শম্পা ব্যানার্জি
বুদ্ধ যাত্রা ( তৃতীয় পর্ব)
আমাদের গয়া এক্সপ্রেস ভোর ভোর পৌঁছে দিলো গয়া স্টেশন। তারপর, টাঙা রিক্সা নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ভারত সেবাশ্রম। আশ্রমের দোতলার দক্ষিণ দিকে আমাদের দুটো বড় ঘর দিয়েদিলেন স্বামীজি মহারাজ। একঘরে, মেয়েরা আর বাচ্চারা সবাই। অন্যঘরে পুরুষদের থাকার ব্যবস্থা। সামনে, লাল মেঝের বিশাল চওড়া ঝুল বারান্দা। আমাদের ঘরের পাশে, কোণের দিকে ঘরটায় টেবিলের ওপর নরদা বসালেন মা নিস্তারিণীর একটা এক ফুট উচ্চতার ছবি। আশ্রমের বাগান থেকে আমি ফুল এনে দিলাম। নরদা পেতলের গ্লাসে জল ঢেলে, ছোট পেতলের থালায় নকুলদানা দিয়ে পুজো আহ্নিক সেরে নিলেন। বড্ড ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছে যেন কোনো যৌথ পরিবারের গৃহদেবীর আসন পাতা হোলো। এরপর, প্রসাদ বিতরণ। নকুলদানা আমাদের বরাবরের প্রিয়। কিন্তু, একটা দুটো নকুল দানায় কী আর মন ভরে। মাসিমণির ছোট ছেলে রাজু গিয়ে নরদার নকুলদানার কৌটো থেকে কিছু নকুলদানা ঝেড়ে দিলো। ব্যাস, দাদা এতো রেগে গেলেন তারপর নকুলদানার কৌটো সুটকেসে রেখে তালা দিয়ে, দাদা চাবিটা পৈতে তে বেঁধে নিলেন। এরপর, আমরা আশ্রমের সামনে, রাস্তা পার হয়ে উল্টো দিকের দোকানে আটার লুচি, আর কালো ছোলা আর খোসা সমেত আলুর তরকারি দিয়ে জলযোগ সেরে বাজারে ঘুরতে চলে গেলাম। বড়রা অনেকেই আশ্রমে বিশ্রাম নিতে রয়ে গেলেন।
গয়া, শহরটার বাঁ দিকে বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলা ফলগু নদী আর ডানদিকে শহর। আমার কাছে সবটাই সে মুহূর্তে বড় আশ্চর্যের। এসেছি এমন এক জায়গায়। প্রতিটা মানুষ অজানা ভাষায় কথা বলে। বাজার আছে কিন্তু সে বাজারের রূপ অচেনা। মহিলারা শাড়ি পরেছেন সামনে আঁচল। আমি শুধু ভাবছি এ কোথায় এলাম রে বাবা!
গয়ার বাজারে খুব তামার জিনিস বিক্রি হচ্ছে। ছোট, বড়, মেজো বিভিন্ন সাইজের তামার থালা আর সেই থালার মাঝে একটা পায়ের প্রতিকৃতি। সেই পায়ের মাঝে ফুল পাতার নক্সা। মা, বল্ল ভগবান বিষ্ণুর পদ চিহ্ন। জানলাম, এখানেই বিখ্যাত বিষ্ণুপদ মন্দির। যেখানে পিণ্ডদানে মৃত মানুষের আত্মা মুক্তি লাভ করে। এই কারণেই গয়া বিখ্যাত। নরদা বলতে শুরু করে গয়াসুরের সাধনায় তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু বর দান করেছিলেন। অমরত্বের পরিবর্তে তাঁর শ্রী চরণ মাথায় নিয়ে গয়াসুর ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মাথায় ভগবান বিষ্ণু যে শ্রী চরণ রেখেছিলেন কষ্টি পাথরের ওপর সেই পায়ের ছাপ রয়ে যায়। এই শ্রী চরণেই পিণ্ডদান করা হয়। অবশ্য, আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না পিন্ড কী? বার বার জিজ্ঞাসা করাতে মা আর মাসিমণি অসম্ভব বকে দিলো। আমিও চুপ হয়ে গেলাম। শুধু দিদার জন্য একটা বিষ্ণুর পাদপদ্মের ছবি আঁকা একটা তামার ছোট্ট থালা কিনে আশ্রমে ফিরে এলাম। কেন জানিনা, মনে হয়েছিলো আমার ভক্তিমতী দিদা শ্রীমতি সুনীতিবালা দেবীর ওই থালাটা খুব পছন্দ হবে। আমার মনে আছে পরে আমি যখন দিদার হাতে সেই থালা তুলে দিয়েছিলাম, দিদার দু চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল। বলছে, "ভাই, তুমি জানোনা আজ তুমি আমাকে কী দিয়েছো।"
আশ্রমে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। ওপরে তাকাতেই দেখছি বারান্দায় মেলে দেওয়া মাসিমণির শাড়ি, মায়ের শাড়ি আর মাসিমণির বড় জা জেঠিমণির শাড়ি হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে। আমাদের স্বামীজি খেতে ডাকলেন। আশ্রমের মুগের ডাল, পাঁচমিশালি তরকারি আর ভাত এক সাবেকি লাঞ্চ খেয়ে আমরা ঘরে চলে গেলাম। ভাবতে অবাক লাগে সেই সাবেকি খাওয়া, সাবেকি থাকা সব কিছুর মাঝে আমরা এতোগুলো মানুষ কত আনন্দে দিন কাটাচ্ছিলাম।
রাতে, ভারত সেবাশ্রম আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দের আরতি দেখলাম। অন্যান্য আরতি থেকে এই আরতি আমার কাছে কেমন শক্তিশালী লেগেছিলো।বাবা, বললেন উনিই এই সংঘের প্রতিষ্ঠাতা। রাজকুমার ছিলেন একসময়।
এরপর আমাদের প্ল্যান হোলো আমরা বাইরের হোটেলে খাবো। আমরা বড় রাস্তা পার হয়ে একটু এগোতেই একটা জমজমাট টি পয়েন্ট এলো। সেখানে, একটা বড় হোটেলে আমরা খেতে গেলাম। সেদিনও সবাই নিরামিষ খাবার খেলাম। আমি আর বাবা, হোটেলের লাগোয়া বাইরের দোকান থেকে বিশাল বিশাল রুটি নিয়ে এলাম। কারণ, হোটেলে কোনো রুটির ব্যবস্থা ছিলো না। এই হোটেলে একটা অদ্ভুত লাইট দেখেছিলাম যা আজও ভুলিনি। একটা কাঁচের লাইট তার ভেতর জল ভরা আর সেই জলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আসছে। জলটা ঘুরছে, সবটাই কৃত্রিম। কিন্তু, আমি খাওয়ার ফেলে সেই লাইট দেখতেই ব্যস্ত। আসার পথে বাবা আমাকে একটা কোল্ডড্রিংক খাওয়ালো তার নাম ডবল 7, বোতলের লেবেলে দুটো ইংরেজি সাত 77 এইরকম পাশাপাশি। বেশ লাগলো। আমাদের দলে আমি, বাবা আর মেসো এই তিনজন ছাড়া কেউ কোল্ডড্রিংক পান করে না। আমরা, খাওয়া সেরে আশ্রমে ফিরে এলাম।
ছোট ছিলাম তাই আমার কাজ ছিলো দেখে যাওয়া শুনে যাওয়া। পরের দিন অনেক ভোরে জেঠিমণি, জেঠু, নর দা আর আমার বাবা কোথায় যেন রওনা দিলেন। জেঠিমণি হাও হাও করে কাঁদছেন। কিছুই বুঝতে পারছিনা। সকলের পরনে সাবেকি পোশাক। জেঠিমণি লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। পুরুষ মানুষেরা সকলেই ধুতি পাঞ্জাবি। সকলের মুখ উদাস। জেঠিমণিকে নর দা ধরে ধরে নিয়ে গেলেন। পুরো ব্যাপারটাই আমার কৌতূহলী চোখ জরিপ করে চলেছে। জিগ্গেস করার উপায় নেই। কারণ, আমি আমি জানি সেই মুহূর্তে কিছু জিগ্গেস করতে গেলে মায়ের কাছে বকুনি খাবো। সারাদিন, প্রায় আশ্রমের বাগানেই বিভিন্ন ফুলগাছের সাথে কেটে গেলো। মেসো সেদিন আশ্রমের লাঞ্চ স্পন্সর করে দিলেন। আশ্রমে, খাওয়ার ঘন্টি বেজে গেলো, কিন্তু বাবা, জেঠিমণি, জেঠু কেউ ফিরে এলেন না। আমরা খেতে বসলাম। দেখলাম, সেদিনের খাওয়াটা একটু আলাদা। প্রসাদের রোজকার মেনুতে একটু রঙিন পালক। বেগুনি ভাজা, চাটনী আর পায়েস। যাইহোক, দেখলাম মা আর মাসিমণি খুব একটা ভালো করে খাচ্ছে না। সারাদিন, ধরে একটা কথাই ভেবে চলেছি এই আনন্দ যাত্রায় আজ এতো কালোমেঘ কেন নেমে এসেছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের প্রারম্ভে, বাবা সহ বাকি সবাই ফিরে এলেন। সকলেরই খুব খারাপ অবস্থা কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছেন না। সবাইকে মা, জল মিষ্টি এসব দিলো। তখন চুপিচুপি নর দা কে জিগ্গেস করলাম কী হয়েছে। যা শুনলাম, সেই ছোট মনে আমিও খুব ভেঙে পড়লাম। নরদা বললো, " তোর অমিত(নাম বদলে দিলাম) কে মনে আছে?" আমি বল্লাম হ্যাঁ মনে আছে। জেঠিমণির বড় ছেলে। লম্বা চওড়া সুন্দর দেখতে অমিতদা বছর খানেক আগে, জেঠিমণিরদের যৌথ পরিবারের এক বিশালকায় বাড়ির গৃহপ্রবেশের মাসখানেক আগে, ওই বাড়ির চিলেকোঠায় এসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। তখন নরদা, জানালেন সেদিন ছিলো ওর আত্মার শান্তির জন্য পিন্ড দানের দিন। আর সেই পিণ্ডদান বিষ্ণুপদে হয়নি। কারণ, অপমৃত্যুর পিণ্ডদান বিষ্ণুপদে হয় না। আমাদের শাস্ত্রে আছে ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ। তাই পিন্ড দানের জন্য যেতে হয়েছিলো, আড়াইশো সিঁড়ি ভেঙে সীতা কুণ্ডের কাছে কোন এক পাহাড় ঘেরা জঙ্গল এলাকায়। সেই সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সারা রাস্তা জেঠিমণি ভয়ঙ্কর চিৎকার করে কেঁদেছেন, বলেছেন এমন সন্তান তুই। কোথায় তুই আমাদের কাজ করবি। আর আজ এমন অপমান করে গেলি যে বিষ্ণুর পাদপদ্মে তোর পিণ্ডদান হোলো না। এই ঘটনা শোনার পর সব কিছুই জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেলো। বোঝা গেলো নরদা কেন আমাদের সঙ্গে এসেছেন। বুঝে গেলাম, সেদিন আশ্রমের ভোজটা আসলে ছিলো অমিতদার শ্রাদ্ধের ভোজ। ভারাক্রান্ত মন, বিকেলের এক পশলা বৃষ্টি কিছু ঠান্ডা হাওয়া, ভিজে মনকে আরও ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। আমি জেঠিমণিকে জড়িয়ে বসে রইলাম। জেঠুর চোখ জুড়ে উদাস চাউনি। আর দুটো অবুঝ বাচ্ছা, মাসিমণি র ছোট ছেলে রাজু আর আমার বোন কোনকিছু না বুঝে অনাবশ্যক দৌড়াদৌড়ি হৈচৈ করতে লাগলো।



No comments:
Post a Comment