অরিজিৎ চক্রবর্তী
ডারউইনের চিঠি ( ১২ তম পর্ব )
এরকম বহু ঘটনার চাক্ষুষ উপলব্ধি সম্মোহ করেছে, এবং আশ্চর্য হয়েছে। ভেবেছে মানুষকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, তাকে উপলব্ধি করতে হয়। উপলব্ধির মধোও যে একটা তেপান্তর আছে! আর সেই তেপান্তরের একটা শীতলতা আছে! যে একবার ভেতরটায় ঘুরে এসেছে সে জানে! এখন সম্মোহও জানে। তার প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার পথে শীতলতার শিউলি ফুল ফোটে! জীবন সাজিতে সবটাই কুড়িয়ে নেয় সম্মোহ।
তবু পরিবেশ সৃষ্টিতেই কাহিনীর অভিনবত্ব এই কথাটিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই নন্দিনী সেনের চিঠিটা বালিশের তলা থেকে আবার বের করলো সম্মোহ। এটা কি প্রেমপত্র! নাকি একজন মধ্যবয়সীয় মহিলার জীবনের হাহাকার!
হাহাকার! কথাটা ভেবেই আবার হাসি পেল সম্মোহের। হাহাকার ছাড়া যে আমাদের জীবনটাই অর্থহীন! হাহাকার আছে বলেই ছবি, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, যৌনতা! মানুষে মানুষে মৌলিকতা! সন্ধ্যার নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে, অনেকটা সময় ধরে তাকিয়ে থাকলে কত রকম হাহাকার ধরা দেয়। আবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। তখন মনে হয় অনন্তের মুগ্ধতায় আমরা কত অসহায়! সম্মোহ চিঠিটা পড়া শুরু করলো।
সুজনেষু সম্মোহবাবু,
আশাকরি ভালো আছেন। আপনার ওখান থেকে ফেরার পর কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল আপনাকে একটা চিঠি লিখি। একবার ভাবলাম চিঠির কথা গুলো হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠাই। কিন্তু লেখা হয়ে উঠলো না। আজ রাতে প্রায় কুড়ি বছর পর কাগজ আর পেনের মধুচন্দ্রিমায় আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। লিখেও ফেললাম। বেশ লাগছে! আপনি আমাকে যেন নতুন একটা জীবন দিলেন!
আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি একটু সাইকো আছি। আমাকে নিয়ে আপনার এই ভাবনা আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে। তোয়ার মুখে কথাগুলো শুনে প্রথমটায় কিছুটা হতাশ হলেও পরে মনে হলো আপনি আমাকে নিয়ে যে এতটা ভাবছেন এটাই আমার ফেলে আসা অতীতের স্পন্দন! চিন্তা করবেন না, আমি আবার আপনার কাছে আসবো। আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনার শরীরের গন্ধ নেব। এরকম বুনো পুরুষ গন্ধ আমাকে বড্ড বেশি ঘনীভূত করে!
শোয়ার ইচ্ছে থাকলে ভণিতা না করে সরাসরি বলবেন। আমার কোন অসুবিধা বা আপত্তি নেই। এবার থেকে অনন্ত আমাকে আপনার মুখটা দেখান। মুখোশ দেখাবেন না প্লিজ।
সম্মোহ এই চিঠির কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। ভাবছে একবার তোয়াকে ফোন করবে। তাপসদাকে বিষয়টা জানিয়ে মতামত নিয়েছে।তাপসদা বলেছে ইগনোর করতে, কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। বরং এগুলোর থেকে দূরে থাকাই ভালো।
অথচ একটা অস্থিরতা কাজ করছে ক্রমাগত। বিষয়ের সঙ্গে নিজের তেমন কোন যোগসূত্র খুঁজে না পেলে যা হয়! সম্মোহের তাই হচ্ছে।অদ্ভূত মহিলা মাইরি। বাল এমন কথা বলছে যেন আমি ওর হারিয়ে যাওয়া নাঙ।না তোয়াকে একটা ফোন করা দরকার। আমি ওকে কি বলেছি সেটা জানা দরকার। সম্মোহ তোয়াকে কল করলো।
---"হ্যালো, নমস্কার আমি সম্মোহ বলছি..."
---" বলুন জামাইবাবু, কেমন আছেন?"
----" জামাইবাবু! এসব কি বলছেন! আমি বাঁকুড়া থেকে সম্মোহ বলছি..."
----" জানি তো! আপনি আমাদের সম্মোহ জামাইবাবু" কথার সঙ্গে হাসির ফোয়ারা।
----" দেখুন বিষয়টাকে আর নেওয়া যাচ্ছেনা। ফাজলামির একটা সীমা থাকে। আমি আপনার জামাইবাবু নই। নন্দিনী ম্যাডাম কি বলেছে আপনাদের!" রাগে সম্মোহ আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
---" নমস্কার। ফোন রাখছি।"
---" জামাইবাবুবুবু..."
সম্মোহ ফোন নামিয়ে রাখল। নাহ্ , এর একটা বিহিত করতে হবে! ছেলেখেলা নাকি!
হাম তুম দোনো জব মিলেঙ্গে...! মোবাইলে রিং বাজছে। আর রিং টোনের বিপরীত প্রান্তে অত্যধিক বিরক্ত হচ্ছে সম্মোহ।
---" হ্যালো, কি হচ্ছে এসব! কি চাই আপনার?"
---"সুমু সুমু শুধু তোমাকে চাই গো। ঝিঙ্কু ঝিঙে তোমাকে চাই"
--- "সুমু মানে?! কি বলছেন এসব!"
---" সুমু আমার আদরের সম্মোহ গো!"
---" আপনি ডাক্তার দেখান। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।"
---" ঠিক বলেছো সুমু। আমি তোমার জন্য পাগল।"
সম্মোহ প্রবল ক্ষেপে গিয়ে ফোনটা রেখে দিল। তারপর নন্দিনী সেনকে ব্লক লিস্টে ফেলল। তাপসদা ঠিকই বলেছে ইগনোর। ইগনোর একমাত্র ওষুধ।
কিন্তু কি এমন ঘটলো যার জন্য নন্দিনী সেন এরকম অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।সম্মোহ কোনো কূলকিনারা পেল না!
রাতে প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ফেসবুক একাউন্টটা খুলতেই দেখল "ধন্যিমেয়ে" গ্ৰুপের একটা নটিফিকেশন। নন্দিনী সেন আর তোয়া গোলপার্কের একটা ক্যাফেতে ক্লিভেজ উন্মুক্ত করে দাঁতক্যালানো কয়েকটা সেল্ফি পোস্ট করেছে। সঙ্গে লেখা " প্রতিদিন সম্মোহিত হই..."
এটা দেখে সম্মোহের গা জ্বলে উঠল। তারপর নিজেকে নিজেই বলল, ইগনোর! কিন্তু মনের ভেতর থেকে কিছুতেই নন্দিনী নামের প্রদাহটা কাটছে না। এর আগেও কত ট্যুরিষ্ট এখানে কাটিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই সম্মোহের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে কি সেই রাতে সম্মোহ নন্দিনীর কাছে কোন বিশেষ সুযোগ নিয়ে ছিলো! সবাই নিজের নিজের রুমে চলে আসার পর, সম্মোহ খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে আসে। খানিক বাদে নন্দিনী ফোন করে সম্মোহকে ডাকে। বলে ঘুম আসছে না। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সম্মোহ নন্দিনীর রুমে গিয়ে দেখে, নন্দিনী এই ঠান্ডায় একটা স্লিভলেস নাইটি পড়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে আছে। সম্মোহ রুমে যেতেই, বিছানায় বসতে বলে। সম্মোহ বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে।
---" আপনি এতো রাতে এলেন, ধন্যবাদ। আসলে আমার ঘুম আসছে না। তাই আপনাকে বিরক্ত করলাম।"
----" সে ঠিক আছে। আপনি ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। আমি আসি।"
----" ইশারা বোঝেন না! আপনি ন্যাকা! আমার কি কিছুই নেই। এত বুড়ি আমি!"
---" কি বলছেন এসব। আপনি নিজেকে শান্ত করুন। ঘুমিয়ে পড়ুন।'"
সম্মোহের মাথাটা নেশায় ঝিমঝিম করছে। কি বলবে আর কি করবে বুঝতে পারছে না! নন্দিনী বিছানা থেকে নেমে একেবারে সম্মোহের চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
---" নাও আমাকে নাও। এরকম সুযোগ পুরুষ মানুষ ছেড়ে দেয়! "
সম্মোহ নন্দিনীকে জাপটে ধরে বুকের উষ্ণতায় মুখ লুকিয়ে ভাবছে, লীমার কথা! মনে হচ্ছে লীমা নামের এক নিশ্চল বাতাস আবর্তময় কঠিন আঘাতে হয়তো এখনই সব এলোমেলো করে দেবে! সম্মোহ কি এই অসীমের ভার বইতে সক্ষম!


No comments:
Post a Comment