অরিজিৎ চক্রবর্তী
ডারউইনের চিঠি পর্ব-২০
মহুয়ার কথা বলতে বলতে ধলু কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, " বাবু , মহুয়া আর দিশি মুরগি! আমি এখনই জিতেন সর্দারকে খবর করছি।"
সম্মোহ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল।
ধলু চলে যাওয়ার পর বিকাশ বলল, " রানীবাঁধ থেকে সুতানের রাস্তাটা বড় অদ্ভুত লাগল! মনে হয় দার্জিলিং এর কোনো পাহাড়ি পথ। হেয়ারপিনের মতো তীক্ষ্ণ বাঁক। আর চারপাশে পাইনের বদলে শালের জঙ্গল।ফারাক এটুকুই।"
----" এই জন্যই তো এখানে থেকে গেলাম। মোট পঁচাশিটা পরিবার নিয়ে সুতান গ্ৰাম। তার মধ্যে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসে ছিয়াশি নম্বর পরিবার। বেশির ভাগ সাঁওতাল জনজাতি। মূলত চাষবাসই জীবিকা।"
---- " তোর নির্বাচনের তারিফ করতেই হচ্ছে! জায়গাটা সত্যিই সুন্দর রে। কিন্তু ভয় লাগে না তোর? জন্তু-জানোয়ার, সাপ-কোপের ভয়তো আছেই। সঙ্গে অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের ভয়!"
----" কোনো ভয়ই হয় না রে। এরা আমার সহচর। যাপনসঙ্গী! "
----"পশু-পাখিরা হয়তো দেকার্তের মতো ভাবতে পারে না? আই থিঙ্ক দেয়ারফোর আই একজিস্ট"। সে কারণে তারা নিশ্চয়ই মানুষের তুলনায় ' নিন্মচেতনাসম্পন্ন'?" বিকাশ বলল।
----" নিন্মচেতনাসম্পন্ন" কথাটায় ঘোর আপত্তি রাখছি! অথচ তাদের মধ্যে এমন এমন অনুভূতির সন্ধান পাওয়া যায় যা সহজেই আমাদের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বহু আলোচিত ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির কথা না হয় বাদই দিলাম।
সৌন্দর্যের বোধই কি মানুষের একচেটিয়া? ময়ূরী কে আকৃষ্ট করতে ময়ূর পেখম মেলে যে দৃশ্য সৃষ্টি করে তা মানুষের ভাষায় অপরূপ সুন্দর। অর্থাৎ'নিম্নচেতনাসম্পন্ন'প্রা ণীর স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছে যে দৃশ্যে তা মানুষের মতো উচ্চচেতনাসম্পন্ন' প্রাণীর মনে সৌন্দর্যের সৃষ্টি করছে।ব্যাপারটা কি বিস্ময়ের নয়!"
----" ফাটাফাটি বন্ধু। তোকে একটু নেড়ে দেখলাম আগের মতো আছিস কিনা! পড়াশোনাটা করিস তাহলে এখনো?"
----" ছাড়, অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা হল। এবার মহুয়া-মাংসের আয়োজন কদ্দূর খোঁজটা নিই চল।"
সম্মোহ বাইক স্টার্ট দিল। বিকাশ সম্মোহের পেছনে বসে পড়ল। আবার সেই আঁকাবাঁকা খাড়াই রাস্তা।
লেদাপুকুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পার করে কিছুটা এগিয়ে সম্মোহ বাইকটা থামাল। বাড়ির সামনে কতগুলো বাচ্চা নিজেদের মধ্যে খেলছে। কালো রঙের কাঠের দরজা। সম্মোহ দরজার মাথার শিকল ধরে নাড়া দিল।
----" খুড়ো ও খুড়ো কই গেলে"!
কাঁচা-পাকা চুলের এক বুড়ো বেরিয়ে এসে, হাতজোড় করে বলল, আসেন বাবুরা আসেন।"
সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। মাটির দালান ঘেরা উঠোন। একটা খাটিয়া আর চৌকি পাতা। মেঝেতে তালাই বেছানো। দূরে বালতিতে জল রাখা।
চারপাশে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার আভাস। বিকাশ বেশ অবাকই হচ্ছিল।
---" চল ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিই। এবার দুই বন্ধু মিলে একসঙ্গে স্বর্গের সিঁড়িতে পা রাখব।"
----" সেটা আবার কেমন! রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি!"
----" পাবে পাবে আরো অনেক কিছু পাবে!"
দালানের ভেতরের ঘর থেকে ধলু বেরিয়ে এলো। হাতে একটা জামবাটি আর কচুপাতা।ধলু তালাই বেছানো মেঝের উপর পাশাপাশি দুটো কচুপাতা রেখে তার ওপর কাঁচা লঙ্কা জলজিরা আর কয়েকটা শসা কুচি দিয়ে সম্মোহকে ইশারায় ডাকল।
সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে ওখানে বসল। ততক্ষণে খুড়ো মহুয়ার বোতল সম্মোহের সামনে রেখেছে।
----" আমি কিন্তু চেক করবো, মালটা ঠিকঠাক কিনা! "
----" করো বাবু করো। দেখে লাও। জীবন সর্দারের মাল বটে।"
সম্মোহ বোতলের ছিপিতে সামান্য মহুয়া ঢালল। তারপর লাইটার বের করে জ্বালাল। ছিপির মহুয়া দপ করে জ্বলে উঠলো।
----" একদম ঠিক আছে ধলু। তাই তো তোদের কাছে আসা।"
সম্মোহ দুটো গ্লাসে মহুয়া ঢালল। তারপর তাতে খানিকটা জল মেশাল।
----" নে এক চুমুকে মেরে দে। তারপর লঙ্কায় জলজিরা লাগিয়ে একটা কামড়। তারপর এককুচি শশা। আহা...!"
বিকাশ বলল, " পাগল! আমি তোর মতো দক্ষ মাতাল নই। আস্তে ধীরে নিচ্ছি।"
দ্বিতীয় পেগ ঢালতে ঢালতে একটা মাটির পাত্রে মাংস নিয়ে হাজির খুড়ো।
সম্মোহ খুড়োর হাতে মাংস দেখে যেন আরো খানিকটা এনার্জি পেল। বিকাশ তখনও আগের পেগটা শেষ করতে পারেনি। বিকাশের কাছে মহুয়ার গন্ধটা বেশ চড়া লাগছে।
সম্মোহ বিকাশকে বলল, " শোন পুরো মালটা এক নিঃশ্বাসে মেরে দিশি মাংসটা মুখে দে। দেখবি অতটা অসুবিধে হবে না। তারপর তিন পেগ হলেই মহুয়া তোর বন্ধু হয়ে যাবে।"
----" পাগল! আমি আর একটা নেব। তাও তোর জন্য। আমার এসবে আসক্তি বা অভ্যেস কোনোটাই নেই।"
-----" তা বললে হবে না বন্ধু! আমার সম্মান রাখাটা তোমার দায়িত্ব!"
----" শোন ঢলু তোরা ওইদিকটায় মহুয়া নিয়ে বসতে পারিস।" সম্মোহ বলল।
----" সে হবে। আগে বাবুরা ফূর্তি করুক।"
দালানের ভেতর ঠান্ডা হাওয়ার একটা আমেজ আসছিল। তাও সম্মোহের গরম লাগছে দেখে ঢলু একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিল। ফ্যানের হাওয়ায় নেশাটা টানটান হয়ে উঠল।
---" মাথাটা ঝিমঝিম করছে রে। বেশ লাগছে! তুই মাইরি সত্যি খুব ভালো।"
বিকাশের কথায় সম্মোহ বেশ মজা পায়।বলে ," এই বার পথে এসো খোকা! প্রিয় বন্ধু বুড়ো খোকা!"
-----" আমি বুড়ো খোকা! আর তুই ছোটখোকা! ছোটখোকা বলে অ আ... হিহিহিহি হাহাহা..."
------" গাঁড় মেরেছে! এতেই ধরে গেল! "
----" এই শোন! লীমা কেমন আছে রে। ওর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?" বিকাশ বলল।
--- "কে লীমা?"
---- " কেন তোমার প্রেমিকা হবু বউ! "
----" হবু বউটউ বলে লাভ নেই। সেসব গতজন্মের রিংটোন। এখন ও একটা সাংসারিক ছাগল! "
---- "বললি বটে সাংসারিক ছাগল!"
---" বলবো না! মা-ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কলুর বলদ হয়ে গেল! সংসারের ঘানি টানছে!"
----"ওকে একবার এখানে নিয়ে আয়। দেখবি তোদের মিল হয়ে যাবে।"
----" ও এখন অসম্ভব সাইকো! ওর আর কিছু হবে না।"

No comments:
Post a Comment