Sunday, November 1, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
| নভেলেট |
অরিজিৎ চক্রবর্তী

ডারউইনের চিঠি~( নবম পর্ব )

লীমাকে খিস্তি দেওয়ার পরমুহুর্তেই সম্মোহের খারাপ লাগে। ভাবে বেচারা ভালো মানুষের যা হাল হয় লীমা তাই। তবু ওর প্রতি মাঝে মাঝেই বিরক্তি দানা বাঁধে।লীমার কথা ভাবতে ভাবতে সম্মোহ খানিক অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো যেন প্লেব্যাকে বেজে ওঠে। তবু সম্মোহ আজ ভুলে থাকার উপায় খুঁজে নিয়েছে। এই জঙ্গল তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। একটা নতুন জীবন দিয়েছে।

--" দাদা আপনার নামটা কে দিয়েছিল? খুব আনকমন মিষ্টি নাম!"শতাক্ষীর প্রশ্নে সম্মোহের অন্যমনস্কতা কাটলো।

---"আমার ছোটমাসি। উনি যেমন সুন্দরী তেমন আপডেট সব সময়। ছোটবেলা থেকে দেখছি। এখনো এই সত্তর বছর বয়সেও সব সময় পরিপাটি। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম সবেতেই এ্যাকটিভ।"

---" বাঃ! ওনার তারিফ করতেই হচ্ছে। আপনার লুক কথাবার্তা হাঁটাচলা সবেতেই একটা সম্মোহ দাঁড়িয়ে আছে।"

----" আপনার ওরকম মনে হচ্ছে! আসলে আমি একটা মরিচীকা! দূর থেকেই মায়াবী! কাছে এলেই খাঁ খাঁ শূন্যতা!" সম্মোহ একগাল হাসির ভেতর কথাগুলো বলে চলে।

---" এত ভালো কথা বলতে পারেন আপনি! ফলে আমাদের বলা গুলো হারিয়ে যায়.."

---" পেগটা শেষ করুন। নাকি ভালো লাগছে না? ভালো না লাগলে জোর করে খাওয়ার দরকার নেই। একটু চড়া গন্ধ আছে। সবাই নিতে পারে না।"

--- " ভালোই লাগছে। আচ্ছা ফাস্ট কাটের মাল ব্যাপারটা কি?"

---" আসলে গুড় , চালগুড়ির বাখর, মহুয়া ফল দিয়ে একটা হাঁড়িতে পাঁচ-ছ'দিন জিনিসটাকে পচানো হয়। তারপর আগুনের জালে হাড়ির ওপর হাঁড়ি রেখে প্রথম যে মদটা পাওয়া যায়, ওটাই ফাস্টকাট। বিশুদ্ধ তীব্র মহুয়া। র-খাওয়া যায় না। জল মিশিয়ে নিতে হয়।"

---" আমাদের মতো পাগলের পাল্লায় এর আগে পড়েছেন?"

----" পাগল নিয়েই তো আমার কারবার। পড়েছি পড়েছি, সেসব অনেক কাহিনী আছে! রাতে আপনাদের দুএকটা ঘটনা শেয়ার করবো। চলুন এবার লাঞ্চ করে নিন। বেলা পড়তির দিকে।"

---" হ্যাঁ ঠিক আছে, এবার লাঞ্চ দিতে বলুন।"

---" নন্দিনীদি এত তাড়া কিসের! আর একটু আড্ডা হোক!"

নন্দিনী সেন সবাই কে আদেশের সুরে বলল," না না, আগে লাঞ্চ করে রেস্ট নিয়ে নাও সবাই। রাতের জঙ্গলে আসল মজা! তখন কেলিয়ে গেলে চলবে না।আর খিদেও পাচ্ছে। সম্মোহবাবু লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন।"

খেতে খেতে সবাই রান্নার তারিফ করলো। তারপর যে যার নির্ধারিত রূমে রেস্ট নেবার জন্য চলে গেল। সম্মোহ এই ফাঁকে নিজের খাওয়া শেষ করে আবার লালু কাকাকে খুঁজতে বেরোলো।

সন্ধে নেমে আসছে। জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠছে বুনো গন্ধ আর ঝিঁঝিঁর ডাকে । না লালুকাকার খোঁজ কেউ দিতে পারছে না। আচ্ছা পাগলাচোদা লোক।বাইরের লোকজন আছে আর ও খেল দেখাচ্ছে। ডবির মুরগি ফার্মের কাছে গাড়িটা নিয়ে আসতেই কেলে সন্ধান দিলো লালুকাকার। বললো, " দুপুরে হাঁড়িয়া ভাটিতে ছিল লিটনের সঙ্গে। তারপর লিটনের বন্ধুক নিয়ে জঙ্গলে পাখি মারছিল। এখন গিয়ে দেখ আটচালায় নেশায় ঘুমোচ্ছে।"

কথাগুলো শোনা মাত্রই সম্মোহের মাথাটা রাগে ঝনঝন করে উঠলো। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সোজা আটচালার দিকে এগিয়ে গেল।

শালাকে আজ রাত্রে এক ফোঁটাও মদ দেব না। খেয়ে খেয়ে আশ মেটে না। এসব লোককে আর এখানে রাখা যাবে না। বুড়ো হয়ে মরতে চললো...

---" ও লালুকাকা ওঠো, এখানে কি করছো। চলো। ঘরে চলো"

লালুকাকার কোনো হুঁশ নেই। অচেতন হয়ে ঘুমোচ্ছে। সম্মোহ এবার লালুকাকাকে ঠেলা দিল। ওঠো ওঠো।চলো।

লালুকাকা হুঁ শব্দে আবার অচেতন হয়ে রইলো।সম্মোহ বুঝলো ওর বাড়ি ফেরার মতো হুঁস নেই। তাই এখানে বেশি দেরি না করে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

বাড়ি ফিরে দেখলো কেউ রুম থেকে বাইরে বেরোয়নি। হয়তো তখনো ঘুমাচ্ছে। কারণ, কারো ঘরের ভেতর কোনো আলো জ্বলছে না।সম্মোহ বুলির মা'কে চা করতে বললো। এখন দিনের আলো নেই। চারপাশ ঘন অন্ধকার। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বনফায়ার হবে। অথচ বনমুরগির জোগাড় নেই। ওটা লালুকাকার জোগাড় করার কথা। কিন্তু লালুকাকার যা অবস্থা তাতে আজ কখন যে সে স্বাভাবিক হবে কে জানে! আর একটু পরেই নন্দিনী সেনরা উঠে পড়বে। ওদের আবদার মেটানোই সম্মোহের কাজ। বলা ভালো সম্মোহের বর্তমান রুজিরুটি। এই বিষয় গুলো একদম বুঝতে চায় না লালুকাকা।

বুলির মা চা এনে দিয়েছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সম্মোহ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
এমন সময় একজন মহিলা এসে বলল," সম্মোহবাবু, আমি শর্মিষ্ঠা। সবাই ঘুমোচ্ছে। আর আমার ঘুম না আসার জন্য একা একা বোর হচ্ছিলাম। দেখলাম আপনি বসে আছেন। তাই চলে এলাম।"

---" ভালো করেছেন ম্যাডাম। একটু চা বলি?"

--- "সিওর। আপনার এখানে একা থাকতে বোর ফিল হয় না! ফ্যামিলি কোথায় থাকে?"

---" মা-বাবা কলকাতায়। আর আমি এখানে। এখানকার গাছপালা মানুষজনই আমার পরিবার।"

---" বিয়ে করেননি?"

----" সে আর হয়ে উঠলো না। আপনার কথা বলুন।"

----" গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পড়াশুনা। এখন ছবি আঁকাটাই পেশা। একটি মেয়ে। হাসবেন্ড ডাক্তার।গোলপার্কে থাকি। নন্দিনী আমার স্কুল জীবনের বন্ধু।"

----" ও! আপনি ছবি আঁকেন। খুব ভালো। আপনার ছবি দেখার ইচ্ছে থাকল।"

---" অবশ্যই। আমার একটা ওয়েবসাইট আছে। ওখানে আমার কাজগুলো আপনি দেখে নিতে পারেন। আর নতুন কোন এক্সিবিশন হলে আপনাকে নিশ্চয় জানাবো।"

----" অবশ্যই। আপনার এক্সিবিশন দেখার ইচ্ছে থাকল। ম্যাডাম স্ন্যাক্সে কি খাবেন বলুন। "

---" আপনি যা খাওয়াবেন তাই খাব। আর একটা কথা। আমাকে নাম ধরে ডাকলে খুশি হবো।"

----" মাথায় থাকলো। ধীরে ধীরে হবে। এখন ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে। ওদের কি ডেকে দেবেন এবার!"

----" হ্যাঁ ডেকে দেওয়াটাই ঠিক হবে। আমি ডেকে তুলছি। আপনি ওদের চায়ের ব্যবস্থা করুন।"

সম্মোহ বুলির মা'কে চা বসাতে বলল। শর্মিষ্ঠা যাওয়ার আগে একটা সিগারেট ধরালো। সম্মোহকে অফার করলো। সম্মোহ বললো," থ্যাক্স্ , এই খানিক আগেই খেলাম। আপনি খান। আমি ববং রাতের খাবারের জন্য রান্নাঘরের গাইডলাইনটা বানিয়ে দিয়ে আসি।"

---" অদ্ভুত মানুষ আপনি! এতকিছু মাথায় রাখেন কি করে!"

----" এ আর এমন কি! আপনার ছবি আঁকা কাজ। আমার আপনাদের হসপিটালিটি দেওয়াটাই কাজ।" সম্মোহ হাসতে হাসতে কথা গুলো বলে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে লালুকাকা বিড়ি টানছে।


No comments: