Showing posts with label কবিতার ডালপালা. Show all posts
Showing posts with label কবিতার ডালপালা. Show all posts

Saturday, September 13, 2025

কবিতার ডালপালা | অরিজিৎ চক্রবর্তী

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||

কবির সামাজিক ভূমিকা / অরিজিৎ চক্রবর্তী


পরিচিত বস্তুবিশ্ব বিশেষ করে জীববিশ্ব থেকে মানুষের নিত্যদিনের গল্পগুলি তাদের কুশীলব বেছে নেয়। পৌর্বাপর্যের ঢাল বরাবর কালপট বেয়ে এরা ধাবমান। অনুকৃতির আদর্শ মেনে কর্মরত কবি, এদের কান্না হাসির জটলা থেকে বেছে নেন প্রজনন-ক্ষম একটি অন্তঃসত্ত্বা মুহূর্ত! আমরা যারা পড়ছি এবং দেখছি আত্মীয়তা এবং শখ‍্যের দাবি মেনে নৈকট্যের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে এদের সঙ্গে। অর্থাৎ অন্ধের বর্ণের মতো শব্দের আইকনোগ্ৰাফি আমাদের জানিয়ে দেয়,"মাটি থেকে গন্ধ ওঠে, গন্ধ মাখা রুটি / খেয়ে চলে হেতু আর অহেতু প্রকৃতি।"প্রসিদ্ধ জীববিজ্ঞানী ত‍্যেলর দ‍্য সাঁদা ( Teilhard de Chardin ) Phenomenon of Man গ্ৰন্থে Biosphere এর সঙ্গে Noosphere যোগ করেছেন। কবি রাহুল পুরকায়স্থ 'হেতু' আর 'অহেতু'-র Creative imagination -এ প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষ উন্মিলীতাায় জানিয়ে দিলেন গাছ বাঁচলে মানুষ বাঁচে।

সবচেয়ে মুগ্ধ হই যখন দেখি স্হান ও কালের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া একটা ইচ্ছাকৃত বন্ধনমুক্ত রেখাহীন অস্পষ্টতা,যার আপাত কল্পলোকের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক স্পষ্ট জীবনবোধ‍্যতা, আমাকে আনত হতে বাধ্য করে।

"আহতকে প্রাণ
আমার জীবন আজও

উড়ন্ত বৃক্ষের
আজান আজান"

ক্লোরোফিলের শব্দরজ্ঞক নিয়ে কবি উড়ন্ত বৃক্ষের আজান ধ্বনির সম্প্রীতির উপনিষদ গড়ে তুললেন।সব রূপের অনিত‍্যতা যেমন স্পষ্ট হলো, তেমনি তাদের মূল ঐক‍্য ' বর্ণান্ অনেকান্ নিহিতার্থো দধাতি'। কবি প্রশ্ন রাখলেন, কোনটা সমাধান?"প্রলয়শরীর" নাকি "বিক্ষোভ,ভাসান"! কিংবা সেই তরু--"ঊর্ধ্বমূল অবাকশাখঃ এষোহশ্বথ্থঃ সনাতনঃ"---এর প্রতিধ্বনি।

কবিতার চেয়ে বিস্ময়কর পৃথিবীতে আর কিছুই নেই,থাকতে পারেনা।আর এই কবিতা বিচ্ছিন্ন কোন প্রতীতী নয়,সে সর্বোতোভাবে সমাজ ও সময় সম্পৃক্ত। তাই কবি রাহুল পুরকায়স্থ প্রণীত কাব‍্যলিপি "অন্ধের বর্ণনামতো" বইটির অনুভবী ক্রোম‍্যাটিসিটি ভাবনার আন্তরিক নৈকট্যবশত পাঠককে বলে দিতে পারে "আরও দূরে দূরাগত একা হেঁটে যায়"।

Sunday, March 30, 2025

কবিতার ডালপালা

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা
অষ্টম পর্ব                                                                                         

নিলস বোর বলতেন, অপোজিট টু এ গ্রেট ট্রুথ ইজ অলসো আ ট্রুথ৷ প্রতিটি মহাসত্যের বিপরীতেও একটি সত্য আছে৷ বিজ্ঞানজগতে এই সত্যাসত্যের সংঘাত মানুষের কাছে চিরন্তন আকর্ষণের বিষয়৷ তারই মধ্যে উঁকি মারে সেই অমোঘ প্রশ্ন- সবকিছুর ভিড়ে মানুষের ভূমিকা কী? মানুষী যে সাফল্যকে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, ‘দি মোস্ট ইনকমপ্রিহেনসিবল থিং ইন দিস ইউনিভার্স ইজ দ্যাট ইট ইজ কমপ্রিহেনসিবল৷’ একদিকে বিশ্ব-চরাচরের রহস্যময়তা, অন্য দিকে সেই প্রহেলিকা সমাধানে মানুষের এই নিত্য সাধনাই আমাদের সপ্রাণ, চলমান, আনন্দঘর ! বাহ্যিক অনেক বদলের পরও, মনের মধ্যে সেই একই ধারা বয়ে চলে, জীবনের সেই অখন্ডতা অব্যাহত রাখতে পারাই হয়তো একজন স্রষ্টার কাছে, পৃথিবীর সব ছেঁড়া তার থেকে বেরিয়ে আসা মনোলীন সিম্ফনি। কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের "নগ্ন, আনন্দঘর" পড়তে পড়তে আমার এমনটাই মনে হয়েছে বারংবার। কিন্তু কেন? মনে হয়েছে বললাম কেন? বিশ্বাস হয়েছে বলাটা কি সঙ্গত ছিল না? না। ছিল না। কারণ, কবিতায় সঙ্গত বিশ্বাস বলে কিছু হয় না। যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলত চেতনারই পরিবর্তন। চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার আলো আঁধারির চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে । 

" হোক থির, টলটল হোক, জরায়ু ঘোর ঘোর

   দ্যাখো নাভির নীচে জোড়া জোড়া জোড়া

   সব দেওয়া আর ফেরত

   চাঁদ... ঈগল...ডানা দ্বীপ ডানা..."  ( প্রতি অঙ্গ মোর )

কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তাই " ঘোর ঘোর" আর " জোড়া জোড়া" এই শব্দদুটির দ্বিমাত্রিক ব্যবহারে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার আভাস দিতে দিতে কবি মনে করিয়ে দিচ্ছেন কুণ্ডলিনী জাগরণের অমোঘ লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।

আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে। কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই "সব দেওয়া আর ফেরত" এর প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি (Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 

"প্রতি এক নতুন দিন অভিপ্রেত শব।

বৃদ্ধ দু-হাত ধীরে ধীরে

ডানা হয়। হয়ে ওঠা কুঁজময়; স্মার্তভার---

যেমন 'হয়' বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক আর প্রবাদ;---" 

( প্রতি অঙ্গ )

শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে; যার "স্মার্তভার" অর্থাৎ স্মৃতির অনুসারী সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব ! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন আমাদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তির অভিপ্রেত অপেক্ষা। যেখানে একজন পাঠক হিসেবে আমিও তাকিয়ে থাকি আরো বহু অপেক্ষার উৎসে। তখন মনে হয় হৃদয়সংবাদী এসব কবিতা যেন একটি ভ্রমণ।বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক ও প্রবাদ কবিতার বয়ানে যেমন ধরা রইল, বহু পাঠপ্রসঙ্গ ঘোষণাহীন প্রখরতায় তেমনি সহৃদয় সামাজিক। আর গড়ে উঠেছে এক বহুস্বরিক আনন্দ। স্বপ্ন কল্পবাস্তব এখানে স্থান পরিবর্তনে অনলস উৎসাহী। কী বলছে নয়, বরং কীভাবে কথনটি পরিবেশিত—সেই বুনন এই কবিতায় তুমুল।

কবিতায় ধ্বনি রচনার দুটি প্রধান বৈপরীত্য আলো-অন্ধকার, স্থিরতা-অস্থিরতা স্বরের ধ্বনিপদার্থিক বৈশিষ্ট্যে আভাসিত। তাই ধ্বনিসচেতন প্রাবল্য অমৃতার কবিতায় অদ্ভুত ভাবেই অনুনাদের চিত্ররূপ। এখানে সচেতন ভাবে বলতে ইচ্ছে করলো না। কারণ, কবিতার আলোর মধ্যে যে শব্দের উত্তোরণ ঘটেছে সেটা আত্মার আলো, বুদ্ধির যবনিকা ভেদ করে সেই আলো আমাদের দেখা ও ভাবার মধ্যে একটা প্রতিসরণ ঘটিয়ে দিয়েছে ক্রমাগত। কিন্তু কিভাবে? আরও একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক---

" আলোয় দেখেছি কোণ ঠেসে রাখা সিলমোহর

আর যত কিছু বৈধ তলব, সাবধানি

গিঁট বেঁধে রাখা অস্ত-রঙের আবডালে

দারুণ সেজেছ। যত্নে এবার পথভুলে

স্বেদ জমে জমে পুণ্যের লোভে ধূপদানি,

ভালো লাগে দাগ, জাপটিয়ে ধরে চারপ্রহর---"

( আনন্দঘর )





প্রথমত বলে রাখি, কবিতাটি এখানে শেষ নয়। আবার শুরুও নয়। আসলে সমগ্ৰ কাব্যগ্ৰন্থ জুড়ে যেন ভাস্কর্যের চেতনায় এক নর্তকী। মহেঞ্জোদারোর রঙ্গশালায় তাকে দেখা গেছে। অথবা ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে। মনে পড়ে যায় রামগড়ের গুহালিপিতে দেবদাসী সুতনুকার উদ্দেশ্যে দেবদীন্ন যে ভালোবাসাটুকু খোদাই করেছিল, সেই কাহিনীর অভিমুখ যেন এই কবিতাটি। দেবদীন্ন সুতনুকার সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পারেনি এই কারণেই যে, সুতনুকা নিশ্চয়ই নৃত্যের কারণে দেবতার কাছে আত্মপ্রদও ছিল। তাই বৈধ তলবের চারপ্রহরে কবিতার চিত্রকল্প জুড়ে আমরা দেখতে পাই নারীর সংরাগ, চমকানো মেঘ, করুণ সুখের কুঠুরি! 

বহু লুকনো মিথের পরতে পরতে এক প্রিয়দর্শিনীর কথাই হয়তো কবি বলতে চেয়েছেন অবদমনের কলঙ্ক ও কোকনদে। কবির কথায় "ইচ্ছেধারী ছোটে" আর "ইচ্ছেধারী দ্যাখে" সৃষ্টির ঈশ্বরস্রোত... । আসলে অমৃতা দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে আপাত সারল্যের মধ্যে ক্রমশ জটিলতর রূপ নেয়; যা কিছু অগভীর তা ক্রমবর্ধমান গভীরতার জন্যে স্থান করে দেয়, বিশ্বলীলার মধ্যে অপরা-প্রকৃতি ক্রমে পরা-প্রকৃতির প্রকাশের জন্য পথ ছেড়ে দেয়... এই সমস্ত কিছুর ঋজু ও প্রত্যক্ষ রীতির ছন্দবিজ্ঞান। যেমনটি " জন্ম" কবিতায় পাই----

" অজান্তে গিলেছ শব্দ, রতিকাঁটা আর অন্তে মিল।

উজ্জ্বল পলায়ন যার,মজুত রেখেছে দিন

ফুটিফাটা কত হেঁটে যাওয়া। রাত তবু

জানলা নেশায় পাশ ফেরে তার, ভাবে,

                           উদবৃত্ত আলোর মুখে যতটা

বেঁচেছে ঋণ, অন্ধকার চোখে--

তারও রোপণ বাজে, উদাস সে ফেলে যাওয়া দিকচিহ্নময়

কোঁচড়ে কুড়ানো থাক,দশ মাস,নয় দিন, পরাজিত ভয়!"

"পরাজিত ভয়" আনন্দেই কি আমাদের এগিয়ে যাওয়া? আমাদের পিছিয়ে আসা? জীবনের বীজতলায় দাঁড়িয়ে যেন অনন্ত জাগে।নারীদেহে থাকে রাধাবিন্দু এবং পুরুষদেহে কৃষ্ণবিন্দু।দুটি বিন্দুই আধা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, বাউলদের একাংশ মনে করে কৃষ্ণবিন্দু থেকে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি। অর্থাৎ পূর্ণ কৃষ্ণবিন্দু থেকে খ–ত হয়ে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি হওয়ায় তা খ–ত। অর্থাৎ অর্ধ। … বিন্দু সাধনায় এই দুই অর্ধবিন্দু নির্দিষ্ট যোগ ও নিয়ম মেনে মিলিত হলে পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই রাধাবিন্দু-কৃষ্ণবিন্দুর মিলনে সাধক/ সাধিকা সূক্ষ্মতম মহানন্দের অনুভবে নির্ভার হয়, যা বাউল-সাধনার লক্ষ্য।বিচিত্র সাধনায় এ-দুটিকে মিলিয়ে যার সন্ধান পাওয়া যায় বাউলের ভাষায় সেই হচ্ছে মনের মানুষ, অচিন পাখি, আলেক সাঁই ইত্যাদি ইত্যাদি। একে পেলে মহাসুখ, মহানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু দুই অর্ধবিন্দুকে পূর্ণতায় পরিণত করা কঠিনসাধ্য, আর্জান শাহ তাঁর একটি গানে যাকে কালার সঙ্গে বোবার মিলন বলেছেন। আমার কালা আর বোবার মিলনে খুঁজে পাই বেঁচে আনন্দ। সৃষ্টির ষড়ঙ্গ। আমাদের আত্মিক অভিব্যক্তি, যার শিকড়টি বসানো রয়েছে দৈহিক জীবনের মাটিতে। মানুষের মুক্ত অসীম আর মুখরিত সসীমের আশ্রয় নীড় এই কবিতাগুলির খন্ড খন্ড আনন্দভৈরব...

Saturday, February 26, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
সপ্তম পর্ব        

কবিতার কোন আচরণই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটে না। উদ্দেশ্য মূলক আচরণের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই যে আভ্যন্তরীণ তাগিদ তাকেই আমরা কবিতাটির প্রেষণা বলব। কবি এই কার্যপদ্ধতির মধ্যে চেতনা জারিত করে। তাই প্রেষণা বাধাপ্রাপ্ত হলে প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। অথচ কবিতা দুভাবেই লেখা হয়। মূর্ত অথবা বিমূর্ত। কেউ কেউ নিজের চারপাশে খুব বিমুর্ত এক আবহের সৃষ্টি করে নিয়ে লিখতে পারেন  বা লেখেন। চেনা জগতের অনেক বাইরের কথা।পাঠক তার নাগাল বা স্পর্শ পায়না  সহজে। আবার কেউ লেখেন জীবনঘনিষ্ট কিছু পংক্তিমালা যা পাঠকচিত্তের কাছাকাছি। পাঠক চাইলেই  স্পর্শ করতে পারে, ঢুকে পড়তে পারে কবিতার আদ্যোপান্ত শরীরে। কবিতার ভাষায় ধ্বনিপ্রতীকতার কথা বলেছেন ভাষাবিদরাও। সকলেই জানেন শব্দ ও অর্থের মধ্যে অন্তর্লীন কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু কবিতায় কখনও কখনও ল্ক্ষণীয় হয়ে ওঠে শব্দ ও অর্থের মেলবন্ধন। তৈরি হয় motivated sign। আর এরকমই এক পরিত্রাণের ত্রাণ নিয়ে যখন কোন কবি অভিজ্ঞতার রূপায়ণে রূপকের ইমেজ গড়ে তোলেন তখন পরিকল্প ( schemas ) চেতনার চর্যায় একটা বিশেষ রৈখিকতা তৈরি করেন । কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের "একটি গোপন বাঘ" ( প্রকাশক- প্ল্যাটফর্ম, প্রকাশকাল- ডিসেম্বর ২০২২ )    নামের কবিতার বইটি তেমনই এক শিল্পায়নের চিহ্নায়ক।

এখানে "চিহ্নায়ক" শব্দটির লেখার পেছনে অবশ্যই আমার একটি সচেতন বিধেয় আছে। মানুষ কেন বিমূর্ত ধারণা গঠন করে রূপকার্থে? মানুষের ভাষায় বিমূর্ত ভাবনা গড়ে ওঠে কতগুলি অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে। দেখা,ধরা, দাঁড়ানো,হাঁটা প্রভৃতি দৃষ্টিগ্ৰাহ্য ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপ গুলির ভেতর মানুষ বিমূর্ত ধারণা তৈরি করে নেয়। সময় যেন চোখে দেখার বিষয়। কবি দেখছেন। "একটি গোপন বাঘ" - এর Personification বা সমাসোক্তির মাধ্যমে।


"ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি, সামনেই বসে আছেন কাফকা। না ঠিক কোনো 
পোকার মতো দেখতে নয়।চোখের তলায় কালিও নেই।শ্বাস নিতে অসুবিধে 
হচ্ছে? উত্তরে চুপ করেই থাকলেন।আমিও চুপ করেই থাকলাম। বাইরে শ্রাবণ। 
ভিতরে শ্রাবণ। আর আশ্চর্য ভয়। কাফকা বসে আছেন।আর ক্রমশ আমি রোগা 
হয়ে যাচ্ছি। এলোমেলো উড়ে যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি। চেনা, পরিচিত, ইস্কুলড্রেসের 
মতো লেখা।আর কাফকা অস্ফুটে বলছেন, আমার লেখাগুলো তোমরা পুড়িয়ে 
দিলে না কেন? আমার ভয় করছে।মেঝে, ছাত দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালগুলো 
দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ গাইতে গাইতে একটা মাঠের মধ্যে চলে এসেছি। দূরে 
দূরে পাহাড়।সেখানে আমার দেওয়ালগুলো। আমার ছাত থেকে মেঘ নেমে 
আসছে মাথার উপর। ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।ফ্রাঞ্জ কাফকা। 
আর বিড়বিড় করে বললেন," আলোই অন্ধকার, অন্ধকারই আলো"। আমার ঘর 
আর খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে 
ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

( ম্যাক্স ব্রড )

এই কবিতাটি পাঠ করতে করতে কাফকা আর তার বন্ধু মাক্স ব্রডের অবিস্মরণীয় ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর সেই বিখ্যাত উপন্যাস "ডি ফেরভান্ডলুঙ্গ"(রূপান্তর)। উপন্যাসের প্রথম লাইনটি----" এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল–সে পোকা হয়ে গেছে!' এই উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠক এই একটি লাইনে যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যাক্স ব্রড নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। যাঁর সঙ্গে কাফকার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। এদিকে প্রেমে ব্যর্থ,  স্বল্প রোজগেরে ক্ষীণজীবী মানসিক ভাবে ভঙ্গুর ও বিষাদাচ্ছন্ন কাফকা বন্ধু ম্যাক্সকে এক আশ্চর্য চিঠি লিখলেন।  প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স, আর হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও করা হয়ে উঠছে না। আমার লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলি হয়তো কালস্রোতে হারিয়ে যাবে। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় বলছি, সব পাণ্ডুলিপি আর নোট পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলি সংগ্রহ করেও পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ যেন সেসব পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। বলাই বাহুল্য বন্ধুকে অত্যন্ত  ভালবাসলেও এক্ষেত্রে বন্ধুর কথা রাখেননি ম্যাক্স ব্রড। বরং তিনি নিজে সেসব লেখা পড়লেন। পড়ে বিস্মিত হলেন। আর যত্ন করে সেই সব লেখা প্রকাশ করলেন।

এটি আমাদের চেনা একটি দৃষ্টান্ত মূলক কাহিনী। অথচ হিন্দোল "ম্যাক্স ব্রড" নামের কবিতাটিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাফকার সঙ্গে তার কাল্পনিক যাপনের চিত্ররূপ। এখানে ফ্রান্‌ৎস কাফকা আর হিন্দোল মিলেমিশে একাকার। তাদের মধ্যে যেন একই রকম যাপন প্রবাহের প্রেক্ষাপট। শুধু পোকাটিকে নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই।বাইরে শ্রাবণ। ভিতরে শ্রাবণ। মা কবির কল্পনা ও  অনুভবের আলোআঁধারিতে স্বতন্ত্র। এই কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্যোতনাসঞ্চারী ধারণাগত বা Conceptual রূপক। তাই কবিতাটি বহুবার পাঠ করার পরেও আবার পাঠের অপেক্ষা রাখে। কবি কবিতাটির একবারে শেষ পঙক্তিতে গিয়ে লেখেন--

"সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

আলো অন্ধকারের সঙ্গে যেমন Acute-Grave স্বলক্ষণের সম্পর্ক, তেমনি স্থিরতা-অস্থিরতার সঙ্গে Compact-Diffuse স্বলক্ষণের সহযোগ। সমস্ত কবিতার বইটি জুড়ে কবি লিখে দিয়েছেন এরকমই বহু প্রতিবর্তের আবর্তন। আসুন আমরা সেই আবর্তনের স্পন্দনে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখি---

"আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। হয়তো তোমার কথা লিখি কিংবা 
দীনু ভিখারির। যে দেহ মৃতের মতো ঠান্ডা কিংবা যে মৃত দেহের, লিখি তারও 
কথা।যে পুজো তোমার,কিংবা যে তুমি পূজার, — তুমিও তো লেখ আমাকেই । 

আমি ও লেখার মধ্যে এক আকাশ আলোকবর্ষ আছে। সাতের দশকে তিন 
ছেলেকে হারিয়ে আজও হারুর দোকানে রোজ জিলিপি ও রাজনীতি খেয়ে যান
রমেন ঘোষাল।রাতের হাঁপানিটুকু চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে হারুনচাচার।
আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। ভোররাতের বড়োবাজার শুঁকতে 
শুঁকতে বুঝি,জীবন মশলার গন্ধ। গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ। 

এ কথা ভুলিনি তবু, সে রয়েছে ঝোপের মধ্যে, গুঁড়ি মেরে, পুরোনো স্যাঙাত। 
আমিও সংগীতপ্রিয়, যার কোনো স্বরলিপি নেই। একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই 
অহঙ্কার করে।

যে-কোনো মুহূর্ত শেষ হয়ে যেতে পারে লেখা, এ জীবন অসমাপ্ত রেখে। বাসি 
মুখে নেমে পড়ি হরিদাস মোদকে। ওপাশে নেতাজি আর এপাশে মা-কালী।"

( আচমন )

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ধ্বনিকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে বিদেহ রাজের প্রশ্ন ছিল-- পৃথিবীতে যখন সূর্য থাকবে না, চন্দ্র থাকবে না, সেই অন্ধকারে কিভাবে পথ চলব? যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-- ধ্বনি। ধ্বনিই তোমাকে পথের সন্ধান দেবে। জাগতিক জীবন যেকোনো মুহুর্তেই থমকে যেতে পারে। কিন্তু তাতেই বা দুঃখ কিসের? ধ্বনি! জেগে থাকবে ধ্বনি। কবি তাঁর নিজস্ব ধ্বনিতেই জেগে থাকবেন। এরপর অন্য আর একটি চিত্রকল্পের দ্যোতনা---

"একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই অহঙ্কার করে"

আমাদের অভ্যস্ত, পরিচিত জীবনের মধ্যে এই চিরকালের ছবিটির সঙ্গে কবি প্রবিষ্ট করালেন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের হরিদাস মোদক, নেতাজি, মা কালীর মন্দিরটি। অর্থাৎ কবিতাটি ব্যস্ততর পাঁচমাথার মোড়ের অনিবার্য রসায়নে শেষ হচ্ছে। কবিতাটির সংগঠনে সামাজিক-রাজনৈতিক সংবর্তন লক্ষ করা গেলেও, এরই ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেমের প্রবাহন। উজ্জ্বল অতীত আর ছায়াঘন বর্তমান নিয়ে কবির প্রশ্নকাতরতা। জীবন অভিযোজিত মেটাফর।

" একটি গোপন বাঘ" আসলে ব আ ঘ -- এই তিনটি ধ্বনির মিলিত ধ্বনিরূপ। আর আমাদের মনের চোখে বাঘ নামক প্রাণিটির যে ধারণাগত রূপ, তাই হলো চিহ্নায়িত। মনোলোকে বস্তু বা প্রাণি জগতের ধারণাগত উপস্থিতি সম্ভব হয় বলেই আমাদের পক্ষে শব্দের উদ্দীপক থেকে অর্থে পৌঁছনো সম্ভব। বাঘ কে বোঝানোর জন্য বাঘের কাছে উপস্থিত হবার প্রয়োজন ঘটছে না। ফলত ভাষার একটি নিজস্ব এলাকা আছে, যেখানে শব্দের অন্তর্গত এক একটি ধ্বনিও চিহ্নায়কের ভূমিকা নিতে পারে। গড়ে উঠতে ভাবনার সঙ্গে ভাষার পারস্পরিকতা। একে আমরা বলতে পারি phono-signifier বা স্বন-চিহ্নায়ক। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের এই কবিতার বইটির পাতায় আমরা খুঁজে পাই এই স্বন-চিহ্নায়কের ধ্বনিতরঙ্গ। আশাকরি করি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বাঁকবদলের অভিমুখে প্রতিষ্ঠা পাবে বইটি।



Sunday, February 13, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
[ ষষ্ঠ পর্ব ]

আমরা কি কবিতাকে শিকড়ের সমসাময়িক অনুসন্ধান বলে মনে করতে পারি? কবিতায় সমসাময়িকতার কি কোন নিজস্ব সত্তা আছে? অথবা শিকড় অনপেক্ষ হয়ে সাম্প্রতিক কি কখনো দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কবি যেহেতু একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তি যেহেতু একটি সমাজ ও ঐতিহ্যের অংশ,  ফলত সময় এবং স্থান এই দুইয়ের মিলিত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই সামাজিক এবং ঐতিহ্যগত স্বারায়নের প্রভাব তার অভিজ্ঞতাকে পরিবর্তিত করে, যে পরিবর্তন কবি তার ঘনিষ্ঠ পৃথিবীর বোধ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গ্ৰহণ বা বর্জন করতে পারেন।
এখানে শিকড় খোঁজার চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। আমরা অনন্যপায় হয়ে কবির মানস জগতে অনুসন্ধান করি। প্রতিমা ও প্রতীকগুলিকে বিশ্লেষণ করি কোন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বা অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য।


"অতিদ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি বনসাই শহরে। তোমার শরীর থেকে 
নেমে আসা সহজ গোধূলি আজ আর কোন জেব্রা পারাপার করল না
পুরোনো গ্রামাফোনে ঘাড় কাৎ করে থাকা বেহালার ছড়টাও
একটানা বেজে বেজে ঘুমিয়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের ভেতর

যে সাঁকোর পার বরাবর সূর্যাস্ত  হারিয়ে যায় তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে 
কাঁটা-চামচেরা একটা তদন্ত শুরু করুক
প্যালেটের কিনারে লেগে থাকা ছইনামচা অন্তত সে কথাই বলছে

ল্যান্ডস্কেপের মৃদু শিথিলতাও

পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল 
ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক

পাড়াতুতোদের চোখ এড়িয়ে অডিটোরিয়ামের গলায়
কয়েকশো মেগাবাইট চুপ করে থাকা যতিচিহ্নের দিনযাপন গাইছে"

( সিম্ফনি )

এই কবিতাটি বহুমাত্রিক পাঠের দাবিদার হয়ে আমাকে কবিকৃত "ডেলিরিয়াম" শব্দটির প্রয়োগ দক্ষতায় উপমেয় আর উপমানের পরস্পর অভেদ কল্পিত সাঙ্গ রূপকের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। কারণ ইংরেজি শব্দ "ডেলিরিয়াম"- এর বাংলা অর্থ "ভুল বকা"। অর্থাৎ ডেলিরিয়াম হল মস্তিষ্কের ক্রিয়ার হঠাৎ অবক্ষয় যা মানসিক কর্মহীনতা সৃষ্টি করে। ডেলিরিয়ামের অবস্থায় একজন মানুষ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অনুভব করেন। অথচ কবি লিখে ফেলেন " পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল / ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক"! আমরা রূপকের অভিপ্রায়কে অতিক্রম করে একটা প্রার্থিত স্পর্ধার দিকে এগিয়ে যাই। কবি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান। সমগ্ৰ কবিতাটি তাই উৎপ্রেক্ষার ঘনঘটায় ঘটমান। বর্তমানকে লুকিয়ে রেখে কবি তাঁর পাঠককে চিনিয়ে দেন কিভাবে শব্দপ্রগতির অবগাহন মানসিক ও বাচনিক প্রযত্ন পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুর তোলে। 

কবি শান্তিময় মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতার বই "অপঠিত জলপাইলিপি"- র পাতায় পাতায় এরকম আরো চিত্রকল্পের আকুলিবিকুলি প্রযুক্ত করেছেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই বইটির প্রকাশক 'কবিতাপাক্ষিক'। কবি মাত্রই প্রেমিক। তাঁর প্রেম উৎসারিত হয় লালিত শব্দে,ছন্দে, অদেখাকে দেখার স্বভাবজাত বিন্যাসে। কিন্তু শান্তিময়ের দেখার ভেতর একাকিত্বের ডেলিরিয়াম আছে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যের মুন্সিয়ানায় বিচ্ছিন্নতার সুরটি তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত। 

"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে
না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে
তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল
প্রসূতিসদনের দরোজায়

শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে
কপাললিপির অস্পষ্টতা ধরা পড়বে মোটা দাগের রেখায় 

আমলকি পাতায় ফুটে ওঠা করচিহ্ন 
আজো জানল না এইসব 

মৃগশিরা নক্ষত্রের চোখে কেন একদিন
নেমে এসেছিল অন্তবর্তীকালীন ঘুম"

( পরকীয়া )

কুণ্ডলিনী জাগরণের একটি লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।
আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে।
কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই না জ্বলে ওঠা আলোটির প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি ( Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 


"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে / না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে / তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল /প্রসূতিসদনের দরোজায় / শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে "

যেন এক আশ্চর্য সংবর্তনের শৈলী। দৃশ্যমান ও বোধগম্য বাস্তবের সীমার ওপারে যার দ্বিজত্বলাভ কিংবা কপাললিপির নিয়তি। যেখানে পরাবস্থারও পরাবস্থা আছে। আছে "অন্তবর্তীকালীন ঘুম"!  অর্থাৎ অবস্থার স্থিতিলাভ। কবিতার পূর্ণ জাগরণ !  কবিতার ইউটার্ন পরিণতি।

শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতার বইটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে । এখানে সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন প্রসূতিসদনের দরজার অপেক্ষা। আশাকরি এরকম আরো বহু অপেক্ষার উৎসে পাঠক তাকিয়ে থাকবে পরবর্তী কবিতার সেমিওলজির দিকে।





Sunday, February 6, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা (পঞ্চম পর্ব )

মানুষের সমস্ত সৃজনই সময়-শাসিত। সময়ের স্বর যেমন বদলায় অভিব্যক্তির ধরনও নিশ্চিতভাবে বদলে যেতে থাকে। বাস্তব ও কল্পনার যুগলবন্দিতে সময়ের ভাষা যত রূপান্তরিত হয়, কবিতার শিল্পভাষায় তত মাত্রান্তর ঘটে। নান্দনিক বোধ তাই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিরন্তর নতুনভাবে প্রতিফলিত হয়। সেই প্রতিফলনের পরিগ্রহণ গ্রহীতার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। বাংলা কবিতার চারণভূমি যেহেতু নানা অঞ্চলে সম্প্রসারিত, পাঠকবর্গের উপলব্ধিও বহুমাত্রিক, স্থির ও বহমান সময়ের মধ্যে সেতু রচনা করতে গিয়ে কবিতা আপন প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু কতভাবে বিনির্মাণ করছে, তারই বিশ্লেষণী পাঠ আলোচনা করার প্রস্তাবে আমি কবি তিলোত্তমা বসুর কবিতার দিকে আচ্ছন্ন হলাম। তিলোত্তমার কবিতার সময়শীলিত শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের দ্বিরালাপে অনির্বচনীয় নান্দনিক আলো কীভাবে জ্বলে ওঠে, তারই হদিশ  পেতে " জার্নি" কাব্যগ্ৰন্থটির ( প্রকাশক- ধ্যানবিন্দু, ২০১৫ ) একটি কবিতার পাঠ নেওয়া জরুরি।


যদি ক্ষমার আয়না দেখ -- আমি আফ্রোদিতি।
শরীরে গোলাপ-ক্ষত।
দারুন বিরহ থেকে চুমুর স্পঞ্জই পারে
কাঁটার পাহারা মুছে দিতে!
এমন ঘোরাও তুমি নাগরদোলায়
চামচে চামচে এত প্রেমের সিরাপ
যদি ঢালো...
চলো তবে গুহাজীবনেই ফিরি--
বুনোফুল অজানা বেনামী।
বুকের চাতালে প্রেমের মজলিশ রোজ বসে
বিনুনি এলিয়ে দিয়ে বসেছি অলস
সোলাঙ্কি-কুমারীর বেশে।


ঘোরে সূর্য আমার নির্দেশে
ইচ্ছে গতিতে যেন অক্ষ ঘুরছে
তারাদের ফুলঝুরি কুড়িয়ে কুড়িয়ে
বাতাসে ছড়িয়ে যায়
বর্শা ভলকেরা স্তব্ধ মেরুদেশে...
যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস !
এসো আমার ইগলুতে...


হাওয়া মোরগেরা ভোর থেকে ডাকে।
খামার বাড়িতে ঘোড়া ছুট দেয়
সোনালী গমের ক্ষেতে...
তোমার পায়ের গোছ
আলগোছে বুকে তুলে দেখি 
শস্যের দানা লেগে আছে ,
লেগেছে দিগন্ত ধুলো
সরল সবুজ ঘাসে উপত্যকা ঢাকা।
রাত শেষে কেন
আমার স্কার্টের ঘের পেয়ে বসে
দর্জির খ্যপামি ?
স্কার্ফ যায় উড়ে... হু হু অলি মন খারাপের
তুমি কি মার্চের সাইকেলে !


জানি খেলতে এসেছ... খেলো...
দাবা হোক ক্যারম বা লুডো
নিজেকে চালিনা আর ঘুঁটি
সাদ কালো লাল পয়েন্টেরা সময়ের
কেন হারাবে আমাকে ? -- চিটিং মানি না মোটে
সবুজ ঘাসের সঙ্কেতে চুপিচুপি
উড়ে আসি...


এসে দেখি ক্ষমার আয়না !
চুমুর স্পঞ্জে সব মুছে দিলে কিনা !
লজেন্স লজেন্স গন্ধ খাতার পাতায়
বোতাম খুলতে কি অবাক--
এদেশে এখনো
ম্যাপ আঁকা বাকি !! 

( আফ্রোদিতি)


গ্রিক পুরাণের প্রেম, আনন্দ, আবেগ এবং সৌন্দর্যের দেবী হলেন আফ্রোদিতি।  হেসিওডের থিওগোনি অনুসারে আফ্রোদিতির জন্ম সমুদ্রের ফেনা থেকে। ইউরেনাসপুত্র ক্রোনোস তার পিতার লিঙ্গ কর্তন করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে সেই লিঙ্গ থেকে শুক্র সমুদ্রের জলে মিশে আফ্রোদিতির জন্ম হয়। এই আফ্রোদিতির অনুষঙ্গ আত্মস্থ করেই তিলোত্তমা কবিতাটির মুক্তি ঘটালেন। যৌনতা মৌনতা ও তারুণ্যের বোধ থেকে এই কবিতা পৌঁছে গেছে নিসর্গনিবিড় আবেশের স্নিগ্ধতায়। চন্দ্রকলার পরিবর্তনের মতো ঋতুচক্র যেন জীবনচক্রকে, বিকাশের বৃত্তে অবস্থিত সব চাপকে, সৃষ্টি ও শিল্প সৃষ্টির ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাই কবি বলেছেন, "যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস ! / এসো আমার ইগলুতে..."। কবিতাটি বৃত্তবদ্ধ পরিবর্তন এবং নিরন্ত পুনর্জননের প্রতীক হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ঊষরতা-উর্বরতার 
শরীরী অনুবর্তনে কবি ঘটিয়ে ফেলেছেন রতি ও আরতির প্রতিমান। সংযুক্তি ও বিযুক্তির নিরিখে যা একেবারেই বিপরীতমুখী ভাবনার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত শমিত হয়, "বোতাম খুলতে কি অবাক-- / এদেশে এখনো ম্যাপ আঁকা বাকি !! " অর্থাৎ একটা আকাঙ্ক্ষা। একটা প্রশ্নবোধক অতৃপ্তি। সব আছে, তবু কবি যেন জীবন অভিমুখী দূরত্ব-দ্যোতনার সঞ্চার ঘটাতে চাইছেন ! স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তিলোত্তমার কবিতার এই অর্জন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ইঙ্গিতবাহী।

সেই ইঙ্গিতের পরিকল্পিত মগ্নতা খুঁজে পাই "বন্ধু" নামের কবিতাটিতে। পরিকল্পিত মগ্নতা বললাম এই কারণেই যে, কবিতাটি আসলে একটা সেলফ
পোট্রেটের মতো। কবি নিজেকে নিজেই নিয়োজিত করেছেন।

"অথচ প্রেমের তাপ লাল শাড়ি পরায় আমাকে।
 
যাজ্ঞসেনী, হোম থেকে দেখি পাঁচ স্বামী।
আছেন যদিও ওঁরা তবু সখা তুমি কেন?
কেন যে স্মরণ করি তোমাকেই বিপদভঞ্জন!
আর শাড়ির আবেশ এসে ঢেকে দেয় নগ্ন
না পাওয়া আমার। পাঁচ স্বামী পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মতো।
তুমি তবু ষষ্ঠইন্দ্রিয় জন, পদ্মমধুতে গুন্ গুন্ ,
নীল উড়ে আসা টান চৌকাঠ ডিঙানো...
 
ফুলের বাগানে যাই। সরোবরে জ্যোৎস্নায়।
এই কি আমার কুঞ্জ? আজীবন নিজেকে শাসন, তবু,
তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"

( বন্ধু )

যজ্ঞের অগ্নি থেকে তিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে তার নাম যাজ্ঞসেনী। সে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। কবিতার শুরুতেই প্রেমের উষ্ণতা আর লাল শাড়ির দৃশ্যকল্পে আমরা একটা আশ্চর্য অনুভবের প্রান্তদেশে পৌঁছে যাই। চলে আসে যাজ্ঞসেনীর মতন এক অমর চরিত্র। কিংবা চরিত্রের অস্থিরতা। একেবারে শেষ লাইনে, "তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"এই কবিতার গভীরতা অনুধাবন না করতে পারলে পাঠক হিসেবে ব্যর্থতাই স্বীকার করে দিতে হবে। যেন সহজিয়া পথের কুঞ্জে ফুল ফোটান কবি। অতীতকে ভিতরঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসেন তিনি। অথচ আজীবন নিজেকে শাসন করেন তিনি। আমরা অদ্ভূতভাবেই খুঁজে পাই আজ্ঞাবহ নিখোঁজের পর্যাঙ্ক ! কবির আবেগ এখানে নিয়ন্ত্রিত আর চিত্রকল্প শুধু চিত্র নয়, অন্য অনেক কিছুর ভাসক।

তিলোত্তমার কবিতা প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে, গহনভাবনার ডুবুরি কবি কাব্যের আবাহনে জগৎ-সংসারের যাবতীয় অসুন্দর ও আবর্জনাকে প্রত্যাখ্যান করতে করতে বোধের উত্তুঙ্গ মহিমার দিকে এগিয়ে যান। বিশেষত তিনি আঁধি ও স্খলনের মধ্যেও ঐতিহ্যের চিরায়তনে আস্থা রাখেন।


হয়তো আস্থা রাখেন বলেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা অনতিক্রম্যতা কবিতার উপপাদ্যে প্রযুক্ত হয়। অথচ কবিতার মতো শক্তিমান অবাস্তব আর কী আছে? কয়েকটি ধ্বনি দিয়ে অথবা চিহ্ন দিয়ে পরপর সাজিয়ে তোলা একটি পরম্পরা, একান্তই আর্ত গঠন একটি, কী মায়ার খেলায় জড়িয়ে ফেলেছে মানুষকে। যেমন ইউক্লিড জ‍্যামিতির axiom-গুলি অথবা পিয়ানোর সংখ্যাসংক্রান্ত axiom গুলি। প্রথমে গুচ্ছকে ধারণ করার জন্য আছে বিন্দু, সরলরেখা ইত‍্যাদি জ‍্যামিতিক অবাস্তব বস্তগুলি। আর দ্বিতীয় গুচ্ছের জন্য বিমূর্ত পূর্ণ সংখ‍্যার দল। এইভাবেই বাস্তব বস্তু থেকে কল্পনায় এবং তার পরে সে কল্পনার বাণীরূপ। তাই কবিতা হলো নিয়মবদ্ধ সিমেট্রি থেকে মুক্ত হবার একটি রিক্ত কৌশল।

Sunday, January 30, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী  

কবিতার ডালপালা ( চতুর্থ পর্ব )

রঞ্জিত সিংহের কবিতার এই উদ্ভব, অভ্যুদয় ও পরিণতির যে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িত ধ্বনিরূপ, তার ডায়াক্রমিক স্পন্দন অনুভব করতে করতেই আমরা ভাষার সজীব রূপ-রহস্যের দিকে এগিয়ে যাই। তখন বস্তুজগতের নির্দশক অর্থ থেকে যা বিশিষ্ট। কারণ, আমরা ততক্ষণে মনের চোখে প্রত্যক্ষ করি কবিতার ক্রিয়াশীলতা।

ভাষাতাত্ত্বিক সোস্যুরের উত্তরসুরী ইরাকসন ভাষাতত্ত্বের আঙিনা থেকে কবিতার ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে তাঁর প্রাজ্ঞ অনুধাবনে জানিয়েছেন, " The poetic function projects the principal of equivalence from the axis of selection into the axis of combination" একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে গ্ৰন্থনা। শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক যখন আপতিক, দার্শনিক চার্লস স্যান্ডর্স পার্সের বিবেচনায়, তা প্রতীক। কিন্তু কিভাবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কবির অন্য একটি কবিতার দিকে মনোনিবেশ করছি।

" সময়ের কখনো পর্যঙ্ক বা কেদারা থাকে না।
পনেরো বছর কোথা দিয়ে চলে গেল---
বাঁশবন, শালবন, একর একর মহুয়ার বন।
একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল।
বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ, লাল পলাশফুল।

মণিকাকে আজকাল সেইভাবে মনে পড়ে না।
জ্যোৎস্নার জোয়ারে আড়াল দিয়ে চাঁদ যেমন
লুকিয়ে-চুরিয়ে রুপোলি হাসির ঝলক দিতে দিতে
চলে যায়, মণিকা তেমনিভাবে, ঠিক সেইভাবে,
হাসির ঝলক কখন যে জোয়ারের বেগে চলে যায়
সারারাত ইজিচেয়ারে বসে থেকেও একদিনও ঠাহর পাইনি।

চমকে উঠি। পরক্ষণে বুঝি ভুল, আমার বয়সের ভুল।
চোখ যেমন সবসময় ঠিক ঠিক দেখে না, এও তেমনি
সেই ভুল দেখা।
রাত্রে সিঙ্গল খাটে ঘুমোচ্ছি, এটা আমার আজীবনের সিঙ্গল খাট,
ওটা আমার পনেরো বছরের ইজিচেয়ার, যে-রাত্রে
ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় সফেদাগাছটাকে ঢেকে ফেলে সফেদা খায়,
আমার আর মণিকার সে-দিন জন্মান্তর হয়, দুজনেই বাদুড় হয়ে যাই।

বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি, চোখদুটো খুলতেও পারি না, বন্ধ করতেও পারি না।
লেপটা জড়িয়ে ধনুকের মতো বেঁকে শুয়ে থাকি,
পাশ ফিরলেই পিঠ থেকে লেপ সরে যায়,
একটা উষ্ণ তাপ মাঝে মাঝে অনুভব করি,
কে যেন লেপটায় পিঠ ঢেকে দেয়, রাত্রে দু-বার তিনবারও,
কে যেন লেপটা টেনে দেয়।

সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।

( মণিকা সম্ভবত বিভ্রম )

কবিতাটির নাম 'মণিকা সম্ভবত বিভ্রম'। অর্থাৎ কবি নামকরণেই জানিয়ে দিচ্ছেন মণিকা সম্ভবত বিভ্রম বি. ১. ভ্রান্তি (দৃষ্টিবিভ্রম); ২.(প্রধানত প্রণয়জনিত) মানসিক চাঞ্চল্য বা বিমূঢ়তা; ৩. লীলা; ৪.বিলাস; ৫.শোভা। [সং. বি + ভ্রম]। সুতরাং এখানে আমরা কবিতাটির চিহ্নাবলির তিনটি বিষয় খুঁজে পাচ্ছি। প্রতীক ( Symbol ) , সূচক ( Index ) , এবং প্রতিম ( Icon ) । কবিতাটির আরোপিত অভিজ্ঞানে ভাষার শব্দচিহ্নগুলোও তেমনি ধ্বনিরূপ ও ধারণার আপতিক সম্পর্ক- সঞ্জাত। সূচক ও প্রতিম মূলত বাচনিক নয়, চিত্রধর্মী। যেমন- 'বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ' থেকে লালপলাশ ফুলের ধারণা কিংবা ' একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল' অর্থাৎ অস্তগামী সূর্যের ধারণা। আর এই সমস্ত অনুভবের প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের অবকাশটি কবি নিজস্ব সূচকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। কবি তুলে ধরলেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার সিনট্যাক্স-- প্রদত্ত পুনরুক্তি ও প্রবর্তিত নতুনের মাধ্যমে নিজের ভিতরের বিবাদী ভাবনার রূপায়ণ। 

' বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি চোখদুটো খুলতেও পারি না বন্ধ করতেও পারি না' 

সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য--- এই দুয়ের মিলিত মালকোষে রঞ্জিত সিংহ বাংলা কবিতায় একটি চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় এই স্তরবহুল আকস্মিক উন্মোচনের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। শুধু অভিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না কবিতার ধ্বনি। সহসংবেদনের স্নায়ব সূত্রে তা রূপকধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন-

"সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।"

ভাষা কিভাবে অভিধেয় অর্থ থেকে দ্যোতনা অর্থে পৌঁছে যায় তার একটি মডেল দিয়েছেন রোলাঁ বার্তে। অভিধেয় প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের ছকটি তিনি এভাবে দেখিয়েছেন---

( ছবি লক্ষণীয় )


বার্তে চিহ্নকে দেখেছেন ECR- র সমবায়।

E -- an expression ( or signiffier )

C -- a content ( or signified )

R --- in relation 

আমি রঞ্জিত সিংহের কবিতার আলোচনার প্রসঙ্গে বার্তের পরিধেয় ভাবনার মডেলটি সঙ্গত ভাবেই গ্ৰহণ করেছি। কারণ, তাঁর কবিতার সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য গৃহীত ও যোজিত অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে সাবলীল। বাংলা কবিতায় এই ধরনের অভিজ্ঞান খুব একটা চোখে পড়ে না। আর পড়ে না বলেই কবিকে থেকে যেতে হয় পাঠকের সচেতন অন্তরালে। প্রাসঙ্গিক ভাবে কারণ সেই একটাই। কবিকে হত্যা করার নিহিত কৌশল। ভাবলে খারাপ লাগে বাংলা কবিতায় মনীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে যে লম্ফঝম্প, যে উচ্ছ্বাস; রঞ্জিত সিংহের কবিতা নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না। হয়তো দেখা হয় না।

কবিতার চরম ও পরম চেতনায় দশকের পর দশক ধরে এরকম উৎকণ্ঠা প্রযুক্ত করা হয়। কারা করেন এই প্রযুক্তির কাজ? তাঁরাই করেন যাঁরা 'কবিতা' বাদ দিয়ে সবকিছু করেন। তথাপি কবিতা জেগে থাকে আশাবাদের অলংকার নিয়ে। 

ফিরে দেখা-- ১
----------------
কলকাতার গনেশচন্দ্র এভিনিউতে শতাব্দী প্রাচীন পানশালা ব্রডওয়ে। বাংলা কবিতার দুজন স্বনামধন্য কবির সঙ্গে আমিও পৌঁছে গেছি সেই সন্ধার মায়াবী আলোচনার জগতে। আলো, মায়া আর নৈকট্য নিয়ে সেই ঘন্টাখানেকের আলোচনায় উঠে এসেছে কবিতার প্রকৃত প্রস্তাব। বাড়ি ফিরে একটা ঘোরের মধ্যে কিছুদিন কেটেছে।

মাসখানেক বাদে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত এক কবির বাড়িতে পৌঁছলাম। কথা প্রসঙ্গে আবার কবিতার আলোচনা।

বর্ষীয়ান কবি প্রশ্ন করলেন, ক- এর কবিতা কেমন লাগে?

আমি বললাম, ' খুবই ভালো লাগে। ওনার কবিতা পড়লে একটা পরিত্রাণ অনুভব করি।'

বর্ষীয়ান কবি বললেন, ' তুমি বাল বোঝো কবিতার!'

----' কেন দাদা ? সেইদিন আপনিও ব্রডওয়েতে বসে কত প্রশংসা করলেন ওনার কবিতার। উনি লাজুক কন্ঠে বললেন, ' আরে ছাড়ো অরিজিৎ, ও আমার বন্ধু তো, তাই আমার কবিতার প্রতি দূর্বলতা!'

--- ' দাদা সেইদিন ওরকম বললেন কেন?'

হা হা হা হা... ম্যাচিউরিটি এলো না তোমার ! ওরকম বলতে হয়। আসলে ও কিছু লিখতেই পারে না।

কেন এরকম বলতে হয় হে অগ্ৰজ? আপনি যে সব গুলিয়ে দিলেন। আসলে বাংলা কবিতায় এই গুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যুগে যুগে অব্যাহত।



Sunday, January 23, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  অরিজিৎ চক্রবর্তী  
 কবিতার ডালপালা ( তৃতীয় পর্ব )  



Kill a man and you are an assassin. Kill millions of men, and you are a conqueror. Kill everyone, and you are a god.”

 – Jean Rostand

কাব্যের আত্মার কাছ থেকে, প্রেরণাধন্য কবির কাছ থেকে কোন ধরনের সত্য আমরা দাবি করতে পারি? যখন অহমাত্মক বিনয়ের এক জীবন্ত চর্ষায় কবি লিখে চলেন একের পর এক স্বরভঙ্গিমা ! তখন কি কোনো প্রত্যয় কাজ করে তাঁর মধ্যে? নাকি ভাবের পরিখায় নিজেই ঝাঁপ দিয়ে খুঁজে নেন আত্মহননের আকুতি।

      আসলে মানুষ কখনো এমন কোনো কিছুর অন্বেষণে নিজেকে প্রবৃত্ত করে না, যাকে আয়ত্ত করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অমৃত আমাদের ক্ষণে-ক্ষণে স্পর্শ করে যায় বলেই আমরা অমৃতের অভিলাষী। ওটা অধরা, কিন্তু অচেনা নয়। কী বলেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য? তিনি একটা উপমা দেন। নুনের একটা ডেলা জলে ফেলে দেওয়া হলো। সেটা গলে জলে মিশে গেল। এবার সেই দ্রবণের যেখান থেকেই পান করি না কেন, নোনতা স্বাদই পাব। অথচ আলাদা করে নুন বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর রইল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, " এই জীবনেই কতবার মরেচি ভেবে দেখ। শিশুকালে আমার দাইকে অসম্ভব ভালোবাসতুম। তখনকার যে জীবন সেটা তাকেই কেন্দ্র করে ছিল। এক ঘন্টার মতো তার তিরোধানের কথা সেদিন বিনা অশ্রুপাতে প্রসন্নমনে চিন্তা করতে পারতুম না। কিন্তু সে আজ ছায়া হয়ে গেল, কোনো ব্যথার দাগ নেই। তার পরে অন্য কেন্দ্র নিয়ে যে জীবন সৃষ্ট হয়েছে সেটার দাম সমস্ত সুখ দুঃখ নিয়ে অনেক বেশি। কিন্তু অবশেষে এ সমস্ত গিয়েও জীবনান্তরে আর একটা সত্তা যখন জমে উঠবে তখন তাকে নিয়েই এত ব্যাপৃত হব যে গতস্য শোচনা বলে পদার্থই থাকবে না।" ( চিঠিপত্র, ১৩৩৮/ ১৯৩১ )

    এই বিশেষ অর্থে মৃত্যু মানে শারীরিক মৃত্যু নয়, মৃত্যু মানে সম্পর্কের মৃত্যু। উৎকর্ষতায় মৃত্যু। অভিযোজনের মৃত্যু। এরকম বহু মৃত্যু অথবা হত্যার সম্মুখীন আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি হয়ে থাকি। কিন্তু একজন চিন্তাশীল মানুষ যখন একজন চিন্তাশীল মানুষকে সচেতন ভাবে হত্যা করে; একজন কবি যখন একজন কবিকে সচেতন ভাবে হত্যা করে! তখন ভাবতে কষ্ট হয় এই ঋকবেদেই কবিদের ঋষি বলা হয়েছে। ঋষিমনা য ঋষিকৃৎ পদবীঃ কবীনাম্ ।

    কিন্তু তার পরেও আমরা শেষ হয়ে যাই না, কোনো না কোনো ভাবে সার্থকতা খুঁজে নেবার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে চেষ্টা আমরা করতে পারি এই জন্যই যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মৈত্রেয়ী আছেন, যিনি কেবলই মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে চলেন।যিনি কেবলই বলেন, যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর, তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভূবন মস্ত ডাগর।

    নান্দনিক সৃষ্টি সম্বন্ধে মার্ক্স " আত্মিক উৎপাদন"( Spiritual production ) কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। Paradise Lost লিখে মিল্টন নাকি পাঁচ পাউন্ড পারিশ্রমিক পেয়ে ছিলেন, তাই মুনাফা এবং বাজারসর্বস্বতার মানদন্ডে, মার্ক্স বলেছেন, মিল্টনের ওই বিপুল শ্রম " অনুৎপাদন " । আর ঠিক সেই কারণেই তা তাঁকে অমর করেছে। কেননা ওটা তাঁর আত্মার আত্মীকরণ, ওটা দমনাতীত একটা প্রক্রিয়া। এমনই একটা কিছু যেটা না করলে উৎপাদকের রেহাই নেই। যেটা সে নিছক বাইরের তাগিদে করছে না, করছে নিজের অন্তরের গভীরতম তাগিদকে প্রকাশ করবার জন্য। 

     অথচ তাগিদ গুলো যখন তদবিরের পাণিগ্ৰহণ করে! তখন গ্ৰহণ আর বর্জনের গোলকধাঁধায় স্রষ্টা বিষ্ঠা ত্যাগ করেন। আমরা যারা কবিতা লিখি কিংবা কবিতা লিখতে চাই এই বিষয়টি খুব দক্ষতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু পারি কই? পারিনা বলেই চারপাশ হয়ে ওঠে অসত্য, অসুন্দর এবং বিজ্ঞাপিত। ঘটনাক্রমে কত কিছু উঁকি দিয়ে চলে যায়। আবার কত কিছু দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে যায়। 

 

কবি রঞ্জিত সিংহের " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্ৰন্থটির পাতা ওল্টাই। 

( প্রকাশকাল- আগষ্ট ২০০৯, প্রকাশক- অস্ট্রিক ) 

 কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তেমনই একটি কবিতার দিকে চোখ রাখলাম----

 "বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?

তখন কি আমি অবাস্তব?

দেওয়ালে টাঙানো হয়তো একটা ছবি অথবা তাও নয়।

 

একদিন রাত্রে যাঁকে দেখেছিলাম, স্বপ্নে না জাগরণে মনে নেই,

তিনি কে? বাস্তব না অবাস্তব কেউ?

মনের ভিতর ঝড়। পঞ্চজ্যোতি চোখে তাঁকে আমি যা দেখেছি,

তাকে অস্বীকার করি কি ক'রে।

শাদা লুঙ্গি, শাদা আলখাল্লা, মাথায় শাদা ফেট্টি,

গাড়ি থেকে নামলেন, চতুর্দিকে তাঁর মণ্ডলাকার দৃষ্টি

ছড়িয়ে আশীর্বাদ করে দ্রুত পদক্ষেপে গাছপালাময়,

যেন একটা ফার্ম হাউস, মুহূর্তে অদৃশ্য।

 

উনি কে? কেউ উত্তর দিল না, শুধু কথাহারা শীতল বাতাসি হাসি।

লোকজন আছে, দেখতে পাচ্ছি, কোথাও তবুও কোনো শব্দ নেই।

 

আমিই-বা এই স্থানের সন্ধান পেলাম কোথা থেকে?

 

টুকরো টুকরো ছড়ানোছিটানো অথচ সুরচিত সরল স্থাপত্য।

লম্বাটে,চৌকো,গোল করুগেটের আচ্ছাদন, মাথার দু-দিকের

ঢাল ছেয়ে গাছপালা, সবুজে সবুজ। বেগুনি, হলুদ, গোলাপি

হরেকরকম ফুল, হরেক রঙের প্রজাপতি।

 

হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

 ( বাবা কে?  তারও উত্তর নেই )

    কবিতাটি একাধিকবার শান্ত হয়ে পাঠ করতে করতে অনুভব করলাম প্রতিটি শব্দ যেন যথার্থ, সঠিক অর্থবোধক এবং স্বচ্ছ চেতনাজাত। কবি কী লিখছেন বা লিখবেন এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই কেবল এ কাজ স্বার্থক হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে ‘Album of old verses’ বইতে ভালেরি শব্দের যে পূর্ণ শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, "I feel the full strength of every word for having waited for it"  অর্থাৎ "সেটাই হচ্ছে কবিতার আসল কথা" এই প্রতিভাবনার ক্রমমুক্তি অনায়াসেই ঘটে রজ্ঞিত সিংহের কবিতায়।

   চৈতন্য তীব্র যন্ত্রণাপ্রদ এক অস্তিত্বের নাম। তা সত্ত্বেও চৈতন্য কবির জন্য অপরিহার্য। আর এই চৈতন্যের যতাযথ প্রয়োগের ফলেই অদৃশ্য কিছুও দৃশ্য হয়ে ওঠে। রঞ্জিত সিংহের কবিতায় এই অপরিহার্যতা স্বাভাবিক ও স্বত্যোৎসারিত। 

   আবার চৈতন্য প্রজ্ঞাপ্রদ। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা কবিকে জীবনভর যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। তাই কবি বলেন, " বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?"

   ভারতীয় দর্শনে পঞ্চভূতের সমষ্টিই এ জগৎ। সে অর্থে মানুষও পঞ্চভূত। ১৩০৩ সালে প্রকাশিত " পঞ্চভূত" প্রবন্ধ গ্ৰন্থে  রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচটি উপাদানকে নাম দিয়েছেন ক্ষিতি, স্রোতস্বিনী, দীপ্তি, সমীর ও ব্যোম। এই পাঁচ পাত্রপাত্রী মিলে একটি তর্কসভা গড়ে তুলেছে, যার কেন্দ্রে আছে ভূতনাথ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে বরীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুকৌশলে তার নিজস্ব সহিত্যাদেশ প্রকাশ করেছেন। কবি রঞ্জিত সিংহ আলোচ্য কবিতাটিতে যেন তেমনই এক বার্তাবহ অভিসন্ধির প্রজ্ঞা ফুটিয়ে তুলেছেন।

তারপর একদম অন্তিমে ঘটিয়ে দিয়েছেন ঘটমানের তক্ষণশিল্প।

 "হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

   আমি শুধু একাগ্ৰ মনোযোগে এই কবিতার দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু উত্তর পাচ্ছি না। আসলে উত্তর যে প্রত্ত্যুতর হয়ে প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে বসিয়ে রেখেছে। পাঠককে বসিয়ে রেখেছে। তাই

রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘গড়ের মাঠে এক ছটাক শস্য জন্মে না, তবু অতোটা জমি অনাবশ্যক নহে। আমাদের পাঞ্চ ভৌতিক সভাও আমাদের পাঁচজনের গড়ের মাঠ, এখানে সত্যের শস্য লাভ করিতে আসি না, সত্যের আনন্দ লাভ করিতে মিলি।’ (পঞ্চভূত / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )