ডারউইনের চিঠি ( ১০ ম পর্ব )
----" আরে তুমি! খানিক আগে তো উঠতে পারছিলে না! এখানে এলে কিভাবে? আর তোমার আক্কেল জ্ঞান কবে হবে? "
---" বাবু আইছি তো! একটু হেঁড়ে খেয়ে নিলাম। তুমি গেছিলে। হুঁস ছিল নি। ভাগনা লিয়ে এল।"
----" শুন, কাকা আসতে চাইছিল নি। আমি জোর করে লিয়ে এসেছি।"
---" ভাগনা, চুপ দে। মিথ্যা বলবি নি। তোর পুলি মেরে দিব..."
লালুকাকার কথা শুনে ভাগনা খিল খিল হেসে ফেলে। সম্মোহ হাসি চাপতে পারে না। লালুকাকার উপর সমস্ত রাগ জল হয়ে যায়। আসলে লালুকাকা একটা আজব মানুষ। ভালো মানুষ। ওর ওপর বেশিক্ষণ রেগে থাকা যায় না।
---" তোমার জন্য লিয়ে এয়েছি বাবু। বনমুরগী !"
---" বন্ধুক চালিয়ে ধরলে?"
----" তিনটা ধরেছি। আমি বলেছি একটা দিতে হবে। বাবুর জন্য লিয়ে যাব।"
----" তা ভালো করেছো। কিন্তু ওর মাংস কি এখন ঠিক আছে? নষ্ট হয়ে যাবে তো!"
----" আমি ছাড়িয়ে রেখেছি গো লবণ হলুদ মাখিয়ে। নষ্ট হবে নি। এই বুলির মা, মশলা বাটবি। মিক্সিতে করবি নি।বাটা মশলায় ভালো হবে খেতে!"
লালুকাকাকে হাতের কাছে পেয়ে সম্মোহ নিশ্চিন্ত হলো। বলল," তোমরা এদিকটা দেখ, আমি, ওঁরা কি করছে দেখে আসছি।"
নন্দিনী সেন এবং বাকিদের রুমে আলো জ্বলছে। একসঙ্গে অনেকগুলো কন্ঠ ঘরে ফেরা পাখিদের মতো কিচিরমিচির করছে। সম্মোহ এগিয়ে গেল। নন্দিনী সেনের রুমের কাছে আসতেই তোয়া বলল, " দাদা আমি কি দেখতে খারাপ! আপনি নন্দিনীদিকে বাইক রাইড করালেন, জঙ্গল ঘোরালেন! এতক্ষণ সেসব গল্পই শুনছিলাম।"
----" আপনি দেখতে খারাপ হবেন কেন! আপনাকে নিয়ে আমি চন্দ্রালোকিত সফরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আপনি কি সম্মতি দিচ্ছেন?"
সম্মোহের কথা শুনে আবার হাসির ফোয়ারা! তোয়া বলল," কোথায় নিয়ে এসেছো দিদি! এতো রসালো আবিষ্কার! সম্মোহ বাবু, রাত্রির কোলাহলে আপনাকে চাই... কবিতার অজুহাতে আপনাকে চাই... জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে আপনাকে চাই..."
আবার হোহো হাহা হাসি। সম্মোহ এবার একটু লজ্জা পেল। মনে মনে বলল, " ধন্যিমেয়ে!!"
কিন্তু ঘন্টাখানেক বাদে পরিবেশটা যে এতটা অস্বস্তিকর হবে সম্মোহের কল্পনার বাইরে ছিল! রাত প্রায় ১১ টা। সবাই কমবেশি তিন-চার পেগ নিয়ে ফেলেছে। ভালোই আড্ডা চলছিল। গান, ছবি আঁকা, কবিতা, নাটক। অথচ এখন খিস্তির বন্যা বইছে। কাউকেই থামানো যাচ্ছে না। মহিলারা যে নিজেদের মধ্যে এরকম বাওয়াল করতে পারে সম্মোহের জানা ছিল না। কথা হচ্ছিল সুফি মেলা নিয়ে। নন্দিনী সেন প্রতিবছর ওটা এ্যারেঞ্জ করেন। মেলার প্রসঙ্গ উঠতেই ঝগড়াটা দানা বাঁধল!
---" নন্দিনী প্লিজ, আপনি শান্ত হোন। তোয়া, শতাক্ষী প্রত্যেককেই বলছি,প্লিজ... ঝগড়া কলকাতায় গিয়ে করবেন। ছিঃ ছিঃ আপনাদের মতো শিক্ষিত লোকজন সম্পর্কে এখানকার মানুষ কি ধারণা করবেন একবার ভাবুন। অনন্ত আমার সন্মানটা রাখুন..."
----" এইসব জানোয়ারদের আপনি বোঝাতে পারবেন না সম্মোহবাবু! " নন্দিনী সেন বলল।
---" শোন নন্দিনীদি কি বলছে! আমরা জানোয়ার! প্যাকআপ, আর এক মুহূর্ত এখানে নয়!"
----" দিদি বলছিস মাগীটাকে! চল প্যাকআপ। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না! সম্মোহবাবু আপনি আমাদের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। এখনই কলকাতায় ফিরবো!"
সম্মোহ কাউকেই আর শান্ত করতে পারে না। সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে, আগামীকাল সকালে কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করে দেবে। এতরাতে এই জঙ্গলে গাড়ি পাওয়া সম্ভব নয়।
----" শালা মাগী সুফি মেলা মারাচ্ছে। পোস্টার বানিয়ে স্টেজ সাজিয়ে পয়সা দেয়না। আর উনি প্রেসিডেন্ট হয়ে ফুটেজ খাবেন, মিডিয়াকে বাইট দেবেন!"
----" এইইইইই! চুপপপপ! ইতরের দল। আমি প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি। তোরা বলেছিলি!আর ফান্ডতোলার মুরদ আছে তোদের! কত টাকা চাস, বল! এখনই নিয়ে নে।" নন্দিনী সেন উত্তেজিত হয়ে রুমের দিকে ছুটে যান। তারপর হন্তদন্ত হয়ে পার্স নিয়ে বেরিয়ে লনের সামনে এসে ওদের উদ্দ্যেশ্যে টাকা ছুঁড়তে থাকে। সম্মোহ নন্দিনী সেন কে যতটা সম্ভব আটকাতে চেষ্টা করে। তারপর টানতে টানতে গেটের বাইরে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। ---"শান্ত হতে হবে এবার। প্লিজ! কি ছেলেমানুষী হচ্ছে এসব!"
নন্দিনী ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। সম্মোহ নন্দিনী কে বুকের কাছে চেপে ধরে শান্ত করতে চায়।
---" লালুকাকা, এক বোতল জল দিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি।"
সম্মোহের কথা শুনে লালুকাকা জল নিয়ে আসে। সম্মোহ নন্দিনীর চোখে মুখে জলের ছিটে দেয়। তারপর লালুকাকাকে ইশারা করে!
তখনও ভেতরে উত্তেজনা প্রবল। গালিগালাজ চলছে। এরমধ্যে বুলির মা চেচিয়ে ওঠে," হাতি হাতি,হাতি এসেছে। তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে যান। হাতির সামনে পড়লে আর বাঁচার উপায় নেই।"
সবাই বেশ ঘাবড়ে যায়। কেউ কেউ প্রশ্ন করে," কোথায় হাতি! দেখতে পাচ্ছি নাতো! "
---" ওই যে ওই জঙ্গলের ভেতর। একদল হাতি এসেছে। তাড়াতাড়ি ঘরে যান।বিপদ হয়ে যাবে!"
হুইস্কির নেশা প্রায় কেটে গেছে। সবাই পড়িমরি করে যে যার রুমের দিকে যাচ্ছে। আর লালুকাকা বলছে," বেশি চেঁচামেচি করবেন নি। হাতি আইছে!"
--- " এই নন্দিনীদি কোথায় গেল! রুমে নেই তো! " তোয়া বলতে থাকে।
তোয়ার কথা শুনে বাকিরাও নন্দিনীর খোঁজ করে। ততক্ষণে লালুকাকা বিদ্যুতের মেন স্যুইচ অফ করে দিয়েছে। আর সেই সুযোগে সম্মোহ নন্দিনী সেন কে মুখে চাপা দিয়ে তার ঘরে নিয়ে এসেছে।
----" কথা বলবেন না। চুপচাপ থাকুন। হাতি এসেছে। ভয় নেই। আমি আছি।"
নন্দিনী সেন চুপ করে খাটের উপর বসে পড়ে। চাঁদের আলোয় নন্দিনীর কাঁচুমাচু মুখটা দেখে খুব মায়া হয়। ইচ্ছে করে একটা আলতো চুমু খেতে। সম্মোহ দেখে নন্দিনী একটা কিশোরী মেয়ের মতো ভয়ে উৎকন্ঠায় কেমন টুকটুকে ফর্সা মুখটা লাল করে বসে আছে।
---" লালুকাকা হাতিগুলো গেল!"
----" যাইনি গো! কাছেই আছে। "
----" আমাদের ঘরের কাছে?"
----" না গো, একটু দূরে।"
----" আচ্ছা, এবার আলো জ্বালিয়ে দাও!"
অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো জ্বলে ওঠে। একেবারে থমথমে পরিবেশ। শেয়াল ডাকছে। সেই সঙ্গে সমস্বরে কুকুর।
---" এবার ডিনার করে নিন।।"
---" আমার ভয় করছে!"
----" ভয় নেই। হাতির দল অনেকটাই দূরে। ওরা এদিকে আর আসবে না। আপনারা খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ুন।"
প্রত্যেকের ঘরে দরজা লাগানো। কেউ বাইরে নেই। সম্মোহ লালুকাকাকে, রাতের খাওয়ার প্রত্যেকের রুমে পৌঁছে দিতে বলল।
এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। মদ্য মাতালদের থেকে বাঁচার এবং তাদেরকে ঠান্ডা করার এই উপায় লালুকাকার মাথাতেই প্রথম আসে। তবে এখানে সারাবছরের বিভিন্ন সময় হাতি দাপিয়ে বেড়ায়। তাদের নিয়ে এলাকার মানুষদের সতর্কতা ও উৎকন্ঠা দুই থাকে। ট্যুরিস্ট আসা যাওয়ার পথে বনদপ্তরের সাইনবোর্ড দেখতে পায়," হাতি চলাচলের রাস্তা, আস্তে গাড়ি চালান"! সুতরাং এলাকায় যে হাতির আনাগোনা আছে এটা তাদের জানা। গতবছর শীতের ঘটনা তমোঘ্ন সেনগুপ্ত কলকাতা থেকে দু'দিনের ছুটিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর রাতে তুমুল ঝগড়া। কাউকেই শান্ত করা যায়। অ্যাশট্রে, কাঁচের গ্লাস ছোঁড়া থেকে কিছু বাকি নেই।লালুকাকা চেঁচিয়ে উঠলো, "হাতি হাতি, বাবু হাতির পাল! আপনারা চেঁচাবেননি, ক্ষেপে যাবে ওরা..."
মুহূর্তে সবাই চুপ। সেনগুপ্ত বাবুর স্ত্রী ভয়ে কেঁচো। আর চেঁচামেচি নেই। শান্ত চারপাশ।এবারেও সম্মোহ একই ওষুধ প্রয়োগ করতে বলেছিল লালুকাকাকে। কারণ সম্মোহ বুঝেছিল নন্দিনী সেন- দের এই ঝগড়া থামার নয়! বরং বাড়বে। এখন হাতির আতঙ্কে সবাই গুটিয়ে গেছে। সম্মোহ ট্যুরিষ্ট এলেই কথাচ্ছলে হাতির গল্প শুনিয়ে দেয়। হাতি কিভাবে ভোরের অন্ধকারে ছাতু তুলতে আসা নেপু লোহারের বউকে মেরে ছিল! একেবারে সামনের পা দিয়ে চেপে মাথাটা থেতলে দিয়ে ছিল! কিভাবে বিটবাবুকে দৌড় করিয়েছিল! তবে এই ঘটনা গুলো মিথ্যে নয়। কিন্তু নন্দিনী সেনরা থাকাকালীন হাতি আসার ঘটনাটা একটা আস্ত ঢপের চপ্। এই চপ্ বাধ্য হয়েই লালুকাকাকে দিয়ে ভাজাতে হলো। নাহলে মাল গুলোকে থামানো যেত না! পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতো।
নন্দিনী সেনারা যে যার রুমেই ডিনার করেছে। সম্মোহ পরিস্থিতি সামলে কিছুটা নিশ্চিন্ত। এবার লালুকাকাকে সঙ্গে নিয়ে অল্পবিস্তর হুইস্কি সেবন করে ঘুমোতে যাবে। সঙ্গে পর্যাপ্ত চাট থাকার কারণে ডিনার করবে না।
মোবাইলে রিং বাজলো! সম্মোহ হ্যালো বলতেই, " আমি তোয়া বলছি, একবার আসবেন প্লিজ" কাঁদো কাঁদো কন্ঠস্বর!
---" যাচ্ছি" । সম্মোহ নিজেকে নিজেই বলল," বাঁড়া শান্তি নেই! শান্তি সেই যে কবে আন্টির বাড়ি গেল! আর ফিরল না!"
---" বলুন, কি হলো আবার!" সম্মোহ কথা শেষ করে একটু অবাক হলো! দেখলো, সবাই নন্দিনী সেনের খাটের চারপাশে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে!
---" সম্মোহ বাবু আপনি প্লিজ নন্দিনীদিকে বলুন আমাদের ক্ষমা করে দিতে!"
----" সে উনি করে দিয়েছেন! আপনারা ঘুমতে যান। আশেপাশেই হাতির দল আছে। বেশি রাত পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে রাখা ঠিক হবে না!"
নন্দিনী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল," হ্যাঁ রে! তোরা ছাড়া আমার কে আছে! তোদের আমি ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই! যা ঘুমোতে যা!"
সম্মোহ নন্দিনী সেনের দিকে তাকিয়ে বলল," আচ্ছা, গুডনাইট! কাল সকালে ব্রেকফাস্টে আপনার গান শুনবো!"
নন্দিনী প্রসন্নতার ভঙ্গিতে সম্মোহের দিকে তাকালো।যেন চাহুনির গভীরে অনেক তারা লুকিয়ে রেখেছে নন্দিনী!
লালুকাকার সঙ্গে হুইস্কি খেতে খেতে বার বার নন্দিনীর কথা মনে পড়ছিল। লালুকাকা যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে বলে উঠল," পুলি মেরে দিছি বাবু! মাতাল গুলার পুলি মেরে দিছি।"
সম্মোহ হেসে ফেলল। নেশার ভেতর নন্দিনীর পারফিউমের গন্ধটা নাকে এল। লাস্ট পেগটা নিয়ে সম্মোহ লালু কাকাকে বলল," অনেক রাত হলো, এবার শুয়ে পড়।"
একটা সিগারেট ধরালো। ধীর পায়ে নন্দিনী সেনের ঘরের দিকে এগিয়ে চললো। নন্দিনী কি ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখল ভেতরের বড় আলো গুলো নেভানো। নাইট ল্যাম্পের ক্ষীণ আলো জ্বলছে।


No comments:
Post a Comment