Friday, March 11, 2022

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা



আকাশে রক্তের রং 

রক্ত ঝরে মেঘ থেকে, গাছ থেকে, পাতা ফুল থেকে 
পরিযায়ী পাখিরাও শেষবার দিগন্তে ডানা মেলে উড়ে চলে গেছে 
লক্ষ্মীপেঁচার মতো অনির্দেশ ছায়া অন্ধকারে। 


আজ মহাপৃথিবীর ফসলের মাঠে 
কৃষকের শেষ কান্না -- সম্মোহন বাঁশির ডাকে করুণ সে সুর 
গোসাপ চন্দ্রবোড়া বহুরূপী দুধরাজ বাঁশ জলঢোঁড়া 
লুকিয়ে পড়েছে বহুদূরে।  


জল আর নেই, নদী আজ ডুবে গেছে চাঁদের কিনারে  
অস্তাচলে শেষ লেনদেন। 
পালতোলা ধানশালি নৌকোর মতো
স্বপ্নের মতো নীল, স্বর্ণের মতো তার আভা 
গাংচিল লক্ষ্মীপেঁচা গাঙুড়ের কাব্যময় বিভা  
ইতিহাস বিবর্ণ হয় সিঁড়িভাঙা বুরুজে, মিনারে। 


মনুষ্যপ্রজাতির স্বপ্নমাখা স্বর্ণিল খড় 
মন্দির মসজিদ খেলা, যুদ্ধবাদী রাজনীতি ঝড় 
থেমে গেছে -- ফেলে যাওয়া পুরোনো প্রাচীন গ্রহতীরে। 


রেখে গেছে আকাশের নৈর্ব্যক্তিক সীমা 
ঝরে পড়া রক্তের নীরে। 


যুদ্ধ 

ওদের পাশেই ছিল বিষমাখা ছুরি। 
ওদের হাতেই ছিল বুনো কুকুরের দড়ি। 
ওদের ঘরেই ছিল পিস্তল, বোমা ও গ্রেনেড। 
জমা করে রাখা ছিল যুগ যুগ ধরে।

ওদের শেখানো ছিল,
“মারতে এলেই যেন মার খেয়ে মরে।”
ওদেরকে বলা ছিল,
“লাশের ওপরে যেন অন্য লাশ পড়ে।”

তারপর, রণক্ষেত্র। 
বাঁচার লড়াই। 

কিন্তু ওরা ছোরা বোমা পিস্তল না নিয়ে 
অদ্ভুত কৌশলে 
তুলে নিলো সংবিধান,
ঢাল বর্মের মতো এঁটে নিলো বুকের ওপরে।

রাস্তা গ্রাম নদী দেশ 
ভেসে গেলো নতুন জোয়ারে। 


বিপ্লব 

এসো, ধরো 
আঙুল বাড়াও 
বন্ধুরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

ওঠো, জাগো 
রক্তপলাশ ফোটা 
সকালের আলো 
হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে। 

নামো, সিঁড়ি বেয়ে 
তাকাও নিচের দিকে 
রাস্তার ধুলো মাখো পায়ে 
জুতো খুলে রাখো 
পবিত্রতার পথে হাঁটো। 

এসো, খেলো 
কিতকিত, চড়ুইভাতির খেলা 
কাটাকুটি, সাপলুডো, বল 
ইশারায় ফিসফিস  
ইঙ্গিত, নিষিদ্ধ সঙ্গীত গাও, 
ওদের শেখাও। 

তারপরে চলো 
ভেঙে ফেলো একসাথে 
এই ব্যর্থ অন্ধকার 
পাপিষ্ঠ অচলায়তন। 
চূর্ণ করো কারাগার,
মুক্ত করো বন্দীদের। 

হাত ধরাধরি করে সব 
একসাথে হেঁটে যাও 
দূরে নীল সমুদ্রের দিকে। 


সমুদ্র আর আকাশের গল্প 

সমুদ্র থেকেও কখনো কখনো আগুন বেরোয়। 
উৎক্ষিপ্ত হয় আগ্নেয়গিরির মতো। 
যেন সমুদ্র বলছে,
"আমাকে দেখে যদি মনে করো আমি শুধু নীল জল 
ভুল করবে। 
আমার মধ্যে লাল আছে জ্বলন্ত শিখার মতো,
আমার মধ্যে ধূসর আছে উত্তপ্ত ছাইয়ের মতো,
আমার মধ্যে হলুদ আছে লাভাস্রোতের মতো।"

সমুদ্র পাড়ি দেয় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে 
সে বয়ে নিয়ে যায় তার সমস্ত রং, উত্তাপ, আবেগ 
জঠরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ঝিনুক প্রবাল শঙ্খের মতো,
অক্টোপাস, বিষাক্ত জেলিফিশ, হিংস্র হাঙ্গরের মতো,
জাহাজ গিলে খাওয়া দৈত্যাকার তিমির মতো। 
এক এক বিশাল ঢেউতেই সমুদ্র এক একটা শহর, জনপদ 
সভ্যতা গিলে খেতে পারে। 

সমুদ্র শান্ত হয়ে থাকে সারাদিন। 
দিবানিদ্রা দেয়।  
হয়তো বা খেলা করে, 
ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় শিশুর হাসির মতো 
ছোট ছোট ধবধবে সাদা দাঁত মেলে হাসে। 
ঘোরাফেরা করে, মানুষের গন্ধ মাখে,
যুবতী প্রেমিকার মতো যুবক প্রেমিকের গায়ে 
লাস্যভরে ঢলে ঢলে পড়ে। 
মূর্খ নৌকোগুলো তার বুক চিরে চলে যায় 
অর্বাচীন ঔদ্ধত্যে। 

রাত হলে সমুদ্র চোখ খুলে চায় 
পূর্ণযৌবন পুরুষের মতো 
আকাশের বুকে অজস্র তারার দিকে চেয়ে 
তাদের সঙ্গে যেন কী একটা পরামর্শ করে 
জোনাকির মতো অদৃশ্য ব্যস্ততায়। 
তারপর বহুকাল ধরে জমে থাকা, 
বুকের ভেতরে বেঁধে রাখা 
জলকে, ঢেউকে, হাওয়াকে, রংকে 
ফুসফুসকে, অন্ত্রকে, হৃদয়কে 
খুলে দেয়। 
তার চোখে নতুন আলো জ্বলে 
তার মুখে তখন নতুন শব্দ হয়। 

সমুদ্র আকাশের দিকে চায় 
হাসে। 
চুপিচুপি কী যেন পরামর্শ করে। 
তারপর হাত ধরাধরি করে 
চোখে চোখ রেখে 
পাড়ি দেয় 
অজানা এক বিশেষ গন্তব্যের দিকে। 
 
ওদের সে রাঁদেভুর কথা 
মূর্খ নৌকোগুলো আর তার ঘুমন্ত মানুষযাত্রীগুলো  
জানতেও পারেনা। 


নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
মোমবাতি শিখার মতো 
দুহাতে আড়াল করে। 
সে আলোতে মুখ দেখি। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
অসুস্থ সন্তানের পাশে 
নিদ্রাহীন রাত্রির মতো। 
প্রহরে প্রহরে তাকে দেখি। 
হাত রাখি কপালে ও গালে। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
আকাশঘুড়ির মতো 
সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নামবার আগে 
লাটাই গুটিয়ে রাখি 
কাল ভোরে ফের খেলা হবে। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
বাংলা ভাষায় 
প্রিয় মানুষের সাথে 
একবার পরিচিত 
নির্মেঘ নির্জলা 
হৈ হৈ আড্ডা দেবো বলে।



No comments: