Wednesday, December 25, 2019

চিঠি- হিয়া













হিয়া
১.
রুরু,
তোর আমার শহর থেকে দূরে গোলাপি রুমাল রেখে এসেছি আকাশে।গোটা দিন চালসা - নাগরাকাটাতে ঘুরে বেড়িয়েছি পাতালপ্রবেশের রূপান্তর ইচ্ছে নিয়ে।ভোরের বাসে যখন শিলিগুড়িতে এলাম , তখন তিস্তা জেগে গেছে।শিলিগুড়ি জংশনে নামার পর রাস্তার ওপার থেকে সেবক মোড়ের অটোতে মিত্তাল বাসস্ট্যান্ড।বাসস্ট্যান্ডে আলিপুর অথবা বীরপাড়া যাওয়ার বাসে উঠে অবশেষে চালসা।চোখে ঘুম লেগে থাকলেও ,সেবক কালীমন্দির , তিস্তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম চালসার দিকে।চোখে তখন পাহাড়ের ঘোর , মনে তোর।রুরু,আমি তোর থেকে যত দূরে যাই ,তত কাছে থাকি তোর।আচমকা কানে ভেসে এল ড্রাইভার দাদা কাউকে বলছে -" ইন্দুর আসে (আছে), ইন্দুর ! হুই তাকের ভিতর।প্যাকেটটার অনেকটা খায়ে লিসে।বাকীটা বান্দররে দিয়া দাও।" তারপর কিছুক্ষণ ইঁদুর-বাদর নিয়ে গবেষণা চলল বাসের অনেকের।আমি খেয়াল করলাম রাস্তার ধারে বসে থাকা পাল পাল লেজওয়ালা প্রাণীগুলো ছুঁড়ে দেওয়া বিস্কুটগুলো কী অসামান্য দক্ষতায় লুফে নিচ্ছে!বাস থেকে নামার পর ইচ্ছে থাকলেও হাতে ধরে রাখা মোবাইলটা হারাবার ভয়ে ওদের দিকে যাইনি বা ওদের ছবি তুলিনি।রুরু, তুই যখন রেগে থাকিস তোকে ঠিক ওদের মতোই দেখতে লাগে।ওদের মতোই আমার থেকে কেড়ে চিলিফিশ খাস।যাইহোক ,তিস্তানদী - মূর্তিনদী , চালসা ভিউ পয়েণ্ট , কুঠির দিকের রাস্তা , রেলস্টেশন , স্কুল- ফেরত মেয়েটির একলা ঘরে ফেরা ,নাগরাকাটার পথ , বুনো ফুল - একে একে সব নিজের ভেতর ভরতে ভরতে যখন রাতের ডিনারের ডিমের ঝোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম , হোয়াটস অ্যাপে তোর কবিতাটা এল।নির্মোহ না হলেও ,পথিক তো বটেই আমি ! পথিকপ্রাণ মানুষ পথে পথেই রচনা করে তার পথের পাঁচালী , পথের প্রেম তবু তার জন্য নয়।ঘর পথ পথ ঘর - এ কেমন দোটানা আমার ! একটা মোহ আমার এ জন্মে ঘুচবে না , তোর কাছে ঘুমোবার মোহ।এ মোহ ঘুচে গেলে আমার মৃত্যু হোক।আর তা এই তিস্তার জলেই।আর এ আজন্মের মোহ নিয়ে আমি দূরেই থাকতে চাই।আর যে যাই বলুক , এটুকু জেনে রাখ ,আমিই তোর একমাত্র প্রেমিকা যার তোকে ভালোবাসতে তোকেই লাগবে না; নদী - পাহাড় - পর্বত কিছু একটা পেলেই হল , কাজ চালিয়ে নেব।ভালো থাকিস , ভালো রাখিস , নইলে হারিয়ে যাব।
                                                            ইতি
                                                 তোর প্রেমিকা

২.
রুরু ,
এই যে তোকে ভালোবাসি , এও এক ভ্রম।আমার একলষেঁড়ে আমিটা নানান বাহানায় তোকে খুঁজি।রাতের তোর্সার মিঠে হাওয়া যখন আমাকে অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছিল মনে , আমি ভেতরে ভেতরে তোকে ছেড়ে যেতে চাইছিলাম।মাথাভাঙ্গার বাসে চড়ে বসলাম।তুইও তখন বাসে।তবে কোলকাতা থেকে নিজের কাজের শহরের দিকে যাচ্ছিস তখন।আমি মাথাভাঙ্গার দিকে ।কী অদ্ভুত প্যারালাল জার্নি! আমার গোটা জীবনে একটাও ভালোবাসার মানুষ ছিল না বলে তোকে ভালোবাসি , কিন্তু তোর যত্ন - আমার প্রতি দায়িত্ব এসব থেকে পালাতে চাই।আমরা কখনো প্রেম করব না , বন্ধু হয়ে থাকব আজীবন।এই পালানোর স্বভাবটাকে মজ্জাগত করেই আমার উত্তরবঙ্গ সফরের সূত্রপাত।আমার অশ্বমেধের ঘোড়া শহর- গঞ্জ পেছনে ফেলে সুটুঙ্গা নদীকে সঙ্গে করে পরের দিন ভোরে পৌছে গেল মানসাই নদীর ধারে তিনকুনিয়া পার্কে।ওখানে বালিতে পা ডুবিয়ে ফোন করলাম তোকে।জানিসতো আমি আজকাল সব বড়ো ভুলে যাই।এই যেমন এখন মনে পড়ছিল না তোকে ফোন করেছিলাম তখন।পিঠে রোদ এসে লাগছিল।বালির ওপর সাধনায় বসতে ইচ্ছে করছিল ধ্যানযোগে।নিজেকে মেরে ফেলার চাইতে অনেক বেটার সমাধিস্থ হয়ে যাওয়া।পথ চলতে চলতে পায়ে কাঁটা বিঁধেছিল - চোরাকাঁটা।ঠিক তোর মতো।এখন আমার জ্বর।বাসে একা ফিরছি কোলকাতা।এ আমার স্বভাবদোষ - তাই তোকে কখনো আমার শূন্যতা দেখাব না , বরং উদাসীনতার ঘেরাটোপে ফুলের চেয়েও তীব্র ভাত-গন্ধকে বেছে নেব।
এরপর আমি কবিতা হয়ে গদ্যের সভায় গিয়ে বসবো, তুই আমার পায়ে চোরাকাঁটা হয়েই বিঁধে থাক।জ্বর বাড়লে তুই আমার জ্বরের ঘোর হয়ে সঙ্গে থাকিস, প্যারাসিটামল হোস না কখনো।
                                                              ইতি
                                                    তোর প্রেমিকা  
৩.
রুরু ,
আমার ছন্নছাড়া জীবনের নড়াচড়াগুলো তোকে কিছুই বোঝাতে চাইছি না।এই যে খুঁতভরাটমার্কা জীবন , কিছুই বোঝাতে চাইছি না।ওসব মোহ আসে না বলেই মোহ নিয়ে খেলি।আজীবন সমর্পণের নামে তোর হাতে তুলে দিয়েছি নিখুঁত অপেক্ষার হদিশ।এ অপেক্ষায় আস্তানা দুজনেরই।আমি বড্ড স্পষ্ট।আর এই স্পষ্টতা নিয়েই আমার সব চলাচল।আমি বিশ্বাস করি সততা আর সহমর্মিতায়।তুইও তাই বলেই জানি।আপাতত চলেছি পুরুলিয়াতে।ভোররাতে ট্রেনের কামরা বদলালাম আদরাতে।এই কামরাবদলের ফেজটায় নিজেকে কেমন যেন অশরীরী বলে মনে হয়।এক খোপ থেকে আরেক।তা সে যাই হোক , ধেনোমাঠ - ঘাসজমি যাই থাক পাশে আমি তোর রুক্ষতার পাশে মারাত্মকভাবে মানানসই।তুই আমাকে না ছাড়তে চাইলেও আমি তোকে ছেড়ে যাবই।খলিশবাতি জ্বেলে রোজ রাতে কাঁদে যে মেয়ে তাকে আশ্রয় মানায় না।এ বন্ধুত্ব আজীবনের ,হয়তোবা হাজার বছর পার করব আরো। পিয়ানোতে বাজুক রিদম ডিভাইন।
                                                        ইতি
                                               তোর প্রেমিকা
৪.
রুরু,
বিশরী গ্রাম , কুমারী নদী , লোকগান , নতুন বন্ধু , পুরোনো খুশি , সৃজন উৎসব নিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষের অবরোধ , কুর্মীদের প্রত্যাখ্যান এসবই স্মৃতি আমার।সত্যি কথা বলতে তুই জানিস আমার ফেরার কোন ঘর নেই।যে ঘর আছে তা ছাড়বার উপায় নেই ,আর সে ঘরে আশ্রয় নেই।এই ক্রমশ আশ্রয়হীনতায় জেদী মেয়েটা লড়তে লড়তেও কখনো কখনো হার মানে।আজ কিছু বলব না।বলতে চাইছিই না আর।অভিমান ভর করলে যে জেদ চেপে বসে তাতে আর যাই হোক কাউকেই সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।হাঁসের ডিম নিয়ে দিশি জুয়া দেখে এসেছি।আমিও এবার দান দিলাম , তবে তা শূন্য।দেখি কতদূর যাওয়া যায়।খুঁজিস না।আমার চোখে কান্না নয় আগুন দেখেছে যারা , তাদের কাছে নিজের হেরে যাওয়া দেখাতে আসব না কখনোই।নিজের যত্ন নিস।কোলেস্টেরলটা নিয়ন্ত্রণে রাখিস।আপাতত আমার হয় শূন্য, নয় ছক্কা।
                                                                 ইতি
                                                    তোর প্রেমিকা
৫.
রুরু,
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব জানি না,আসলে আমাদের জার্নিটা ঠিক কোথায় কবে শুরু হয়েছিল তা মনে থাকলেও , এটা ঠিক মনে নেই কবে তা গাঢ়তর বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল।এই যেমন মনে নেই , আমি ঠিক কবে একা একা পথে পথে ঘুরতে শুরু করেছিলাম।গোটা সফরটায় অনেকেই প্রশ্ন করেছিল ,' তুমি একা !' হুঁ আমি একা।আসলে দোকার মতো যাদের দেখায় , তারাও একা।এতশত সম্পর্কের জটিলতা দেখেছি যে বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে ঐ 'সম্পর্ক' নামক শব্দটার ওপর।একে অপরের সাথে থেকেও কত নানান সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে দেখছি।ফাঁক আর ফাঁকি রাশি রাশি।কোথাও সমর্পণ নেই , অপেক্ষা নেই।সেই জ্বলজ্বলে আলো নেই।সব কেমন যেন টুনি বাল্ব।তাই বলে এতটুকু পড়ে, টুনির মা গানটা গাস না যেন।যদিও আমি সব শুনি , সব দেখি , সব পড়ি , তবু ভালো মন্দ বলে একটা বিষয় তো আছে নাকি! ভালোটা কেন ভালো তা বুঝতে গেলে আগে মন্দটুকু চিনতে হয়।আমাদের জীবনে তাই ভালোর আগে অনেক কিছু খারাপ ঘটতেই থাকে।এসবের মাঝে আমি নিজেকে তোর প্রেমিকা বলে ঘোষণা করেছি , যদিও আমরা বন্ধুত্বে বিশ্বাসী।আসলে ভালোবাসা ঈশ্বরের মতো।একজন কাউকে সেই আসনটায় বসাতেই হয়।যার জন্য গোটা জীবন একা থাকতে হয় ।তুই কখনো কোনদিন চাইলেও তোর সাথে ঘর করব না , অন্য কারোর সাথেও না।গতকালও এক বন্ধুর চুমুকে প্রত্যাখ্যান করেছি।ঠিক ঐ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল ,তুই বলেছিলি...থাক সেকথা।জানি মনে আছে তোরও।এই মেয়েটা তোরই।আর কেউ কখনো সত্যি ছুঁতে পারবে না।এই অপেক্ষার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কান্না লেপ্টে থাকে এক প্রগাঢ় আনন্দকে ছুঁয়ে।আমি কোলকাতা থেকে দুর্গাপুর হয়ে উত্তরবঙ্গ , পুরুলিয়া হয়ে ফের ঘরে ফিরেছি।বুঝদার বাবা আর অবুঝ মায়ের ঘর আমার।অনেক কাজ জমে আছে , লেখাও।ধীরে ধীরে সবেতেই ফিরছি।কিন্তু এও বুঝতে পারছি , উত্তরের কোন এক মনাস্ট্রিতে আমার মন আটকে গেছে।সেখানে অবশ্য আমার যাওয়া হয়নি।তথাগতদা গিয়েছিল।ওখান থেকে কল করেছিল।আমি সেখানে পৌছতে চাইছি অন্যান্য কবিদের একাকীত্ব- নির্জনতা- বিষণ্ণতা সঙ্গে করে।অথচ আমাকেই গ্রাস করছে ডিপ্রেশন।অন্ধকার ঘরে আটকে ফেলছি নিজেকে।গতকালের বন্ধু আমার ঘরকে ' স্বপ্নের বাসা ' বলেছে।সেই ঘরেই আমি আলো নেভাচ্ছি , ফের জ্বালছিও।পিঠে অনেক কাজের বোঝা , তাই আলো জ্বালছি।অথচ রুরু, আমি তোর বুকের ওপর মাথা রেখে সেই ভোররাতের ঘুমটা গোটা জীবন ঘুমোতে চাইছি।আমার কিছু হয়ে গেলে তুই নাকি আমাকে ছেড়ে কথা বলবি না ! কিন্তু আমি তো আরো আরো শান্ত হয়ে যাচ্ছি।চুপ আরো চুপ।নিঃসারে পথ চলব শুধু।আর বাকীটা সময় মেরুদণ্ডের সেই আলোটা খাব।ওতেই আমার কবিতা আসে ,কবিতাই অর্গাজম আমার।আমি আসলে কোন সুইসাইড নয় ,সেই দীর্ঘ সমাধিতে যেতে চাইছি ,তার আগে পর্যন্ত কাজ আর পথ চলা।আমি হয়তো আর কখনো ফোন করব না।তাই বলে গত পরশুর মতো পথে পথে ঘুরে অন্য কারোর ফোন কেঁড়ে ফোন করিস না।তুই ফোন করলে ধরব ,তবে আমি করব না।এই অপেক্ষাটুকু থাকুক একান্ত আমার হয়ে।আমি মনে মনে চাইলে তোকে আমার কাছে আসতেই হবে।তার জন্য আমাকে মুখে বলতে হবে না।আমার গলার স্বর শুনে যে সব বুঝে যায়, সে নাহয় এটুকুও পারুক। রুরু, তোর জন্য শেষ অব্দি আমি রইলাম।
                                                               ইতি,
                                                   তোর প্রেমিকা

1 comment:

Supratim Rong said...

আমিও কোনো মৃত্যু নয়, সমাধিতে যেতে চাই; আপাতত নিস্বন টুকু থাকুক।