Sunday, October 18, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
| নভেলেট |
অরিজিৎ চক্রবর্তী

ডারউইনের চিঠি  ( পর্ব- ৭ )

পৃথিবীতে ২৩০ রকমের রঙ আছে। এই বিভিন্ন রঙের অস্তিত্ব খালি চোখে দেখা যায় না। আমরা শুধু এই সমস্ত রঙ একটা যৌগিক বর্ণের সাদায় অনুভব করি। সম্মোহ কি তেমনই এক অনুভবের ক্রীতদাস হয়ে গেছে! প্রথমটায় সম্মোহ ভেবেছিল লালুকাকা এমন কিছু কথা শুনতে পায় যা ভুতুড়ে।কেউ ওকে এসব বলছে না। সবটাই তার কল্পনা। কিন্তু লালুকাকার মনে হচ্ছে সেগুলো সত্যি সত্যি শুনতে পাচ্ছে। তার কোনওটা আদেশ।কোনওটা বা কিছু অদ্ভুত অবজার্ভেশন। প্রাথমিক এই অনুমান থেকে সম্মোহকে অবশ্য দিন কয়েক পরেই সরে আসতে হয়।ওই অনুমানটা মিলে গেলে সনাক্তকরণের কাজটা জলের মতো সহজ হয়ে যেত। তা তো হলই না, উল্টে সম্মোহ ভাবতে বাধ্য হল, কোনও না কোনও ভাবে সে নিজেও হয়তো বধির। এমনকি অন্ধও। কিন্তু সম্মোহ অনেকটাই নাছোড়বান্দা গোছের। কিছুতেই হাল ছাড়বে না।বলা ভালো ওর মধ্যে আছে অনির্দেশ্য শব্দাবলী! অর্থাৎ যাদের প্রযোজ্যতা সম্পর্কে সঠিক নির্দেশদান অসম্ভব। তাই কারও সম্পর্কে আলটপকা কিছু বলাটা ওর অভ্যেসে নেই।

--- " লালুকাকা আগে তুমি কি কাজ করতে?"

----" ডাকাতি করতাম গো!"

----" কেন হঠাৎ ডাকাতি কেন?"

----" আমার বাপ তো বড় ডাকাত ছিল। এলাকা কাঁপতো। তারপর একদিন আমার মাকে ছেড়ে চলে গেল। আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আর খোঁজ নিল নি।"

---" তা তুমি কেন ডাকাতিতে গেলে?"

----" গেলাম। বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায় পড়লাম।"

----" কিভাবে ডাকাতি করতে?"

----" জঙ্গলের বড় রাস্তার মাঝখানে বোল্ডার পেতে রাখতাম রাতের বেলায়। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ।" লালুকাকার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

---" গোটা কুড়ি গাড়ি ডাকাতি করেছি। তারপর একবার গেলাম ফেঁসে। পালানোর সময় পুলিশ ধরে ফেলল। বেদম মারল।পা-টা নষ্ট হয়ে গেল।জেলখাটলাম বারো বছর।"

----" লালুকাকা তোমাকে দেখে আমার বিশ্বাস হয় না তুমি ডাকাত ছিলে! এখন কেমন শান্ত হয়ে গেছ। " সম্মোহ বলল।

----" জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মা খুব কান্নাকাটি করলো। দিবি দিল। সেই থেকে সব বন্ধ করে দিলাম। চাষবাস শুরু করলাম।"

সম্মোহের মনে হলো," প্রকৃতির নানা রূপ, তার বিচিত্র প্রকাশকে আমরা দর্জির ফিতে দিয়ে মাপতে পারি না। বস্তু সম্পর্কে একটা কেজো ধারণাকেই যথেষ্ট বলে ভাবি। যেই কোনো মানুষের সংস্পর্শে এলাম তাকে নিয়ে অপারেশন টেবিলে তুলবোই।মালটা আসলে কি জানতেই হবে। লালুকাকাকে ঘিরে একটা নয় অনেক জট।"

আসলে লালুকাকা কেমন যেন অদ্ভূত প্রকৃতির মানুষ। এই যে এখানে কাজ করে এবং প্রতিমাসে তার দরুন যে টাকা তার প্রাপ্য সেটার প্রতি কোনো মোহ নেই। শুধু দুবেলা দুমুঠো খাওয়া, এক প্যাকেট বিড়ি আর খানিকটা দেশি মদ। এর বাইরে কোন চাহিদা নেই। আসক্তি নেই। বাড়ি যাওয়ার সময় প্রতিবারই সম্মোহ মায়নেটা দিয়ে দেয়। দু- তিন দিনের মাথায় লালুকাকা ফিরে আসে। আবার কাজে লেগে পড়ে।

"ধন্যিমেয়ে" গ্ৰপের নন্দিনী সেনরা আজকে দুপুরের মধ্যেই এখানে এসে পড়বেন। তাই সকাল থেকে রান্নার তোড়জোড়। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়বে সব। সম্মোহ স্নান সেরে পাজামা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে একেবারে ফিটফাট। গা থেকে ফুরফুরে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। দুপুরের মেনুতে মোচাচিংড়ি, মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, দেশি মুরগির ঝোল আর চাটনি। সম্মোহ নিজেও রান্নাবান্নায় পারদর্শী। মোচাচিংড়ি সে নিজেই বানিয়েছে। বাকি রান্না বুলির মা করেছে। সম্মোহ এখন অনেকটাই বুলির মা'কে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে।আগে একদমই রাঁধতে জানতো না।

---"হ্যালো, নন্দিনী বলছি, আমরা দশ মিনিটে ঢুকছি... "

----"কাউকে পাঠাবো? চিনতে অসুবিধা হচ্ছে নাতো! "

----" একেবারেই না। আপনি বেশ ফেমাস মানুষ এখানকার দেখছি! সবাই চেনে। *

---"না না , একেবারেই নয়!  ওই লোকজন ভালোবাসে আর কি! চলে আসুন। " সম্মোহ বলল।

সম্মোহ লালুকাকাকে উত্তোরিও গুলো একটা ট্রে-তে সাজিয়ে আনতে বললো। তারপর মোবাইলের ক্যামেরা অন করে নিজেকে সেলফি মোডে আপাদমস্তক দেখে নিল।

--- " সুস্বাগতম,আসুন আসুন। লালুকাকা ওনাদের মালপত্রগুলো নামিয়ে রুমে রেখে দিয়ে এসো। "

---" জায়গাটা বেশ নৈঃশব্দ্যে ভরা! বেশ লাগছে! কিরে তোদের কেমন লাগছে? " নন্দিনী সেন সবাইকে জিজ্ঞেস করলো।

প্রায় সমস্বরে সবাই বলে উঠলো, " অসম্! জাস্ট ভাবা যায় না! "

সম্মোহ ডাইনিং হলের দিকে নিয়ে এসে ওদের সবাইকে বসতে বললো। ততক্ষণে ওয়েলকাম ডিঙ্কস এসে গেছে। এবার উত্তোরীও পড়ানোর পালা।

---" দাদা, শুরুতেই যা দিচ্ছেন! প্রেমে পড়ে যাচ্ছি!"

---" ভালো তো। প্রেম স্বাস্থ্যকর!" সম্মোহ হেসে বললো।

---"সম্মোহবাবু আসুন আমরা সবাই আলাপটা সেরে নিই। আমি নন্দিনী, ও শর্মিষ্ঠা, তারপাশে শতাক্ষী,ওর পাশে ডলি আর তোয়া।আমারা পাঁচজন।" নন্দিনী বললো।

সম্মোহ প্রত্যেকের দিকে নমস্কার বিনিময় করলো। তারপর ওদের নির্ধারিত রুমগুলো দেখিয়ে দিল।

---" লালুকাকা , মিনিট কুড়ি বাদে চা বিস্কুট দিয়ে দিও ওনাদের রুমে। আমি একটু বাজার থেকে আসছি।"

সম্মোহ জঙ্গলের রাস্তায় বুলেটের তীব্র শব্দ হাঁকিয়ে যাচ্ছে। বেরোনোর খুব একটা দরকার ছিল না। সিগারেটের স্টক আছে। তাও একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছে করলো। তিন চার কিলোমিটার বাইক চালিয়ে বঙ্কার দোকানের এককাপ লিকার চা খেয়ে আবার ফেরার রাস্তা ধরলো। সম্মোহ ভাবলো বাড়িতে ফিরলেই নন্দিনী সেনরা ওকে ঠিক দেখতে পাবে। কারণ সম্মোহ ওদের রুমের উল্টো দিকের জানালার কাছেই বাইকটা রাখবে। আর বুলেটের যা বাদশাহী আওয়াজ। সম্মোহ বাইক থেকে নামতে নামতে ওদের দিকে হাসি ছুঁড়ে দেবে। যেন কতো ব্যস্ত। তড়িঘড়ি এগিয়ে যাবে রান্নাঘরের দিকে। নন্দিনী ঠিক এইসময় সম্মোহকে ডাকবে। বাকিরাও কথা বলতে চাইবে। সম্মোহের প্রতিটা মুহূর্তের চিত্রনাট্য প্রায় মুখস্থ।

সম্মোহ বাড়িতে পৌঁছে গাড়িটা স্ট্যান্ড করছে, তখন ওদের মধ্যে একজন বেরিয়ে এসে বললো," দাদা একটু আসবেন। কথা ছিল।'

---" হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যাচ্ছি।"

সম্মোহ বাইরে থেকে বলল, " বলুন ম্যাডাম। "

---" বলছি, এখন মহুয়া পাওয়া যাবে? সবাই খাবে বলছে।"

---" অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু কি দিয়ে খাবেন? "

--- " আপনি বলুন? নন্দিনীদি বলেছে আপনি মহুয়া স্পেশালিস্ট!"

সম্মোহ হেসে ফেলে।" মাছভাজা দিয়ে খেতে পারেন। আমি মাছের ঝালঝাল ঝুড়ো করে দিতে বলছি। আর আইস কিউব পাঠিয়ে দিচ্ছি। বরফ দিয়ে খেলে তীব্র গন্ধটা কম লাগে। বেশ একটা শান্তি শান্তি পায়।"

সবাই হেসে ওঠে। বলে, " তবে তাই হোক। একটু শান্তি শান্তি হোক।"

সম্মোহ বুলির মা'কে মাছের ঝালঝাল ঝুরো বানাতে বলে। তারপর হঠাৎ মনে হয় লালুকাকাকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় গেল লালুকাকা। রান্নাঘরে নেই। আবার ভুতে পেল নাকি!

--- "লালুকাকা ও লালুকাকা! কোথায় তুমি।"

কোন উত্তর এলো না। বুলির মাও কিছু বলতে পরলো না।

গুম। গুম্ গুম্ !!! পরপর তিনবার গুলির শব্দ। জঙ্গলের সমস্ত পাখি কিচিরমিচির শব্দ ছড়াল। চারপাশ থমথমে হয়ে উঠ

No comments: