অরিজিৎ চক্রবর্তী
এই এক সমস্যা সম্মোহের। যেকোন কিছুর সঙ্গে এতকিছু রিলেট করে ফেলে! তলিয়ে ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো তলানিতে গিয়ে ঠেকে সবকিছু। তখন ক্লান্তি অনুভব হয়। মাথা টনটন করে। সিগারেটের পরিমাণটা বেড়ে যায়। ছবি আঁকতেও ইচ্ছে করে না। পুরনো কাজের দিকে তাকিয়ে মনে হয় কিছুই হয়নি। রঙ তুলির মৌতাত গড়ে ওঠেনি এখনো। কলকাতা ছেড়ে এই গভীর জঙ্গলে চলে আসার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। আবার ভাবে এটাই হয়তো তার জীবনের ভবিতব্য! অরুণদা বুঝিয়েছিল চেনা লোকজন চেনা মহল্লা ছেড়ে একেবারে শিকড় উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক একবার ভেবে দেখতে। সম্মোহ ভাবেনি। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা ভাবেনি কখনো। বরং ভাবনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে আপন খেয়ালে। বিয়ে না করে নিজের মতো বাউন্ডুলে জীবন কাটিয়ে আজ কতটা সুখী সে? নাকি এই সুখের ভেতরে অসুখ বাসা বেঁধেছে।
মাঝে মাঝে কিছুই আর ভালো লাগে না। বড় একা লাগে। ট্যুরিস্ট বেড়াতে আসে। কখনো পূর্ব পরিচিত। কখনো একেবারেই অচেনা। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। আড্ডা হয়। ভালো লাগে। আবার নিজের থেকে কম বয়সী কাপেল দেখলে চোরা ঈর্ষা তৈরি হয় মনের ভেতর। যৌনতা বায়না করে। ডাক দেয়। সম্মোহ আড় চোখে তাকিয়ে দেখে তাদের উষ্ণতা! শিৎকার! চুম্বন! ভাবে কদিনের জন্য কোথায় ঘুরে আসবে। তারপর একদিন লালুকাকাকে দায়িত্ব দিয়ে চলে আসে কলকাতায়।
সেই চেনা শহর। চেনা জীবন। বাল্যকাল। ক্যালকাটা বয়েজ। কলেজস্ট্রিট।গ্লোব সিনেমা। গড়ের মাঠ। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মোলাকাত। তর্ক। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান।সব যেন একসঙ্গে ঘিরে ধরে সম্মোহকে। কিন্তু এই ভালোলাগা আবার মন্দ লাগার দিকে এগিয়ে যায়। মনে হয় কবে বাঁকুড়ায় ফিরবে আবার!
বিচিত্র এই জীবন। জীবনের মায়া। কলকাতা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্বতা। মূল্যবোধ। টাকা! আরো টাকা! আরো স্বপ্ন! শপিং মল! মাল্টিপ্লেক্স! পপকর্ণ! স্পা!
আর সম্মোহ এসবের থেকে আলাদা! জেনারেশন গ্যাপ? মোটেও না। সম্মোহ যথেস্ট আপডেট। এবয়সেও বান্ধবী আছে। যৌনতা আছে। আছে সিগ্ধ জীবনবোধ!
আজ সুখেন গড়াইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্ন। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হচ্ছে। কোতলপুরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। অমায়িক ব্যবহার। জোর হাত ছাড়া কথা বলেন না। মুখে বিশুদ্ধ হাসি। দুটো রাইসমিলের মালিক। বিঘে বিঘে জমি। দুটো মদের দোকান। একটা পেট্রোল পাম্প। সেই সুখেন গরাইয়ের শ্রাদ্ধে আজ যেতে হচ্ছে। ওঁর স্ত্রী ও ছেলেরা অনেক করে বলেছে।সম্মোহ এড়াতে পারেনি। সুখেনদার সঙ্গে সম্পর্ক টা দীর্ঘ দিনের না হলেও বছর পাঁচেক হবে। ভায়ের মতো স্নেহ করতেন। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। এই শৌখিন শব্দটা মনে পড়তেই সম্মোহ বিডন স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেটের দিকে গাড়িটা ঘোরালো। সুভদ্রা নার্সারি। প্রায় সত্তর আশি বছরের দোকান। চমৎকার বোকে বানায় এরা।সুখেনদার জন্য একটা ভালো বোকে আর মালা কিনতে হবে। সঙ্গে একটু মিষ্টি।
নিউমার্কেটে গাড়িটা পার্ক করিয়ে সম্মোহ সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল।
---" কেমন আছিস রে?" ভীড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো।
সম্মোহ প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারলো না, কে কার উদ্দেশ্যে এই কথা বলল।
--" কিরে? কানে কম শুনছিস আজকাল!"
সম্মোহ অন্যমনস্কতা কাটিয়ে তাকিয়ে দেখে বিকাশ!
---" তুই!"
---" বোকাচোদা তুই!"
---"শালা। একই ধাঁচের রয়ে গেলি!"
--- " হঠাৎ কি গাঁড়মারাতে?"
---" চুপ শালা! বুড়ো বয়সেও শুধরালি না!"
---" চল, চা খাই।"
---" চল।"
----"তিন বছর ধরে বানানোর পরে অবশেষে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হল নতুন বাজারের দরজা। কিন্তু বাজার তো হল। এর নাম কী রাখা হবে? কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের নামে বাজারের নামকরণ করা হল, ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কারণ নতুন বাজার তৈরির পিছনে তাঁর উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি।"
---" আবার! আবার শুরু করলি! সেই পুরনো অভ্যেস!"
বিকাশ হোহো করে হেসে ওঠে।সম্মোহ চা দোকানিকে দুটো বড় ভাঁড়ের চা দিতে বলে।গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চলে আসে অতীতের কথা। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব এমনই হয়! ভালোলাগা আর ভালোবাসার উষ্ণতা থাকে। হঠাৎ সম্মোহের খেয়াল হয় সুখের গরাইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্নর কথা। মালা,বোকে আর মিষ্টি নেবার কথা।
---" শোন, আজ তাড়া আছে। তোর মোবাইল নং টা দে। রাতে কথা হবে।"
---" কেন রে এত তাড়াহুড়ো কিসের? প্রায় দশ বছর পর দেখা হলো। চল, আমার বাড়িতে চল। আজ আমার কাছেই থেকে যাবি।"
---" আজ হবে না। রাগ করিস না। একটা শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। অনেক করে বলেছে। না গেলে ভালো দেখাবে না।"
---" কার শ্রাদ্ধ রে?"
---" তুই চিনবি না। আমাদের বাঁকুড়ায় থাকেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি গত হয়েছেন।"
----" আমাদের বাঁকুড়া! মানে?"
----" সে অনেক কথা। তোকে রাতে বলবো।"
সম্মোহ বিকাশের উৎসাহে ভাটা টেনে সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল। পাশে বিকাশ পা মেলাল।
---" শোন তোকে রাতে ফোন করছি। কথা হবে। আর তোর বাড়ি অবশ্যই যাচ্ছি না। শেফালীর হাতে চিতল মাছের মুইঠা খাব।"
---" শেফালী নেই রে! গতবছর ক্যানসারে মারা গেছে!"
সম্মোহ চমকে উঠল। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিকাশের হাতটা চেপে ধরলো। বিকাশের হাতের মুঠোয় মনে হলো কোনো স্নায়ুকোষ নেই।শিরা উপশিরা নেই। কেবল হলদে রঙের অবুঝ শূন্যতা আছে।


No comments:
Post a Comment