Thursday, April 15, 2021

১-লা বৈশাখ সংখ্যা || গল্পে~সোমা ব্যানার্জী

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || ১-লা বৈশাখ সংখ্যা ||     

সোমা ব্যানার্জী

পাপী
" ও রঘু মিঞা বাড়ি আছো না কি"
" যাই কত্তা--"
রঘুমিঞা ঘরের চাল ছায়।
সামনে ঝড়বাদলের দিন 
আমনধানের খড়ে চাল ছেয়ে নেয় সব্বাই
রঘু এখন বড় ব্যস্ত,
একদিন কাজ জুটলে দু' কুনকে চাল আসে ঘরে
মাথার উপর চাল না থাক হাঁড়িতে দুটি চাল তো থাকে।
সাতসকালে  দুটি পান্তা খেয়ে কাজে বেরোয়
আজ সেটুকুও জোটেনি-- ঘরে চাল নাই এক ফোঁটাও।
রঘুর ঘরের চালে আধখানা তেপ্পল ঢাকা
রুগ্ন বৌটা দাওয়ায় শুয়ে গোঙ্গায়
খোলা ছাদের নিচে আঘনের হিমে জ্বর বাড়ে।
সেই কবে আম্ফানের ঝড়ে জীর্ণ চালখানা উড়ে গেছিলো
আজও ঢাকা পরেনি তার জীর্ণ সংসারের কঙ্কাল -
রঘুর বৌ ছেঁড়া কাঁথাখানা গায়ে টানে
জ্বরের ঘোরে তারা দেখে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে।
শূন্য হাঁড়ির  মাঝে একমুঠো চাল খুঁজতে খুঁজতে 
রঘু পরম মমতায় বৌয়ের মুখখানার দিকে অপলক চেয়ে থাকে,
তার সে হলদে ডুরে শাড়ির বৌ আজ
যেন ঝরে পরা বর্ণহীন পাতার মত।
ঝড়ের পরে নেতারা এসেছিলো
চিঁড়ে গুড়ের সাথে সারি সারি তেপ্পল-

আনাড়ি রঘু লাইনে দাঁড়িয়ে পিছোতে পিছোতে
 যখন হাজার ইঁটের লাইন পেরিয়ে 
সেই টেবিলের সামনে হাজির হলো তখন তেপ্পল ফুরিয়েছে,
নেতা বাবু বলেন" ফুরিয়ে গেছে রে রঘু
 আবার আসবে তখন নিস"
দুর্বল শরীরে রঘু মাথা নাড়ে " হ' কত্তা"
সেদিন আর আসেনি।
গাঁয়ের বড় বাবুদের উঠোনে ধান শুকোয় সে সরকারি তেপ্পলে
শুধু রঘুর মাথার চাল আজও ফাঁকা।
রঘু শিমের মাচায় জল ঢালে
শিমের সবুজ পাতাগুলি অবুঝের মত শূণ্য ঘরের চাল ঢাকতে চেষ্টা করে 
এক আকাশ সবুজ ভালোবাসা। 
" ও বাবু,  দুকাহন খড় দ্যন না,  
রুগ্ন বৌটা যে এবার বর্ষার জলে ভিজবে"
" উফ্ জ্বালালি রঘু, দেখছিস গোয়ালঘরটা ছাইতে হবে
যেই দেখলি খড়গুলান জমা আছে
 অমনি নোলা বেড়ে গেলো তর"।
মনের ভেতর জেদ চাপে রঘুর
রুগ্ন বৌটা অনেক কষ্টে তুলসীতলায় পিদিম জ্বালে,

আজ অনেকদিন পর উঠোনে ভাতের গন্ধ-
সারাদিনের পরিশ্রমে পাওয়া দুমুঠো চাল।
সে গন্ধ জ্বালা ধরায় রঘুর মনে
আধঢাকা হোক তবু তো তার ঘর
দুদিন পর পেটে গরম ভাত,
বৌটা অঘোরে ঘুমায়।
রাতের অন্ধকারে বাবুর বাড়ি ঢোকে রঘু
উঠোনে তখনো পরে আমনধানের খড়
কয়েক বোঝা খড় মাথায় নিয়ে
 রঘু দৌড়ায় বাড়ির দিকে--
বাবুদের পোষা কুকুরটা আজ হেরে গেছে রঘুর কাছে।

"ও বৌ ওঠ-- ওঠ না
দ্যখ খড় আনসি-- চাল ছাইবো রে
তরে আর বর্ষায় ভিজতে হইবো না
ও বৌ ওঠ না"
রঘুর রুগ্ন বৌটা আজ আর তারা দেখে না,
ছেঁড়া মাদুরে মোড়া শরীরটা আজ অন্তিম যাত্রায়।
রঘুর কানে বাজে বৌয়ের গলা
যেন খয়েরে রাঙানো ঠোঁটে কানেকানে বলে 
" সেই আনলা খড়-- কিন্তু এতো দেরি করল্যা ক্যন?"
ও রঘু-- কাঠ কিনতে হইবো তো
ট্যকা আছে? বৌরে পোড়াবি ক্যমনে?"
ঘরের খোলা চালের বাঁশ ক'খানা খুলে নেয় রঘু, সিম গাছটা চাল না ঢাকার  লজ্জায়  মরেছে
একে একে সাজায় চিতা
দুআঁটি খড়ে আগুন ধরিয়ে বৌয়ের মুখে দেয় রঘু।
পরজন্মে আর যাই হস না ক্যন বৌ
তর মাথায় যেন চাল থাকে রে--
তরে যেন খোলা আকাশে শুইতে না হয়।

রঘু আজ মাঠে ঘাটে খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায় 
সেদিন  বড়বাবু হেঁকে বলেন--
" ও রঘু-- বাদলের দিন আসছে রে
চালখানা তো ছাইতে হয়। কবে যাবি?"
" আমি আর চাল ছাই না গো কত্তা
রঘু ঘড়ামি মইরা গ্যসে গিয়া"
পাগলের মতো হেঁটে চলে নদীর পাড় ধরে।
সারাজীবন সৎ কাম করলাম আল্লা
দুবোঝা খড় চুরির এমন শাস্তি দিলা তুমি--
 এ কেমন বিচার তোমার
কতশত পাপী ঘুইরা বেড়ায়
তুমি শুধু আমারেই দ্যখলা।




No comments: