সম্পাদক~ অদিতি ঘোষদস্তিদার-এর অণুগল্প
আড্ডা নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ই-ম্যাগাজিন অভিব্যক্তি-র সম্পাদক
র্যাডিকাল
ক্লাস টেনে কেমিস্ট্রি ক্লাসে আজ যৌগমূলক পড়াব।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম লেশন প্ল্যানটা।
এখানে পড়াতে গেলে আমাকে বাংলা প্রতিশব্দগুলো ভালো করে মনে রাখতে হয়, নামেই ইংলিশ মিডিয়াম।
আগে গাড়িতেই আসতাম। এখানে জেলাশাসক দপ্তরের আধিকারিক আমার কর্তাটি, অলোক।
আধিকারিক মানে যে অফিসার সেটাও হালে শিখেছি।
হাঁটতে এই রাস্তায় মন্দ লাগে না। আজীবন সেন্ট্রাল কলকাতার মেয়ে আমি।
বিয়ের পর কিছুদিন দক্ষিণে থাকলেও এই রাঙামাটি, দূরে ধূসর পাহাড় আর চারদিকের সবুজ বেশ লাগে।
আদিবাসী প্রধান জায়গা এটা। বছর খানেক আগে অলোক এখানে ট্রান্সফার হয় দু'বছরের জন্যে।
কিন্তু অলোক চাইলো এখানেই কাজ করতে।
বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছে লোকটা জায়গাটা আর এখানে মানুষজনকে।
আমাকে ও চাপ দেয়নি আসার জন্যে। মাসে দু'বার কলকাতা যাচ্ছিল।
আমি ওকে না জানিয়েই এখানে একটা স্কুলে এপ্লাই করি আর কাজটা হয়েও যায়।
আমি আসতে ও খুব খুশি বলাই বাহুল্য।
এলাকায় গত দুই তিন মাস ধরে বেশ গন্ডগোল চলছে।
মাইলের পর মাইল জমি নিয়ে চলবে উন্নয়নের কাজ -- তাতে কাটা পড়বে হাজার হাজার গাছ।
জঙ্গল থেকে আদিবাসীদের সরিয়ে এনে তাঁদের জন্যে আলাদা বাসস্থান আর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে---
এই সব পরিকল্পনা। কিন্তু আদিবাসীরা তাতে একেবারেই রাজি নন, পরিবেশবাদীরাও তাঁদের সঙ্গে সহমত।
চারদিক গত সপ্তাহ থেকে বেশ উত্তপ্ত। তাই অলোক অনেক ভোরে চলে যাচ্ছে অফিসে।
ও পুরোপুরি এলাকার লোকেদের পক্ষে।
আমি একটু গা বাঁচিয়ে চলতে ভালোবাসি।
দু'একবার বুঝিয়েছি ওকে, "কি দরকার বাপু ঝামেলার! বদলি নিয়ে নাও!"
উত্তরে বলেছে, "এদের ব্যথা বুঝলে এ কথা বলতে না!"
ক্লাসে পড়াতে শুরু করলাম, "আজ তোমাদের মূলক বা radical পড়াবো।"
সংজ্ঞা পড়লাম বই থেকে।
তাকিয়ে দেখি একরাশ
চোখ -তাতে ফাঁকা দৃষ্টি।
বুঝলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেছে।
আবার বোঝাই, "প্রকৃতিতে মূলকদের আলাদা করে পাওয়া যায়না।
অন্য পরমাণুর সঙ্গে জুড়েই এদের অস্তিত্ব।"
খুব একটা মাথায় ঢুকল বলে বোধ হলোনা।
"আচ্ছা, এই যে তোমাদের নাক, কান এগুলো আছে তো?"
সমস্বরে হ্যাঁ।
"কিন্তু কোনদিন কি দেখেছো একজোড়া কান আলাদা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বা একটা বোঁচা নাক আর একটা
টিকোলো নাকের সঙ্গে গপ্পো জুড়েছে?"
ক্লাসে হাসির রোল উঠলো। চকচকে চোখ সব।
"মূলকরাও এমনি করে থাকে মিলেমিশে, ওদের আলাদা করা যায় না!"
"ঠিক যেমন জঙ্গল আর আদিবাসীরা, তাই না মিস!"
আমি স্তম্ভিত! বাহ্! বেশ বুঝেছে তো!
"এই তো দারুন বলেছ! কি নাম তোমার!"
"গিরীন মুর্মু!"


No comments:
Post a Comment