Sunday, September 27, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
| নভেলেট |
অরিজিৎ চক্রবর্তী



ডারউইনের চিঠি ~ ৪ র্থ পর্ব 

( ৪ )

দীনেন্দ্রস্ট্রিটে সাধনদের বাড়িতে একটা লম্বা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আসতে হয়। দুপাশে উঁচু পাঁচিলের পলেস্তারা মাঝে মাঝেই ভেঙে পড়ে মাটিতে। দিনের বেলা একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। এই আলোর নিচ দিয়ে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ আরো পাঁচটা পরিবারের। সুরঙ্গ যেখানে শেষ তার ডানদিকে একটি পরিবার।বাঁ দিকে একটি। প্রায় ত্রিশ বছরের বাক্যালাপ বন্ধ। একটু এগিয়ে এজমালি বাথরুম। তার ডানদিকে ও বাঁদিকে দুটো পরিবার। আর শেষ মাথায় সাধনদের দুটো ঘর। মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া।সাধন সম্মোহের কলেজ জীবনের বন্ধু। সেই বন্ধুত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা দীর্ঘ সময়ের। সাধনের মা খুব আন্তরিক এবং সম্মোহের প্রতি অনেকটাই আস্থাশীল। সাধন কিছুটা উড়োনচন্ডী, বামপন্থী ধারায় উদ্বুদ্ধ এবং সব সময় অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা। কাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে, কাকে রক্ত দিতে হবে, আবার কারও মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হবে ইত্যাদি নানান কর্মকান্ডে তার জীবন জীবন্ত। রোজগারের বালাই নেই। চাকরির চেষ্টা নেই। বাবার সামান্য রোজগারে আর কাকিমার ফল্স পিকো বসিয়ে কোনরকমে সংসার চলে। কুড়ি উর্ধ্বো একমাত্র বোন তনিমা। সে মাকে কাজে সাহায্য করে। সুন্দর গানের গলা। তবে গান নিয়ে সেভাবে এগোনো সম্ভব হয়নি আর্থিক কারণে।

কাকিমা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তনিমাকে বিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সম্মোহ এড়িয়ে গেছে। উল্টে বলেছে ওর জন্য ছেলে দেখুন কাকিমা আমরা তো আছি। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সম্মোহ সাধনকে বলেছে একটা চাকরির চেষ্টা কর। মাথার উপর বোন আছে, ওর বিয়ে দিতে হবে।তোর দায়িত্ব অনেক। এবার সংসারের হাল ধর। সাধন সেসব কথায় কান দেয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে সম্মোহ সাধনদের বাড়িতে গেলেই কাকিমার অতিরিক্ত আপ্যায়ণ বারবার সম্মোহকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফলে সম্মোহের ও বাড়িতে যাওয়া ধীরে ধীরে কমেছে।

কিন্তু আজ প্রায় চারমাস পর একবার যেতেই হচ্ছে সাধনের কাছে। দার্জিলিং এর একটা হোটেলে একজন সৎ দায়িত্ববান ম্যানেজার চাই। স্যালারিও ভালো। সম্মোহের পরিচিত রায়চৌধুরীবাবু কথায় কথায় সম্মোহকে এই কাজের জন্য একজন লোক খুঁজে দিতে বলেছিল গতপরশু। শুনেই সম্মোহের সাধনের কথা মাথায় আসে। তাই আজ বিকেলে অফিস ফেরত সে সাধনের কাছে যাচ্ছে। সঙ্গে সাধনের অতি পছন্দের মিত্র ক্যাফের মাছের চপ্। সম্মোহ ভাবছে এবার একটা হিল্লে হবে সাধনের। গান্ডুটাকে দূরে পাঠিয়ে সমাজসেবা আর বিপ্লবের ভূত মাথা থেকে বার করতে হবে।

সম্মোহ যখন ওদের বাড়ির সুরঙ্গে পা বাড়ালো তখন ওই চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বটাকে দেখে বড্ড হাসি পেল সম্মোহের। ভাবলো এই মলিন আলোর নেগেটিভিটি থেকে এবার বেরিয়ে আসবে সাধন। তারপর ধীরে ধীরে ওদের পরিবারের সবাই।

-- "কাকিমা!"

-- "আরে এসো এসো"

-- "সাধন কোথায়?"

--" কোথায় আবার, ক্লাবে গজল্লা করছে! তুমি বসো, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি।"

--" কাকিমা এটা রাখুন। "

---" এটা আবার কি!"

---" মাছের চপ্"

---" কি দরকার ছিল এসবের। তুমি না সত্যি! এই তনিমা দেখ তোর সম্মোহদা কি এনেছে দেখ! তোর পছন্দের মাছের চপ্!"

সাধন ঘরে ঢোকে।

--" কিরে কি খবর? হঠাৎ পথ ভুলে! অনেক দিন এদিকে আসিসনি! অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে নাকি রে!"

--" তা একটু বেড়েছে। শোন না তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে। চাকরি পাকা। দার্জিলিং যেতে হবে। রায়চৌধুরীদের হোটেলের ম্যানেজারি করতে হবে তোকে। ভালো স্যালারি দেবে।"

-- " এই শোন, আমার চাকরি নিয়ে কে ভাবতে বলেছে তোকে। মা তুমি বলছো? শোন শালা বেশি দরদ দেখাস না। আমার মা-তো তোকে আরো অনেক কিছুই বলেছিল। সেটা কি শুনেছিস তুই? আবার দরদ মারাতে এসেছিস। চল শালা ফোট্।"

কাকিমা আর সাধনের বোন পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়। সম্মোহ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওদের বাড়ি থেকে সোজা হনহন করে বড় রাস্তায় এসে পড়ে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজে নিজেই বলতে থাকে, বোকাচোদা লেনিনের নাতি, নিজের পরিবারের কথা ভাবে না। নিজের বোনের কথা ভাবে না। বুড়ো বাপের কথা ভাবে না। শুধু বোনটাকে আমার ঘাড়ে ঝোলানোর ধান্দা! তুই সব জানিস। লীমার কথা জানিস। শালা কুঁড়ে চোদা। একটা কাজের হদিস নিয়ে এলাম। ঠিকই বলেছিল লীমা, " এরা হচ্ছে গুড ফর নাথিং..."

না সাধনদের বাড়িতে সম্মোহ আর কোনদিন যায়নি। শুধু বারবার মনে হয়েছে ওই চল্লিশ পাওয়ারের আলোর সুরঙ্গ গলিটাই ওর জীবনের কাল। অথচ সাধন ছেলে হিসেবে খারাপ নয়। প্রত্যেকের আপদে বিপদে সব সময় পাশে থাকে। দিনের পর দিন অসুস্থ রুগির বেডের পাশে রাত জাগে নিঃস্বার্থ ভাবে। অথচ নিজে কোনো কাজ করবে না।

পৃথিবীর সব মানুষেরই ক্রোমোজোম সংখ্যা ছেচল্লিশ। এই ক্রোমোজোম মানুষের দেহের প্রতিটি কোষের মধ্যেই উপস্থিত। প্যারিসবারে প্রবীরের সঙ্গে মদ খেতে খেতে কেন যে হঠাৎ বারেবারে এই কথা গুলো মনে আসছিল তা বোঝার চেষ্টায় সম্মোহ আর একটা সিক্সটি এম এল চাইলো। বার ডান্সারের প্রতি মুহূর্তের যৌনতা বুঝিয়ে দিতে একটা দশটাকার নোট দিয়ে এলো। একটা সিগারেট ধরালো। তখন সিঙ্গার গান ধরেছে " প্রিয়া তু আপ তো আজা..." আর দুজন বার ডান্সার নাচের তালে তালে তাদের বুকের ঘুলঘুলি প্রর্দশন করছে। আর চারপাশের হুল্লোড় ফূর্তি মানুষ বক্ষদেশ আইসকিউব সব কিছুকেই মনে হচ্ছে এক একটা ক্রোমোজোম।

-- "হ্যালো প্ররররবীর! কি দেখছো ভায়া!"

---" হ্যাঁ, বলো কি বলছো?"

--" তুমি কি বিজ্ঞানের ছাত্র?"

--" হ্যাঁ! কেন গো?"

--" ভালো করে দেখ?"

--" কি দেখবো বস্!"

--- "ক্রোমোজোম! '

---" মানে এই প্যারিসবারটা আর আমরা সবাই ষাটটা ক্রোমোজোমের ধারকবাহক, মানে আই মিন গরুর ষাটটা ক্রোমোজোম!"

---" ভাই মাল খেতে এসে এ্যাতো কিছু মাখায় ঢুকছে না। তোমার শালা নেশা হয়ে গেছে। আর নিও না। চলো ওঠা যাক।"

--- " সাধনেরও ষাটটা ক্রোমোজোম।গরু একটা।"

--- " আরে ছাড়ো। মজা নিতে এসছো। মজা নাও। "

প্রবীর ইশারায় বিল দিতে বলে। সম্মোহ টলতে টলতে টয়লেটের দিকে এগিয়ে যায়। খানিকবাদে ফিরে আসে। পার্সে হাত রাখতেই প্রবীর বাধা দিয়ে বলে, " গুরু আজকের টা আমার।"

সম্মোহ বলে, " নো! নো! দিস ইস নট ফেয়ার। টুডে ক্রোমোজোম ডে! মাই ডে!"

প্রবীর বাধা দিয়ে বিল মিটিয়ে সম্মোহকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। তারপর একটা ট্যাক্সিকে হাত নেড়ে ডেকে নেয়।"

No comments: