ডারউইনের চিঠি দ্বিতীয় পর্ব
জাহাজটি থিসিউসের।বন্দর ছেড়েছিল অনেককাল আগে। তারপর থেকে যুদ্ধে যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে এক সময়ে এক অচেনা বন্দরে আটকে পড়ে। এবং জীর্ণ হতে থাকে। আস্তে আস্তে মেরামতিও চলে। প্রথম বদল হয় মাস্তুল, কিছুদিন চলে, তারপরে দাঁড়, আবার কিছুদিন, তারপরে একটি করে পাটাতনের কাঠ। প্রতিটি পর্যায়েই তো সেটি থিসিউসের পুরনো জাহাজ থেকে সামান্যই বদলেছে---"একই" জাহাজ বলতে কোন স্তরেই কোন বাধা হয়নি। কিন্তু শেষে যখন তা ফিরে এলো ঘরের বন্দরে তখন আর তাকে চেনা যাচ্ছে না। যে জাহাজটি বন্দর ছেড়ে গিয়েছিল, তা কি অভিন্ন? শুধু ওই " থিসিউস" নামটি ছাড়া। সুতরাং অভিন্নতার কথা বলা যায় না ভিন্নতা ছাড়া।
লীমা জানে তার জীবনেও এরকম অনেক অভিন্নতার আসা যাওয়া। প্রত্যুষ্যের পাখিদের মতোই ভুলের আনাগোনা। আর এই ভুল গুলোকে সে নিজেও ঠিক ভুল ভাবতে প্রস্তুত নয়। জীবনের প্রথম যৌনতা কি ভুল! সম্মোহ কি ভুল!
অভিজ্ঞতা। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা কে "ভুল" শব্দের একটা দায়সারা বিধিবদ্ধতায় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
ঘাটশিলায় সম্মোহের সঙ্গে প্রথম বেড়াতে যাওয়ার শিহরণে এখনো সেই ছবির মতো বুরুডিড্যাম্প মনে পড়ে। সেই দিনের ডাইরির পাতায় লিখে রাখা আশ্রয় এতদিনে বাদেও অপার শুশ্রুষা দেয়। এই বা কম কি!
২৫.০৩.১৯৯০
------------------
এই চমৎকার ছবির মতো জায়গায় আমরা শেষ অপরাহ্নে নেমেছি। যেদিকে তাকাই চোখ ফেরাতে পারি না। উঁচু নিচু জমি দূরের পাহাড় শালবন অচেনা নীল আকাশ আমার ভেতরটাকে ক্রমাগত ওলটপালট করে দিচ্ছে। আমি বাইরের উঁচু রকটায় দাঁড়িয়ে আছি।রকের নিচে প্রশস্ত লন। ঠিক সামনে গেটের দু'পাশে কয়েকটা শালগাছ। তার ফাঁক দিয়ে ক্রমশ উঁচু হয়ে যাওয়া দিগন্ত দেখা যায়। গেটের বাইরে রাস্তা। রাস্তাটা এখানে প্রায় কচ্ছপের সবচেয়ে উঁচু শিরাটার মতো। তারপর মাইলখানেক ধরে সোজা নেমে গেছে।রাস্তার পরে রেললাইন। কিন্তু লাইনটা দেখা যাচ্ছে না। এখানে এসে হঠাৎ কিরকম খাদের মধ্যে ঢুকে গেছে। একটু আগে একটা মালগাড়ি গেল। আমি শুধু তার চলমান ছাদ দেখতে পেলাম।
এখন অবশ্য চানটান করে বেশ ঝরঝরে লাগছে।সম্মোহ বাথরুমে ঢুকেছে। এখানে এই ছবির মতো জায়গাটায় আমার পরিচিত সমাজ নেই। বস্তুত সেই পরিচিত সমাজ থেকে দিন তিনেকের জন্য আমরা পালিয়ে এসেছি।বুক উজার করা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
আগামীকাল সকাল সকাল বেরোব। যাদুগড়ায় তাপসদার কোয়ার্টারে যাব। দুপুরে ওখানেই খাওয়ার নেমন্তন্ন।
২৬.০৩.৯০
----------------
গতরাতে যা হল তা আমার কাছে পরম পাওয়া। এক্ষেত্রে কোন অপরাধবোধ নেই আমার। বরং বলা ভালো চেতনার অন্ধকারে অজস্র জোনাকির জ্বলানেভা আছে। ম্যাগেলানের মতো একটা পরিক্রমা আছে। সম্মোহ মহুয়ার নেশায় নিজেও যতটা মাতাল হয়েছিল আমিও ঠিক ততটাই মৌনতার পরিপূর্ণ ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম। কোন বিরক্তি ছিল না। বিকৃতি ছিল না। আমরা পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠে ছিলাম।
সম্মোহ বললো, অটো এসে গেছে। চলো বেরোতে হবে।
-- চলো আমি তৈরি।
সকালের বাতাস গায়ে লাগছে। অদ্ভূত শীতলতা অনুভব করছি। ভালো লাগছে। বহুদিন পর এই ভালোলাগা। দূরে রাকামাইন্সের লালচে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছি দহনের দাহ্যতাও এত ইঙ্গিতবাহী হয়!
---- এই ব্রীজটা পেরোলেই রাতমোহনা। আর রে নদীটা দেখছো, এটা সূবর্ণরেখা।
সম্মোহের কথায় অন্যমনস্কতা কাটলো। লীমা জিজ্ঞেস করলো, তুমি তাও কতবার এসেছো এখানে?
-- অগুন্তি। বার তিরিশেক।
তাপসদা এসে গেছি। আরে সাহেব যে! এসো এসো, ভেতরে এসো।মেমসাহেব আপনিও আসুন। প্লিজ। শুনছো ওরা এসে গেছে। তারপর দুহাতে তালি দিয়ে তাপসদার হাসি। একেবারে বাচ্চা ছেলেদের মতো।
--- ও তন্দ্রা আমার মহারানী। তবে চিন্তা করোনা ওনার মধ্যে কোন তন্দ্রা নেই। সদা জাগরুক। আবার হোহো হাসি।
--- লীমা ভেতরের ঘরে এসো। দুই পাগলকে এক হতে দাও।
-- বৌদি, আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?
--- জানবো না ! তোমার দাদাকে সাহেব যেদিন ফোন করে জানালো সেদিন থেকেই লাফাচ্ছে। সাহেব আসবে, সাহেব আসবে। সেই সঙ্গে তোমার কথা। মেয়েটা প্রথম আসবে। ওকে আদর যত্ন করতে হবে। তুমি বসো আমি গরমগরম লুচি ভেজে নিই।
--- বৌদি আমি হেল্প করছি বলো কি করতে হবে?
--- আরে না ভাই। তুমি বসো। হেল্পটেল্প পরে হবে। আগে জলখাবারটা খেয়
নাও। তোমরা আবার বেড়াতে বেরোবে।
-- আচ্ছা, তোমরা হোটেলে উঠলে কেন? আমাদের বাড়িতেই উঠতে। কতো ভালো হতো।
লীমা অপ্রস্তুতে পরে যায়। আমতা আমতা করতে থাকে...
বুঝেছি বুঝেছি এক মুহুর্ত ছাড়বে না তোমাকে। মহা দস্যি ছেলে তো!
লীমা খুব লজ্জা পায়।


1 comment:
বাহ! বেশ লাগল!
Post a Comment