সভ্যতা ও প্রেম
১
বাতিল দিনগুলো ধুলোজমা অদৃশ্য একটা ঘরের ভেতর
রেখেছে কেউ।
অতিদীর্ঘ, বামন কিংবা ট্যারাবাঁকা দিন।
কোনো সভ্যতা ধ্বংসের পর আরেকটা সভ্যতার জন্মের ফাঁকটুকু হয়তো এইসব বাতিল দিনগুলো ঠেকা দিয়েই
কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে!
২
সূর্য এমন তেরছা হয়ে আছে,
মানুষ সেই ক্ষীণ অস্বচ্ছ আলোই গায়ে মেখে নেয়।
যেখানটায় বরফ জমে থাকে, তার কাছে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে একটা বেলচা — অনুগত শ্রমিকের মতো।
লম্বা লম্বা ছায়া এ ওর গায়ে এলিয়ে পড়ে আছে,
আমি বিক্ষিপ্তভাবে সেই জায়গাটা খুঁজছি, যেখানে
আমাদের দেখা হয়েছিল, সেখানেই অপেক্ষা করব
তোমার জন্য।
৩
আমি যখন কোথাও নেই, আমার চিহ্নমাত্রও ...
তখনই হাতড়াতে হাতড়াতে একটা জায়গায় হয়তো
জীবনে প্রথমবারের মতো আমাকে তুমি খুঁজে পেলে!
মাৎস্যন্যায়ের আবর্জনার ভেতর থেকে আবিষ্কৃত হবে
নতুন এক সভ্যতার প্রস্তাবনা!
৪
মৃত্যু বেঁচে থাকাকে ঘিরে ফেলেছে।
অন্ধকার যেভাবে ঘিরে আছে নাক্ষত্র উজ্জ্বলতাকে!
মৃত্যু আর পরাজয়ের অনুশোচনা দিয়ে তৈরি বলয়ের
ভেতরে কোথাও আমাদের প্রেম জেগে আছে।
৫
ধ্বসে পড়া একটা দেশের ওপর দাঁড়িয়ে
মৃতপ্রায় কোনো ভাষায় কথা বলে চলব আমরা।
কোনো নৈতিকতার পরোয়া না করে ভালোবাসব।
যেভাবে মরচে পড়া ছোরাও অপেক্ষা করে থাকে,
সন্ধ্যাভাষায় লেখা আমাদের অজেয় প্রেমগাথাও
অর্থোদ্ধারের অপেক্ষায় থাকবে।
এভাবে একটি দৃশ্যের পরিসমাপ্তি হল।
যেভাবে একটা ঢেউ মিলিয়ে যাওয়ার পরও,
তুমি কিছুক্ষণ ঢেউটাকে সেখানেই দেখতে পাও।
আমার ওপর তুমি বিরক্ত হলেই, দেখি
হাওয়ায় তোমার বিরক্তমুখের ছবি ভেসে বেড়ায়।
৭
তোমার দেওয়া অপমান একটা সত্যি রেখার মতো,
তোমারই করা আদরের স্মৃতিগুলোকে
এফোঁড়ওফোঁড় করতে থাকে।
অনেকদিন পর কেউ দেখবে,
তোমার আদরের আঁচড়গুলির পাশেই উজ্জ্বল রেখার মতো অপমানের আঁচড়টি পড়ে আছে।
৮
একাকিত্বে ভরা একটা ঘরে আমি
নিঃসঙ্গ একটা হারমোনিয়ামের ওপর ঝুঁকে পড়ি,
আর হাঁটু মুড়ে তোমার শরীরের রিডগুলিকে একে একে কল্পনা করে ধীরে ধীরে বাজাতে শুরু করি ...
অতীত আর অস্তিত্ব থেকে সুর বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়।
৯
রোদ্যাঁ জানতেন শিল্প দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের শরীরের
একটা নির্ভুল জ্ঞানের ওপর ...
...। নিখুঁত পরিমাপ ও সীমানা।
তোমার দেহের প্রতিটি কোণ, এমনকি মনের বহির্ভাগও
আমার ভালোবাসায় ঝলমল করে উঠবে একদিন।
১০
তোমার পিচ্ছিল গম্যস্থানে প্রবেশ করি, এবং তখনই
আমার সারাশরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে
এক সুরেলা হাহাকার।
তারপর আমাদের আধবোজা চোখের দৃষ্টি, ঠোঁট,
বুক পরস্পরকে বিদ্ধ করতে থাকল।
১১
দুটো আধপোড়া কাঠ কাছাকাছি পড়ে আছে।
আগুনে ঝলসে গেছে তাদের রূপ ভালোবাসা ;
এখন মুখ কালো করে কাছে শুয়ে
দিন গোনারও ক্ষমতা নেই!
১২
একটা ফাঁকা চত্বরের মতো দুপুর, সে আসেনি ...
আমি একা একা নোঙর তুলে আনি, দেখি,
ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের করুণ দাগ!
আবারও পুঁতে দিই আরো গভীরে,
দুপুর একা একাই ফাঁকা চত্বরটা পেরোতে থাকে।
১৩
নাক্ষত্র বিষয়ে কথা বলি, আমরা যখন কাছে আসি,
কল্পনায় আন্দ্রোমিদা পর্যন্ত চলে যাই।
অথচ জীবন ততটুকুও নয়,
যেটুকু সময়ে একটা নক্ষত্র পাশ ফেরে, হাই তোলে ...
এই অন্তরঙ্গতা হয়তো অনুপলমাত্র, একটা ঢেউ!
১৪
যেই তোমার শরীর থেকে লাভা বেরিয়ে আসার উপক্রম হল, আমি সেই কাতর কান্নার দিকে তাকিয়ে
বললাম,
— এইখানে টেথিস সাগর ছিল এককালে আর তার
দু'দিকে দুই প্রবল পুরুষ — সেই দ্বন্দ্বের কাছে
কোনো যুদ্ধই কিছু নয়, সব অস্ত্রই অর্বাচীন!
আমরা এখন একটি স্ফুলিঙ্গ নিয়ে লড়াই করছি মাত্র।
১৫
আমাদের প্রেম কি কোনোভাবে একটা দেশের চিহ্ন বহন করে?
যখন মুখর করে তুলছি একটা ঘর, এত কথা কথা আর কথার ভেতর উঠে আসে কোনো সভ্যতার দায়?
এমনকি শরীর দুটো — যখন তারা নিজের মতো চলতে শুরু করে দেয় এবং মেঝে বিছানা দেওয়াল পর্যন্ত
তোলপাড় করতে থাকে, তখনও কি তারা মনে রাখে প্রাচ্য রীতিগুলিকে?
১৬
আমি মাঝেমাঝেই লগি ফেলে দেখে নিচ্ছি।
কোথাও তল পাই না, কখনো চড়ায় ঠেকে যাচ্ছে লগি।
তুমি কখনো গভীর, কখনো অর্ধমনস্ক।
আমি লগি ফেলেই যাচ্ছি।
জলের উপরিতলে প্রকৃত বাস্তবতা ও একটা গ্রীষ্মকাল।
১৭
এখানে আমরা ছিলাম আর নক্ষত্রদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল।
যখন থাকব না, তখন ওরাও টের পাবে শূন্যতা।
শূন্যতা সেই বহন করবে, যে থেকে যাবে।
হয়তো এই দিনগুলো থাকবে না, গোটা একটা মে মাস,
... হয়তো একটা নক্ষত্রও — তার শূন্যতা!
১৮
ওখানে একটা বৃত্তচাপ পড়ে আছে, একা।
হয়তো অনেক আলোকবর্ষ দূর থেকে আঁকা
আরেকটা বৃত্তচাপ তাকে স্পর্শ করবে একদিন
—আমি কল্পনায় দেখতে পাই সেই ছেদবিন্দু,
নতুন একটা শুরু।
কিন্তু এখন তার প্রতিটি বিন্দুই সম্ভাবনায় কাঁপছে।
১৯
একটা চলমান সভ্যতাকে খুঁড়ে ফেলা হল।
এই সভ্যতার পুরাতত্ত্ববিদ্যা ঝুঁকে পড়েছে খননের ওপর
... এখানে স্নানাগার, নালা, রাস্তা ...
জীবনের টুকরোটাকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যেন জীবাশ্ম!
কিন্তু সেখানে কোনো চিহ্নই ছিল না —প্রেম আর বিশ্বাসের, মমতা আর অপেক্ষার!
২০
একটা রেখার প্রান্ত সময়ের নরম দিকটায় গেঁথে আছে,
অন্য প্রান্ত সম্ভাবনা হয়ে অপেক্ষা করছে।
আমরা কবে আসব, তারপর হেলাফেলায় দিন কাটাতে
কাটাতে হঠাৎই এক সময় রেখাটা তুলে আনব।
২১
তুমি যেন ক্রমেই বদলে যাচ্ছ।
পৃথিবী কোন খেয়ালে তোমাকে এখানে এনেছিল,
আর আমি তোমাকে শুধু ভালোবাসতে চেয়েছি!
এই দুই ভিন্ন রেখার মাঝখানে তোমার
সরে সরে যাওয়া...
কোটি কোটি বছর ধরে শিলা রূপান্তরিত হয়ে চলেছে।
২২
ভোরবেলা, কোনো একটা গর্ত থেকে দিনটা উঁকি দেয়,
আর তখনই প্রথম সূর্যের আলোয় কেউ তার
লম্বা দেহটা টেনে বের করে আনে।
অঙ্গুরিমাল প্রাণীর মতো কুঁচকানো দেহ,
কেউ ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নেয় তার দুপুরটা, হয়তো
বিকেলকে ছোট্ট রোয়াকের মতো বের করে, রাত্রিকে
সে প্রায় সীমাহীন করে তোলে!





1 comment:
Post a Comment