এরকম কত কিছু মাথায় আসে আবার মাথা থেকে বেরিয়েও যায়। মাঝে মধ্যে একা লাগে। আবার চারপাশের প্রকৃতির দিকে তাকালে একাকিত্ব কেটে যায়। শাড়ির খসখস শব্দ তুলে বুলির মা চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। শূন্য ফাঁকা দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে সম্মোহ।লীমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ফেসবুকের ছদ্মবেশী আইডি খুলে লীমার প্রোফাইলে ঢুকে যায় সম্মোহ। দেখে বহুদিন আগের একটা ছবিকে প্রোফাইল পিক করেছে লীমা, ছবির সঙ্গে কয়েকটা লাইন, "বহুদিন মনে ছিল আশা,ধরণীর এক কোণে রচিব আপন মনে, ধন নয় মান নয়, এতটুকু বাসা, মনে ছিল আশা"।
সম্মোহের হাসি পায়, মনে মনে বলে, বিড়াল! শ্রডিংগারের বিড়াল! অদ্ভূত সেই ঘটনার কথা মনে আসে। একটা বিড়াল বন্দী আছে স্টিলের বাক্সে। যার মধ্যে অবশ্যই জীবটার নাগালের বাইরে রয়েছে আরেকটা ব্যবস্থা। একটা নলে সামান্য খানিকটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এতটাই কম যে একঘন্টায় তার মধ্যে থেকে হয়তো বা শুধু একটা পরমানু ভাঙবে। আবার হয়তো বা সেটাও নয়। যদি ভাঙে, তবে আয়োজন অনুযায়ী রিলে ব্যবস্থায় হাতুড়ির আঘাত পড়বে হাইড্রোরাসায়নিক অ্যাসিডের একটা ফ্লাক্সে। বেরোবে বিষাক্ত গ্যাস। মরবে বেচারা বিড়াল।
আজকাল লীমাকে ওই বিড়ালটার মতোই অসহায় লাগে সম্মোহের। "বিজ্ঞানী আরউইন শ্রডিংগার আপনার এই কাল্পনিক পরীক্ষা পদার্থবিদ্যার এক অমূল্য সোপান। আর আমি সম্মোহ চ্যাটার্জী, আমার জীবনে এটাই বিরহের গান।" কথাগুলো বেশ জোড়ে জোড়ে আউড়ে নিজেকে হালকা লাগে সম্মোহের। কারণ, সময়ের কাছে ফুরফুরে করে নেবার মধ্যে একটা অহংকার আছে।এই ধরনের অহংকার আঁকড়ে সম্মোহের তৃপ্তি! না পাওয়ার বেদনায় অমলিন প্রলেপ। শুধু একটাই দোষ তার, সে বড় বেশি কথা বলে। একবার শুরু হল তো থামতেই চায় না। বলতে বলতে কোথায় যে চলে যায় সে নিজেও জানে না। এখানকার লোকে তাই হেসে বলে বাগাড়ে বুড়ো। অথচ সম্মোহ ততটা বুড়ো নয়। বয়সটা এই শ্রাবণেই একষট্টিতে পড়েছে। দেখলে বোঝা যায় না। লাল টি শার্ট আর ব্লু জিন্সে পঞ্চাশের বেশি মনে হয় না।
লীমাকে মাঝে মধ্যে দেখতে ইচ্ছে করে। আবার করেও না। ফেসবুকের পোস্ট গুলো দেখলে সম্মোহের গা জ্বালা করে। সম্মোহ বিরক্ত হয়। লীমা যেন তার জীবন থেকে জীবনের পূর্ণতাটা কেড়ে নিয়েছে। লীমারও বয়স বেড়েছে। চামড়া কুঁচকেছে। কিন্তু বুক ঝোলেনি। সুচরিতা বলেছিল, ঝুলবে কেন? ওর বাচ্চা হয়েছে? বাচ্চা হলেই মেয়েদের ধকল!
আজকাল লীমার ওপর মায়া হয়। ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে। ভাই বিয়ের পর গ্যাংটকে হানিমুনে গেছে। লীমা সেই হানিমুনের ছবি গদগদ হয়ে ফেসবুকে শেয়ার করেছে। শুধু মা আর ভাই, এর বাইরে যেন কোনো জগৎ নেই। জবাবদিহি নেই। বাবার চাকরিটা গলায় ঝুলিয়ে মা আর ভাই সারাটা জীবন শুধু শোষণ করে গেল একজন সৎ ভালো মানুষের উপর। কোনো মা যে এত স্বার্থপর হতে পারে জানা ছিল না।গেট খোলার শব্দে সম্মোহ তাকাল।
--" লালুকাকা কখন এলে গো!"
--- "খানিক আগে। মাঠে ধান কাটা চলছে। বড় খাটনি গো বাবু।"
---" হ্যাঁ, তা তো হবেই! সারাদিনের ধকল কম নয়!"
---" তা আজকে একটু হবে নাকি?"
এই "হবে নাকি?" শুনলেই লালুকাকা যে স্বর্গীয় হাসিটা দেয়, সেটা লাখ টাকার থেকে কম নয়! সম্মোহ এই হাসিটাকে খুব এনজয় করে।আর লালু কাকাকে নিয়ে মাল খেতে বসলে খুব এন্টারটেইন হয়। বেশি না! তিন পেগের পর লালুকাকার মতো বীর মাতাল এ তল্লাটে খুব একটা দেখা যায় না।
সন্ধ্যায় আজ হাঁসের মাংসের আয়োজন। লালু কাকা হাঁস কাটছে। পালক ছাড়িয়ে পরিস্কার করতে অনেকটা সময় লাগবে।প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। তারপর রান্না। বুলির মা আটা মেখে মশলা বাটতে ব্যস্ত। শিলে বাটা মশলায় রান্নার স্বাদ ভালো হয়। কাছাকাছি একদল শেয়াল খানিকক্ষণ একসঙ্গে ডাক দিল। সেই ডাকে গলা মেলালো কয়েকটা কুকুর। কাঠের উনুনে ঢিমে আঁচে এখন মাংস রান্না হবে।
তারপর সম্মোহ আর লালুকাকার শুরু হবে নৈশ কেত্ত্যন। মাসে দু-তিনবার এই ব্যবস্থা থাকে। শীতকালে পাঁচ-ছবার হয়ে যায়। এখন এখানে শীতের আমেজ এসে গেছে। মাঝে মধ্যেই ট্যুরিষ্টদের আনাগোনা। বেশিরভাগ লোকজন কলকাতা কিংবা পার্শ্ববর্তী শহরতলী থেকে বেড়াতে আসে। কংক্রিটের জঙ্গল থেকে এই বিশুদ্ধ শালের জঙ্গলে অবসর যাপন করে। তখন সারাদিন অতিথিদের ঝক্যি সামলে ঘুমোতে রাত হয়। লালুকাকা বুলির মা সারাদিন ধরে খাটে। বসার সময় পায় না। সম্মোহ হাতে হাতে সাহায্য করে। আগামী শুক্রবার আবার গেস্ট আসবে। তাই আজ একটু রিল্যাক্স করে নেওয়া। এতে অবশ্য বুলির মা রেগে যায়। সে বলে, তোমারা বাবু ফূর্তি করছো, আমার কি হবে!"
সম্মোহ হেসে বলে," কেন! তুমিও ফূর্তি করো!"লালুকাকা তালে তাল দেয়। বলে," হ্যাঁ, তুইও ফূর্তি কর! লাচ কর! দুটা গ্লাস খা।"
---" ওসব খাইনি আমি! বাবু আমাকে পয়সা দিবে"
আচ্ছা ঠিক আছে দেব দেব। কেন দেবনা! তুমি আমাদের এতো সেবাযত্ন করছো। এই বলে সম্মোহ পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বুলির মা'র দিকে এগিয়ে দেয়। বুলির মা টাকাটা হাতে নিয়ে বলে, "ঠিক আছে বাবু, তোমরা খাও। আনন্দ করো। যখন রাতের খাবার খাবে ডাক দিবে। সব একবার গরম করে দিব।"
লালুকাকা বলে," তোকে কিছু দিতে হবেনি, আমরা লিয়ে লিব। তুই তোর মতো খেয়ে ঘুমা মা!"
লালুকাকা তিনপেগের মাত্রা অতিক্রম করতেই সম্মোহ কথাটা বলে ফেলে।
-- "বটুক লোহার জায়গাটা দিবেনি বলছে।"
---" দোষ তো তোমার। তিন বছর আগে টাকা দিলে, কিছু শিখিয়ে নিলেনি! জায়গাটা ঘিরবে ঘিরবে করে ঘিরলেনি!ওর পুলি মেরে দিব। মাঙমারানি!"
---" এই তো মেরা সিপাই। রাত কা বাপ! খেল দেখাও দিকি!" সম্মোহ লালুকাকাকে উত্তেজিত করে আর মিটিমিটি হাসতে থাকে।লালুকাকা ফর্মে আছে। তবে বটুককে টাইট দিতে একটা কোনো উপায় ভাবতে হবে।সত্যিই তো টাকা দিল বটুকের মেয়ের বিয়েতে, ছেলের চাকরির জন্য! এছাড়া আপদে বিপদে সম্মোহ সবসময় টাকা দিয়েছে। শুধু মুখের কথা আর বিশ্বাস! জঙ্গলের মানুষ এমনটা হবে সম্মোহ বুঝতে পারেনি। ঈশ্বর আছেন এই সান্ত্বনা বাক্যে নিজেকে অবরুদ্ধ করলো না সম্মোহ। বরং একটা গোপন হত্যার ফন্দি আঁটল মনে মনে।


No comments:
Post a Comment