নিঃসঙ্গ ছায়ানটের শতবর্ষ [ পর্ব: ৩]
কাঁটাতার ও দেশভাগ
.............................. .....
ওপরের প্রেক্ষাপটটি এই ছবি তৈরির নেপথ্য সত্য হলেও এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে, ঋত্বিক কুমার ঘটকের প্রথম তৈরি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা " নাগরিক" নিয়ে আমার অনুভূতি ও ভাবনা চিন্তার কথা আলোচনা করবো।
মানুষের অবয়বে মানুষ হাঁটছে। মানুষের প্রথম চলার ইতিহাস আনুমানিক, অর্থাৎ মানুষের চেতনঋদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস অনেকটা প্রচারনির্ভর। সেখানে বিভিন্ন সময়ের সেলিব্রিটিদের ভিড়। রাজা রাজড়া আমির ওমরাহ বাদশাহ নবাব সম্রাট প্রভূত রহিস ব্যক্তিত্বের ভিড়। ইতিহাসের চোখ, আইনের ন্যায়দণ্ড হাতে দাঁড়ানো চোখবাঁধা চরিত্রটির মতো অসহায়। কালো কাপড় যেন প্রতীকী। অনেকটা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে
না'র মতো। ইতিহাস তাঁদেরই গুরুত্ব দেয়, যারা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে প্রচারের লাইম লাইটে ওপরের সারিতে এসে দাঁড়ায়। এই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের হয়ে কলম ধরেছেন অনেক কবি সাহিত্যিক শিল্পী ঔপন্যাসিক চলচ্চিত্র পরিচালক। কিন্তু কেউই ঋত্বিক ঘটকের মতো সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে , রাজনৈতিক দুরূহ অভিসন্ধির শিকার
স্বাধীনোওর এই একাগ্র বাংলার বিক্ষত দেশ হারানো হাজার লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের রাতারাতি জীবনের গূঢ় শিকড় ছেঁড়া আর্তনাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। আবেগপ্রবণ অত্যন্ত সংবেদনশীল সৎ ও ঋজু মানুষটির সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বাঙালির অস্মিতা এবং গহন সংস্কৃতির ঐতিহ্য যা একান্তই দেশজ, যা কৃত্রিম শিক্ষার ড্রয়িংরুমে সাজানো বিলাসবহুল চর্যার নিরক্ত করবীর অন্তঃসারশূন্য বিলাপ নয়। এরফলে নানাবিধ বাহ্য প্রলোভন ও সামাজিক সাফল্যের সুযোগ পেয়েও তিনি স্বজাতির হাত কখনোই ছাড়েন নি।
তিনি সিনেমাকে কেবল নিছক বিনোদন, আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তির উপায় কিংবা ধনী রাষ্ট্রে নিজেদের বিপন্ন বিস্ময় আর দারিদ্র্য বেচার কৌশল মনে করেন নি। প্রথম থেকেই তাঁর উপলব্ধি এবং ভাবনার মূল কাঠামো বা ফোকাস একই ছিল, কিন্তু নিজের involvement বা ভাবনার সঙ্গে নিজের সমস্তটাকে এমন ভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন যে জীবনে এসেছে চরম বিড়ম্বনা এবং বিশৃঙ্খল ভাঙনের ক্ষয়। একদিকে চেনা মানুষের বা নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে, যে সমস্ত দলীয় সহকর্মী দলের কাছের দূরের চেনা মুখগুলো, একটু একটু করে পাথুরে মুখোশে বদলে গিয়েছিল, বৃহত্তর স্বার্থকে উপেক্ষা করে, ব্যক্তিগত স্বার্থকে চরিতার্থ করার অদম্য বাসনায়। তারাই বিশেষ করে ঋত্বিকের স্বপ্নে, ভাবনায়, দেশভাগের কাঁটাতারের চেয়েও আরও গভীর যন্ত্রণায় বুকে বিঁধে গিয়েছিল।রাজনৈতিক দৃঢ় বিশ্বাসে যে শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন, ছিন্নমূল মানুষের যে আশা যে গণচেতনা ও গণসংহতি, একক ভাবে বিছিন্ন না হয়ে সামগ্রিক শক্তির উত্থানের কথা ভাবতেন ঋত্বিক, স্বপ্ন দেখতেন নারীর অপরাজেয় শক্তির, নারীর কমনীয়তা সহিষ্ণুতা এবং প্রয়োজনে চূড়ান্ত লড়াকু, একদিকে মা,অন্যদিকে বিক্ষত আপনের ক্ষতের প্রলেপ ভেবে ,এই সর্বংসহা অথচ অনমনীয় নারীর লড়াইয়ে যে মুক্তি তাও যখন বিপন্ন সময় ও বদলে যাওয়া লোভী মানুষের সমীকরণে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছিল সুদৃঢ় শিকড়ের প্রত্যয়, তখন সেই আঘাতের তীব্রতা আজীবন আর সহ্য করতে পারেন নি ঋত্বিক। ভেঙে গিয়েছিল মর্মন্তুদ যন্ত্রণায় তাঁর শরীর, মন, তাঁর আশা স্বপ্ন সবকিছু। তবুও নিবিড়ে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, এবং অশোষহীন লড়াইয়ের অঙ্গার,জীবনপণ করে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের সঙ্গে। তারাই ছিলো তাঁর ভাবনার কথক, তাঁর নিজস্ব লড়াইয়ের সুপ্ত বারুদ। একদিকে ক্রমশ একা হয়ে পড়া, আদর্শবাদী একজন প্রখর ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে লোভী, চূড়ান্ত স্বার্থপর দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের অগণনীয় ভণ্ড মানুষের স্খলিত বিবেক তাঁকে অভিমানী করে তুলেছিল। সমস্ত ব্যাপারেই মেনে নেওয়া। শুধুই আপোষ। ভেড়ার পালের মতো অন্ধ অনুগামী এক অনড় সিস্টেম। বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো এ কারণেই ক্রমশ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। আপাতভাবে যে মানুষটা একদিন মারা গিয়েছিলেন, তার প্রস্তুতি চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনভর দেশভাগের যন্ত্রণা ও বাঙালির স্বখাত সলিলে নিমজ্জিত হবার শিকড় চ্যুতি তাঁর চিরকালীন প্রতিবাদ হয়েই রইলো!

No comments:
Post a Comment