Wednesday, May 28, 2025

পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী | সঞ্চারী ভট্টাচার্য

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||সঞ্চারী ভট্টাচার্য 
পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী
পর্ব:১


মা সরস্বতীর কতগুলি রূপ পাওয়া যায় শাস্ত্রে?

 

শাস্ত্রসমূহে মা সরস্বতীর একাধিক রূপ পাওয়া যায়। এই রূপগুলি ভৌগোলিকআধ্যাত্মিকদার্শনিকতান্ত্রিক ও প্রতীকী ব্যাখ্যার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হয়। সরস্বতী কেবলমাত্র বিদ্যার দেবী ননতিনি জ্ঞানশব্দভাষাবুদ্ধিসঙ্গীতকবিতানদী এবং শক্তির প্রতীকও। তাঁর রূপসমূহ সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিফলিত হয়েছে।

 

প্রথমতবেদের মধ্যে সরস্বতীকে একটি নদী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদে তিনি একটি বিশেষ পবিত্র নদীরূপে বর্ণিতযিনি সাতটি নদীর মধ্যে প্রধান এবং যাঁর মাধ্যমে প্রাচীন আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। বেদে এই নদী শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়বরং জ্ঞানের ধারাকে প্রতীকীভাবে বহন করে। এই নদীরূপ সরস্বতীকে বলা হয়েছে 'সরদ্ ধারাবা 'সপ্তস্বতী', যা সাতটি প্রকারের জ্ঞানের প্রবাহ নির্দেশ করে।

 

ঋগ্বেদ ছাড়াও যজুর্বেদসামবেদ ও অথর্ববেদে সরস্বতীকে বাক্‌দেবী তথা ভাষার দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে তিনি পরম ধীশক্তিযিনি ভাষাকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। বাক্‌দেবীর চারটি রূপ শাস্ত্রে নির্ধারিত: পরাপশ্যন্তীমধ্যমা ও বৈখরী। এই চার স্তরের বাক্‌সমূহ মানুষের অন্তর্লোক থেকে বহির্জগতে ভাষারূপে প্রকাশ পায়। পরা বাক্‌ ব্রহ্মচৈতন্যের সঙ্গে যুক্তপশ্যন্তী হচ্ছে অন্তর উপলব্ধ ধ্বনিমধ্যমা বাক্‌ মানসিক স্তরের ভাষা এবং বৈখরী বাক্‌ শ্রবণযোগ্য ধ্বনি।

 

উপনিষদে সরস্বতী মূলত ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমরূপে দেখা দেন। তিনি ব্রহ্মার বাম অংশ থেকে উৎপন্নতাই তাঁকে ব্রহ্মপত্নী বলা হয়েছে। সরস্বতী এখানে জ্ঞানের উৎসশব্দের আধার এবং সচেতনতার প্রকাশ। বামদেবীয় উপনিষদ ও মাণ্ডূক্য উপনিষদে বাক্‌ বা ধ্বনির মাধ্যমে আত্মার উপলব্ধির কথা বলা হয়েছেযেখানে সরস্বতীই এই ধ্বনির রূপে বিরাজমান।

 

পুরাণসমূহে সরস্বতীর রূপ আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। ব্রহ্মান্ড পুরাণস্কন্দ পুরাণশিব পুরাণদেবী ভাগবত ও পদ্ম পুরাণে সরস্বতী কখনও শান্তশ্রীদায়িনীকখনও রুদ্রাণীকখনও ত্রিদেবীর অন্যতমা মহাশক্তিরূপে উপস্থিত। দেবী ভাগবত পুরাণে তিনি আদ্যাশক্তিতাঁর রূপই ললিতাদুর্গাকালী ও সরস্বতী। শিব পুরাণে তিনি ব্রহ্মার মানসকন্যাআবার কখনও তাঁর পত্নী। কোনো কোনো পুরাণ অনুসারে সরস্বতী রুদ্রের শক্তিরূপে আবির্ভূতাযাঁর দ্বারা সমস্ত শব্দতত্ত্ব ও উচ্চারণ শুদ্ধ হয়। ব্রহ্মার চার মুখ থেকে চার বেদ যেমন নির্গত হয়েছেতেমনি সরস্বতীর মুখ থেকেও জ্ঞানের ঝর্ণাধারা প্রস্ফুটিত হয়েছে। পুরাণে সরস্বতীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হল শ্বেতবসনা’—যিনি হাতে বীণাপুস্তকজপমালা ধারণ করেন ও রাজহংসে বিরাজমান।

 

তন্ত্রশাস্ত্রে সরস্বতী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তির রূপ। তিনি এখানে শুধুমাত্র বিদ্যার দেবী ননবরং একটি জীবন্ত মন্ত্রময়ী চেতনা। সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'বাগ্লামুখীও 'ত্রিপুরাসুন্দরী'-র সহচরী। তন্ত্রে তিনি বীজমন্ত্রের মধ্যেও বাস করেন। যেমন—'ऐं' (ঐং) হল সরস্বতীর বীজমন্ত্রযা জ্ঞানবৃদ্ধিবাগ্‌সিদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি প্রস্ফুটনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তন্ত্রসারে মা সরস্বতী দশ মহাবিদ্যার অংশ নন ঠিকইকিন্তু তন্ত্রচর্চার জন্য অপরিহার্য। অনেক তান্ত্রিক মত অনুসারে তিনিই বীজজ্ঞান ও জপের অন্তর্গত সত্তা।

 

লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ধর্মাচরণেও মা সরস্বতীর নানা রূপ পাওয়া যায়। বাংলায় তাঁকে 'বসন্তপঞ্চমীর দেবীহিসেবে পূজা করা হয়যেখানে তাঁর প্রতীক হল খড়ের তৈরি পট বা হংসবাহিনী রূপ। রাজস্থানে তাঁকে 'চারবাহুরূপে দেখা যায়যেখানে তাঁর হাতে থাকেন কলমকিতাবসঙ্গীততন্তু ও মালা। দক্ষিণ ভারতে তিনি 'শারদানামে পরিচিতআর কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে 'সরস্বতী হোমও 'আক্ষরাব্যাহানামক রীতি প্রচলিত আছেযেখানে শিশুদের বিদ্যার সূচনা সরস্বতীকে উৎসর্গ করে হয়।

অনেক স্থানে সরস্বতীকে রুদ্রাণী বা কালী রূপেও কল্পনা করা হয়েছেযেখানে তিনি শুধু শুভ্র ননকখনও রক্তবর্ণাও। কাশ্মীরের একাধিক তান্ত্রিক গ্রন্থে সরস্বতীকে ত্রিনেত্রা ও দশভুজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রূপে তিনি ভাষার স্রষ্ট্রী এবং ধ্বংসকারিণী একত্রে।

 

সংগ্রহ করলে মা সরস্বতীর শাস্ত্রসম্মত রূপগুলি এভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়:

 

১. নদীরূপে – ঋগ্বেদ অনুসারেসাত তীরবাহিত এক পবিত্র নদী।

২. বাক্‌দেবীরূপে – ভাষা ও ধ্বনির প্রতীকচারস্তরীয় বাক্‌তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত।

৩. জ্ঞানের দেবীরূপে – বেদ ও উপনিষদ অনুযায়ী চৈতন্য-জ্ঞানের আধার।

৪. ব্রহ্মপত্নীরূপে – পুরাণে ব্রহ্মার শক্তিস্বরূপা।

৫. শ্বেতবসনা ও বীণাবাদিনী রূপে – শিক্ষাসঙ্গীত ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী।

৬. তান্ত্রিক রূপে – বীজমন্ত্রের আধারশক্তিরূপিণীত্রিনেত্রা ও দশভুজা।

৭. লোকরূপে ও উপজাতীয় প্রতিমায় – আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন।

৮. সিদ্ধিদাত্রী ও বাগ্‌সিদ্ধি দায়িনী – সাধনা ও মন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম।

৯. রুদ্রাণীরূপে – শিবতত্ত্বের সহচরীশব্দতত্ত্বের সংহারিণী রূপে।

১০. ধর্মদর্শন ও সংগীতের রূপে – সমস্ত শাস্ত্রকলা ও বিজ্ঞানরূপী চেতনার উৎস।

 

এইসব রূপ আলাদা আলাদা হলেও তারা এক মূলতত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করেসেই মৌলিক জ্ঞানচেতনাযা ভাষার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়সৃষ্টির ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধ হয়। মা সরস্বতী সেই চেতনার বহুমাত্রিক প্রকাশ। তাই তাঁকে গণনা করা যায় না কেবলমাত্র সংখ্যায়কারণ তিনি সংখ্যার অতীতবর্ণের অতীতএবং রূপেরও অতীত। তবুযেহেতু মানুষ রূপের ভেতর দিয়ে চিন্তা করেতাই এই রূপগুলি আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করেআত্মিক অনুসন্ধানকে শক্তি জোগায়।


সরস্বতীর কোন রূপটি নদীরূপে চিহ্নিত?

 

মা সরস্বতীর উপাসনা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারার মধ্যে পড়েতবে আজ যাঁকে আমরা শিক্ষাসংগীতবিদ্যা ও ভাষার দেবী বলে জানিসেই সরস্বতী এক কালে প্রথমত পরিচিত ছিলেন একটি নদী হিসেবে। এই রূপটি সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। তাঁর নদীরূপটি শুধু ভৌগোলিক নয়বরং আধ্যাত্মিকসাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের অন্যতম মূল আধার। এই রূপটিই হল মা সরস্বতীর প্রাচীনতমমৌলিক ও সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত প্রতীক।

 

ঋগ্বেদের প্রায় ৭২টি মন্ত্রে সরস্বতীর নাম উল্লেখিত হয়েছে। এর মধ্যে বহু ক্ষেত্রে তিনি নদী হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষ করে ঋগ্বেদ ৬.৬১ সূক্তে সরস্বতীকে একটি জলপ্রবাহঅর্থাৎ নদী বলা হয়েছে – “ইমাম্‌ মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শুতুদ্রে স্তোমম্‌ সচ্ছতা পরূষ্ণ্য। এখানে গঙ্গাযমুনা ও সরস্বতীকে পাশাপাশি উচ্চারিত করা হয়েছেযা নদীরূপে তাঁকে গঙ্গা ও যমুনার সমপর্যায়ে স্থাপন করে। এছাড়া ঋগ্বেদ ১০.৭৫-তে নদীসূক্ত’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ সূক্ত রয়েছেযেখানে দশটিরও বেশি নদীর নাম রয়েছে এবং সরস্বতীকে সেখানে নদীনাম্‌ শ্রেষ্ঠা বলা হয়েছে।

 

এই নদী শুধুমাত্র একটি জলপ্রবাহ নয়বরং ঋগ্বেদীয় আর্য জীবনের প্রাণরেখা। সরস্বতী নদী প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত হতো বলে মনে করা হয়বিশেষত বর্তমানে হারিয়ানাপাঞ্জাব ও রাজস্থান অঞ্চলজুড়ে। বহু গবেষণা ও উপগ্রহচিত্র পর্যালোচনায় প্রমাণ মিলেছে যে, ‘ঘঘর-হাকড়া’ নামে যে শুকনো নদীর ধারা পাকিস্তান ও ভারতের মরুভূমি অঞ্চলে দৃশ্যমানসেটিই প্রাচীন সরস্বতীর ধারা হতে পারে।

 

ঋগ্বেদের মতেএই নদীর উৎস ছিল হিমালয় থেকে এবং এর জলধারা ছিল অত্যন্ত প্রবাহমানসজীব ও উর্বর। তাঁকে বলা হয়েছে – “সপ্তস্বতী” অর্থাৎ সাতটি ধারা বিশিষ্ট নদী। আবার অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী” – এই শ্রুতিতে তাঁকে বলা হয়েছে স্নেহময়ী মাসর্বশ্রেষ্ঠ নদী এবং দেবীএই তিন রূপে একত্রিত প্রতীক।


এই নদীরূপে সরস্বতী কেবল শারীরিক বা ভৌগোলিক উপস্থিতি নয়বরং প্রাচীন ঋষিরা তাঁর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন এক ধারাএক জ্ঞানস্রোতযা মানবজীবনে ভাবভাষা ও ধ্যানের রস এনে দেয়। তাঁর নামের অর্থই হল – ‘সরঃ’ অর্থাৎ প্রবাহ ও স্বতী’ অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত। সেই অর্থে সরস্বতী মানেই যিনি নিজের থেকে প্রবাহিত হন। এই প্রবাহ শব্দেরবাক্‌শক্তিরজ্ঞানের এবং ধ্যানের।

 

মার্কণ্ডেয় পুরাণবিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মান্ড পুরাণেও সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছেএই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলে প্রবাহিত হত এবং পরে রজতপর্বতের মধ্যে আত্মগোপন করে। এই আত্মগোপন করাকে মহাকালগত ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যা করা হয়একদা যে জ্ঞানযে ভাষা সমাজকে আলোকিত করতকালের প্রবাহে তা অন্তর্হিত হয়ে পড়ে।

 

মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে স্পষ্টভাবে সরস্বতী নদীর অবস্থান ও গুরুত্বের কথা বলা আছে। সেখানে পাণ্ডবরা সরস্বতীর তীরে তপস্যা করেন এবং বহু ঋষি এই নদীতীরকে আশ্রম স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। নদীটি তখনও প্রবাহমান ছিলযদিও কিছু কিছু স্থানে তার জলধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে বলেই বর্ণনা।

 

জৈন গ্রন্থাবলিতেও সরস্বতী নদী উল্লেখিত হয়েছেযদিও সেখানে তাঁর নদী ও দেবীরূপের সংমিশ্রণ খুব সীমিত।

 

পরবর্তীকালে এই নদীর ধারা হারিয়ে যায় বা ভূগর্ভস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতীকার্থে সরস্বতী রয়ে যানকখনও গঙ্গার মধ্যেকখনও ত্রিবেণী সঙ্গমে অদৃশ্য তৃতীয় নদী’ হিসেবে। এই ত্রিবেণী সঙ্গমেযেখানে গঙ্গা ও যমুনা মেলেছেসেখানে বলা হয়, ‘সরস্বতী গুহ্যভাবে প্রবাহিত’—অর্থাৎ তিনি আর দৃশ্যমান ননকিন্তু তলে তলে রয়েছেন। এই অন্তর্হিতা সরস্বতী’ হলো আধ্যাত্মিক প্রতীকযে জ্ঞান দৃশ্য নয়কিন্তু উপলব্ধির জন্য অপেক্ষমাণ।

 

তন্ত্রশাস্ত্রেও নদীরূপে সরস্বতীকে চর্চা করা হয়েছে। বিশেষতনদীর প্রবাহ ও বীজমন্ত্রের ধ্বনির মধ্যে এক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে বলা হয়েছে, 'যে নদী অন্তরে প্রবাহিতসেই সরস্বতীই প্রকৃত তন্ত্রময়ী'। এই তত্ত্ব অনুসারেসরস্বতী নদীই শব্দতত্ত্বের উৎসঅর্থাৎ ধ্বনির যে উৎসতা-ও একধরনের প্রবাহ এবং সেই ধ্বনিই মন্ত্রের রূপে প্রতিষ্ঠিত।


আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানও এই নদীর অস্তিত্বের পক্ষে অনেক প্রমাণ এনেছে। ২০০২ সালে ইসরো ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া যে উপগ্রহচিত্র সংগ্রহ করেতাতে স্পষ্টভাবে একটি বৃহৎশুকিয়ে যাওয়া নদীর শুষ্কপথের চিহ্ন ধরা পড়েযা ঘঘর নদীর সঙ্গে মিলে যায়। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনযেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার উপকরণকেশেতুবানওয়ালিকালিবঙ্গা প্রভৃতি স্থানেও এই নদীস্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত নগরভিত্তিক বসতির প্রমাণ মেলে। এর অর্থসরস্বতী নদী শুধু ধর্মগ্রন্থেই নয়সভ্যতার গঠনতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

 

তবে এই নদীরূপটি ক্রমশ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তার প্রতীকমূল্য কখনও মুছে যায়নি। মা সরস্বতী আজ দেবী হিসেবে পূজিতা হলেওতাঁর নদীরূপে স্মরণ আজও তীর্থক্ষেত্রেমন্ত্রেআশ্রমে ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রতিফলিত হয়। একদিকে তিনি দৃশ্যজগতের গঙ্গা ও যমুনার মাঝখানে অদৃশ্য’, অন্যদিকে তিনিই অন্তর্দৃষ্টিঅন্তর্জ্ঞান ও মৌনবাক্‌রূপে প্রবাহিত।

 

এইরকমভাবে মা সরস্বতীর নদীরূপটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞান একটি প্রবাহযা স্থির নয়এক স্থানভিত্তিক নয়বরং সে গতিশীলসজীবকখনও প্রকাশমানকখনও অন্তর্হিত। এই প্রবাহ কখনও শোনার মতোকখনও উপলব্ধির মতোকখনও শুধুই অনুভবের মতো।

 

সুতরাংশাস্ত্রে সরস্বতীর যে নদীরূপ চিহ্নিততা কেবল এক ভৌগোলিক স্মৃতি নয়তা ভারতীয় চেতনায় এক মৌলিক ও চিরন্তন স্রোতযা যুগে যুগে প্রকাশ পেয়েছে ভাষাবাক্‌সঙ্গীত ও সাধনার মধ্যে দিয়ে। তিনি যে নদীসেই নদীই আজ বাক্‌দেবীআর সেই বাক্‌ই আবার আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ব্রহ্মতত্ত্বে পৌঁছবার সেতু।


তথ্যসূত্র –

 

১. সরস্বতী নদী: ইতিহাস ও পুরাণ – ড. শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী১৯৮৫

২. ভারতের হারানো নদী: সরস্বতী – বিভূতিভূষণ সেনগুপ্ত১৯৯২

৩. সরস্বতী ও বাণীপুরাণ – প্রফুল্ল চন্দ্র দত্ত১৯৭৮

৪. ভারতের জলপথ: সরস্বতী নদীর গৌরব – অমরেন্দ্র কুমার দাস২০০১

৫. পুণ্যসরস্বতী: নদীসংস্কৃতি ও লোককথা – হেমন্ত মুখার্জী১৯৯৯

৬. ভারতের হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো – ড. অনিলকুমার রায়২০০৫

৭. সরস্বতী নদীর ভৌগোলিক ইতিহাস – ড. মধুসূদন বসু১৯৯০

৮. বৈদিক ভারতের নদী ও সরস্বতী – স্বর্ণলতা সেন১৯৯৪

৯. সরস্বতী নদী: পুরাণ থেকে বিজ্ঞান – রবি চন্দ্র ঘোষ২০০৩

১০. নদীর দেবী সরস্বতী – কুমুদ রায়১৯৮৮


 

No comments: