|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||
অলোক বিশ্বাসের আলোচনা
সমর চক্রবর্তীর কবিতা যাপন
অলোক বিশ্বাসের আলোচনা
সমর চক্রবর্তীর কবিতা যাপন
বাংলাদেশের নয়ের দশকের অতি পরিচিত কবি সমর চক্রবর্তীর যাপন ও কবিতা আমাকে আকৃষ্ট করেছে অন্তরঙ্গভাবে। কোনো একজন কবিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কী কী ভালোবাসেন, কেউ হয়তো বলবেন, মানুষ ও প্রকৃতি। কেউ বলবেন, ছন্দের ব্যবহার। কেউ বলবেন, কবিতায় মিথ ও পুরাণের প্রয়োগ। সমর চক্রবর্তী বলবেন, জীবনের এপারে ওপারে যাকিছু আছে, ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের যাকিছু সম্পর্ক, তার সবকিছুই তিনি ভালোবাসেন। সমর চক্রবর্তী বলবেন, তিনি টোটাল কবিতায় বিশ্বাসী। অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের সমস্ত বস্তু ও প্রাণী জগতের আচরণ তিনি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতায় প্রয়োগ করতে চান, তিনি খণ্ডচেতনায় বিশ্বাসী নন। অখণ্ড নিরবতায় দিগন্তের স্বপ্নারোহী হতে চান তিনি। তাঁর 'দিগন্তের স্বপ্নারোহী' কবিতা বইয়ের প্রথম কবিতায় লিখছেন তাঁর কবিতা পথের গন্তব্য। কবিতাটির নাম 'আমার গন্তব্য'--- 'প্রাচীন একটি পথরেখা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাচ্ছি আমি অসংখ্য ডিজিটাল সড়ক রেখায়। ভেবেছিলাম, ভাষা-বিন্যাসের পাখি উড়ে যাবার পর শূন্যে যে গতিপথ এঁকে যায়, হয়তো তার কাছ থেকে পেয়ে যাব কিছু পথনির্দেশ। সহসাই বোধ হয় অনির্দেশিত ভ্রমণের কোনো গন্তব্য থাকতে নেই। আমার ভ্রামণিক পা হাঁটতে হাঁটতে তৈরি করছে অসংখ্য নতুন সড়ক। এখন পা দুটোকেই আমার ভ্রমণের গন্তব্য ভাবছি।' কবিতার শেষে যতিচিহ্ন নেই। আমি দিলাম। জিজ্ঞাসা চিহ্ন আর প্রশ্নবাচক চিহ্ন ব্যতীত কোনো কবিতায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি, একমাত্র টানাগদ্যে লেখা কবিতাগুলোর ভেতরে যতি চিহ্নের ব্যবহার ছাড়া।
কবি সমর চক্রবর্তী ফরিদপুরের বাসিন্দা। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। পেশা সাংবাদিকতা। তাঁর অজস্র কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকেই তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশ সাংবাদিকতার মাধ্যম অবলম্বনে। বারবার তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন সাংবাদিকতার পেশা সত্বেও। কবিতা ছাড়াও লেখেন ছোটোগল্প। প্রকাশ করেছেন গল্পের বই 'রঙিন স্বপ্নের বাসিন্দারা'। দীর্ঘদিন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে থেকে প্রকাশ করেছেন 'সৈকত', 'উচ্চারণ', 'অনিকেত' এবং 'কথাশিল্প' নামে বিভিন্ন পত্রিকা। এই কবির জন্ম ১৫ ই মার্চ ১৯৭৩। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নয়টি কবিতার বই--- যে যার গন্তব্যে একা। দিগন্তের স্বপ্নারোহী। নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়। কঙ্কালে কুরচিফুল। নিসর্গ অনূদিত কণ্ঠ। অন্ধকার ডানার মানুষ। রৌদ্র ক্ষয়ে যায় তুষারে। আদিম অশ্বের পিঠে।
গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা কবি নগর জীবনে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু গ্রামজীবন রয়ে গেছে তাঁর অস্তিত্বে প্রবলভাবে। নগর জীবন তাঁকে অর্জন করতে বাধ্য করেছে নাগরিক জীবনের ভাষা। তাঁর সত্তা নগরে মিশে গেলেও তিনি নগরের চলমান জীবনে বাউল বাতাসের গন্ধরহিত নন। তাঁর কবিতা 'তোকে লিখতে গেলেই' যেন কবিতাকেই সম্বোধন করে লেখা, কিছুটা উদ্ধৃত করি--- 'বাতাসে সবুজপাতাগুলো কেঁপে ওঠে/আলিঙ্গনের উষ্ণবৃত্ত পার করে আমি নগরের বাউল বাতাসে উড়ি/তৈরি করি হৃদয়ে সহস্র অলৌকিক সেতু/তারপর কি-প্যাডে হাত রেখে/তোকে জানাই মনের সকল আকুলি- বিকুলি/#কখনো রোদের আনন্দে হারাই, অন্ধকারে হাঁটি একা/বিনীতভাবে চেনাদৃশ্য থেকে সরে থাকি দূরে/#তোকে লিখতে গেলেই ভাষাগুলো প্রেমিক হয়ে যায়'।
স্বপ্নভরা মনের কবি সমর চক্রবর্তী। স্বপ্নকে কোনো বাঁধা পথে বেঁধে রাখেননি। স্বপ্ন হোক এলোমেলো। এলোমেলো স্বপ্ন নিয়ে তাঁর ভাষাগুলো উড়ে বেড়ায় ভিড়ের মধ্যে। তিনি চলমান বাসের লুকিং মিররে চুলের ভেতর আঙুল দিয়ে নিজেকে আদর করতে করতে স্টপেজ ছাড়াই আচমকা নেমে পড়েন। তাঁর বহু কবিতায় স্বপ্নের প্রত্যক্ষণ হয়েছে আনন্দে বিষাদে উল্লাসে যন্ত্রণায়। ১.স্বপ্নহীন ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ওরা কারা হাতছানি দেয় ?(নগর নাগরী)। ২.শরীর ক্যাম্পাসে জীবন আর স্বপ্ন দাপাদাপি করে/স্বপ্নপোকাগুলো রাত জেগে লেগে থাকে চোখে(সড়ক সভ্যতা)। ৩. মধ্যবিত্ত স্বপ্নগুলো প্রাপ্তির ভঙ্গিতে অর্ধেক উলঙ্গ অর্ধেক উন্মাদ(শ্রেষ্ঠ আশ্রয়)। ৪. কেন এতো স্বপ্নব্যঞ্জনা রাতের প্লেব্যাক ?(অদৃশ্য ভ্রমণ)। ৫. বাবা স্বপ্ন দেখেন, লাল স্বপ্ন, সবুজ স্বপ্ন, হরিৎ-ঐশ্বর্য বিমূর্ত স্বপ্ন/স্বপ্নগুলো বাঘের অরণ্যে হরিণীর মতো ছুটে যায় আলেয়ার প্রান্তরে/বাবা তবু স্বপ্ন দেখেন/ফুলের বাগান থেকে দুঃস্বপ্নের সাপ তাড়াতে তাড়াতে স্বপ্ন দেখেন(বাবার স্বপ্ন)। ৬. স্বপ্ন নেই, জীবন নেই ব্যাধিখেকো সংসারে...যাদের স্বপ্ন আছে সংগ্রাম আছে--- জীবন তাদেরই আছে(স্বপ্ন নেই, জীবন নেই)। ৭. আমাদের রমণীরা খোলা বুকে তবু স্বপ্নের তাঁত বোনে (নামতা শিখি প্রতিদিন)। ৮.স্বপ্নভর্তি ঘুমের গাড়ি এক দাঁড়িয়েছে শিয়রে এসে/অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে আসছে বোকা অন্ধকারে সশস্ত্র আন্ধার (স্বপ্নভর্তি ঘুমের গাড়ি)।
কবি সমর চক্রবর্তীর কবিতায় আমরা বারবার পেয়ে যাই হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। একটা নেশায় পরিণত হয়েছে কবির হেঁটে যাওয়া। শুধু তিনি নন, তাঁর কথাও হাঁটতে থাকে। ১. হেঁটে যাই আমি সেই তেপান্তরে/সম্মোহনের সুতোয় যেন কে আমাকে টানে(সীমান্তে তোমার)। ২. আমি যতই হাঁটি বেড়ে যায় পথ(দুরতিক্রম)। ৩. কথাগুলো হাঁটতে হাঁটতে/একটি সড়কের পাশে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়(আমাদের কথাগুলো)। ৪. কত বর্ষীয়ান সড়ক হেঁটেছে সেই যুবক প্রেমিক(ঈর্ষা)। আশ্চর্য রকমভাবে ছায়ার ব্যবহার হয়ে উঠেছে মিথের মতো সমর চক্রবর্তীর কবিতায় একাধিক গ্রন্থে--- ১. আমি আমার পাশে ছায়াহীন দাঁড়িয়ে আছি/মেলে আছি সৌন্দর্য
ঐশ্বর্যডানা(ঈর্ষা)। ২. নিদ্রিত বৃক্ষের দীর্ঘ ছায়ারা নৈঃশব্দ ভেঙে/গেয়ে ওঠে উদ্বাস্তু প্রণয়ের গান(নিদ্রিত বৃক্ষের মতো)। ৩.আমি আমার ছায়ায় অসংখ্য বিপ্লব দেখতে পাচ্ছি(উঠোনে দ্বাবিংশ শতাব্দীর আয়না)। ৪. অন্ধকারে তাই পালিয়ে যায় আপন ছায়াও আলোর সাথে (টেবিলের ছাইদানি হতে ইচ্ছা করে)। এভাবেই শূন্য, মহাশূন্য, আদর, স্মৃতি, স্বপ্ন, সংগ্রাম, পাথর, কুয়াশা, দীর্ঘশ্বাস, দুঃখ, বেদনা, বিষাদ, দারিদ্র্য, মহাকাল, যুদ্ধ, বিপ্লব, আত্মীয় অনাত্মীয়, সীমানা, নদী, পাখি, বর্ণ ইত্যাদি অসংখ্য উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে সমর চক্রবর্তীর কবিতায়।
কতো কাব্যযোগ্য নতুন শব্দ নির্মাণ করেছেন তিনি এবং সেই সব শব্দের প্রয়োগ কবিতায় কখনো আরোপিত মনে হয়নি। যেমন, শ্রমরোদ, আত্মৎসব, বহুবাহুস্বপ্ন, আলোকাত্মা, স্বপ্নব্যঞ্জনা, প্রেমবিদ, নগ্নস্বপ্ন, স্বপ্নসংগ্রাম, স্বপ্নপোকা, স্বপ্নছায়া, চিতাগ্নিফেরিওয়ালা, যন্ত্রণাবর্ণ, ব্রাত্যসারস, মৌনটিলা, চেতনাফুল, হৃদয়ান্ধ, স্বপ্নপোড়া, নৃ-নূপুর ইত্যাদি। সমর চক্রবর্তীর কবিতায় যেমন আছে চিত্রকল্পের বহুতর ব্যবহার, তেমনি আছে অজস্র মেটাফর, সিমিলি, উপমা। আছে দার্শনিকতার ভরা কবির প্রশ্ন আর মায়াময় পৃথিবীর কথা,শূন্য মহাশূন্যের কথা। তাঁর কবিতায় কখনো বেজে ওঠে রাবীন্দ্রিক গানের আবহ, বাউল দর্শনের সুর। তাঁর কবিতায় আমরা দেখছি যেমন আছে গদ্যময় পৃথিবীর ভাষারূপ, তেমনি আছে রোম্যান্সভরা গীতিধর্মিতা। তাঁর একটি অসাধারণ উদাস বাউলি পংক্তি কানে বাজে বারবার---'অমৃতের লোভে বিষ খাই, স্বপ্ন তবু থামে না, থামে না'। 'কবিতা' নামাঙ্কিত একটি দুই পংক্তির কবিতায় তিনি জানাচ্ছেন---'কবিতা এক রহস্যময় জানালা/উঁকি দিয়ে চেনা যায় অচেনা বন্দর'।







