Showing posts with label অণুুগল্প~ঝুরো গল্প সংখ্যা. Show all posts
Showing posts with label অণুুগল্প~ঝুরো গল্প সংখ্যা. Show all posts

Wednesday, August 12, 2020

| অণুুগল্প | আলোক মণ্ডল |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












আলোক মণ্ডল
কালো

অ্যাই,অ্যাই, এখনেই দাঁড়া, নামব, দাঁড়া-দাঁড়া! সাথে সাথেই ব্রেক কষল সন্দীপ। সুন্দরী স্মার্ট  তরুণীটির দু'ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে এক ঝটকায় বেরিয়ে এল কথা গুলো,  যেন মুড়ি পটকা এক্কেবার সন্দীপের বুকের কাছে ফাটল!

‌সন্দীপ টোটো থামাতেই সুন্দরী ঝপ করে নেমে ফুটফুটে মেয়েটিকে নামিয়ে নাকের ডগায় একটা ২০ টাকার নোট দেখিয়ে বলল,নে, দশ টাকা ফেরৎ দে! এবার সন্দীপ থাকতে না পেরে সমস্ত রাগ সংযত করে খুব মৃদু স্বরে বলল, ম্যাম একটা কথা বলি? সুন্দরী ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,বল্ কি বলবি বল্,  তাড়াতাড়ি!দেরি হয়ে যাচ্ছে! সন্দীপ এবার একটু কঠিন করেই বলল,ম্যাম এতো ক্ষণ আপনি আপনার মেয়েকে বলছিলেন না, সবচেয়ে খারাপের ইংরেজী, ভেরি ব্যাড্?  আর আপনার মেয়ে কোন মতেই সে কথা মানতে চাইছিল না,বলছিল না,না, এটা নয় আরও অন্য কিছু ওয়ার্ড আছে, তুমি জান না। আর একথা শুনেই মেয়েকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, চুপ কর! আমার চেয়ে তুই বেশি জানিস! সুন্দরী রাগত বলল,হ্যাঁ, তাতে হয়েছেটা কি, আর তোরই বা এতে নাক গলাবার কি আছ! সন্দীপ এবার থাকতে না পেরে, গলা ঝেড়ে প্রতিটি শব্দ বসিয়ে বসিয়ে জোরের সঙ্গেই বলল, হ্যাঁ নাক গলাতেই পারি, আপনি  যদি কিছু না জেনে একজন টোটোওয়ালাকে তুই বলে  সম্বোধন করতে পারেন,  আমি একশো বার নাক গলিয়ে বলতে পারি আপনার বিহ্যাভ ওয়ার্স্ট!  - মানে সবচেয়ে খারাপ। সু্ন্দরীর হাতে ধরা বাচ্চা মেয়েটি এবার লাফিয়ে বলে উঠল ম্যম, মনে পড়েছে! মনে পড়েছে! "ওয়ার্স্ট ",  সবচেয়েখারাপ,দিদিমণি তাই-ই বলেছিলেন।

‌সন্দীপ দেখল, সুন্দরীর মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল!এক ঝটকায় মেয়েকে  টেনে নিয়ে, গলিতে ঢুকে পড়ল।

| ঝুরো গল্প | কাজল সেন |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












কাজল সেন 
গোপনকথা

ফুলশয্যার রাতে রক্তিমা তার সদ্য বিবাহিত বর চন্দ্রকান্তকে জানাল, দেখ, তুমি  গত পরশু রাত দশটা নাগাদ আমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করছ। কিন্তু সিঁদুরদানের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি আমার স্বামী ছিলে না এবং আমিও তোমার স্ত্রী ছিলাম না। কথাটা কি তুমি বুঝতে পারছ?
চন্দ্রকান্ত এর আগে বিয়ে করেনি, আর তাই ফুলশয্যাও হয়নি। ফুলশয্যার রাতে প্রথম মিলনে কী কথা বলতে হয়, তার জানা ছিল না। সে প্রথমে কোনো কথা বলেওনি। প্রথম কথা বলল রক্তিমাই। আর রক্তিমার কথা শুনে চন্দ্রকান্ত ভ্যাবলা বনে গেল। মাথা নেড়ে সে বলল, না, কিছুই বোঝেনি। রক্তিমা বিরক্ত হলো, কেন, কেন? আমি তো বাংলায় বললাম! খুব সহজ সরল বাংলায়! আমি কি  তাহলে ইংরেজিতে বলব?
চন্দ্রকান্ত তখনও বুঝে উঠতে পারছে না, রক্তিমা আসলে কী বলতে চায়! একটু ভেবে আলতো করে বলল, না তা ঠিক নয়। তুমি যা বললে তা শুনলাম, কিন্তু বলার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলাম না, এই আর কী!
রক্তিমা এবার একটু নরম গলায় বলল, আমি জানি তুমি অবুঝ নও, আর তাই আমি আশাকরি, বিয়ের আগে যেহেতু আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তাই আমাদের আগের জীবন সম্পর্কেও কেউ কিছু জানি না। আমি বলি কী, আজ রাতটা আমরা আমাদের জীবনের সব কথা শেয়ার করি। একদম খোলাখুলি। সততার সঙ্গে। কোনো কিছুই গোপন করা যাবে না।  
এবার ফাঁপরে পড়ল চন্দ্রকান্ত। জীবনের সব কথা শেয়ার করা যায় নাকি? গোপন   কথাও? তাহলে তো সমূহ বিপদ! না না, তা হয় না! মিলির কথা রক্তিমাকে বলা  যায় কখনও? কিছুতেই নয়! মিলি তো তবু ভালো। শুধু জড়াজড়ি, ধামসাধামসি,  চুমোচুমি। কিন্তু ইন্দ্রাণীর সঙ্গে! সে তো রীতিমতো শরীর দেওয়া নেওয়া!  রক্তিমাকে বললে কোনো সন্দেহ নেই, আগামীকালই বাই বাই করে পিতৃগৃহে যাত্রা করবে।
বিভ্রান্ত চন্দ্রকান্ত অত্যন্ত সততার সঙ্গে তাই মুখ খুলল, বুঝলে রক্তিমা, আমি মেয়েদের কাছে ঠিক সহজ হতে পারি না। কেমন সংকোচ লাগে। আর তাই বুঝলে না, আমার জীবনে তেমন গোপন কিছুই নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেই কখনও কোনো...
রক্তিমা চন্দ্রকান্তর কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। রক্তিমা বুঝতে পারছিল, চন্দ্রকান্ত  সত্যিকথা বলছে না। বলল, সে কী! তুমি এতটাই গোবেচারা, ক্যাবলা? এই  কথাটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
চন্দ্রকান্ত বলল, কেন, আমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি মেয়েদের পেছনে লাইন মারতাম?
রক্তিমা বলল, আমি তো ছেলেদের পেছনে লাইন মারতাম।
চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে বলল, সে কী! তুমি বিয়ের আগে লাইন মেরেছ ছেলেদের পেছনে?
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? শুধু পেছনে কেন, সামনেও লাইন মেরেছি। আমি তোমার মতো আনস্মার্ট নাকি?  
এবার আর চন্দ্রকান্ত নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। রক্তিমা তার আত্মসম্মানে হামলা করেছে। সে এটা মেনে নেয় কী করে? মরিয়া হয়ে শেষে  বলেই ফেলল, আমার সঙ্গেও অনেক মেয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মিলি, ইন্দ্রাণী...     

| অণুুগল্প | অভিজিৎ পালচৌধুরী |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












অভিজিৎ পালচৌধুরী
ফেল্টহ্যাম পার্ক ..

কনকনে ঠান্ডা , এগারো বারো হবে হয়ত ।সকাল সাতটা পঞ্চাশ । তিতলি পড়ি কি মরি হাঁটছে না দৌড়চ্ছে বিস্টন ওয়ে থেকে বেড়িয়ে ফেল্টহ্যাম রোড ধরে স্টেশনের দিকে । অফিস টাইমের ব্যস্ততা । রেডিং এর ট্রেন ধরবে ও । রোজ সকালে স্টেশন অব্দি সঙ্গী আমি । ও আগে আগে হাঁটে আর মাঝে মাঝে পেছন ঘুরে বাবাকে শেখায় কখন রাস্তা পেরোতে হয় । রোজ এই ব্যস্ত পথচলা পথের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে এখানে । তাই ফেরা আমার শ্লথ মন্থর পায়ে ।দুপাশে সারি সারি গাছের ছড়ানো সবুজের মাঝে ছবির মত সব বাড়ি ।কিন্তু এইসময়ের ব্যস্ততার মধ্যেও সব কেমন অদ্ভুত কোলাহলহীন। যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম ফুটপাথের ডানদিকে একটা প্রায় আদিগন্ত সবুজ মাঠ লম্বা লম্বা গাছেদের পাঁচিলে ঘেরা , কোথাও কোন জনমনিষ্যি নেই । প্রবেশপথে ছোট্ট পরিচয় লেখা - ফেল্টহ্যাম পার্ক । 

এই ব্যস্ত জনপদের পাশে এরকম নির্জন পার্ক আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিল । ঢুকে পড়লাম সটান । ঢুকতেই নামনাজানা লম্বা একটা গাছের গা বেয়ে নেমে এলো একটা লালচে বাদামী রঙের খরগোশের সাইজের কাঠবেড়ালি। বিশাল লোমশ একটা ল্যাজ তুলে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কিছু তুলে খেতে লাগল আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে । আমি হাঁটতে হাঁটতে কাঠবেড়ালি ,লম্বা লম্বা গাছের সারি পেরিয়ে পৌঁছতে চাইলাম বিশাল মাঠের শেষে এই চিরসবুজ রহস্যের শেষপ্রান্তে ।পৌঁছনো হলো কিনা জানি না , এক ঘোরলাগা সম্মোহনে প্রতিদিন আমার ফেরার পথের পিছুডাক হল সে । 

তিতলিকে পার্কের কথা বলতেই বলল ওখানে যেও না । জায়গা টা ভাল নেই আর । হপ্তা খানেক আগে পার্কের ভেতর খুন হয়েছে একজন । এই সুন্দরের মধ্যে খুন ! মনটা একটু বিস্বাদ হয়ে গেলেও পিছুডাক এড়ানো গেল কই ! তাই আজ ফেরার পথে আবার । সারি সারি গাছ । কাঠবেড়ালির ছুটোছুটি । ডানা উড়িয়ে পাখিদের নেমে আসা । সবুজ ঘাসের ওপর এক অনির্বচনীয় নৈঃশব্দের কুয়াশা । 

কুয়াশা ভেদ করে আমি খুঁজতে চাইলাম সেই খুনীকে । আমার ভেতর থেকে চিৎকার বেরিয়ে এল - কোথায় তুমি .. এগিয়ে এসো ...তোমার হিংসার বলি দাঁড়িয়ে আছি. ..হত্যা কর আমাকে .. আমার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে তোমার হিংসার আগুন নির্বাপিত কর .. আমার টুকরোগুলোকে ছড়িয়ে দাও ঐ ঘাসের বিছানায় .. আদিগন্ত মাঠে .. ঐ বোবা পাহারাদার বিশাল গাছের গোড়ায় .. এই সুন্দরের সমারোহে নিভে যাক তোমার উন্মত্ত হিংসাগ্নি চিরদিনের মত । রাতভোর বৃষ্টির চাদরে ঢেকে যাক আমার লাশ.. ঘাস উঠুক .. ফুল ফুটুক .. আরেকটা লম্বা গাছ আমার লাশ ফুঁড়ে উঠে যাক্ সটান আকাশে সবুজের নিশান উড়িয়ে ।

| অণুুগল্প | চন্দ্রদীপা সেনশর্মা |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












চন্দ্রদীপা সেনশর্মা
কেসি 

মেয়ে জানালো কেসি ফিরেছে।

বড়ো উৎকন্ঠায় দু'মাস কাটল। হারিয়ে গিয়েছিল।
ওহ বলা হয়নি কেসি একটি মেনিবিড়াল,
হাইডেলবার্গে কয়েকমাস আমার মেয়ের
অবসরসঙ্গী। যদিও সে এক আলবেনিয়ান মেয়ের
পোষ্য। কিন্তু আমার মেয়েকে সে ভালোবেসেছে
ঢের। মেয়ের গায়ে, তার টেডিদের গায়ে কেসি কম
হুটোপুটি করেনি। তার মালকিন পড়ার সুবাদে
অন্য জায়গায় গেছে, সেখানে 'পেট ইজ নট
অ্যালাউড'! এ কী আমাদের দেশ, সব ককটেল,
মানুষ পশুপাখি। 'অতিথি দেবো ভবঃ'।

এদেশে অতিথির হাতেই রাজত্ব! তারা ছাঁকনি
চালনি দিয়ে অন্য অতিথি খুঁজে তাড়াতে ব্যস্ত।
মানুষের অবস্থা বেশ অসুবিধের, বিড়ালের? দূর
হচ্ছে জর্মানির কথা, কেসির কথা, বিদেশিনীর
জর্মান পোষ্য। এর মধ্যে আমাদের দেশ কোথা
থেকে এল? মালকিন ফিরে আসার আগেই আমার
কন্যাকে আখেন ফিরতে হল। ইন্টার্নশিপ শেষ,
আখেন সুডেন্ট ডর্ম, পোষ্য নৈব নৈব চ। ইহাও সত্য
না বলিয়া অন্যের সম্পত্তি নিজের ভাবিতে নাই।
আমি বললাম : কেসির কী হবে? কে দেখবে? মেয়ে
জানালো ওর ঘরে নতুন একটি ছেলে এসেছে,
তাকে মেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কেসির দায়িত্ব।
সামান্য ক'দিন আলবেনিয়ান ফিরছে। বললাম :  ছেলে? কেন জানি না ভিন দেশের যুবক অন্যের
বিড়াল দেখবে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, যদিও মেনি। মেয়ে বুঝে ধমক দিল।

মাত্র সপ্তাহখানেক, মেয়ে আখেন, আলবেনিয়ান
ফিরেছে। ছেলেটি কেসিকে যত্নে রেখেছিল। কিন্তু
ওই মেয়েটির ভিসা রিনিউ হল না। বাধ্য হয়ে
মেয়েটি জর্মানিতে ওর মাসির বাড়িতে কেসিকে
রেখে আলবেনিয়া ফিরে গেল। মাসির বাড়ি 
থেকেই একদিন কেসি হারিয়ে গেল। কান্নাকাটি
আখেন, হাইডেলবার্গ, আলবেনিয়া এমনকি
কলকাতায়। বিড়াল বাড়ি ছাড়ে মৃত্যু কাছাকাছি
এলে। কেসি তো বাচ্চা, সবে দুই, তবে কি গাড়ির
তলায় বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা? দুশ্চিন্তা সবার,
ওর নরম শরীর যারা ছুঁয়েছে বা ছোঁয়নি, চোখের
মায়া, ডোরাকাটা রেশমের মতো লোম। মেয়েটি
আলবেনিয়া থেকে ফিরল ভিসা নিয়ে, খোঁজ
খোঁজ। না, কেসিকে কোথাও পাওয়া গেল না।
মেনিবিড়ালটি কাউকে না জানিয়ে হারিয়ে গেল।

ঠিক একইভাবে দুমাস বাদে ফিরেও এল। না, ওকে
কেউ প্রশ্ন করেনি, কোথায় গিয়েছিল। প্রশ্ন করতে
নেই (একদিন প্রতিদিন/মৃণাল সেন), একদিন বা
দু'মাস, মেনি বলে ওর কি স্বাধীনতা নেই? কেসি
একটি মেনিবিড়াল, 'তারে আমি ছুুঁয়ে  দেখিনি 
তার অনেক গল্প শুনেছি...' আনন্দে গেয়ে উঠি।

| অণুুগল্প | হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
দুই জানলার ধারাবাহিক গল্প


আজ নিয়ে পরপর পাঁচদিন আমি উত্তরদিকের জানলাটা খুললাম। দিনে বেশ কয়েকবার। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই। তবে এটা মনে আছে পঞ্চম দিনে আমি প্রথম দিনের সংখ্যাটা শুরুর মুখেই খুব দ্রুত পেরিয়ে এসেছি। 

জানলা খোলার কারণ একটাই ----- আমার জানলার ঠিক বিপরীতে খুলে যেত আরও একটি জানলা। আর দেখা যেত দুটো চোখ। কোনো কোনো দিন দেখতাম আমি খোলার আগেই সে খুলে রেখেছে। এটা দেখেই আমার আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়। 

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আমি জানলা খোলার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই জানলাটা বন্ধ হয়ে যেত। এই ঘটনা আমাকে খুব বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারত না যদি না আমি দেখতাম আমার জানলা খোলার পরেই সেই জানলাটা খুলে যাচ্ছে এবং এর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। 

আমার মনে হতো মানুষটা কথা বলে কম। ভাবে অনেক বেশি। শুধু তাই নয় নিজের ভাবনার ওপর তার যথেষ্ট জোর আছে। তাই আগে থেকে জানলা খুলে সে নিজের মতো করে ঘুঁটি সাজাত। আমি জানলা খোলার পর তার সেই সজ্জায় হয়তো ব্যাঘাত ঘটতো। অথবা এমন ভাবনাও অমূলক নয় আমি তার কল্পনার এত দূর দিয়ে যেতাম যে, সে তার প্রথম জানলা খোলার সিদ্ধান্তে বিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে অভিসম্পাত করত আর আওয়াজ করে জানলা বন্ধ করে দিতো। 

যখন সে আমার পরে জানলা খুলতো তখন জানলাটা একটু বেশি সময়ের জন্যে খোলা থাকতো। আর এটাই আমাকে বারবার জানলার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। মনে হতো গত রাতের না মেলা অঙ্কগুলো জানলার বাইরে দু'হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে আর তারপর চালাচ্ছে তার ওপর কাটাছেঁড়া। কারণ চোখ দুটো জানলার গরাদের খুব কাছে সরে আসতো। কখনও চোখে খেলে যেত খুশির ঝিলিক। সেটা যত না আমাকে দেখে তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে কাটাছেঁড়ার সাফল্য নিয়ে। 

আমার কখনও মনে হয় নি জানলা খোলা অর্থহীন অথবা রাস্তা পেরিয়ে চোখের কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া খুব জরুরি। কারণ মানুষটার মতো ভাবুক আগামী পৃথিবীতে খুব জরুরী এটা ভেবে নিয়ে বারবার জানলার কাছে ফিরে ফিরে আসি। 

| অণুুগল্প | সুধাংশুরঞ্জন সাহা |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












সুধাংশুরঞ্জন সাহা
টান


ঠিক চল্লিশ বছর পর অমৃতা তার জন্মভিটেয় পা রাখলো । কিন্তু গ্রামের সবকিছুই অচেনা লাগছে তার । গ্রামটার গায়ে শহরের হাওয়া লেগেছে । বড় বড় আবাসন, শপিংমল, ঝকঝকে চার লেনের পাকা রাস্তা, কী নেই ! হারিয়ে গেছে তার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার গাছ । আম, কাঁঠাল, চালতা, কামরাঙা, তেঁতুল গাছ । সবই  চার লেনের  রাস্তার পেটে ঢুকে গেছে । হারিয়ে গেছে মাটির ঘর, টিনের চাল । ইট-বালি-সিমেন্টের বাড়বাড়ন্ত নির্বিচারে গ্রাস করেছে গ্রামের সবুজ । 

একমাত্র প্রিয় বাওড়টা এখনও তিরতির করে বয়ে চলেছে একাকী । বুকে তার শ্যাওলা আর কচুরিপানা। অযত্নের ছাপ সারা শরীরে ।
বর্ষার সময় তার যৌবন ফিরে আসে। বাকি সময় এমনই দারিদ্রের ছাপ ।

একমাত্র বাজারের চেহারাটাও বদলে গেছে বেশ।  দু'একটি বাদে সবই প্রায় সিমেন্টের পাকা ঘর । শুধু প্রাচীন আমলকী গাছটা এখনও গ্রামের একমাত্র ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
অমৃতার বাবা বিরাশি বছরের কবিরাজ অতীন মজুমদার  আজ বিছানাবন্দী। দশ বছর আগে , ঘুমের মধ্যেই, স্ত্রী সুধা চলে গেছে । কোন সুযোগই  দেয়নি। চল্লিশ বছর আগে অমৃতার বিয়ে হয়ে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া । স্বামী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত সেখানে । একবারও এদেশে আসার ফুরসৎ মেলেনি । একমাত্র দাদাও স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে নিউইয়র্কে ওদেশের মেয়ে বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতেছে । তার আর সময় কোথায়, বাবাকে দেখতে আসার ! বাবাকে অনেক বার বলেছে নিউইয়র্ক চলে আসতে । কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হননি ,জন্মভিটে ছেড়ে যেতে । দেশ ভাগ হওয়ার পরও আত্মীয়স্বজনেরা বহুবার বলেছে পূর্বপাকিস্তানের এই অজগ্রাম মুকসেদপুর ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দিতে । কবিরাজবাবু কারো কথায় কান দেননি, শুধু এই ভিটের টানে। জন্মভূমির টানেই । অন্য কোন কারণে নয় ।আজ তার বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই । আয়া, নার্স ছাড়া । এতোদিন পর মেয়েকে পেয়ে খু্বই আবেগপ্রবণ কবিরাজবাবু । তার শীর্ণ হাত রেখেছেন মেয়ের মাথায়, কপালে,গালে আর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে নামছে অকাতরে ।
চল্লিশ বছরের জমানো কান্না.....।

| অণুুগল্প | অরণ্যা সরকার |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












অরণ্যা সরকার

চাকা ও সিঁড়ির গল্প 

এক যে ছিলর দেশে ছিল এক পোস্ট অফিস। বারান্দায় ঝুলে থাকতো একটা লাল ডাকবাক্সএকা। একদিন,  ই-মেল আর হোয়াটসঅ্যাপের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল এক রাজকন্যে। তার সারা গায়ে রঙিন ট্যাটুর  অলংকার।  কেউ কেউ অবশ্য কালশিটে বলে ভুল করতো। তারপর  খুব আলো করে যখন জীবন নেমে আসতো  তখন তাদের বুকের ভেতর থেকে লম্বা বাতাস বেরিয়ে এসে বলতো ,’না না এ বিভ্রম

রাজকন্যা ডাকবাক্সকে বলল, ‘কালের ঝুলি, আমি অক্ষরমালা। আমাকে নেবে ? আমারও বুকের ভেতরে স্মৃতির খসখস।’ চারদিকে তখন কুয়াশা রঙের স্তব্ধতা। লাল ডাকবাক্স তার মরচেপড়া শরীরের জন্য বড়  লজ্জা  পেল। বলল ‘জখম গুনে গুনে শুধু  সংখ্যায় ডুবে আছি। তুমি কি কথার আকাশ নিয়ে এলে ?’
‘আমার তো আর আকাশ নেই কালের ঝুলি। চর্যাপদের টিলা পেরিয়ে, পদাবলীর যমুনা সাঁতরে, শহীদদের রক্তঋণ বুকে নিয়ে  বেশ দানা বাঁধছিলাম। এই বালি বালি সময় আমাকে খুলে ফেলছে আমার থেকেআমার ভেতর বিঁধে আছে আমারই কাঁটা। ভানে ক্লান্ত, মিথ্যেয় নতমুখ আমি এবার  খুলে ফেলতে চাই ভিনদেশি  রত্নবসানো জামা’  
তারপর কালের ঝুলির বুকের ভেতর রাজকন্যা অক্ষরমালা খুলে ফেললোপোশাক পরে নিলো নীল খামের শিফনকড়ারামধনুরঅনুশাসনথেকেপালিয়েআসাকিছুরঙেরইচ্ছেলুকিয়েপড়লোওদেরদুখজাগানিয়াগানেরতরঙ্গেঅক্ষরমালাগাইতে লাগলো ‘একি  লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ...’ । 

চাকা ঘুরছিল বনবনবলিষ্ঠ হচ্ছিল মেধাএকদিন পোস্টঅফিস নতুন বিল্ডিং পেল। মহলজোড়া মানুষ পেল বোতামটেপা আরাম পেলো পেনশনের লাইন থেকে কত জীবনের গল্প পাক খায় নতুন দেয়ালের ভেতর। দেয়ালের কানে শ্রুতির ঝুমকো  ঝকমকিয়ে ওঠে।  নতুনের হৈ হৈ জমে বাতাসের  ড্রয়ারে।  লালবাক্স পড়ে রইল এক যুবক কদমগাছের তলায়। শুকনো পাতা আর বাতিল কাগজের মধ্যে শুয়ে  শুয়ে ওরা দেখল ওদের চারপাশে ভিড় করে আসছে খাম, পোস্টকার্ডদের আত্মারা।  মেঘ ঘনাল ভীষণ। ভেজা কদমের রেণু মেখে ঝুপ ঝুপ পড়তে লাগলো ‘শ্রীচরণেষু’, ‘কল্যাণীয়েষু’ ‘ প্রিয়তম,’  প্রিয়তমা’রা...। 

| অণুুগল্প | রাখী সরদার |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












রাখী সরদার
মহাজ্ঞানের খোঁজে

সদানন্দ ভোরভোর হেঁটে চলেছে সাধিকা আত্রেয়ীর আশ্রমে।এই কদিন আগে নানা জায়গা ঘুরেএই সমুদ্র তীরে এসেছে। এখানেই তাঁর কথা শুনেছে।
তিনি নাকি সিদ্ধা নারী,সব জানেন।তাঁর কাছেই সেই পরম সত্যের কথা সে জানবে।যার খোঁজে সে এতদিন ঘুরছে। আশ্রমে যেতে যেতে কত কী মনে পড়ছে তার।মিঠেখালির নদীর নির্জন পারে ভণ্ড সাধু সেজে সে একসময় অনেক মানুষ কে ঠকিয়েছিল, কিন্তু ছোট্ট চন্দরাকে ঠকাতে পারেনি।যে তার মৃত মায়ের সাথে দেখা করানোর কথা বলেছিল--

"ঠাকুর তুমি  সব পারো। আমার  মায়ের সাথে দেখা করিয়ে দাও।"

"চন্দরা কেউ পারেনা।সব মিথ্যে বলি রে।"

"তুমি মিছে কথা বলো!তবে যে সবাই বলে তুমি মহাজ্ঞানী।"চন্দরা কাঁদতে কাঁদতে  ছুটে চলে গিয়েছিল।

সেদিন‌ই ওখান থেকে চলে এসেছিলাম।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আশ্রমে এসে গেছিলাম জানিনা।এমন সময় শুনতে পাই --

"কীরে মেয়েটির জন্য কষ্ট হচ্ছে?"

অবাক হয়ে দেখিএকজন শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা রমণী তাকে দেখে মৃদু হাসছে।এই সেই আত্রেয়ী মা!কিন্তু ইনি কিভাবে জানল!

"সব জানিরে।যা  ওই সমুদ্রে ডুব দিয়ে আয় সব
বলব।"

সমুদ্রে আস্তে আস্তে নামি।এক বিরাট  ঢেউ  আমাকে টেনে নিয়ে চললো কোন অতলে। পিছনে কে ডাকছে না ...

"ঠাকুর ,ও ঠাকুর..."

পিছন ফিরে দেখি চন্দরা  ! একটা শুভ্র পাথরে এক আধা ঘোমটা নারী বসে,আর তার আঁচল আঙুলে জড়িয়ে  চন্দরা নীলাভ দেহে রঙিন মাছেদের সাথে জলে খেলা করছে।"

আমার দেহ ভারী হয়ে আসে এমন দৃশ্যে, বাতাসহীন
শরীর আর‌ও তলিয়ে যেতে থাকে।হঠাৎ চন্দরা তার কচি হাতে আমার আঙুল স্পর্শ করে বলে ওঠে --

"ঠাকুর কোথা যাও!দ্যাখো এই আমার মা। ঠিক
খুঁজে পেয়েছি।"

"এ আমি কী দেখছি!  ঈশ্বর এমন ও ঘটে !"

"তুই ঠিকই দেখছিস।"

"তুমিও এখানে আত্রেয়ী মা!"

"হ্যাঁ রে আমিও।সবাই কে এই অনন্ত নীলে আসতে হবে।"

আঃ,বেশ হাল্কা লাগছে।চোখ খুলে দেখি  বালির উপরে শুয়ে।সেই সাধিকা পরম স্নেহে মাথায় হাত
বুলাতে বুলাতে বলছেন --

"কীরে মহাজ্ঞানের সন্ধান পেলি!"

কথা বলার শক্তি নেই।মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।

| ঝুরো গল্প | সোনালি বেগম |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
|| ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...|| || দ্বিতীয় বর্ষ ||












সোনালি বেগম 
ফটো-এডিটিং খেলা 

আনন্দের নানান সম্ভার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। খুশি থাকার কোনো মূলমন্ত্র আছে নাকিসেদিন ব্রিটিশ হিপনোটিস্ট পল ম্যাককেন্না- বই ‘আই ক্যান মেক ইউ হ্যাপি’- কথাগুলো বেজে উঠছিল মনে। এটা একটা অভ্যাস। খুশি থাকার অভ্যাস।
সব সময় সত্যিই কি খুশি থাকা সম্ভব?’
অবশ্যই সম্ভব।
যদি জোর করেকারণ ছাড়াই হাসতে থাকিতখন?’
ফোরসড স্মাইল হোক বা না হোকহাসলেই আমাদের শরীর সেরোটোনিন রিলিজ করে। যেটা হল একটি নিউরোট্রান্সমিটার। যার জন্য আমরা ভালো অনুভব করি। আর যে মানুষটির দিকে তাকিয়ে তুমি হাসছোসেও তো তখন আনন্দ অনুভব করবে।
খুশির বন্যায় ভেসে যাবো শত দুঃখ বুকে নিয়েও
দুঃখটা কিসের শুনি!’
কত-কত দিন হয়ে গেলআমরা বালিকা বয়স ছেড়ে নারী হয়ে উঠেছি। জীবননদীর স্রোতে ঢেউয়ের পর ঢেউ ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে যখন বাল্যসখীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়আনন্দে হেসে উঠি। কিছু কিছু ব্যাপার ভেবে দুঃখ পাই এখনও। একটা ছোট উদাহরণ দিই। যেমনবাসে মেয়েদের উপর অসভ্য আচরণগুলো কি কমেছে একটুওযদিও ব্যতিক্রম আছে। মেয়েদের মলেস্টেশন এবং হ্যারাসমেন্টের পুনরাবৃত্তি বার-বার শোনা যায়। কয়েক যুগ আগেও যা ছিলএখনও সেই একই রকম। এই আনওয়ান্টেড টাচগুলো রেপের থেকেও কিছু কম নয়। বর্তমানে নিউজপেপার ছেয়ে গেছে ‘মি টু’ (# Me Too) ক্যাম্পেন। মেয়েদের সম্মান বাঁচানোর যোগ্য পদক্ষেপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমি আর আমার বন্ধু রিয়া বাসের ভেতর যথাযথ বসার জায়গা খুঁজে নিলাম। দিল্লি-চিড়িয়াখানায় বহুদিন আসা হয়নি। হৈ-হৈ করে পৌঁছে গেলাম। ছবির পর ছবি তোলা হল। মজা আর হাসিএখন ছবির পারফেকশন নিয়ে চললো ফটো-এডিটিং খেলা। ফেস ফিল্টার ‘পারফেক্ট সেল্ফি’ অ্যাপে ছবিআবার ‘এয়ার ব্রাশ’ অ্যাপে ছবির কোয়ালিটি পালটিয়ে দেখতে থাকলাম আমরা।