মফস্ সলের কবি, কবিতা, কিছু কথা নাসির ওয়াদেন
কবিদের আবার সদর মফস্ সল কেন? প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক । কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতামত অন্যরকম কথা বলে । কবিতা লিখতে গিয়ে অনেকেই অবহেলিত হতে হতে একসময়ে লেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ।কেননা তারা সামান্যটুকু স্বীকৃতি পায় না বলে । কীভাবে কবিতা হয়ে উঠে , কবির কবিতা কেন কবিতা হয়ে উঠে না, তা কিন্তু আলোচনা সাপেক্ষ। টি, এস এলিয়ট বলেছেন, autotelic, কোন প্রচারধর্মী, রাজনৈতিক, সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকবে না, ভাষায় ও রূপে তার নির্মাণ এক " হয়ে ওঠা "-র কাহিনি। ম্যাকলিশ্ যাকে বলেন, A poem should not mean but be. কবি তার ভাব বা আবেগকে ব্যঞ্জনার বিশিষ্টতা দেবার ব্যাপারে প্রমুখন বা foregrounding এর স্মরনাপন্ন হয়ে নানা 'বিচ্যুতি'কে ব্যবহার করে । শব্দকে তার গতানুগতিক অর্থ ও ব্যঞ্জনা থেকে মুক্ত করে নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনার মাত্রা দিয়ে থাকে, তখনই কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটে। তাই আধুনিকতাবাদী কবিদের দৃষ্টিতে চিত্রকল্প বা বাক প্রতিমা কবিতার এক অপরিহার্য অঙ্গ।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, কথাটা হলো গিয়ে যে মফস্বলের কবিদের কবিতা খুব একটা দাগ কাটছে না। তাদের কবিতায় শাণ নেই, ধার ভোঁতা, তাই অকবিতা বেশি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা, " কবি যদি লোভী হয় তাহলে সে কবি নয়, তাহলে সে পথের কাঙাল ", কিন্তু মফস্ সলের কবিরা পথের কাঙাল হয়ে বাঁচতে চায় না, রাজার হালে বেঁচে থাকতেই প্রত্যাশী।বাণিজ্যিক কবি ও সাম্মানিক কবির হওয়ার মধ্যে অর্থগত যে প্রভেদ থাক না কেন, ভাব ও ভাষায় কোন অংশে কমতি নেই, তা মফস্বলের একাংশ কবিদের লেখা প্রমাণ করে । কেউ কেউ বাংলা কবিতার নানা বাক বদল ঘটিয়ে দুরন্ত গতিতে বন্ধুর পথে কবিতাযানকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই।
কালের, সীমানার, অহংকারের স্নিগ্ধসৌধ লোভের বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাস দুর্দান্ত গতিবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে শব্দ ও বাকচিত্রের সমাহারে। চারদিকের অন্ধকার যখন গ্রাস করে সমাজকে, জাতিকে, কবি তখন চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে কি, মসিসিক্ত কলমের আঁচড়ে ভালবাসার শব্দতরঙ্গে প্রেমের ছোঁয়া দিয়ে আগুন ঝরাতে বাধ্য হয়।
" আমি ভিতরে বাহিরে /যেদিকে তাকাই আমি স্বদেশে বিদেশে /যেখানে তাকাই শুধু অন্ধকার শুধু অন্ধকার / পিতামহ আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি ।" প্রশাসক যখন ক্ষমতার লোভে ধৃতরাষ্ট্র হয়ে যায়, তখন কবিকেই জাগতে হয়। "সমাপ্তি পর দেখার ছিল না কিছু অন্ধকার ছাড়া /অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে হামাগুড়ি দেওয়া /কেউ জানে না কতটুকু যেতে হবে, কোথায় বা খুঁজে পাবে মাটি ।"
" অন্ধকার পড়ে আছে সারি সারি আমারই শপথ।" "আমাকে আদর করে অন্ধকার /অন্ধকারে বোঝা দায় এ পার ও পার।" " রাত্রি একাকী হাঁটে স্রোতের উপর /আয়না মুখ দেখাতে চাইছে না আর/ ধর্ষণ সুখ প্রতিটি সকালের /উপভোগ্য " "আমাকে আহত করছে, তবু জানি সে যে নির্দোষ /অপাপবিদ্ধ হাতে ছুঁয়ে ছিল শুধু একটুখানি, ,"" অন্ধকারের মধ্যে ঠায় /মাঘ রজনীর প্রহর জাগি /সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ।""একটু ঠান্ডা হব বলে সেই যে ছায়াগুলো কিনলুম/ভাঙাঘর লীজ দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি" ইত্যাদি অসংখ্য পংক্তি পড়ে পৃথকীকরণ দ্বারা বোঝানো যাবে কোন লেখাটা মফস্ সলের , কোনটা প্রতিষ্ঠিত কবিদের ।
প্রান্তিক কবিদের ক্ষেত্রে যে যে সমস্যা দেখা যায়, তারমধ্যে সংযোগবিচ্ছিন্নতা। শহরের কবিদের যোগাযোগ মাধ্যম খুব স্ট্রং, ফলে প্রচারে অনেক এগিয়ে । কবিতার বই পকেট কেটে খরচ করে প্রকাশ করলেও প্রচার সর্বতোভাবে হয় না, ফলে সেই তিমিরে। এলিট শ্রেণী তাচ্ছিল্য করে, পড়ে দেখে না, ফলে গুণাগুণ বিচার পর্যায়ে উঠেই আসে না । লেখার ক্ষেত্রেও মান উন্নত করার জন্য যে যে গুণাবলী প্রয়োজন তাতেও ঘাটতি থেকে যায় । বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে অধিকাংশের ধারণায় স্বচ্ছতার অভাব , যার ফলে উন্নত মানের লেখা হওয়ার পথে পুষ্টির অভাব থাকছে ।
তাছাড়া সময়ের নিরিখে কবিতার প্রতিনিয়ত বাক বদল হওয়ার যে প্রবণতা অহরহ ঘটছে, সেদিকে লক্ষ না রেখে গতানুগতিক দিকে হেঁটে চলা। বিশ্বসাহিত্য ক্ষেত্রে যে যে বিপ্লব ঘটে চলেছে, মতবাদের নতুন নতুন দিক উদ্ঘাটিত হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি না রাখা, কারণ হিসেবে পঠনপাঠনে জোর না দেওয়া, সহজ সরল শব্দের ব্যবহার, অর্থের ব্যঞ্জনা রূপরীতি, আঙ্গিক ও স্বরগ্রামের দ্বারা সিক্ত করে তুলতে হবে । সেই ভাবনা, আবেগ, উদ্বেগকে প্রতীকী শব্দের ব্যবহার করে, পাঠকের জন্য স্পেস ছেড়ে দিয়ে নতুন নতুন চিন্তাকে সাযুজ্য করে কবিতা গঠন করা হলে কবিতা প্রাণ ফিরে পাবে । মনে করতে হবে কবিতা কবির মনের দরজা, যার মধ্যে প্রবেশ করলে বৌদ্ধিক চিন্তা আর আনন্দের খোরাক । অজস্র বৃষ্টিপতনের মতো শব্দের ভেতর স্নিগ্ধ সবুজ মাটির বুকে শ্রাবণজনিত তৃণভূমিতে কবিতার ডানাময়ূরী পেখম তুলে আনন্দ বিতরণের প্রচেষ্টা করবে।
এই আলপথ ধরে মফস্ সলের কবিদের হাঁটতে হবে। কবিতা হোক আসল পরিচয়, ব্যক্তি নয় ।
আমার বিশ্বাস, আমার ভরসা প্রান্তিক কবিদের একদিন জয় আসবেই । বাংলাসাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করে তুলবে।

No comments:
Post a Comment