ডারউইনের চিঠি ( একাদশ পর্ব )
ছায়াছবি। এখানে সব হিসেবের মাপকাঠি হল সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম, এখানে দিন মাস বর্ষ অতিক্রান্ত হয় কালের অমোঘ বিধানে নয়, চিত্রসম্পাদকের বিধান অনুযায়ী ছোট একটি ডিজলভ্ বা ওয়াইপ এর মাধ্যমে। এখানে সবচেয়ে বড় বাহাদুরি হল শিল্পীর রং-তুলির সাহায্য না নিয়েই শুধু ছায়ার মায়া সৃষ্টি করে দুই আয়তনের আয়তক্ষেত্রে তিন আয়তনের বিভ্রম জাগানো। অর্থাৎ প্রকাশ ভঙ্গি মৌলিক এবং আঙ্গিক রীতি পদ্ধতি জটিল।এর কাহিনী বিশেষ সংখ্যক পরিচ্ছেদ বা দৃশ্যে বিভক্ত হয় না। এর কাহিনী গড়ে ওঠে পাঁচশো থেকে হাজার দেড় হাজার দৃশ্যাংশ বা শট্ নিয়ে। কিন্তু আমাদের জীবন! পরিকল্পনাহীন একটি মরীচিকাময় বাস্তব।
সম্মোহ কেমন আছে কিংবা কেমন থাকতে ভালবাসে সেটা কি আদেও তার পরিকল্পনার রূপায়ণ? এই প্রশ্নের হ্যাঁ কিংবা না উত্তর হওয়াটা দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীর আলোকচেতন ফিল্মে ধরে রাখার মতন সীমাবদ্ধ নয়। বরং বলা ভালো, কাহিনীর যে জগৎ সে তো ঘটনার সমাবেশ মাত্র নয়, তারও আছে পরিবেশ! সে পরিবেশে নতুন সূর্যের অম্লান হাসিটি প্রতি গৃহকোণ নতুন আলোয়, নতুন আশায় ভরে তোলে, যেখানে গোধূলির ম্লান আভাসে পুঁইমাচা ঘেরা তুলসীতলায় মাটির প্রদীপটি রেখে পল্লীবধূ দেবতার কাছে আকুতি জানায় রুগ্ন স্বামীর হয়ে--- কেঁপে ওঠা প্রদীপের ম্লান আলো তার ভিজে চোখের পাতায় চিকচিক করে। এখানে ঘটনা গৌণ, পরিবেশ মুখ্য।
আর দর্শক! সম্মোহকে নিয়ে সারাদিন গসিপ করা আর্ত চুতিয়া লোকজন! হঠাৎ লোকটা কলকাতা ছেড়ে এখানে কেন? মাওবাদী লয় তো! কিছু একটা রহস্য বটে!
---" বাবু তোমাকে লিয়ে বলছিল!" লালুকাকা বলল।
----" বলুক! কতলোক কত কথাই বলে! তোমার কি কোন প্রশ্ন আছে আমার কাছে?"
----" নাগো! আমার ওসবে সঙ্ নেই। আমি বলেছি, যা বাবুকে গিয়ে বল। আমাকে বলছু কেনে! ও কে জানু! কত বড়বড় লোকের সঙ্গে উঠাবসা! ছবি আঁকে।আটিস্ট বটে!"
পরিবেশ সৃষ্টিতেই কাহিনীর অভিনবত্ব! সম্মোহ এখন তাই পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দিয়েছে! সিগারেট ছেড়ে এখন হুকো খায়। শীতে নিজেই বাড়িতে ওয়াইন বানায়। আর জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কাটুমকুটুম খোঁজার নেশা। মৃত একটা গাছের ডালকে দেখে কি কখনও মনে হয়েছে, সেটা আসলে একটা হরিণ? অথবা অন্য কোনো জন্তু! অনেকেই হয়তো মন দিয়ে সেভাবে খেয়াল করি না। কিন্তু অবনঠাকুর আমাদের এভাবেই দেখতে শিখিয়েছিলেন। এমনকি বাকি অংশ কেটে-ছেঁটে যখন তাকে হাজির করা হয়, তখন আর কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না। এমন ধরনের শিল্পের একটা নামও দিয়েছিলেন তিনি। ‘কাটুম-কুটুম’।
সম্মোহের এই কাটুমকুটুমের নেশা। আমাদের জীবনটাও একটা কাটুমকুটুম। চেনা মানুষ অচেনা লাগে! তার আচরণ স্তম্ভিত করে দেয়! আবার অচেনা মানুষ কতদিনের চেনা। মানুষের ভেতরে যেন ঈশ্বর আর শয়তান একই সঙ্গে হেঁটে বেড়ায়। সেবার জঙ্গলের মাঝখানে রাতের বেলায় বাইক খারাপ হয়ে গেল! সম্মোহ কিছুতেই স্টার্ট দিয়ে চালু করতে পারছে না। এমন সময় বিশুমাতাল টলতে টলতে বাড়ি ফিরছিল। সম্মোহকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
---" বাবু গো, এখন এই অন্ধকারে ঠিক হবেনি। দাও দিকি! আমি ঠেলে দিয়ে যাচ্ছি।"
---" তুই পারবি! এত ভারী গাড়ি ঠেলে লিয়ে যেতে!"
---" খুব পারবো! চিন্তা করোনি। তুমি আমার সাইকেলটি চালিয়ে ঘর যাও!"
সম্মোহ দেখল, বিশু মাতাল এক অলৌকিক শক্তির ক্ষমতায় গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে মাথায় মায়াবী চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছে! আর সম্মোহ বিশুর সাইকেলে তখন ধীরে ধীরে ফেডআউট হয়ে যাচ্ছে।


No comments:
Post a Comment