুরীর অদম্য উৎসাহে পাঠক তথা লেখকগোষ্ঠী খুঁজে পেল এমন এক প্লাটফর্ম যেখানে দিনগুজরানোর মধ্যে গচ্ছিত হতে থাকে স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ ।সাহিত্যিক অপেক্ষা তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন সাহিত্য কাণ্ডারী রূপে।
নিত্য দিনের সুখদুঃখ-আনন্দক্ষোভ-ক্ষুধামো হঅনুরাগ-অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিশ্বপ্রকৃতি জনারণ্য জীবন ও বহমান উত্তাপ এবং মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের হাতছানি তাঁর লেখনীজুড়ে।দিনলিপির মলিন পৃষ্ঠায় 'আমি'-র ক্ষুদ্রত্ব উপস্থাপনেও এক অভিনব পরিবেশন সত্যি খুব আকর্ষণীয় ।
প্রভাত দা নিজেই বলেছেন, তথ্য মেনে কবিতা লেখা হয় না।কবিতা থেকে আবিষ্কৃত হয় তথ্য ।কবিতা-যাপন একটা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত । ২৪×৭শুধু কবিতাতেই সাঁতার কেটে চলাই হচ্ছে যাপন।যেমন তিনি বলতেন,ফুলগাছে জল দিচ্ছি, এই জল দেবার কাজটি রূপান্তরিত করতে হবে কবিতালেখার কাজে।এটা কীভাবে করতে হবে সেটাই নিজস্বতা ।প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন ঝুলবারান্দা,ভিন্ন ভিন্ন রান্নাঘর।টেনিস কোর্টও
আলাদা,পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ভিন্ন স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে হবে ।
তাঁর একটি কবিতাতেই দেখি এই বৈচিত্র্যের স্বাদ।তিনি লিখছেন---
আমার কবিতা ---আমি বর্ষবরণে কবিতা লিখতে চাইলে বর্ষাবরণের কবিতা উঠে আসতে চায় ।এখন চেষ্টা করতে হবে বর্ষ এবং বর্ষার পালসরেট।একটা আ-কারের জন্য ব্যাঙ্কের আচরণে কী রাসায়নিক পরিবর্তন হয় কিংবা প্রস্ফুটিত ফুলের রং এবং গন্ধেরও রকমফের হয়ে থাকে তার জন্য কোন সূর্যোদয়ে যেতে হবে তাও জানা নেই তবু বর্ষকে তো বরণ করতেই হবে ।না হলে বঁধুয়া কী করে ঘরে ঢুকবে শাঁখ এবং বরণডালা নিয়ে যারা অপেক্ষা করছেন ।
তাদের কথা না ভাবলে লোকে মন্দ বলবে যে ---এভাবেই চলার স্বচ্ছন্দ তাঁর কাছে এক শিক্ষণীয় বিষয়
বাংলা কবিতার পরিবর্তনে কৃত্তিবাস কতটা সফল হয়েছে তার খোঁজ অমূলক।বরং বলাই বাহুল্য যে প্রভাত চৌধুরীর কবিতা পাক্ষিক এমন মাইলফলক,যেখানে নানান ডাইমেনশন, নানান অনুষঙ্গ এবং পরিবর্তিত discourse- এ সাবলীল চমৎকৃত চিত্রকল্পরূপী অটোমেটিক writing skill-এর ব্যাপার টা।এবং পাঠক অনায়াসে তা উপভোগ করে আনন্দ পায় ।প্রভাত দা হলেন rolling stone,তাই শ্যাওলা জমে না।একাধারে পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তেমনি আছে তাঁর স্বয়ংক্রিয়তা।তিনি signature তৈরি করে নিজেকে ধরা দিয়েছেন এবং শপথ নিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে তোলার কাজে।আসলে তিনি প্রকৃতই কবিতা প্রেমিক।তবে তাঁর এই হয়ে ওঠার পিছনে যাঁর ভূমিকা অসামান্য,তিনি হলেন আমাদের বৌদি, সর্বংসহা সারদা, যূথিকা চৌধুরী।
বাংলা সাহিত্য জগৎ এই মুহূর্তে অভিভাবকহীন।১৯৯৩ সালে নতুন উদ্যমে নব কলেবরে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলেও প্রভাত চৌধুরী নিজেকে পরিচিত করেছেন তাঁর পোস্ট মর্ডান টেক্সট স্বরূপ উপন্যাস, গদ্য, এডিটরিয়াল নোটস-এ।তিনি ভালই জানতেন কবিতা পাক্ষিক-এর ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতার যাত্রাপথ।এবং এই কবিতা পাক্ষিক তাঁর প্রাণ।তিনি বারেবারে বলেছেন, কবিতা হচ্ছে নিজের মত প্রকাশের একমাত্র জায়গা।
এটা তো ধ্রুব সত্য যে বাংলা কবিতার ভাষা বদল প্রভাত চৌধুরীর হাতেই।অক্ষরবৃত্তের মহাসমারোহে উত্তর আধুনিক ঢঙ এমন এক রসায়নে রসসিক্ত যে রসিকমাত্রায় কবিতাপথ যেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, তেমনি বহুরৈখিক হাঁটাহাটি যেন তাঁর কাছে অনায়াসলব্ধ।তিনি বারবার বলেছেন এর জন্য চাই আপডেট মাইন্ড ও আপডেট চোখ।শব্দের বহুল অর্থের ব্যাপক বিস্তারে ঘটে যায় আত্ম বিবর্তন ।প্রভাত-দার 'নোটবই '-এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লিখিত করতেই হয়।প্রভাত-দার এভাবেই উত্তর প্রভাতে উত্তরণ ...যেমনটা ব্রাহ্মণ্যবাদের বহতা শব্দের উত্তরণ বুদ্ধে,বুদ্ধ থেকে ভক্তিবাদ,সেখান থেকে রবীন্দ্র নাথ,রবীন্দ্রনাথ থেকে কল্লোল
---এভাবেই শব্দের বিষয়মুক্তি ঘটতে থাকে।এমনটা কেবল কবিতায় নয়,উপন্যাস, এডিটোরিয়াল নোট, গদ্য সর্বত্র মুক্ত চিন্তনের অবকাশে একাধারে আধুনিক ও অধুনান্তপ্রাপ্ত হয়া ।ফলে পাঠক মনে এক মনকেমনিয়া স্রোত বইতে থাকে।এভাবেই তিনি জাঢ্য ধর্ম ভেঙে শব্দের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছেন ।....(চলবে)
প্রভাত চৌধুরীর যে সকল উপন্যাস তার মধ্যে 'সতীসাবিত্রী কথা উপন্যাসে ব্যথারা সুখের মতো হৃদয়ের রাত ছিঁড়ে নামে।কালিঘাটের বেশ্যাপল্লির কাহিনি বিশুদ্ধতায় আলোকময় ।আর 'অনুপম কাহিনি 'এমন এক পোস্ট-মর্ডান টেক্সট যেখানে প্রভাত চৌধুরী ও অনুপম একে অপরের অল্টার ইগো।এরা পাশাপাশি থেকে কথা বলাবলি করে সবার অগোচরে আবার নিজেদের দূরে সরিয়েও রাখে। আত্মজৈবনিক উপন্যাসে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ছায়ায় এইভাবে নিজেকে ও পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারার দক্ষতায় প্রভাত দা চিরস্মরণীয় তথা চিরজীবী হয়ে থাকবেন।বলার অপেক্ষা থাকে না যে তাঁর নিজস্ব পরিচয়ে তিনি অন্যদের থেকে আলাদা ।
প্রভাতদার একটি স্মরণীয় কবিতা আজ খুব মনে পড়ছে :
যারা আমার শবযাত্রায় প্রথম সারিতে থাকবে তাদের বলে দিও--যেন চিৎকার না করে
চিৎকার আমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে
যারা আমার মৃত্যুর পরে শোকসভা করবে তাদের বলে দিও---যেন আড়ম্বর না করে
ঐশ্বর্যের টানে আমি জেগে উঠতে পারি
যে আমার মৃত্যুর পরে
চোখের জল ফেলবে সে তুমি---তোমাকে চুপিচুপি
বলে রাখি,চোখের জলে
আমার ঘুম ভাঙবে না
প্রভাত-দাকে লিখতে হবে এভাবে কখনও ভাবিনি, যেন নিজেকে তিনি লিখিয়ে নিচ্ছেন,যেভাবে কবিতা লিখিয়ে নিতেন আদেশের সোহাগে
যেন চুপিচুপি আমাকে ডেকে বলছেন--কে বলে গো এই প্রভাতে নেই আমি ...
হ্যাঁ, কবির তো মৃত্যু হয় না।
প্রভাত-দা আছেন, থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, আমাদের সাথে, আমরাও আছি তাঁর সঙ্গে, থাকবও।



