ডারউইনের চিঠি ( ১৩ পর্ব )
প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার তানজানিয়ার স্যাঁদিম্যান আগ্নেয়গিরিতে ঘটেছিল এক বিস্ফোরণ। আর পুব দিক থেকে আসা ঝঞ্ঝায় লাটোলি সমভূমির উপর দিয়ে এই বিস্ফোরণের কালো ছাইয়ের ঘূর্ণি রয়ে গেল।বর্ষার শুরুও ছিল তখন। এই বৃষ্টি ঘাসের উপর ছাইয়ের আবরণ ফেলল--- ছেয়ে গেল গাছের উঁচু মগডালও। খাবারের খোঁজে আসা প্রাণীরা গেল হকচকিয়ে, আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত। হাতি,গন্ডার, জিরাফের দল পালিয়ে পথ খুঁজছে। লাফিয়ে চলছে খরগোস, অ্যান্টিলোপ আর বড় দাঁতওয়ালা বাঘ। পোকামাকড়ও হামাগুড়ি দিয়ে ছুটছে চতুর্দিকে। ঠিক তখনই আবার অগ্ন্যুৎপাতের ছাই সবকিছু দিল ঢেকে। এই ছাই-ই ভরিয়ে দিল পদচিহ্নের গহ্বর গুলো--- আমাদের আবিষ্কারের জন্য থেকে গেল এসব...
বহু পদচিহ্নের মধ্যে কয়েকটি আমাদের কল্পনাকে আলোড়িত করল। তিনটি জীব বৃষ্টির পরেই ওই সমভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে গেছে। যেন তিনজোড়া মানুষের পা! এই জীবেরা আমাদের মতো খাড়া হয়ে হাঁটত। তাদের পা-গুলো ছিল ঠিক আধুনিক মানুষেরই মতো। এরাই হলো আধুনিক মানুষের অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস, আধুনিক মানুষের সম্ভাব্য পূর্বসূরি। আদিম মানুষের বিস্ময়,আগ্ৰহ বা ভয়ের এই হঠাৎ চলা বেঁচে আছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। লক্ষ-অযুত-হাজার বছর পেরিয়ে সেই মানুষের উত্তরপুরুষ এই আমরা আজও খুঁজছি নিজেদের অস্তিত্বকে। আগ্ৰহ,বিস্ময়ে, ভয়ে,আবেগে।
কখনো কখনো হাতছানি দেয় বিগত জনম। হয়তো আগের জন্ম। হয়তো সেটা এই জন্মেরই প্রারম্ভ।সম্মোহ বুঝতে পারে না। জায়গাটা চেনা মনে হয়! যেন প্রতিটি ধূলিকণা সম্মোহ স্পর্শ করেছে। আবার পরমুহুর্তেই রাস্তাঘাট, শানবাঁধানো পুকুরপাড়, একটু দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় সেজের বাতি, একটা বারবাড়ি, বৈঠকখানার কড়ি-বরগাওলা মস্ত হলঘর, আবার কোনো অন্দরমহল,পাতকোতলা, একদম উঠোনের সঙ্গে লাগোয়া ছোট রোয়াক পেরিয়ে ব্যারাকের মতো রান্নাঘর-- এই সব কিছু আবছা লাগে, অচেনা মনে হয়। অচেনা মনে হলেও সম্মোহ বুঝতে পারে কোনো একদিন এসবের মধ্যে ছিল সে।
কখনো আবার এই স্মৃতিবিলাসকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয়। স্মৃতির যে অংশে কিছু কিছু বিস্মৃতিময় পেলবতা আছে,সম্মোহ সেই নরম ও মায়াবী সময়গুলি দু'হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিতে থাকে।
ঘুম ভেঙে যায়। সম্মোহ ভাবে স্বপ্ন আর ভাবনার কি বিচিত্র গতি! দেখে বৃষ্টি হচ্ছে। নীল ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি হাওয়ার টানে কখনও বা এদিকে যায়, কখনও বা অন্যদিকে। সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে।কালো ও ঘোলাটে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। দিনের শুরুতেই মনে হয়েছিল বেলা ছোট হয়ে আসছে। সময় চলে যাচ্ছে। অথচ এই ষাটর্দ্ধো জীবনে তার কাছে সবই অধিকন্তুর এক্তিয়ারে বলে মনে হয়। সম্মোহের কলকাতার বাড়ির এক প্রতিবেশী ভোরবেলাকার ভ্রমণটি সেরে এসে যখন চা পান করেন, তার কাছে এক কাপ চা অধিকন্তু হলেও অভ্যার্থনাযোগ্য বিবেচিত হয়।
নদীর ধারে জন্ম বলে আজীবন নদীর স্বপ্ন দেখে গেল বন্ধু দিবাকর। শুধু নদী কেন, চারপাশটা বর্ষায় মনে হতো জলছবি। সেই জলের টান রয়ে গেল। কোথাও গিয়ে নদী দেখলে মনটা ভরে যায় দিবাকরের।সে বলে, জলরাশির মধ্যে একটা প্রসারতাই শুধু নয় গভীরতা আছে। এই দুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার চিরদিনের চলা।যাকে বলি স্রোতধারা। দিবাকর এমন জীবন্ত, এমন দুরন্ত যে, তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সব বিবর্ণতার অবসান--- যেন এভাবেই জীবনের কেন্দ্র বিন্দুতে ফিরে আসা। অচলতা নয় গতি, পেছনে নয় সামনের দিকে তাকানো।উৎস থেকে মোহনায়। তারপর অপরিমেয় বারিধি।
আজ দিবাকরের জন্য মনটা ছটফট করছে। সম্মোহ ভাবলো একটা ফোন করবে। অনেকদিন কথা হয়না।
----" হ্যালো দিবাকর! দিবাকর...!"
----" শুনতে পাচ্ছি। বল। কেমন আছিস?"
--- " চলে যাচ্ছে রে! তুই? তুই কেমন..."
---"ভালো নেই রে ! বিস্ময় আর আনন্দ জীবনের মূল কথা! এদুটোই হারিয়ে ফেলেছি। কিছু ভালো লাগে না রে! কোনো কিছু আর ভালো লাগে না!"
---" কেন রে! কি এমন হলো? বুড়োদের মতো কথা বলছিস কেন রে?"
---" ফাটছে তো আমার! তুই বুঝবি কি! ছেলে বিয়ে করে বাচ্চা পায়দা করে ঘাড়ের উপর বসে বসে খাচ্ছে। আর আমার সামান্য কটা টাকা পেনশন। চলে? চালানো যায়?"
----" ছেলে প্যায়দা করে নাতি দিয়েছে। এতো ভালো কথা। এতে এ্যাতো হাহাকার কেন?"
---" তুমি কি আর বুঝবে ভায়া।বিন্দাস আছো। নদের নিমাই হয়ে।"
---" হাহাহাহা..." সম্মোহ হেসে ফেলে ।
----" শোন, ছেলে সঙ্গে সবসময় খিটখিট করা বন্ধ কর। ওকে কিছু টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা করে দে। তুই নিজেও ব্যবসাটা দেখ! "
----" কি ব্যবসা করবে শুনি। কোনো চেষ্টা আছে?খালি বাপের পেছন মারার ফন্দি করছে।"
---" তুই শুধু শুধু ছেলেটার ওপর রাগ করছিস। ওকে দূরে না ঠেলে ওর পাশে থাক। আর যেকোনো দিন আমার কাছে চলে আয়। তোকে নদী দেখাতে নিয়ে যাব।"
---" নদী এখন যদি হয়ে গেছে রে ভাই। তুমি মনে করে ফোন করলি, ভালো লাগলো। কেউ তো ফোন করে না! তুই করিস মাঝে মধ্যেই! যাব রে একদিন যাব। তোর কাছে কটাদিন কাটিয়ে আসবো।"
দিবাকরের সঙ্গে কথা বলে মনটা খারাপ হয়ে গেল সম্মোহের। দিবাকরের নদীতে এখন অজস্র যদির ডিঙি ভাসছে। ছেলেবেলায় যখন কার্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ দেওয়া হতো উঁচু বাঁশের ডগায়, তখন একটা অনুভুতি হতো আকাশের সঙ্গে মাটির একটা সখ্য আছে! আজ দিবাকর ওর ছেলের সঙ্গে সেই সখ্যতা হারিয়ে ফেলছে কেন? জীবনের অপূর্ণতা কোনদিন শেষ হবার নয়! জীবনের সঙ্গে গা ঘেঁষে দিবাকরকেও অনেকদূর যেতে হবে, এই কথাটা দিবাকরকে বোঝানোর খুব প্রয়োজন।
হাতির গল্প শুনিয়েছিলেন সন্ত ফ্রান্সিস। হাতি তার সঙ্গীনী কখনো বদলায় না। তার ওপর তিন বছরে মাত্র পাঁচদিনের জন্য সঙ্গিনীর সঙ্গে সহবাস করে। ষষ্ঠ দিনে পুরুষ হাতি ফের ভিনদেশে পাড়ি দেয়।দিবাকরের কথা ভাবতে ভাবতে হাতির কথাটা মাথায় এলো সম্মোহের।


No comments:
Post a Comment