রঞ্জন মৈত্র
খিদের ওপারে
দুপুরে রিকশাস্ট্যাণ্ডেও কেমন ঘুমের ভাব। আলস্যটা প্রায় দেখতে পাওয়া যায়। ধারে কাছের দেশির ঠেক, গাঁজার জমায়েত, সাট্টার পেনসিল, যেন নেই। রিকশার উপর তেড়ে বেঁকে ব'সে চালক গান শুনছে। পানের দোকান থেকে আসা মহম্মদ রফির কবেকার সব গান। পরনের পোশাক, শরীরের হাড় গোড় পেশী বেশ গরীব গরীব। একটি গল্পের জন্য আজকাল দু' হাজার টাকা পাওয়া যায়। প্লটের খোঁজে হদ্দমুদ্দ হওয়ার ফাঁকে এই স্ট্যাণ্ড, ওই রিকশাঅলা। তার বাড়িটি দরমার বেড়ার হলে ঠিক হয়। দরজা ঢেউ খেলানো টিনের। এইটুকু বাবুয়ানিই যেন। টালির চালে ফাটল থাকলে ভালো, যা পয়সার টানাটানিতে ঠিক করা যাচ্ছে না। এবার গল্পটা দু' রকম হওয়া সম্ভব। এক, সারাদিন রিকশা টেনে সন্ধ্যায় দেশি এবং জুয়া। বাড়ি ফিরে যে কোন ছুতোয় ঝামেলা পাকিয়ে বউ পেটানো। তারপর রাত বাড়ে। যেমন সম্ভব পেট ভরে। এরপর কে মারলো আর কে মার খেলো সব গুবলেট হয়ে যায় বিছানায়। পরে পরে বাচ্চা হয়। তাদের ঠিকমতো পোশাক পড়াশোনা জোটে না। তবে বাচ্চা হতেই থাকে। এবং দ্বিতীয় রকম, ক্লান্ত শরীরে রিকশাঅলা টিনের দরজার বাইরে বসে খানিকক্ষণ। হাত পাখা চালায়। মাটির উনুনের পাশ থেকে ঘামে চুবচুবে লাল রঙের বউ মাঝে মাঝে পাশে আসে। জলের গ্লাস। সস্তার চা। বিড়ি। তারপর ওই কোনরকমের পেট ভরানো। বিছানায় অল্প চাঁদের আলো ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে। বর্ষাও তার নিয়মে আসবেই। তার আগে টালি সারানোর পয়সা জোগাড় নিয়ে খানিক আলোচনা। রাত আরও বাড়ে। দুজনে টালির ফাঁক দিয়ে ভাঙা চাঁদ দেখে একটু আধটু। ভাবে, বাচ্চাদের খুব ভালো করে বড় করবে। অনেক বড়। গাড়ি, বাড়ি। ফুলের টবে সাজানো ব্যালকনিতে বসার চেয়ার হবে নিজেদের জন্য। হাতে সুন্দর কাপে সুন্দর চা। আর সেই চায়েও কখনও জ্যোৎস্না এসে পড়বে, রোদ কখনও।
সবজির নূন্যতম দাম ৫০টাকা কেজি। মাছের ২০০। চালের হু হু করে বাড়ছে। আটার চিনির সর্ষের তেলের দরমার বেড়ার ঢেউ টিনের, বাড়ছে। অটো এবং টোটোর পাঞ্জা কষাকষির মধ্যে রিকশাস্ট্যাণ্ডে প্রায় সারাক্ষণই মাঝদুপুর। কাস্টমার টানাটানি করতে হয়। এবং খুব পরিচিত ছাড়া বাকি অন্যদের সাথে ভাড়া নিয়ে দুগগিবাজি না করলে সবদিক সামলে বাঁচা অসম্ভব হয়ে যায়। মদ জুয়ায় ওড়ালেও যায়, না ওড়ালেও যায়। ভাঙা টালির উপর সস্তার প্লাস্টিক। কালুর ঘুগনির দোকান, বণিকের মুদী দোকান, কানাইয়ের সাইকেল সারানোর গুমটি, কোথাও একটা ঢুকিয়ে দিতে পারলে বাচ্চাটা সংসারে কিছু আনতে পারবে। একদম ভোগে চলে যাবে তার চেয়ে তো ভালো।
তো গল্পটা মোটামুটি তৈরি। দুটো রকমেরই পাঠক আছে। তারপর বর্ষা আসে, শরৎ শীত মৌরলা মাছ। পত্রিকা আসে। দু' হাজারের চেক। চড়াই ঘুঘু রিকশা এসব দেশ থেকে উঠে যাবে যে কোনদিন। নিয়মে বসন্ত আসে, গ্রীষ্ম। কোথাও মহম্মদ রফির গান বেজে যায়, অনেক পুরোনো সব গান।


1 comment:
মৈএ পড়লাম সঙ্গে সবগুলোই স্বীকৃত প্রায়
Post a Comment