Tuesday, February 25, 2020

বেবী সাউ

সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস... দ্বিতীয় বর্ষ। পঞ্চম প্রয়াস ।










উড়োচিঠি    বেবী সাউ  

৫৭. 
আমরা লিখতে এসেছি! আমরা কিছু লিখতে চেয়েছি! কেন? খ্যাতির জন্য? পুরস্কারের জন্য? নাকি প্রচুর বিজ্ঞ বলে? নাকি আমাদের মধ্যে এত জ্ঞানের ছড়াছড়ি যে না লিখে ছড়ালে পৃথিবী মূর্খ থেকে যাবে? উঁহু! এর কোনটাই কারণ নয়। কোনটাই আমাদের লেখাকে,  লেখাটি লেখার সময় এসব কারণ প্রভাবিত করে না,  মনেই থাকে না। তারচেয়ে, আমার মনেহয়, লেখা যেন এক সাধনা--- নিভৃত,নিবিড়, নিবিষ্ট সাধনা। চুপচাপ ধ্যানের মতো।  ব্যক্তিগত জীবনের প্রান্তে এসে যখন সেই সাধনার কাছে হাত পেতে দাঁড়াই, একা একা মুখস্থ করি নিজের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব, দেখি নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা, অনুভূতি, অনুভব আর ভীড়, ভীষণ ভীড়ের পৃথিবীতে প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো 'একলা আমি' খড়কুটো ভেবে আঁকড়ে ধরি অক্ষরকে। তখন অক্ষর আমার বন্ধু, ভগবান, মা-বাবা--- অক্সিজেনও। সেই অক্ষরদের নিয়ে আমি আবার বেঁচে উঠি, স্রোতে ভাসতে ভাসতে কুল পেয়ে যাই... ঘর বসত গুছাই। জন্ম জন্মান্তরের সখ্য, নির্ভরতা আমাকে দেয় এই ৫২টি অক্ষর!  বাংলা ভাষা! সাদা একটা পৃষ্ঠা আমাকে মুক্তির আকাশ দেখায়, শান্ত নিবিড় ছন্দ শেখায়--- শেখায় এই মুখোশের পৃথিবীতে একমাত্র অক্ষরই বন্ধু, সখা এবং ঈশ্বর! 

আর তখনই বাংলা ভাষাটি আমার কাছে হয়ে ওঠে বেদমন্ত্র!  

  এই ভাষাটিকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। জানিনা এর কারণ! সে হিসেবে দেখতে গেলে বাংলায়, আমাদের দেশের বাড়িতে আমি থেকেছি মাত্র পনেরোটা বছর। মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই ঝাড়খণ্ডে চলে আসি। এখানেই বাদবাকি পড়াশোনা। আর এখানে পেপারওয়ালা থেকে ঝাড়ুদার... সব্জী মার্কেট থেকে কলেজ ক্যাম্পাস... গেট কিপার থেকে আমার বন্ধুমহল সবাই হিন্দি কিংবা ইংরেজিতে কথা বলে। আমারও ওদের সঙ্গে হিন্দি,  ইংরেজিতেই যা কিছু আলাপ, আয়োজন।  এইযে আমি কবিতা লিখি, এইযে, যাইহোক না কেন, সামান্য লেখালিখি করি আমার বন্ধুরা এসব জানেই না! জানলে হয়ত বলতো--- " ব্যা...ঙ্গো...লী পোয়েম!!!" আমাদের বাড়িতেও কখনও বাংলা সাহিত্যের কোনও জায়গা নেই। বাবা, পিসি, কাকা, দাদু সাহিত্য নিয়ে কখনও দু'লাইনও লেখেননি। বাংলা কবিতা লিখছি বলে, পড়ছি বলে আমার ভাই সবসময়ই আমাকে টিটকিরি মারে...
সুতরাং আমার লেখা সম্পর্কে কিছু জানার জন্য, লেখাগুলো কিছু হচ্ছে কি না জানার জন্য আমাকে ফেসবুকে আসতেই হয়। ফেসবুকেও যে কোনও স্বচ্ছ মতামত পাই, তা নয়... কিন্তু ফেসবুকটাই আমার 'বাংলা জানলা'...বাংলার ওয়েব ম্যাগগুলো আমার সাহিত্য চর্চার উঠোন...লিটল ম্যাগাজিনগুলো না থাকলে আমার এই ছাইপাঁশ লেখা আদৌ কী প্রকাশিত হতো! 

কবি গৌতম বসু একবার আমাকে বলেছিলেন,  'তুমি দূরে থাকো বলেই এত ভালো ভালো কাজ করতে পারছ!' আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, "এখান থেকে বাংলায়  কাজ করাটা একটা বিপ্লব। হাতের কাছে বই নেই, আলোচনা করার লোক নেই, কেউ গাইড নেই, বন্ধু নেই। এমনকি কোনও মাধ্যমও নেই..." কলকাতার সঙ্গেও আমি পরিচিত নই...হয়ত কলকাতায়ও আমি উপেক্ষিত... তাই যখন কাঁদনাগীত নিয়ে কাজ করি তখন কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিল...আমি যখন কবিতা লিখি, কবিতার বই বেরোয় তখন হুমকি দেওয়া হয়... আজেবাজে কথা ছড়ানো হয়... যেহেতু আমি দূরে থাকি, আমার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়মিত এই জগতের ওঠাপড়া থাকে না, এমনকী তাঁরা এটিও জানেন না যে আমি কোন বিষয়ে কতটা অ্যাকাডেমিক পড়াশুনো করে চলেছি ( জানলে হয়ত একটু ভেবে বিরক্ত করতেন) কী যে লাভ এতে! কী হয় এতে! আমরা এত অধৈর্য কেন? আমরা এত ঈর্ষাকাতর কেন সামান্য এই ক'টি অক্ষরের কাছে? পংক্তির কাছে? আমরা কী সুষ্ঠু, নিবিড় সাধনার পরিবেশ তৈরি করতে পারি না? যাতে সকলে মিলে হাঁটতে পারি! একে অপরের অক্ষর শেয়ার করতে পারি! ব্যক্তিগত কেচ্ছা ছাড়িয়ে অক্ষরের আলোয় বন্ধু হয়ে উঠতেও তো পারি!

 আমরা, আমি লিখতে চাই। লেখায় থাকতে চাই। কেননা, লিখতে না পারলে মাথা ধরে, বমি পায়... কষ্ট... কষ্ট...

কিন্তু একটা কথা বলি, এত প্যান্ডেল থাকবে না। এত সানাই থাকবে না, এত গেট টুগেদারও থাকবে না। শত শত সাম্রাজ্য ধুলোয় হারিয়ে যাবে। 
যদি কিছু লিখতে পারি, সেটাই থাকবে, যদি একটিও কবিতা লিখতে পারি, যদি একটিও কখনো....

চিরকাল লেখাই থাকে,  রক্তাক্ত অক্ষরগুলি থাকে, তার জন্য হাঁটুমুড়ে ভিক্ষা করতে হয় সময়ের কাছে, এত জেনে গেলে হয় না। 

কারণ ক্ষমতা এক অশ্লীল ও পঞ্চম শ্রেণির গর্ত মাত্র।

No comments: