Tuesday, October 6, 2020

| বিশেষ সংখ্যা | তাসকবিতার ফর্ম | অনিন্দ্য রায় |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||
তাসকবিতার ফর্ম নিয়ে বিশেষ সংখ্যা
অনিন্দ্য রায়



তাসকবিতা

(Cards Poem)

 

 ডেকে তাস থাকে বাহান্নটি।

 চার ধরণের: ইস্কাপন, হরতন, রুইতন, চিড়িতন। প্রতিটিতে তেরোটি করে: টেক্কা (১), দুরি (২), তিরি (৩), ৪ চৌকা (৪), পাঞ্জা (৫), ছক্কা (), ৭, ৮, নহলা (৯), দহলা (১০), গোলাম (১১), বিবি  (১২), সাহেব (১৩)

 

সেভাবেই তাসকবিতা:

বাহান্ন লাইনের, চার স্তবকের।

একটি স্তবকে তেরোটি করে লাইন, লাইনগুলির মাত্রাসংখ্যা ১ থেকে ১৩ (কলা বা দল যেকোনও একটি অনুসারে)।

একটি স্তবকের প্রতিটি লাইনের মাত্রাসংখ্যা আলাদা-আলাদা।

কবিতাটির কেন্দ্রীয় ভাবানা থাকলেও প্রতিটি স্তবকের ভাবনার, প্রক্ষিতের ভিন্নতা থাকবে।

অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না থাকতেও পারে। অন্ত্যমিলবিন্যাস কবির ইচ্ছানুসারী।

শিরোনাম থাকবে।

 

মাত্রাগণনা হতে পারে ‘কলা’ (Mora) অনুসারে: 

 

আমাদের ভালোবাসার মতো

 

একটা পিঁপড়ে 

বইয়ে

খুলে-রাখা পৃষ্ঠায় 

বাঁদিকের মার্জিন বরাবর  

হেঁটে চলেছে  

ধীরে 

অথচ অক্ষরের সঙ্গে 

ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে 

না

বারবার টলে যাচ্ছে 

শব্দ ও যতিচিহ্নের    

নিশ্বাস

জোরসে ধাক্কা দিচ্ছে তার গায়ে  

 

কবিতা  

এতো ছোটছোটো   

হরফে ছাপা হয়

ইদানীং

তা

পড়ার মতো    

আতসকাচ আমাদের কাছে নেই    

আর তাকে বোঝার মতো  

নুন 

নেই আমাদের চোখে   

তবু পাতাটি ওলটাতে গিয়ে

প্রতিবার অভ্যাসবশত    

চশমাটা ঠিক করে নিতে হয়

 

কী

হয়   

কোনও বই  

শেষের মলাট অব্দি

না-পড়ে  

বন্ধ করে রাখলে  

অথবা ধরা যাক  

সমীকরণের মতো হালকা    

সম্পর্ক

একটা পাঁচিলের সামনে 

যদি দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তকাল  

অথচ ভাঙতে পারে না কিছুতে 

ভেঙেও পড়ে না   

 

 

এই

যে

বইপত্তর 

ছাপা হয়    

বাঁধানো হয়  

আর মাঝেমধ্যে খুলে রাখা হয়   

একটা পিঁপড়ে হেঁটে যায় ধীরে   

কিন্তু পড়া হয় না

কয়েকদিন পর

ধুলো ঝেড়ে সেলফে রাখা হয়   

হয়তো

পরে কেউ পড়বে বলে   

আমাদের ভালোবাসার মতো     

 

অথবা হতে পারে ‘দল’ (Syllable) অনুসারে:

 

কেউ ঘুমোতে পারিনি

 

বাঁশপাতা  

রাতপোশাক যেন  

কাঁপছে

আর ভেতরের অন্ধকার

দেখা যাচ্ছে

বারোটা-পঁচিশের গোঙানি    

অভিসম্পাত হয়ে 

ধাক্কা দিচ্ছে নির্জনতায়

প্যাঁচার চোখে চাঁদ উজ্জ্বল হয়েছে

রাঢ়বঙ্গের বাতাস খামখেয়ালির মতো   

তাকে বুঝব বলে জানলা খুলে রেখেছি

কেউ

এখনও পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি  

       

গান

যদি

নৈঃশব্দ্যে

ভেঙে পড়ে

কাচের বাসনের মতো  

যদি রজনী  

নিজেকে রমণী ভেবে

চোখ মুজে অন্ধ সেজে থাকে

স্পর্শের ভেতরে আরও স্পর্শের খঞ্জর

যদি পুরুষের অহংবোধকে আঘাত করে

শুশ্রূষার জন্য কে   

হাত বাড়িয়ে দেবে বারোটা ছাব্বিশে

এখনও কেউ ঘুমোতে পারিনি    

 

আলো জ্বালার জন্য   

আমরা দেশলাইয়ের খোঁজ করি  

কিন্তু পাই না  

পরস্পরের শরীরে ঘষতে থাকি

আঙুল

মাথায় বারুদ নেই বলে

চামড়া ছুলে যায়

দীর্ঘশ্বাস

ছলকে ছড়িয়ে পড়ে ঘরে

কে

আড়াল থেকে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে  

বারোটা সাতাশ বাজল বাঁচোখে

এখনও পর্যন্ত কেউ ঘুমোতে পারিনি

 

একটি কুকুর  

কালপুরুষের দিকে 

মুখ তুলে

ডাকছে

আর তার সঙ্গীরা

শোকপালনের মতো ঘিরে আছে তাকে  

কোথাও মিনিট দুয়েক আগেই  

কি  

ঢং করে উঠল বিভাবরী  

আমরা দোষারোপে আর সান্ত্বনায় ভুল করি

সংশোধন করতে গিয়ে যে ঠকে যাই  

বারোটা আটাশ বাজল  

এখনও কেউ ঘুমোতে পারিনি             

 

 

তাসকবিতা

(Cards Poem)  

 

চারজন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৫২টি তাস সমানভাবে বণ্টন করা হয় (১৩ ×  = ৫২) একজন তার হাতের একটি তাস ফেলেনতারপর দ্বিতীয়জন একটিতারপর তৃতীয়জনতারপর চতুর্থজন এই হল একটি দান।

একটি খেলা ১৩ দানের।

 এইভাবে কবিতা।

 

১৩ স্তবকের, প্রতিটি স্তবক ৪ লাইনের।

লাইনগুলির শব্দসংখ্যা ১ থেকে ১৩

প্রতিটি লাইন হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

কবিতাটিতে অভিন্ন শব্দসংখ্যাবিশিষ্ট লাইন চারটি করে হবে।  

কোনও শব্দের পুনরাবৃত্তি হবে না।     

 

অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না থাকতেও পারে। অন্ত্যমিলবিন্যাস কবির ইচ্ছানুসারী।

শিরোনাম থাকবে।

       

পাহাড়চূড়ায় বাড়ি

 

পাহাড়চূড়ায় বাড়ি এ

        দেয়ালের কাঠ খয়েরি হাওয়ার দাপটে  

        অদূরে পাথরকুচি পরিসীমা বরাবর পাহারায় রয়েছে দাঁড়িয়ে  

        তবুও সুযোগ পেলে ফাঁক গলে বাতাস, বিদ্যুৎ, মেঘ, পাঁচজোড়া পাখি জানলায় ঠোকরাতে জোটে     

 

ঢাল

        পুরুষের স্মৃতির মতো অনুকম্পাহীন  

ঘাস কয়েকগাছি রহস্যকে করেছে আড়াল   

কতিপয় লালচে প্ররোচনা, ছোটোছোটো, নিতান্ত সরল, অর্বাচীন     

 

দুটি মেষ  

চতুষ্পদ ওরে

একটি করে আনম্র ল্যাজ ছটফটে বেশ  

খুঁজে বেড়াচ্ছে অসংযত কোথায় শ্বাপদ  

 

তাদের খুরের আঘাতে ক্ষতগুলি বিশাল পুষ্প হয়ে ফুটেছে সামাজিকতার অগোচরে

এবং আশ্চর্য ঘ্রাণে অল্প ঘুমের মশলা মিশিয়েছে কেউ    

ঢলে পড়লে গা থেকে সমস্ত লোম কেটে নেবে ধরে   

দুধ দুইবে যতক্ষণ জেগে থাকবে শরীরের শেষতম ঢেউ

 

তরাইয়ের দীঘি শান্ত তারপরে   

লবণ উঠবে ভেসে ব্যাপ্ত জলতলে  

সেখানে আমার নাম লিখে রাখি নখের আঁচড়ে

যেন মনে পড়ে আবার বেড়াতে এলে গাঢ় কুহকের দলে     

 

সেবারও ঠান্ডা লাগলে কিনব ভেড়ার উলে বানানো গরম অভিলাষ  

কুসুমের মদ খেয়ে জড়িয়ে আসবে স্বর  

এলোমেলো শ্বাস  

অসতর্ক কথারা পড়বে হুড়মুড়িয়ে গানের ওপর   

 

এবার সংগীত শুরু

একসঙ্গে দুদিকে বাজানো যায় সে তো পাখোয়াজ  

চামড়ার মাঝখানে কালো বৃত্ত দেখেও অন্য চিন্তা করতে মানা করেছেন গুরু

স্পর্শ করলে প্রতিবার যে পানীয় উথলায় প্রথম চুমুকে আদিরসাত্মক ঝাঁঝ     

 

সংজ্ঞা হারিয়ে দেখি অন্ধকার ভেঙে রামধনু আকাশের প্রান্ত থেকে অপর খগোলে

সেই বাঁকা পথে উড়ছে আমাদের অচেনা রংবেরঙের অসংখ্য চাকতি   

ইচ্ছে করে বাংলা কবিতা ছেড়ে ওদের সঙ্গে যাই মান্দারিনে চলে        

পাঠকের সংখ্যা বাড়লে হরফের অদলবদলে প্রেম বা বিরহের, বলো, ভবিষ্যতে কতটুকু ক্ষতি      

 

ভাষার আয়না প্রতিবিম্ব নিয়মমাফিক সোজা ধরে রাখে চিরকাল

চড়াইয়ে যেমন ঘাম ঝরছে স্বতঃস্ফূর্ত উৎরাই বেশি উত্তেজক     

যারা অনায়াস সকলে রাখাল?

তাদের কৌমে তবে বাঘের মিথ্যে গল্পে নেশার চূড়ান্তে আজ মেলামেশা হোক  

 

আদর গড়িয়ে যাক    

জিহ্বার তলায় বারুদের বড়ি চেপে কে সহজে ফেটে পড়তে চায় মহামারীর সময়ে    

কামুকতা প্রকৃতপক্ষে বলিষ্ঠ ইয়াক 

স্তূপাকার বরফের দিকে কখনও যাবে না রোগা রমণীরা লোকহাসির ভয়ে    

 

প্রতিফলিত রোদের তির তাদের বিষণ্ণ চোখে গেঁথে অন্ধত্ব ঝরাবে অশ্রু ও রক্তে মাখামাখি  

কাঠি ছুঁইয়েছে যেই সুষুপ্তির ফুরিয়েছে দৃশ্য ও বিম্বের ভেদ দেখার প্রয়োজন    

লোভের চালাকি

এখানে একলা সন্ধ্যাবেলা এলোচুলে বেড়ানো বারণ?   

 

হয়তো বুঝতে পারছেন বলছি ভ্রমণ নিয়ে আড়ে রেখে দেহতত্ত্ব কিছু অপ্রচলিত গান  

চাষবাসের ব্রত  

শ্রীস্থান

প্রণামের বদলে যদি প্রগাঢ় চুম্বন পঞ্চমুখী ফুলের প্রতীক বলে নিরঙ্কুশ মেনে নেওয়া হত  

 

দুই বিরোধী স্রোতের ভেতর জেগেছে প্রবল ঘুর্নি কেন্দ্রাতিগ, দুর্দান্ত, চটুল, নিয়ন্ত্রণ অসম্ভবপ্রায় 

দ্বিধা হয়েছে বসুধা

নগ্নতা ছাপার কালি স্বচ্ছ, দারুণ গন্ধ, মুখ লাগলে স্বাদে মুহূর্তের মধ্যে চেতনা হারায় ১

সুধা  

 

  

তিনপাত্তি

(Three Cards)

 

তিনটি তাসের খেলাতিনতাসতিনপাত্তি

 

মুখোমুখি দুজনবেটে নেওয়ার পর প্রত্যেকের হাতে তিনটি করে তাস

প্রথমজন একটি তাস ফেলেউত্তরে বিপক্ষ একটি

আবার প্রথমজন একটিবিপক্ষ একটি

আবার প্রথমজন একটিবিপক্ষ শেষেরটি

দুজনের তাসের মান অনুসারে ফলাফল

এই তো খেলাআর এভাবেই তাসের কবিতাতিনপাত্তি

কবি একটি পঙ্ক্তি লেখেন

পরের পঙ্ক্তি লেখেন প্রথমটির বিপরীত ভাবনায়।

দুটি পঙ্ক্তি মিলে একটি স্তবক

প্রথম পঙ্ক্তি হতে পারে কোনও প্রশ্নদ্বিতীয়টি তার উত্তর

আবার প্রথমটিতে কোনও প্রস্তাবদ্বিতীয়টিতে তার প্রতিক্রিয়া এইভাবে থিসিস-অ্যান্টিথিসিসভাবনা-প্রতিভাবনাদৃশ্য-বিম্ব এইরকম বৈপরীত্যে লিখিত হবে পঙ্ক্তিদুটি।

একই নিয়মে আরও দুটি স্তবক।

 

তিনপাত্তি:

মোট ৬ লাইনের, ৩ স্তবকের কবিতা

লাইনগুলির সিলেবল-সংখ্যা তেরো বা তেরোর কম হবে

অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না থাকতেও পারে। 

শিরোনাম থাকবে, যা হবে ভাবনাদুটির সিনথেসিস।  

 

জিজ্ঞাসাবাদ

 

: এক বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?  

শূন্য আর একের মধ্যে— যেখানে বাক্‌ জন্মায়    

 

: দশ বছর পর?

: শূন্যের পরিধিতে নিস্বন ঘুরছে যেখানে   

 

: একশো বছর হলে?   

: কেন্দ্রে নৈঃশব্দ্যে   

 

মানুষ চেনার উপায়  

 

: সামনে ঘুরছে, চতুষ্পদ, চেনো?

: ছাগল

 

: ওকে দেখে কী হয় লতাপাতাদের?     

: ভয়

 

: আর ওই ঝোপের আড়ালে বাঘের?

: লোভ

 

ঝগড়ার পরে

 

কলহের আঘাত বেগুনি

ফুলগুলি, ফুটেছে প্রহারে        

 

কান্না তো শুধু জলনুনই 

বরফকে টুকরো করতে পারে 

 

সে প্লাবনে ভিজেছে সারা গা 

ঝগড়ার পরে রাত জাগা

 

 

আগুনের পরশমণি

 

: ধ্বজা নীচু করো, রোদ লাগুক শরীরে

: তুমি আতসকাচ, যদি দাঁড়াও ফোকাসে   

 

: তোমার উদ্দেশে যাক তরঙ্গ সকল

: যা আসে তোমার থেকে গ্রহণ করি তা 

 

: উষ্ণ করি, জ্বলে ওঠো, জ্বলো

: তোমাকে চেয়েছিলাম, চাইনি ছাই হতে

 

লকডাউন

 

বন্ধুরা আসেনি কতদিন

চারটি দেয়াল, খাট, টেবিল, খাতাবই

 

ভালো লাগে না পড়তে, লিখতে

নিঃসঙ্গতাকে মনে হয় উপন্যাস   

 

শুয়ে থাকি, জানলা খুলি, লাগাই 

একা? না তো, নিজেরই সঙ্গে কথা বলি 

 

প্রেমের কবিতা

 

আলো পড়লে কনীনিকা বুজে আসে

অন্ধকারে ফাঁক হয়

 

ঘনিষ্টতা স্পষ্টতর করে   

দূরত্ব না হলে ঠিক প্রকাশ হয় না

 

আমরা তো বিম্ব দেখি  

চুম্বনের সময়ে চোখ বন্ধ রাখা রীতি

 



3 comments:

Tanima Hazra said...

বেশ নতুন রকম। তবে নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে বেশ বারবার অনুশীলন করতে হবে। দারুণ ফর্ম অনিন্দ্য।

Shirsha Mondal said...

খুব ইন্টারেস্টিং। চেষ্টা করব।

জয়ীতা ব্যানার্জী said...

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফর্মটি অধিকতর ইন্টারেস্টিং মনে হল। অনিন্দ্যদা'র এই কাজগুলিই অনেককে কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে।