সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...
দ্বিতীয় বর্ষ।
অলোক বিশ্বাস
বাংলাদেশের কবি রিঙকু অনিমিখের কবিতা প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কবি রিঙকু অনিমিখ। জন্ম ৫ই এপ্রিল ১৯৮২।
পাবনাবাসী হলেও বর্তমানে বাস ঢাকায়।
সম্ভবত বাংলাদেশের শূন্য দশকের কবি। ইতিমধ্যে তাঁর পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে : বিমূর্ত মিউজিয়াম। নিষিদ্ধ সাইরেন। বসন্ত এসে ফিরে যায়। দল বেঁধেছি একা। রিঙকু অনিমিখের প্রেমের কবিতা। সম্পাদনা করেছেন জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রেমের কবিতা ও অন্যান্য। কবিতা লেখা ছাড়াও তিনি একজন চিত্রকর এবং ভাস্কর্য শিল্পী। চারুকলায় তাঁর অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার। ফলতঃ তাঁর কবিতায়ও রঙ তুলির টান। কবিতায় তিনি একটি অন্ধকারের মধ্যে কল্পনা করছেন এমন মহাবিস্ফোরণ, যে বিস্ফোরণে আলোকিত হবে অন্ধকার। প্রতিটি মানুষ খুঁজে পাবে দেশলাই আর পাহাড়ের গা থেকে হিমোগ্লোবিনের লাভা নেমে আসা। এই কল্পনায় উদ্ভটত্ব নেই। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের বিশেষভাবে চিহ্নিত ছবি ধরা পড়ে তাঁর কবিতায়।
টি.এস.এলিয়টের কথা, কবি তাঁর নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, তাঁর সময়কেই লেখেন--- 'A great poet, in writing of himself, writes of his age.' কতো কবির কবিতায় 'পাখি' এসেছে বিভিন্ন প্রতীকে, উপমায়। 'পাখি' এসেছে ধ্বনি প্রতিধ্বনি সহকারে। কবি রিঙকু অনিমিখ পাখির অন্যরূপ দেখলেন যা মানুষের পক্ষে যায় না, বিপক্ষে যায়। কৃষকের উদ্বেগের কারণ এই পাখি। কৃষকের সোনার শস্য ধ্বংস করে পাখিরা। কবি অনিমিখ কয়েনের উল্টো পিঠে লেগে থাকা সর্বনাশটি প্রত্যক্ষ করলেন মানবদরদী হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। গ্রন্থের বিভাব কবিতায় কবির যে ভিন্ন উপলব্ধি দেখেছি 'পাখি' সম্পর্কে, তাঁর 'আমেরিকা' কবিতায় সেই ভিন্ন উপলব্ধি পাঠক পাবেন। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ দখিনা বাতাস বা পুবালি বাতাস ভালোবাসেন। নদীর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে যাঁদের মন দুলে ওঠে উল্লাসে, সেই মানুষই দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর ভালো লাগার বাতাস কতোটা সন্ত্রাসী। কবি পশ্চিম আকাশের মেঘে ও বাতাসে অ্যাটম বমের ভয়ের দৃশ্য দেখতে পান। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের উদ্বেগ এঁকেছেন কবি রিঙকু অনিমিখ তাঁর কবিতায়।
ধর্মের বিভীষিকা যে কী মারাত্মক ভাইরাস, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ ভালো জানে। বিষয়টাকে খুব সহজ ভাষায় এঁকে দিলেন কবি---'ঘর নেই-- সব দরোজা বন্ধ/ধর্মের এক চোখ-- সে ও আজ অন্ধ/মানবতা ছিন্নভিন্ন/শান্তির সাথে ধর্মের সংযোগ বিচ্ছিন্ন।' মানুষের জীবনে ধর্মীয় কুসংস্কার যে কতো বড়ো অভিশাপ, সেটা কবি শিল্পীরা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছেন। 'ধর্মই আজ অধর্মের মূল'--- লিখলেন অনিমিখ। তিনি দেখতে পেয়েছেন, 'আকাশজুড়ে ধর্মের বিভীষিকা।' একটু আগে বাতাসের কথা হচ্ছিল। ধর্মের বিভীষিকা মানুষের নিঃশ্বাসের বাতাসে আগুন ধরায় আর নিঃশ্বাসে ঘা সৃষ্টি করে, কবি দেখতে পান। যে বস্তুর মধ্যে প্রচুর ইতিবাচক, সেই বস্তুই কখনো পরিবর্তিত হয়ে নেতিবাচক, কবি দেখতে পান। তাঁর 'তাচ্ছিল্য' কবিতায় এর নমুনা দেখলাম। প্রাণধারণের জল ভূমিকে বন্যায় প্লাবিত করে দিলে, সেই ভূমিতে মানুষের আর কোনো কর্তৃত্ব থাকে না--- 'সব জলের হাতে চলে যায়।' অথচ এই জলকেই মানুষেরা কতো তাচ্ছিল্য করে। জলের সঙ্গে তুলনা করে সস্তা দরের তুলনা টানে। বাতাসকেও উপেক্ষা করে, কারণ বাতাস চোখে দেখা যায় না। কিন্তু কবির চোখ দেখছে কতো জায়গা দখল করে নিচ্ছে বাতাস। আলোচনায় একটু আগেই দেখেছি, কবি বাতাসকে সন্ত্রাসী বলেছেন। তিনি 'আমেরিকা' শব্দ ব্যবহার করে আসলে বাতাসের সাম্রাজ্যবাদী রূপ দেখতে চেয়েছেন। একই বস্তুর মধ্যে কবিরা দেখতে পান, দ্বৈত সত্তা বা আরো কোনো তৃতীয় সত্তা।
রিঙকু অনিমিখ তাঁর ৭ লাইনের কবিতা 'অন্তরালে'-তে লিখছেন, আপাতভাবে যা ঘেন্না ও ভয়কে নিরূপিত করে, সেটাই আবার কবির প্রিয়কে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারে। একটি শুয়োপোকা দেখে কবির বা অন্য কারো উপরিতলের হৃদয় ভয়ে কুঁকড়ে
যাচ্ছে। সেই সময় কবি প্রাণী জীবনের
বর্ণবৈচিত্র্যের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখছেন এই শুয়োপোকাই মেটামরফসিস প্রক্রিয়ায় বর্ণিল প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
সেই প্রজাপতি আবার যখন অন্য এক সিগনেচারে পরিণত হচ্ছে, তখন কবি লিখছেন--- 'যার চিত্রল ডানায় ভর করে/তুমি স্বর্গে যেতে পারো।' কিন্তু এই স্বর্গ কোন স্বর্গ ? ধর্ম নিরূপিত স্বর্গ নয়। এই প্যারাডাইস সুন্দরের প্যারাডাইস, কবি কল্পিত অনন্য অনুভূতির নাম।
কবি রিঙকু 'মিতভাষী, বলেন কম, বোঝান বেশি'--- কথাটা তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রযোজ্য। তাঁর সহজ করে বলার মধ্যে দূরের আলো আছে। সুদূরপ্রসারী চিন্তায়ন আছে। তাঁর সহজ বাক্যের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ--- 'ক্ষুদিরাম বিপ্লবী ছিলেন না/ছিলেন আলো---', বাক্যটি লিখে ড্যাশ দিলেন আলোটিকে প্রসারিত করতে। তাঁর কবিতার উপভোগ্যতা আছে এই কারণে যে তাঁর বলাগুলো সবই ইঙ্গিতবাহী। সেই ইঙ্গিত সাধারণ পাঠকের অভিজ্ঞতা ব্যবস্থার সঙ্গে বিট্রে করে না। 'আলামত' কবিতার অন্তিম দুটি পংক্তিতে (পারফিউম আর প্রস্রবণের গন্ধে/ঢেকে যাচ্ছে শহরের নিশ্বাস) আর্বানাইজেশনের প্রকৃতি বিরোধী সংকটের চেহারাটি সুন্দর এঁকে দিলেন। ড্রয়িংরুমের সুদৃশ্য ফুলদানিতে মানুষেরা সাজিয়ে রাখছে এমন ফুল, যে ফুলের গন্ধ নেই। শহরের কৃত্রিম আচরণ, কৃত্রিম হৃদয়, কৃত্রিম ভালোবাসা প্রলম্বিত হয়েছে এই পংক্তিদ্বয়ে। দেখতে পাচ্ছি, কবি রিঙকু অনিমিখ ছোটো ছোটো কবিতায় আঁকছেন বড়ো ক্যানভাস। তাঁর 'বসন্ত এসে ফিরে গেছে' গ্রন্থটি স্পষ্টভাবে সেই মানসকেই প্রকাশ করে। ১,২,৩ লাইনের কবিতায়ও কনসেনট্রেটেড হয়েছে কবির দেশচিন্তা, প্রেমচিন্তা। বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের লেখায় কবিতার অন্যতর স্বাধীনতার রূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নতুন শতাব্দীতে। সেখানকার তরুণ কবিরা কবিতার নিজস্ব এসথেটিক্স নিয়ে অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা করছেন আজকে।


No comments:
Post a Comment