Wednesday, December 25, 2019

বাংলাদেশের কবি নিয়ে কথা-

কামরুল বাহার আরিফের সাম্প্রতিক কবিতা পাঠের অনুভূতিমালা              অলোক বিশ্বাস

বাংলা  কবিতায় প্রেম বহুস্বরে ও বহুসুরে আবহমান কাল ধরে পেয়েছি আমরা। সে তার রঙ-রেখাকে এক হৃদয়ের উৎস হতে অন্য হৃদয়ে বিস্তৃত করেছে বহু কালখণ্ডে। প্রেমের অজস্র অনুভূতিমালা, প্রেম বিষয়ক নিবিড় পর্যবেক্ষণ জারিরাখা চোখে লেখা বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি কামরুল বাহার আরিফের সাম্প্রতিক কবিতাপাঠ আমাকে মুগ্ধ করলো। ঠোঁট হাসলে, মানবীর সমগ্র সত্তা হেসে ওঠে, এই অবলোকন আমরা পেয়ে যাই তাঁর কবিতায়। কবি তাঁর স্বচ্ছ চোখে কোনো বিমূর্তির পরিসর আনেন না। প্রেমিকার চোখের হাসিতে কবির হৃদয় বেজে ওঠে মৃদঙ্গ হয়ে। চিত্রকল্পকে তিনি বাস্তব বিচ্যুত করেন না। তাঁর কবিতায় প্রেমের ঘরানার সঙ্গে প্রকৃতির ঘরানাকে একাকার করে দেন। ওই দুই ঘরানার সংমিশ্রণ চেতনাবোধের নিবিড়তা এনে দেন। তাঁর 'সাদা ক্যানভাস' কবিতার পংক্তিতে আত্মিক-দৈহিক প্রেমের অনন্ত যাপন উপলব্ধ হয়েছে আন্তরিক কলামাত্রায়--- 'যেখানেই চোখ রেখেছি তোমাতে, তোমার সব কিছুই/ সমানভাবে সুন্দর ও মায়াময় হয়ে উঠেছে।' প্রেম আর প্রকৃতি, এমনকি তার সঙ্গে বাঁচার সংগ্রাম তাঁর কবিতায় পরস্পরের পরিপূরক।  অনুরণনের ব্যঞ্জনায় বাজছে প্রেম। কবির মনে হচ্ছে--- 'হৃদয়কে সমুদ্রের সমান হতে হলে প্রেমিক হতে হয়।' পরম্পরার অন্দরে যে স্বপ্নময়, যে স্বর্ণময়, যে উপমা ও অলংকারের মিথ, তার প্রতি কবির আত্যন্তিক নিবেদন প্রতীয়মান কামরুল বাহার আরিফের কবিতায়। প্রেমের ভিতরে যেমন একাকার হয়েছে সমুদ্র তার বিশালতায়, তেমনি প্রেমের গভীরে আছে মৃত্যু চেতনা, এই ভেবে যে, মৃত্যুর পথ ঘুরে কবি নবজন্ম  নেবেন প্রেমের আরেক রূপের ভিতরে, যা পাঠ করে পাঠক চাঁদনী রাতের মায়াময়ের হাতছানিতে সাড়া দেবে। মৃত্যুকে কামনা করছেন কবি, কিন্তু সমুদ্রে, অন্য কোথাও নয়। কবির অকৃত্রিম বিশ্বাস, অসীম সমুদ্র মৃত্যুকে ক্ষুদ্রতায় গ্রহণ করে না। মৃত্যুকে সমুদ্র নিয়ে যায় মহাচেতনায়, যেখানে মৃত্যু ইতিবাচক পুনর্জন্মের প্রতীক। সেই প্রতীকটি জীবনের সমস্ত কর্মজগত ভাষাজগত ও মনোজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই প্রতীকটিকেও আমরা পেয়ে যাই প্রতিদিনের পরিষেবার ভিতর, যেখানে এক মানুষ অপর দুর্দশাগ্রস্ত বা রোগগ্রস্ত মানুষের সেবায় নেমে পড়ে। যখন কবি হাসপাতালের বিছানায় অঘোর অবস্থায় শায়িত, নার্সের সেবাপূর্ণ হাতটিকে মনে হয় তাঁর প্রকৃত প্রেমিকার। প্রেমবিষয়ক এই বোধ তখন শুধু চাঁদনী রাতের রোমান্সেই সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রেমিকা হয়ে ওঠে সর্বত্র আন্দোলিত বিশ্বমানবতার আন্তর্জাতিক রূপ। প্রেমের মধ্যে দার্শনিকতার স্থান থাকতেই পারে শিল্পীর তুলিতে, কিন্তু প্রেমের মধ্যে যখন 'সমাজ শাসন লোকচক্ষুর অগ্নি অনল' বিধৃত, যখন কবি দেখতে পান, 'ছাতিম তলার বাঁশের মাচান ঘুণ খেয়েছে', প্রেম তখন কেবল ব্যক্তিগত পাওয়া-না-পাওয়ার কিনারায়  দাঁড়িয়ে থাকে না। কবি প্রেমকে দেখছেন বিভিন্ন ঘরানায়। 'তুমি' শব্দটা তাঁর কবিতায় বহুবার এলেও, 'তুমি' তার সর্বনামত্বের সীমানা পেরিয়ে সর্বমানবতার জীবন পরিসরে আকীর্ণ। তাঁর কোনো কোনো ছোটো কবিতার দিকে তাকিয়ে পাঠক লক্ষ্য করবেন, পাশাপাশি দুটি প্রায় একই গঠন পরিসরের কবিতায় কবি কিভাবে বৈপরীত্যের খেলা খেলছেন। 'পোষা তিমি' কবিতায়, তিনি তিমি পুষেছেন প্রেমিকার হৃদয়ের গভীরে, এই উদ্দেশ্যে যে, সেখানে স্বয়ং কবি ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করলেই, পোষা তিমি তাকে গিলে খাবেই টুপ করে। এরকম কবিতায় গভীর জাতীয়তা বোধের পরিচয় পেয়েছি। আপাতভাবে প্রেমের কবিতা হলেও, এটি সুদূর রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করছে। অন্যদিকে তাঁর 'দীর্ঘশ্বাস' কবিতাটি জাতীয়তার সীমানা পেরোনো। বিশ্বমানবের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কবি তাঁর দীর্ঘশ্বাসকে দেখছেন। তিনি এমন নদীর প্রত্যাশা করছেন, যেখানে কোনো পার থাকবে না। ফলত, দু'পারের দীর্ঘশ্বাসের গণিত কবির পক্ষে মেলানো সম্ভব নয়। তার মানে এই নয় যে, পারহীন নদীর দু'ধারের দীর্ঘশ্বাস কবির কাছে পৌঁছয় না। আসলে দু'ধারের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে কবি কোনো গণিত দেখেন না। দেখেন, উভয় ধারের দীর্ঘশ্বাসের স্বাভাবিক প্রকৃতি, যার চরিত্র প্রায় এক। সেখানে গণিত ভেবে কোনো লাভ নেই। কবি খেলতে চান রঙ নিয়ে। বিভিন্ন রঙের সঙ্গে ভালোবাসাকে একাকার করেন। রঙে পুড়তে চান কবি। আবহমানের এই চিরন্তন মেজাজ কখন যে পাঠকের চেতনায় ঢুকে পড়ে তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়, তার সময় ও নির্ঘন্ট না জানলেও চলে।

2 comments:

কামরুল বাহার আরিফ said...

সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিনকে। কৃতজ্ঞ অলোকদা

মানিক বৈরাগী said...

অসাধারণ লিখলেন দাদা