Saturday, October 24, 2020

≈ বিকাশ দাস সংখ্যা ≈ শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ≈

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||
বিকাশ দাস সংখ্যা 
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



ছোট গল্প~আহবান

মা,বাবা ঘুমোচ্ছে। চুপিচুপি এসে ঘরের জানলার অ্যালকোবে বসে থাকে বুবাই। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকে। নির্জন দুপুর। কেউ কোথাও নেই। ভোলু নামে তার আদরের কুকুরটা ড্রেনের একপাশে ফেলে রাখা উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে চলেছে একমনে। খাওয়া শেষ হলে বুবাইদের জানলার দিকে তাকিয়ে আপন খেয়ালে ঘউ ঘউ করে দুবার ডেকে উঠলো ভোলু। মনটা যেন কেমন করে উঠলো বুবাইয়ের।ছোট্ট, কচি হাতখানা নাড়ছে জানলার ফাঁক দিয়ে।  'ভোলু' বলে ডাকতে গিয়েও পারলো না। বাবা, মা ঘুম থেকে উঠে দেখলে বকুনি দেবে। 'সন্ধ্যেবেলা ম্যাথের হোমটাস্ক করতে হবে, মনে আছে?  অনলাইন ক্লাসে মিস দেখবেন বলেছেন..আর তুমি এখন না ঘুমিয়ে..।'
ভোলু চলে যায় নিজের মনে.. সোজা লম্বা রাস্তাটা যেদিকে  গিয়ে  বাঁক নিয়েছে সেদিকে।  খাঁচা গাড়ি করে যাওয়া সেই স্কুলের রাস্তা...গাড়ির চাকার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক দূর চলে আসতো ভোলু..সেই মথুরা বিল পর্যন্ত...। একসময় থেমে যেত গতি হারিয়ে। খাঁচার জালের ফাঁক দিয়ে বুবাইয়ের দেখাদেখি অন্য বন্ধুরাও হাত নেড়ে  ইশারা করত ভোলুকে। এগিয়ে যেত গাড়ি। একসময় মিলিয়ে যেত ভোলু দৃষ্টিপথের আড়ালে। 
মন কেমন করা সেই ইশারার অপেক্ষায় আজ আর ও দাঁড়িয়ে থাকে না। অভিমান করেছে নিশ্চয়। 
স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আচার কাকু রবিবার হলেই বুবাইদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে একবার ঠিক হাত নেড়ে ডাকতো। কতদিন হয়ে গেল কাকু আর আসে না এ পথে। যেমন আসে না বাবার অনেক দিনের বন্ধু মজার মজার গল্প বলা সমীর কাকু,রীতা কাকিমা, ছোট্ট টুকাই..। বাবা,মা শিখিয়েছে,' এখন কাউকে আসতে নেই..। '
দিন যত দীর্ঘ হয়েছে, অভিমান বড় হয়েছে ততই।

জানলা দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে বুবাই। কচি হাতের মুঠোয় জড়িয়ে ধরতে যায় তার সেই অনেক দিনের অভিমানী পৃথিবীটাকে যেন..। সেই চেনা রাস্তা, খাঁচার গাড়িতে করে যেতে যেতে গল্প বলা ড্রাইভার কাকু,ঝিল পাড়ের ঘন সবুজ গাছপালা,ঝোপঝাড়ে ঢাকা মেঠো পথ, মাছ ধরা নৌকা,স্কুল মাঠের কাঠবাদাম, জামরুল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে পড়ে আসা বেলার আলো...কোথায় গেল দিনগুলো! 
 
সামনের বাড়ির খাঁচাবন্দি টিয়াপাখিটা বার তিনেক ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডেকে উঠলো। নির্মেঘ, নীল আকাশে ডানা মেলে  বক পাখির দল উড়ে চলেছে.. কার্ণিশ ভাঙা ছাদের ফাটলে কোথায় ঘুঘুর ডাক..নিঃসঙ্গ হাওয়ায় গাছের পাতার খসখসানি... হঠাৎই কারা যেন ফিসফিস করে ডেকে ওঠে..' এই বুবাই স্কুলে যাবি না? ঐ যে গাড়ি চলে এলো..।'
 নীচে মেইন গেটে তালা দেওয়া। ওরা অপেক্ষা করে আছে যে...! বুবাই ফিরে ফিরে তাকায়...একবার টিয়াপাখিটার দিকে। একবার প্রায় দূরে মিশে যাওয়া বকগুলোর দিকে। 
পেছন থেকে একটা আলতো হাতের ছোঁয়া গায়ে এসে লাগে। মা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
' কী করছিস বুবাই? এই ছবিটা তুই আঁকলি!'
নীল আকাশ..এক ঝাঁক বক উড়ে চলেছে, ওপাড়ে বহু দূর বয়ে চলা মথুরা বিল এর দিকে..রাস্তায় অপেক্ষমাণ একটা কুকুর, দূর থেকে খাঁচার গাড়ির দিকে তাকিয়ে.. আরো দূরে কল্পনায় ভেসে ওঠা একটা স্কুলের গেট..।
ফেসবুক ওয়ালে বড়োবড়ো করে লেখা.. 'আমাদের ছোট্ট বুবাই সোনার নিজে হাতে আঁকা একটি ছবি। ওর ভালোবাসার পৃথিবী। '
 ছোট্ট বুবাই জানে, সেই পৃথিবীতে হাত ধরে নিয়ে  যাবার মতো লোক আজ আর তার পাশে কেউ নেই।

No comments: