কবিতা ও কিছু কথা সঞ্জয় চক্রবর্ত্তী
দুর্বোধ্য শব্দ দিয়ে তৈরি কবিতা কী কবিতা হতে পারে ? নাকি ওটা শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিকদের মানপত্র হয়ে ওঠে ? কোনটা ঠিক ?
পৃথিবীর বিখ্যাত কবিরা সহজ আর সরল ভাষায় কবিতা লিখে গিয়েছেন এবং এখনও লিখছেন । তাহলে কী মনে হয় ? তাঁরা দুর্বোধ্য ভাষা জানতেন না অথবা জানেন না ?
রবীঠাকুরের "পৃথিবী" আর "আফ্রিকা", এই কবিতা দুটি এবং আরও কিছু লেখা কঠিন তবু দুর্বোধ্য নয় ।
"মেঘনাদ বধকাব্য", "হেক্টর বধকাব্য", "বীরাঙ্গনা কাব্য", "ব্রজাঙ্গনা কাব্য", "তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য", এবং আরও অনেক নাটক, মাইকেল মধুসূদনও লিখেছেন । তা অবশ্যই কঠিন, তবু কখনও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেনি ।
"কপালকুণ্ডলা", "কমলাকান্তের দপ্তর",
"আনন্দমঠ", "দুর্গেশনন্দিনী", "বিষবৃক্ষ"এবং আরও কিছু প্রবন্ধ আর উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীও উজ্জ্বল, তবু দুর্বোধ্য নয় ।
বর্তমানে কিছু কবি নিজেদের কবিতায় দুর্বোধ্য ভাষা ব্যবহার করছেন ক্রমাগত । ঐসব কবিতাগুলো আবার যারা প্রায় বোঝেন না , তারাই বেশি বেশি করে মন্তব্য করছেন আজকাল । আসলে সেইসব পাঠকেরা এটাই বোঝাতে চান যে, "কবি আপনি যা-ই লিখুন না কেন আমরা একবার পড়ে ফেললে ঠিক বুঝতে পারবই"। কিন্তু তারা ভালোই বুঝতে পারেন মনে মনে যে, কবিতা পড়ে তারা আসলে কিছুই বোঝেননি ।
Abstract (ধোঁয়াশা মার্কা) কবিতার চল এখন ভীষণভাবেই বেশি । সম্পূর্ণ লেখাটা পড়ে শেষ করার পরেও আপনি বিন্দুমাত্র কোনো ঘটনাক্রম খুঁজে পাবেন না । অথচ বিষয়ভিত্তিক লেখা, আবার এই কবিরা লেখেন না ।
মনস্তত্ববিদদের ধারণা অনুযায়ী, "যাঁরা সব সময় দুর্বোধ্যতাই ভালোবাসেন, তাঁদের মন ক্রমশঃ দুর্বোধ্য ও জটিল হতে থাকে"। বিশ্বের সেরা কবিতাগুলো কোনোটাই দুর্বোধ্য নয়, হয়তো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কঠিন হতে পারে । এইসব সেরা কবিতাগুলোই বাংলা কবিতার জগতকে একটা শিকলে বেঁধে রেখেছে । সুতরাং এই ধরনের লেখাগুলোর প্রয়োজন আজও সমানভাবে রয়ে গিয়েছে ।
দুর্বোধ্য কবিতার কবি নিজেও অনেকসময় তাঁর কবিতার মর্মার্থ পাঠককে বোঝাতে পারেন না । নিজেও কী নিজের লেখা কবিতা বুঝতে পেরেছেন ? নাকি একটা ঘোরের মধ্যে থেকে এই পৃথিবীর যত বাংলা অভিধান আছে, সেখান থেকে সংগ্রহ করা দুর্বোধ্যভাষাগুলো কৌশল অনুযায়ী সাজিয়ে দিয়েছেন পরপর নিজের কবিতায় । সন্দেহ থেকেই যায় ।
কবিতা সমাজের আপামর মানুষের জন্য । (কিছু মুষ্টিমেয় অগাধ জ্ঞানী আর বিজ্ঞ পাঠকের জন্য নয়) । যে-সব শব্দ বোধের বাইরে থেকে যায়, সেখানে অনুভব জন্ম নেবে কী করে ?
সাধারণ মানুষ যদি কবিতার রস উপভোগ করতে না-ই পারলেন , তাহলে সেই কবিতা রচনার সার্থকতা কোথায় ? কবিতা সর্বজনীন হবে কীভাবে ? অথচ দুর্বোধ্য কবিতা বুঝতে পেরেছেন, দাবি করা ঐসব জ্ঞানী পাঠকগুলোর বেশিরভাগই, কবিতার বই কিনবেন না মোটেও । অথচ মন্তব্য করার একশোভাগ এগিয়ে আসেন এবং এমন সব মন্তব্য-টন্তব্য করেন যে, তিনি বিরাট বুঝে ফেলেছেন এবং ঐ দুর্বোধ্য কবিতাটাই যেন এই সমাজের একটা হৃদপিণ্ড, ঐ কবিতাটি এখন না লিখলে সমাজ এক্কেবারে গোল্লায় চলে যেত ।
সব শেষে একটাই অনুরোধ, কবিতাকে কবিতা বানিয়ে তুলুন, পাণ্ডিত্যের কোনো দলিল নয় ।

No comments:
Post a Comment