অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি পর্ব~২১
গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, ‘‘চরিত্রগুলোকে পাঠক সব সময়, তাঁরা নিজেরা যেমন চান, সে ভাবে দেখতে পছন্দ করেন, নিজেদের পিসি মাসি ঠাকুরদার মতো করে। যে মুহূর্তে চরিত্রগুলো সিনেমার পর্দায় চলে আসে, পাঠকদের কল্পনাটাও সীমায় ঠেকে যায়।’’ এই কথাটাও আমার কাছে একটা ‘শক্’ ছিল, বুঝতে পেরেছিলাম কেন এত সিনেমা-প্রীতি সত্ত্বেও কোনও প্রিয় উপন্যাস থেকে বানানো ছবি আমি সহজাত প্রবৃত্তি-বশেই এড়িয়ে চলি। আসলে ভয় পাই যে আমার মনের মধ্যে যে ছবিটা, সেটা বড্ড সহজে পর্দায় ফুটে উঠে ছোট হয়ে যাবে।
১৯৪৭ সালে আন্তোন্যাঁ আর্তো লিখেছিলেন, ভ্যান গঘের ছবিতে কোনও ভূত নেই, কোনও বৃহৎ-এর স্বপ্ন নেই, কোনও ভ্রমকল্পনা নেই। আছে কেবল বেলা দুটোর সূর্যের সেই প্রখর তাপদাহ। জন্মপূর্ব যন্ত্রণার স্মৃতি। আছে পবিত্র, উলঙ্গ পৃথিবী। আমরা তার আরও কাছে যাওয়ার মতো জ্ঞান অর্জন করলেই যে প্রকৃতি নিজেকে লুপ্ত করে ফেলে।” গার্সিয়া মার্কেসকে ভাবতে গেলেও এই কথাটাই মনে আসে আমার।
সম্মোহ ওয়াচ টাওয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এরকম অনেক এলোমেলো ভাবনায় নিজেকে ভাবিয়ে তোলে । ভাবতে থাকে। ভাবনার কোনো পরাধীনতা নেই। সে যে বড্ড স্বাধীন! সম্মোহ তার ভাবনার মতোই স্বাধীন। দুঃখ আছে শোক আছে আবার আনন্দও আছে। আর ফেসবুকের চন্ডীমন্ডপ। পিএনপিসি।
শিক্ষক ছাত্রীর যৌনতা। অডিও। স্কিনশর্ট। কমেন্টস। উপযুক্ত শাস্তি হোক। বিচার চাই। ছিঃ ছিঃ ভাবা যায় না। শিক্ষকের আড়ালে শয়তান। মরে যাওয়া উচিত। সবাই বয়কট করুন। সঙ্গে ফেসবুক গ্ৰুপ যাচাই- অভিযানের অন্তর তদন্ত। আরো কত কি! মজা ফূর্তি নিশিগন্ধা... ম্যাজিক রিয়েলিজিম...
এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ জীবনের জাদু-বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেন এভাবে, একদিন আমি আর আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে ছিলাম। এর মধ্যে শুনতে পেলাম কলিংবেলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে! দ্রুত আমি দরজা খুললাম এবং একজন মানুষ জানালো সে ইলেক্ট্রিক আয়রন মেশিন ঠিক করতে এসেছে! আমার স্ত্রী বেডরুম থেকেই জানালো, আমাদের আয়রন মেশিনে কোনো সমস্যা হয়নি।তারপর আগুন্তক জানতে চাইলো, "এটা কি এপার্টমেন্ট নাম্বার দুই?" আমি তাকে জানালাম, "না, নাম্বার দুই উপরের তলায়।" এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী কাপড় আয়রন করতে গিয়ে সুইচ অন করার সাথে সাথেই আয়রনের তারটি শর্ট সার্কিটে পুড়ে গেল!
দেখুন এটাই অন্যরকম কিছু! আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জানার আগেই সে এসেছিল সমস্যাটি ঠিক করতে! আমাদের জীবনে প্রায়ই এমন হয়! যদিও আমার স্ত্রী হয়তো ঘটনাটি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে।
বিকাশ চলে যাওয়ার পর ক'দিন মনটা একেবারেই ভালো ছিল না সম্মোহের। মনে হয়েছিল বিকাশকে এখানে রেখে দিলেই হত।বিকাশেরও আরো ক'দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে এতদিন বাইরে থাকার অভ্যাস একেবারেই নেই বললে চলে। তাই বাড়ির দিকেও বিকাশের মনটা চলে যাচ্ছিল।
শেফালির কথা বলছিল বারেবারে। একদিন সকালে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিকাশ সম্মোহকে বলল, " আমার ট্রেনের টিকিটটা এবার কেটে ফেল। বাড়ি ফিরতে হবে! বদ্ধ ঘরে শেফালির দম বন্ধ হয়ে আসছে! এবার আমাকে যেতে হবে!"
সম্মোহ বিস্মিত হয়ে বিকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে টিকিট কেটে দিয়েছিল। শুধু সম্মোহের মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল, "বদ্ধ ঘরে শেফালির দম হয়ে আসছে!" এও কি এক ধরনের জাদু বাস্তবতা?
শেফালি চলে যাওয়ার পর বিকাশ একেবারে একলা হয়ে গেছে। খুব বুড়ো হয়ে যায় নি। এই বয়সে জীবনসঙ্গীর চলে যাওয়া বড় বেদনার। কারণ প্রতিটি দাম্পত্যের এই বয়সটাই প্রকৃত মধুচন্দ্রিমার সময়! সম্পর্কের গভীরতার সময়। অনুভবের সময়।
আর সম্মোহ এগুলোর থেকে দূরে। তার একাকিত্বের একাকারে গাছ পাখি মানুষের যাওয়া আসা। ফলে সম্মোহের ক্ষেত্রে একজন পঞ্চতপা কর্মযোগির জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
বাস্তব সমাজটা গার্সিয়া মার্কেসের মতোই সম্মোহের কাছে কাছে বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে জাদু তৈরি করত বাস্তবের ফাঁকে ফাঁকে নীরবতা ও প্রকাশের মাঝে, ক্ষমতা ও সংশয়ের মাঝে, আড়ম্বরহীনতা ও চোখ-ধাঁধানো অসামান্যের মাঝে। এবং সম্মোহ গল্প বলতে পারত। সম্মোহ কখনো একটা গল্প বলত না। বরং একটা দুনিয়া তৈরি করে ফেলত , একটা জাতিকে বুনে দিত , সৃষ্টি করত একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহা-আলেখ্য। কী নেই সেখানে, স্মৃতি, কল্পনা, ইচ্ছে, মৃত্যু, স্বপ্ন, জীবনযাপন। অসংখ্য পরস্পর-সংযুক্ত গল্পের দুনিয়া খুলে দিত তার উপস্থিতি।
প্রথম প্রথম সুতানে আসার পর একটা ভয় কাজ করত। মৃত্যু ভয়! একদিন ভয় অতিক্রম করে অভয় এসে হাত ধরল সম্মোহের। মনে হল এই সম্পূর্ণ এলাকাটায় একজন ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান। সমস্ত অশুভ শক্তিকে আটকে দেন তিনি। মাঝরাতে মাঝে মাঝে নুপূরের শব্দ শোনা যায়। কেউ হেঁটে চলার শব্দ! তিনি কি দেবী! তাঁকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সম্মোহ সব সময় তার অস্তিত্ব অনুভব করে। সেই যেন সম্মোহকে আগলে রেখেছে।
একদিন কেউ নেই। লালুকাকা নেই, বুলির মা নেই, সম্মোহ একা! মেঘ করেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ইলেকট্রিক নেই। জেনারেটরে তেল নেই। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। অতি ক্ষীণ আলোর লন্ঠন জ্বালিয়ে সম্মোহ বসে আছে। কানে আসছে কারো হেঁটে চলার শব্দ! কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু অনুভব করা যাচ্ছে।
----- কে তুমি?
------ ম্যাজিক রিয়েলিজম!
------ কোথায় থাকো?
------- তোমার ভেতরে!
-------- প্রমাণ কি?
--------- অনুভব করা ছাড়া এর কোনো প্রমাণ হয় না!!

No comments:
Post a Comment