Saturday, February 26, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
সপ্তম পর্ব        

কবিতার কোন আচরণই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটে না। উদ্দেশ্য মূলক আচরণের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই যে আভ্যন্তরীণ তাগিদ তাকেই আমরা কবিতাটির প্রেষণা বলব। কবি এই কার্যপদ্ধতির মধ্যে চেতনা জারিত করে। তাই প্রেষণা বাধাপ্রাপ্ত হলে প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। অথচ কবিতা দুভাবেই লেখা হয়। মূর্ত অথবা বিমূর্ত। কেউ কেউ নিজের চারপাশে খুব বিমুর্ত এক আবহের সৃষ্টি করে নিয়ে লিখতে পারেন  বা লেখেন। চেনা জগতের অনেক বাইরের কথা।পাঠক তার নাগাল বা স্পর্শ পায়না  সহজে। আবার কেউ লেখেন জীবনঘনিষ্ট কিছু পংক্তিমালা যা পাঠকচিত্তের কাছাকাছি। পাঠক চাইলেই  স্পর্শ করতে পারে, ঢুকে পড়তে পারে কবিতার আদ্যোপান্ত শরীরে। কবিতার ভাষায় ধ্বনিপ্রতীকতার কথা বলেছেন ভাষাবিদরাও। সকলেই জানেন শব্দ ও অর্থের মধ্যে অন্তর্লীন কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু কবিতায় কখনও কখনও ল্ক্ষণীয় হয়ে ওঠে শব্দ ও অর্থের মেলবন্ধন। তৈরি হয় motivated sign। আর এরকমই এক পরিত্রাণের ত্রাণ নিয়ে যখন কোন কবি অভিজ্ঞতার রূপায়ণে রূপকের ইমেজ গড়ে তোলেন তখন পরিকল্প ( schemas ) চেতনার চর্যায় একটা বিশেষ রৈখিকতা তৈরি করেন । কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের "একটি গোপন বাঘ" ( প্রকাশক- প্ল্যাটফর্ম, প্রকাশকাল- ডিসেম্বর ২০২২ )    নামের কবিতার বইটি তেমনই এক শিল্পায়নের চিহ্নায়ক।

এখানে "চিহ্নায়ক" শব্দটির লেখার পেছনে অবশ্যই আমার একটি সচেতন বিধেয় আছে। মানুষ কেন বিমূর্ত ধারণা গঠন করে রূপকার্থে? মানুষের ভাষায় বিমূর্ত ভাবনা গড়ে ওঠে কতগুলি অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে। দেখা,ধরা, দাঁড়ানো,হাঁটা প্রভৃতি দৃষ্টিগ্ৰাহ্য ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপ গুলির ভেতর মানুষ বিমূর্ত ধারণা তৈরি করে নেয়। সময় যেন চোখে দেখার বিষয়। কবি দেখছেন। "একটি গোপন বাঘ" - এর Personification বা সমাসোক্তির মাধ্যমে।


"ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি, সামনেই বসে আছেন কাফকা। না ঠিক কোনো 
পোকার মতো দেখতে নয়।চোখের তলায় কালিও নেই।শ্বাস নিতে অসুবিধে 
হচ্ছে? উত্তরে চুপ করেই থাকলেন।আমিও চুপ করেই থাকলাম। বাইরে শ্রাবণ। 
ভিতরে শ্রাবণ। আর আশ্চর্য ভয়। কাফকা বসে আছেন।আর ক্রমশ আমি রোগা 
হয়ে যাচ্ছি। এলোমেলো উড়ে যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি। চেনা, পরিচিত, ইস্কুলড্রেসের 
মতো লেখা।আর কাফকা অস্ফুটে বলছেন, আমার লেখাগুলো তোমরা পুড়িয়ে 
দিলে না কেন? আমার ভয় করছে।মেঝে, ছাত দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালগুলো 
দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ গাইতে গাইতে একটা মাঠের মধ্যে চলে এসেছি। দূরে 
দূরে পাহাড়।সেখানে আমার দেওয়ালগুলো। আমার ছাত থেকে মেঘ নেমে 
আসছে মাথার উপর। ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।ফ্রাঞ্জ কাফকা। 
আর বিড়বিড় করে বললেন," আলোই অন্ধকার, অন্ধকারই আলো"। আমার ঘর 
আর খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে 
ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

( ম্যাক্স ব্রড )

এই কবিতাটি পাঠ করতে করতে কাফকা আর তার বন্ধু মাক্স ব্রডের অবিস্মরণীয় ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর সেই বিখ্যাত উপন্যাস "ডি ফেরভান্ডলুঙ্গ"(রূপান্তর)। উপন্যাসের প্রথম লাইনটি----" এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল–সে পোকা হয়ে গেছে!' এই উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠক এই একটি লাইনে যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যাক্স ব্রড নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। যাঁর সঙ্গে কাফকার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। এদিকে প্রেমে ব্যর্থ,  স্বল্প রোজগেরে ক্ষীণজীবী মানসিক ভাবে ভঙ্গুর ও বিষাদাচ্ছন্ন কাফকা বন্ধু ম্যাক্সকে এক আশ্চর্য চিঠি লিখলেন।  প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স, আর হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও করা হয়ে উঠছে না। আমার লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলি হয়তো কালস্রোতে হারিয়ে যাবে। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় বলছি, সব পাণ্ডুলিপি আর নোট পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলি সংগ্রহ করেও পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ যেন সেসব পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। বলাই বাহুল্য বন্ধুকে অত্যন্ত  ভালবাসলেও এক্ষেত্রে বন্ধুর কথা রাখেননি ম্যাক্স ব্রড। বরং তিনি নিজে সেসব লেখা পড়লেন। পড়ে বিস্মিত হলেন। আর যত্ন করে সেই সব লেখা প্রকাশ করলেন।

এটি আমাদের চেনা একটি দৃষ্টান্ত মূলক কাহিনী। অথচ হিন্দোল "ম্যাক্স ব্রড" নামের কবিতাটিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাফকার সঙ্গে তার কাল্পনিক যাপনের চিত্ররূপ। এখানে ফ্রান্‌ৎস কাফকা আর হিন্দোল মিলেমিশে একাকার। তাদের মধ্যে যেন একই রকম যাপন প্রবাহের প্রেক্ষাপট। শুধু পোকাটিকে নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই।বাইরে শ্রাবণ। ভিতরে শ্রাবণ। মা কবির কল্পনা ও  অনুভবের আলোআঁধারিতে স্বতন্ত্র। এই কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্যোতনাসঞ্চারী ধারণাগত বা Conceptual রূপক। তাই কবিতাটি বহুবার পাঠ করার পরেও আবার পাঠের অপেক্ষা রাখে। কবি কবিতাটির একবারে শেষ পঙক্তিতে গিয়ে লেখেন--

"সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

আলো অন্ধকারের সঙ্গে যেমন Acute-Grave স্বলক্ষণের সম্পর্ক, তেমনি স্থিরতা-অস্থিরতার সঙ্গে Compact-Diffuse স্বলক্ষণের সহযোগ। সমস্ত কবিতার বইটি জুড়ে কবি লিখে দিয়েছেন এরকমই বহু প্রতিবর্তের আবর্তন। আসুন আমরা সেই আবর্তনের স্পন্দনে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখি---

"আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। হয়তো তোমার কথা লিখি কিংবা 
দীনু ভিখারির। যে দেহ মৃতের মতো ঠান্ডা কিংবা যে মৃত দেহের, লিখি তারও 
কথা।যে পুজো তোমার,কিংবা যে তুমি পূজার, — তুমিও তো লেখ আমাকেই । 

আমি ও লেখার মধ্যে এক আকাশ আলোকবর্ষ আছে। সাতের দশকে তিন 
ছেলেকে হারিয়ে আজও হারুর দোকানে রোজ জিলিপি ও রাজনীতি খেয়ে যান
রমেন ঘোষাল।রাতের হাঁপানিটুকু চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে হারুনচাচার।
আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। ভোররাতের বড়োবাজার শুঁকতে 
শুঁকতে বুঝি,জীবন মশলার গন্ধ। গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ। 

এ কথা ভুলিনি তবু, সে রয়েছে ঝোপের মধ্যে, গুঁড়ি মেরে, পুরোনো স্যাঙাত। 
আমিও সংগীতপ্রিয়, যার কোনো স্বরলিপি নেই। একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই 
অহঙ্কার করে।

যে-কোনো মুহূর্ত শেষ হয়ে যেতে পারে লেখা, এ জীবন অসমাপ্ত রেখে। বাসি 
মুখে নেমে পড়ি হরিদাস মোদকে। ওপাশে নেতাজি আর এপাশে মা-কালী।"

( আচমন )

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ধ্বনিকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে বিদেহ রাজের প্রশ্ন ছিল-- পৃথিবীতে যখন সূর্য থাকবে না, চন্দ্র থাকবে না, সেই অন্ধকারে কিভাবে পথ চলব? যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-- ধ্বনি। ধ্বনিই তোমাকে পথের সন্ধান দেবে। জাগতিক জীবন যেকোনো মুহুর্তেই থমকে যেতে পারে। কিন্তু তাতেই বা দুঃখ কিসের? ধ্বনি! জেগে থাকবে ধ্বনি। কবি তাঁর নিজস্ব ধ্বনিতেই জেগে থাকবেন। এরপর অন্য আর একটি চিত্রকল্পের দ্যোতনা---

"একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই অহঙ্কার করে"

আমাদের অভ্যস্ত, পরিচিত জীবনের মধ্যে এই চিরকালের ছবিটির সঙ্গে কবি প্রবিষ্ট করালেন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের হরিদাস মোদক, নেতাজি, মা কালীর মন্দিরটি। অর্থাৎ কবিতাটি ব্যস্ততর পাঁচমাথার মোড়ের অনিবার্য রসায়নে শেষ হচ্ছে। কবিতাটির সংগঠনে সামাজিক-রাজনৈতিক সংবর্তন লক্ষ করা গেলেও, এরই ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেমের প্রবাহন। উজ্জ্বল অতীত আর ছায়াঘন বর্তমান নিয়ে কবির প্রশ্নকাতরতা। জীবন অভিযোজিত মেটাফর।

" একটি গোপন বাঘ" আসলে ব আ ঘ -- এই তিনটি ধ্বনির মিলিত ধ্বনিরূপ। আর আমাদের মনের চোখে বাঘ নামক প্রাণিটির যে ধারণাগত রূপ, তাই হলো চিহ্নায়িত। মনোলোকে বস্তু বা প্রাণি জগতের ধারণাগত উপস্থিতি সম্ভব হয় বলেই আমাদের পক্ষে শব্দের উদ্দীপক থেকে অর্থে পৌঁছনো সম্ভব। বাঘ কে বোঝানোর জন্য বাঘের কাছে উপস্থিত হবার প্রয়োজন ঘটছে না। ফলত ভাষার একটি নিজস্ব এলাকা আছে, যেখানে শব্দের অন্তর্গত এক একটি ধ্বনিও চিহ্নায়কের ভূমিকা নিতে পারে। গড়ে উঠতে ভাবনার সঙ্গে ভাষার পারস্পরিকতা। একে আমরা বলতে পারি phono-signifier বা স্বন-চিহ্নায়ক। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের এই কবিতার বইটির পাতায় আমরা খুঁজে পাই এই স্বন-চিহ্নায়কের ধ্বনিতরঙ্গ। আশাকরি করি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বাঁকবদলের অভিমুখে প্রতিষ্ঠা পাবে বইটি।



No comments: