Sunday, September 20, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||
| নভেলেট |

ডারউইনের চিঠি  ৩য় পর্ব 
২৭.০৩.৯০

----------------

আগামীকাল খুব সকাল সকাল উঠতে হবে। ৬.৫০ এর স্টিল এক্সপ্রেস ধরে কলকাতায় ফেরা। আমি বাড়িতে ঢোকার আগে মিথ্যে গুলোকে ঠিক ঠাক সাজিয়ে নেওয়া। ভুল হলেই সমস্যা। সে যাইহোক তাপসদা বৌদিকে খুব মিস্ করবো। এত জমাটি খোলা মনের মানুষ খুব কমই দেখা যায়। আর সম্মোহ আমার জমাট বাঁধা বুকে পাখি হবে উড়বে। শিশুর মতো ঝাঁপাবে। কদিন খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগবে চারপাশ। শরীরের অন্তরালে লাল দাগগুলো হয়তো সেই শূন্যতা পূরণ করবে।

"এ্যাই ডাইরি লেখা থামিয়ে তাড়াতাড়ি এসো। প্লিজ!" -- সম্মোহ বললো।

লীমা মুখ তুলে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো," না যাব না!"

"কেন কেন! কি অপরাধ আমার?"

" মুড অফ্ আমার। মন ভালো নেই।"

-- " আরে আবার আসবো তো! মনখারাপ করো না।"

-- " আচ্ছা, এবার তো একটা সিদ্ধান্ত নাও। বাড়ির জন্য তো অনেক কিছুই করলে। একটু নিজের কথা ভাবো। আমার কথা ভাবো। চলো বিয়েটা করে ফেলি!"

সম্মোহের কথা শুনে লীমা ডাইরির পাতা বন্ধ করে মুহূর্তে সম্মোহের বুকের কাছে বুকের কাছে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

সম্মোহ লীমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো, " এবার তো একটা সিদ্ধান্ত নাও। আর কতদিন এভাবে..."

                            ( ৩ )

আমরা দুটি বিরোধী বাক্যতে আস্থা স্থাপন করতেই পারি। কারণ হয়তো আমরা জানি না কোনটা সঠিক।যেমন মহাবিশ্বে অন্য কোথাও জীবন আছে আবার জীবন নেই। যেমন ঈশ্বর আছেন আবার নেই। সম্মোহ লীমাকে ভালোবাসে আবার ভালোবাসে না। ভাবনার নিটোল সমরূপতা ( Symmetry ) থেকে একসময় মুক্তি পেতে চায় সবাই। তখন বাঁদিকে একটি নদী এবং ডানদিকে নদীর বদলে নৌকো। আরো একটু মুক্তি চাইলে নদী বা নৌকো নয় তাদের আভাসমাত্র, কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্ম। আরো প্রত্যাশী হলে অচিন পাখিটি হয়তো অধিক স্বস্তিবোধ করবে এই ছড়ানো ছিটানো অসংগতির মধ্যে আসা যাওয়ার খেলায়!

অন্ধকার ঘরে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সম্মোহ মনে মনে এসবই ভাবতে থাকে। আজ আর গতকালের মধ্যে কত ফারাক। তবু কোথাও যেন একটা চিরকাল লুকিয়ে আছে। লীমাও হয়তো বিছানায় শুয়ে সম্মোহের কথাই ভাবছে। আজ ও কি লীমা গত পরশুর সেই গোলাপী নাইটিটা পরে শুয়েছে? লীমার টুকটুকে ফর্সা গায়ের রঙটা একেবারে কাশ্মীরি মেয়েদের মতো। আস্তে লীমার সম্পূর্ণ শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সম্মোহের একলা বিছানায় যেন ভাবনার চাঁদ গোলাপী লালায় ভিজে যাচ্ছে। আর লীমার নিটোল স্তন তীব্র শঙ্খের গর্জনে সম্মোহকে কেবলই আক্রান্ত করছে। সম্মোহ ভাবছে লীমাকে ছাড়া একমুহূর্ত কাটানো সম্ভব নয়।‌

হয়তো বহিরঙ্গে আমরা আলাদা আলাদা। একজন X হলে, অন্যজন Y, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু কমন এলিমেন্ট আছে, যা ব্র্যাকেটে থাকে। যৌনতাও সেই কমন এলিমেন্ট। না থাকাটাই অসুস্থতা। আবার বেশি থাকাটাও অসুস্থতা। কিন্তু একলা বিছানায় সিঙ্গুলারিটির গান গাইবে কে! শুধু এখন লীমার মায়াবী মরুপ্রভায় সম্মোহ কাতর। অগত্যা প্রথম যৌবনের হস্তশিল্পই ভরসা!

ভাবনা যেহেতু কোনো বাস্তবতার দাবি করে না, তার চলার পদ্ধতিতে লৌকিক-অলৌকিক পদসঞ্চার মেনে নিতে সম্মোহের কোনো বাধা নেই।

কে.বি. স্যারকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখার পর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল সম্মোহের। ক্লাস ফাইভে ওঠার পর যাঁকে পেয়েছিল সে। নাম ছিল কে. বি. পুরো নাম সম্ভবত কুনাল বিশ্বাস। কবি নামেই বিখ্যাত ছিলেন কেবি। কারণ তিনি কবিতায় অঙ্ক করাতেন। ওঁর কাছেই সম্মোহ প্রথম শুনেছিল ওমর খৈয়াম কবি এবং অঙ্কবিদ ছিলেন।

কবি স্যার বইয়ে লেখা প্রশ্নের বাইরে কবিতায় অঙ্ক বানিয়ে বোর্ডে লিখে দিতেন। কয়েকটা মনে আছে আজও। যেমন—

তিরিশ টাকায় কিনলি খাসি/লোক ছুটেছে একশো আশি/ সবাই বলে খাবে খাবে/ সমান সমান ভাগায় নেবে/ সাতাশ সের ওজন ধর/ কে কত পয়সা দেবে হিসেব কর।

যদিও এটা সাধারণ গুণ-ভাগের অঙ্ক, কিন্তু তখন সের পোয়া ছটাক এবং টাকা আনা পাই-এর হিসেব বেশ জটিল ছিল। কবি স্যার লসাগু, গসাগু থেকে নল চৌবাচ্চার অঙ্ক, সুদ কষা, ক্ষেত্রফল, বাঁশ-বাঁদরের অঙ্ক নিয়েও কাব্য করতেন। কবি স্যারের একটা নল-চৌবাচ্চার অঙ্ক এ রকম—

চৌবাচ্চা ছিল এক প্রকাণ্ড বিশাল/দুই নলে জল আসে সকাল-বিকাল/ এক নলে পূর্ণ হতে বিশ মিনিট লাগে/ অন্য নলে পূর্ণ হয় না আধা ঘণ্টার আগে/ চৌবাচ্চা পূর্ণের সময় করোগো নির্ণন/ দুই নল খুলে দিলে লাগে কতক্ষণ।

লসাগু-গসাগু-র অঙ্কগুলো বিচ্ছিরি লাগত সম্মোহের। একটা বিচ্ছিরি শব্দ আছে বলেই শুধু নয়, কী ঘোঁট পাকানো অঙ্ক সব!

একটা চার্চে এক ঘণ্টা পর পর ঘণ্টা বাজে, একটা স্কুলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্তর ঘণ্টা বাজে, একটা কারখানায় আট ঘণ্টা পর পর সাইরেন বাজে। কখন তিনটে শব্দই একসঙ্গে বেজে উঠবে?

এই ধরনের প্রশ্ন দিয়ে বানানো কবিতার জট ছাড়ানোটা কী ঝকমারি ব্যাপারই না ছিল।
সম্মোহ ভাবে, পাটিগণিতের অঙ্কপ্রণেতারা কী সব প্যাঁচানো ভাবনা ভাবতে পারতেন।

আর জীবনের মারপ্যাঁচই বা কম কি! লীমা বাবা মারা যাওয়ার পর চাকরিটা পায়। ভাই মায়ের দায়িত্ব কাঁধে চাপে। তারপর ভাইয়ের পড়াশোনা মায়ের ভালোমন্দ দেখার সমস্ত দায়িত্ব সে মাথা পেতে নিয়েছে। নিজের কথা বিশেষ ভাবতে পারেনি। বিয়ের কথা উঠলেই মা আপত্তি করেনি ঠিকই, তাও কোথাও যেন উৎসাহের অভাব ছিল। লীমার মা ভয় পেত। লীমা বিয়ে করলে যদি দূরে সরে যায়। যদি পরিবারের প্রতি এতটা দায়িত্বশীল না থাকে। ফলে বিয়ের বিষয়টা  বেশি দূর এগোয়নি।

অথচ লীমার প্রতিটি শর্তে সম্মোহ সায় দিয়েছে। বলেছে অবশ্যই মা- ভাই কে দেখবে। ওদের ভালোমন্দ দেখাটা তোমার দায়িত্ব। তাছাড়া আমি যা রোজগার করি তাতে আমাদের ভালো ভাবেই চলে যাবে। তোমার রোজগারের টাকা মাকে দিও।‌ওরা ভালো থাকুক।

সম্মোহের বাবা এখনো একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। বছর দুয়েক বাদে চাকরি থেকে অবসর নিলেও যা পেনশন পাবেন সেটাও কম নয়। লীমার কথা সম্মোহের বাড়ির সবাই জানে। কেউ তেমন আপত্তি করেনি। একমাত্র ছেলের পছন্দকেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু লীমার বাড়ির এই স্বার্থপরের মতো আচরণে সম্মোহের মা সমালোচনা করতে ছাড়েনি। এ কেমন মা, যে মেয়ের ভালো চায় না। শুধু নিজেদের কথাই ভাবে!

সম্মোহ মাকে আশ্বাস দিয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় দাও। আমি নিজে ওদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলবো। কিন্তু লীমার একগুঁয়েমি সে ভাবনায় খুব একটা পরিণতির দিকে এগোয়নি। লীমা বলছে, আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। তারপর তুমি একদিন এসে মার সঙ্গে কথা বলে যেও। এইভাবে পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গেল। কোনো সুরাহা হলো না। লীমা মাকে এখনো বুঝিয়ে উঠতে পারলো না। এই ঘাটশিলা আসার আগে কত যে সাধ্য সাধনা করতে হয়েছে। লীমা বলেছে, বাড়িতে জানতে পারলে কি হবে! মুখ দেখাতে পারবো না। ওখানে গিয়ে যদি পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! ছিঃ ছিঃ! মুখ দেখাতে পারবো না! তাছাড়া আমি কখনো একা বাড়ির বাইরে রাতে থাকিনি। কি বলে বাড়ি থেকে বেরোব।

সম্মোহ বলেছে, " বলবে বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছি।"

-- "দূর একটা কিছু বললেই হলো। কে বান্ধবী, কোথায় থাকে, আমাদের বাড়িতে এসেছিল কখনো! কি নাম বান্ধবীর। কত প্রশ্নের জবাব দিতে হবে মাকে। আর আমি এতো সাজিয়ে মিথ্যে বলতে পারি না!"

-- "কি পারো তুমি! সিনেমা হলে চুমু খেতে পারো না। সপ্তাহে একদিনের বেশি দেখা করতে পারো না! নিজের বিয়ের জন্য বাড়িতে বিদ্রোহ করতে পারো না। এই না পারা গুলো জীবন থেকে এবার মুছে দাও। দেখবে শান্তিতে থাকবে। এতো অ্যাংজাইটি থাকবে না তোমার। আর তোমার মা যে কিরকম আমি সত্যিই বুঝিনা!"

-- " দেখ আমার মা ভাই নিয়ে কিছু বলবে না!"

--- " কেন? বলবো না কেন?"

--- "ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি বুঝবো।"

---- "আমি কি বহিংস্থ ব্যাপার! অদ্ভূত!..."

---- "অত সব বুঝি না। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করো। আমার জন্য নিজের জীবন ভারাক্রান্ত করবে কেন!"

2 comments:

অনিন্দ্য রায় said...

খুবই ভালো লাগল।

পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়

Boitaroni said...

ধন্যবাদ দাদা।