অরিজিৎ চক্রবর্তী-র ডারউইনের চিঠি পর্ব~২২
সন্মোহ দেখল তাকে।
খুব নিচু স্বরে বলল, তোমার ভাবনাগুলোকে আমি এনডোর্স করছি না। তবে এখন যা ভাবার আমি ভাবব। যা বলার আমি বলব। তুমি চুপ করে শুনবে। প্রতিবাদ করবে না। প্রতিরোধ করবে না। মেঘে ঢাকা তারার ভেতর থেকে এগিয়ে আসবে চাঁদের মতো।পাটভাঙা দুধে আলতা শাড়িতে খোলাচুলে তুমি হয়ে উঠবে সিন্ডারেলা!
আচমকা উচ্চকিত হাসিতে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একদলা ঘৃণা ছড়িয়ে কেউ বলে ওঠে, ছিঃ! প্রতারক! স্বার্থপর! অমানুষ!
সন্মোহ চেঁচিয়ে উঠলো, " তুমি আসলে কেউ নও! তুমি প্যারানইয়া! সন্দেহবাতিকগ্ৰস্থ রুগি!
---- ঠিক বলেছ। একজন সুস্থ মানুষকে রুগি বলে চালিয়ে দেওয়ার সহজ প্রতিহিংসা তোমার মধ্যে ছাড়া আর কার মধ্যে থাকবে!
"মুহূর্তের নির্বাপন চাইছি আর দশবার চটজলদি
"গীতা"উচ্চারণ করছি... তুমি শুনছ "ত্যাগ"
অরিজিতের লেখা কবিতার দুছত্র মনে পড়ে যায় সম্মোহের। মনে পড়ে যায় আরও অনেক কিছু।
মহাদেবের কথায় ব্রক্ষ্মা লজ্জা পেলেন এবং একই সঙ্গে অনলের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, " কাম যেমন আপনার সন্মুখে আমাকে শরাঘাত করল, তার ফল সে পাবে। এই কন্দর্প অহঙ্কারে মত্ত হয়ে অতি দুষ্কর কাজ করতে গিয়ে আপনার নয়নানলে ভষ্মীভূত হবে।"
এই শাপ শুনে ভীত কাম ব্রক্ষ্মাকে বললেন, " আমার কি দোষ প্রভু? আপনিই বলেছিলেন যে, "আপনি, বিষ্ণু এবং মাহেশ্বরও আমার বশবর্তী হবেন। আমি তো তারই পরীক্ষা করছিলাম। আমি নিরপরাধ। আমার শাপ মোচন করুন।"
ব্রক্ষ্মা বললেন," তুমি মহাদেবের নয়নাজলে ভষ্মীভূত হয়ে আবার তারই অনুগ্ৰহে শরীর ফিরে পাবে।"
---- গাঁড় মারানোর কেত্তন!" সম্মোহ অস্ফূটে বলে উঠলো। আজ যেন চিন্তার কোন মাথামুন্ডু নেই।"
একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ট্রু-কলারে ভেসে উঠলো, অলিভিয়া দত্ত।
---- "হ্যালো!"
---- "হ্যাঁ হ্যালো, আমি অলিভিয়া দত্ত বলছি ব্যারাকপুর থেকে। আপনার ওখানে আগামী শুক্রবার রুম পাওয়া যাবে?"
---- "হ্যাঁ, পাওয়া যাবে। কটা রুম লাগবে?"
----- "একটাই ডবল বেড। আমি আর আমার মা যাব। সঙ্গে জিল। পেট অ্যালাও তো!"
---- "না না, হবে না।"
-----" জিল খুব ভালো। সহবত জানে। আপনাদের কোন অসুবিধে করবে না। প্লিজ না বলবেন না।"
----" আচ্ছা ঠিক আছে। দায়িত্ব আপনার। কাউকে আবার যেন কামড়ে-টামড়ে না দেয়!"
---- " আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কিছু এ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
-----" লাগবে না। চলে আসুন। এটা কি আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নং?"
-----" হ্যাঁ, এটাই।"
-----"আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
----" ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আর একটা কথা, সঙ্গে ড্রাইভার থাকবে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করবেন প্লিজ।"
-----" শুনুন রুম চার্জ পনেরো শো। এখানে এসির কোনো ব্যবস্থা নেই। ড্রাইভার রুম পাঁচশো। খাওয়াদাওয়া আলাদা। আপনার জিল বিড়াল কিংবা কুকুর যাইহোক ও যদি আপনাদের সঙ্গে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা চাদর বালিশের ওয়্যার প্রোভাইড করবো না। আপনাদের করে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, বড় সমস্যা হয় এদের নিয়ে। দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে দেয়।"
---- না না, আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না। ও খুব জেন্টল!"
-----"সে হোক। তাও ওগুলো সঙ্গে নিয়েই আসবেন। ঠিক আছে। রাখি তাহলে, ভালো থাকবেন।
সম্মোহ ফোনটা রেখে আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকল! যেন চারপাশে একটা ঘোর লেগে আছে। আকাশের তারা গুলোকে কেমন যেন সেলাই করা সারি সারি বিস্ময়চিহ্নের মতো লাগছিল! জীবনের বিস্তারিত আয়োজনে কোথায় যে কী অভিজ্ঞতা বা অনুষঙ্গ সমাহৃত হয়ে থাকে তা আগে থেকে বোঝা যায় না।
মজার ব্যাপার এই, আমাদের আচরণের মূল নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। আরো বিশদ ভাবে বলতে হয় মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র। মানসিক অস্থিরতার গভীরে ডুবে থেকেও কী করে যে নিজেকে সৃজনশীলতার শীর্ষে নিয়ে বসাতেন ভ্যান গখ, সে এক বিস্ময়। এক অস্থির মুহূর্তে নিজের কান কেটে তিনি পাঠিয়ে দেন জনৈকা নগরকন্যাকে। তারপর আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন!
আজ কি এমন হলো সম্মোহের! ঘুরে ফিরে বিভিন্ন ভাবনা আর কথার মিথোস্ত্রিয়া ঘটে চলেছে মনে, মনের গভীরে। সেখানে হয়তো মন কিংবা মন্তব্য নেই। কেবল একটা অস্থিরতা আছে।কিছুতেই যেন নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। তবে কি এবার একজন মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে সম্মোহকে!
ফেসবুকে একটা নটিফিকেশনের শব্দ হলো টিং। সম্মোহ খুলে দেখল অনলাইন কাগজ গুলোর সেই একই ঝালমুড়ির গল্প!
বলিউডের প্রথমসারিতে ইতিমধ্যেই নিজের নাম পাকিয়ে নিয়েছেন বঙ্গতনয়া শ্রেয়া। যার হট মুভসের আভায় মুগ্ধ সাইবারবাসী। এককথায় বলিউড মাতিয়ে রেখেছেন বাঙালি কন্যা। সম্প্রতি পছন্দের ডেস্টিনেশন মলদ্বীপ গিয়ে একগুচ্ছ ছবি শেয়ার করেছেন। ব্রালেট-মিনিস্কার্টে খোলামেলা শরীরে ঝড় তুললেও পোশাকের উপর স্পষ্ট শরীরের হাড়। মৌনির এই সুপারহট ছবি দেখেই কটাক্ষ করেছেন সাইবারবাসী।
বিষয়টা পড়তে পড়তে শ্রেয়ার শেয়ার করা ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছে করে সম্মোহের। নারীর এই শরীরী ভঙ্গিমা শিল্পীর চেতনায় কত ধরনের মোটিভ রচনা করে! সম্মোহ হাতের কাছে একটা কাগজে কয়েকটা লাইন ড্রইং- এর আঁকিবুকি কেটে নেয়। তারপর অদ্ভূত ভাবে খানিকটা শান্ত হয়ে যায়। অনেক দিন বাদে আবার ছবির কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ছবি আঁকাটাই এক সময় জীবনের প্যাশন ছিল! আজ সবটাই অতীত।
ছবি ঘুমন্ত। অথবা সে নিদমহল। ঘুমন্ত বাক স্বয়ং।তার মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে উপস্থিত এই যে প্রচ্ছন্ন অনাদি রূপটি-- সদাসর্বদা সে অপেক্ষমান গা-ঝাড়া দিয়ে সজীব ও সক্রিয় হয়ে উঠবার জন্য! তাই চিত্রকলা সান্দ্র অনচ্ছ ছায়াঘন। আমাদের দৃষ্টিপাত তাতে, মাত্র তাতেই, সংলগ্ন হয়ে যায়!
একজন শিল্পীর ন্যুডস্টাডি করার সময় এই দেখা গুলোই অনপেক্ষ এবং সাপেক্ষ। অর্থাৎ পার্থিবে বিরাজমান দ্রষ্টব্যগুলি হল অনুকার্য, আর অনুকারক হল অনুকৃতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ রূপসাদৃশ্যের ন্যায় মেনে সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন চিত্র-ভাস্কর্য এবং সাহিত্য-কর্ম।
রবীন স্যারের কথাগুলো আজও মনের মধ্যে গেঁথে আছে সম্মোহের। আজকাল ছবি আঁকার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেললেও ভেতরের উজ্জীবনটা রয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তো আজও কয়েকটা আঁচড়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে সম্মোহের অনায়াস লাইন ড্রইং।
মাঝেমধ্যে সে সব ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সম্মোহ। অনেক প্রশংসা পায়। পুরনো বন্ধুরা দু-একজন যারা ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, তারা সম্মোহকে আবার ছবি আঁকায় ফিরতে বলে।

No comments:
Post a Comment