Tuesday, February 25, 2020

অলোক বিশ্বাস

সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস... দ্বিতীয় বর্ষ। পঞ্চম প্রয়াস ।









আবু হাসান শাহরিয়ার-এর কবিতা প্রসঙ্গে কিছু প্রতিক্রিয়া    অলোক বিশ্বাস
বহু কবিতা গ্রন্থের রচয়িতা বাংলাদেশের কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। তিনি আমার সমসাময়িক লেখক। আমাদের জন্ম একই বছরে, ১৯৫৯। কবিতা ছাড়াও তিনি প্রকাশ করেছেন অনেকগুলো কবিতা বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থ, কয়েকটি সম্পাদনা। তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতা সমগ্র। প্রামাণ্য শামসুর রাহমান ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ, এবছর 
পাখিবন্যা হবে, হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ, তোমাদের কাচের শহরে, ইত্যাদি। তাঁর সাম্প্রতিক কবিতার বই 'অসময়ে নদী ডাকে' প্রান্তিক মানুষের সহজ জীবন যাপনের আবহমান ধারার মতো আন্তরিক এবং অকপট। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এই কবিতার বইতে পাঠক পেয়ে যাবেন কথোপকথনের প্রাঞ্জল ভাষা--- 'কত কী খোয়া তো যায়; ট্রেনও গেলে যাবে/ ছটা বেজে পনেরোয় পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে'(ছ'টা বেজে অনন্ত পনেরো)। আবু হাসান শাহরিয়ার বিষয়কে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছেন বলেই, বিষয়ান্তর বা বিষয়হীনতার প্রসঙ্গ ভাবার অবকাশ খুঁজিনি তাঁর কবিতা পাঠের সময়। পাগলাভোলা রোমান্টিক ভিশনভরা চাঞ্চল্যের পরিচয় পেয়েছি তাঁর কবিতায়। নৈসর্গিক বিস্ময়গুলোর প্রতি তাঁর সানন্দ আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় 'অসময়ে নদী ডাকে'র কবিতাগুলোতে। সেই আকর্ষণে নিসর্গের অন্তর্নিহিত আত্মাটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি মগ্নচৈতন্যে। ভালবাসেন স্যাটায়ার লিখতে। কবিসত্তা বিষয়ে গরিমাও কাজ করে কখনো যা অভিব্যক্ত হয়েছে কোনো কবিতার পঙক্তিতে। তাঁর 'শাদাছড়ি' নামক কবিতায় এগিয়ে থাকা আত্মঅহংকারী কবিমনের তীব্রতা প্রকাশিত এরকম পংক্তিতে--- 'আবার হাওড়ে গেলে লঘুচিত্ত কবিদের নাওয়ে ওঠাব না/ ছেঁদো কবি এঁদোজলা খোঁজে।' উল্লিখিত কবিতাগ্রন্থে একটি কবিতায় তিনি 'চাক্ষিক' শব্দটা ব্যবহার করেছেন। যদিও অনাভিধানিক এই শব্দটির ব্যবহার বা প্রয়োগের কৌশলমাত্রা আমার পছন্দের বাইরে থেকে গেলো। পর্যবেক্ষণের মেধাও তাঁর কবিতার উপাদানশক্তি হয়ে ওঠে, তিনি সেই উপাদানের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে লিখছেন--- 'ভাষার আদিতে ধ্বনি; আমার বসতি ধ্বনিমূলে।' আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় খুঁজে পাই বাক্যের ধ্বনিগুণ এবং তা জারিত অন্যান্য কাব্যগুণের স্পার্ক নিয়ে। পৃথিবীর যাবতীয় রূপ, যাবতীয় সুর কবির চেতনাকে রাঙায়, সন্নিবিষ্ট হয় কবিতায় এবং তার বহিঃপ্রকাশ দেখি 'অসময়ে নদী ডাকে' কবিতার বইয়ে। চা বা কফিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জীবনের নিজস্ব বহুরৈখিক বিস্তার অভিব্যক্ত হয়েছে 'চা না কফি' কবিতায়। অপর কবিতা ভাবনা থেকে উঠে আসা হৃদয়নিষ্ঠ উচ্চারণের সক্রিয়তা স্পষ্ট হয়েছে 'ঢেউভাষা' নামক কবিতায়--- 'অভ্যাসবশত আমি নদীর রচনাবলি পড়ি/ পাঠে পাঠে আসমুদ্র ঢেউভাষা শিখি/ শব্দে দিই ধার।' তাঁর এক পংক্তির কবিতা--- 'আমি নই; অন্য কেউ বেঁচেছিল আমার শরীরে' (আত্মা)। এক পংক্তির কবিতার পরিসর পাঠকের ভাবনায় সম্প্রসারিত হতে থাকে মাত্র লেখাটির প্রতি তাকিয়ে থাকলেই।  স্থানিকতাকে কবি গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন। তাঁর স্বপ্নাদেশ, পাঠকের প্রতি, ছায়ালিপি ইত্যাদি কবিতার পাঠ অপর অভিজ্ঞতার স্মারক। কী অসাধারণ পংক্তি দেখেছি 'পাঠকের প্রতি' কবিতায়---'কবি কি সমাস নাকি, পা দোলাবে ব্যাকরণ গাছে ?' কিছু কবিতা টানা গদ্যে। টানাগদ্য কবিতার গতিরূপ স্বাভাবিকভাবেই অন্য কবিতার থেকে আলাদা হবেই।।  'শহীদ কাদরী' নামাঙ্কিত কবিতায় তিনি লিখছেন--- 'কবিরা রাখাল ছিল এই দেশে, এখন ভিখিরি'--- বেশ স্ট্রাইকিং। অগ্রজ কবি শামসুর রাহমানের প্রতি হার্দিক নিবেদনের প্রকাশ ঘটেছে এভাবে---'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা/ তার নামে আজও মাঠে ভাঁটফুল ফোটে/ ঘাটের হিজলও মিছিলে শামিল হয়।' 'অসময়ে নদী ডাকে' কবিতাটির ভেতরে চাপা বেদনাজনিত দীর্ঘশ্বাস মরমিয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে হৃদয়ের বেদনা-পরবর্তী উল্লাস--- 'আমার সাঁতারু-মন নদীর শৃঙ্গাররসে ভাসে।' পশ্চিমা ধরণের  বিনির্মাণ ও বহুরৈখিকতা খোঁজার দরকার পড়ে না তাঁর কবিতায়। বরং বাংলার চিরকালীন পুনঃনির্মিত অন্তর্লীন বহুত্ববিন্যাসি ধারা অনুভব করেছি আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায়। পেয়েছি বাংলার স্বপ্রকৃতিজাত গীতিকবিতার স্পর্শবিন্যাস। 'শুভরাত্রি' কবিতার শেষ দুই পংক্তিতে লিখছেন---' সারাদেশই  বধ্যভূমি; সারাদেশই রায়ের বাজার/ পরশু অনেক দূর; কালই গুলিবিদ্ধ হতে পারি'। কবিতাটি পড়ে মনে ঝলকে গেলো হুমায়ুন আজাদ লিখিত সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থটির কথা 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম'?


No comments: