Sunday, February 13, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
[ ষষ্ঠ পর্ব ]

আমরা কি কবিতাকে শিকড়ের সমসাময়িক অনুসন্ধান বলে মনে করতে পারি? কবিতায় সমসাময়িকতার কি কোন নিজস্ব সত্তা আছে? অথবা শিকড় অনপেক্ষ হয়ে সাম্প্রতিক কি কখনো দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কবি যেহেতু একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তি যেহেতু একটি সমাজ ও ঐতিহ্যের অংশ,  ফলত সময় এবং স্থান এই দুইয়ের মিলিত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই সামাজিক এবং ঐতিহ্যগত স্বারায়নের প্রভাব তার অভিজ্ঞতাকে পরিবর্তিত করে, যে পরিবর্তন কবি তার ঘনিষ্ঠ পৃথিবীর বোধ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গ্ৰহণ বা বর্জন করতে পারেন।
এখানে শিকড় খোঁজার চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। আমরা অনন্যপায় হয়ে কবির মানস জগতে অনুসন্ধান করি। প্রতিমা ও প্রতীকগুলিকে বিশ্লেষণ করি কোন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বা অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য।


"অতিদ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি বনসাই শহরে। তোমার শরীর থেকে 
নেমে আসা সহজ গোধূলি আজ আর কোন জেব্রা পারাপার করল না
পুরোনো গ্রামাফোনে ঘাড় কাৎ করে থাকা বেহালার ছড়টাও
একটানা বেজে বেজে ঘুমিয়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের ভেতর

যে সাঁকোর পার বরাবর সূর্যাস্ত  হারিয়ে যায় তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে 
কাঁটা-চামচেরা একটা তদন্ত শুরু করুক
প্যালেটের কিনারে লেগে থাকা ছইনামচা অন্তত সে কথাই বলছে

ল্যান্ডস্কেপের মৃদু শিথিলতাও

পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল 
ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক

পাড়াতুতোদের চোখ এড়িয়ে অডিটোরিয়ামের গলায়
কয়েকশো মেগাবাইট চুপ করে থাকা যতিচিহ্নের দিনযাপন গাইছে"

( সিম্ফনি )

এই কবিতাটি বহুমাত্রিক পাঠের দাবিদার হয়ে আমাকে কবিকৃত "ডেলিরিয়াম" শব্দটির প্রয়োগ দক্ষতায় উপমেয় আর উপমানের পরস্পর অভেদ কল্পিত সাঙ্গ রূপকের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। কারণ ইংরেজি শব্দ "ডেলিরিয়াম"- এর বাংলা অর্থ "ভুল বকা"। অর্থাৎ ডেলিরিয়াম হল মস্তিষ্কের ক্রিয়ার হঠাৎ অবক্ষয় যা মানসিক কর্মহীনতা সৃষ্টি করে। ডেলিরিয়ামের অবস্থায় একজন মানুষ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অনুভব করেন। অথচ কবি লিখে ফেলেন " পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল / ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক"! আমরা রূপকের অভিপ্রায়কে অতিক্রম করে একটা প্রার্থিত স্পর্ধার দিকে এগিয়ে যাই। কবি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান। সমগ্ৰ কবিতাটি তাই উৎপ্রেক্ষার ঘনঘটায় ঘটমান। বর্তমানকে লুকিয়ে রেখে কবি তাঁর পাঠককে চিনিয়ে দেন কিভাবে শব্দপ্রগতির অবগাহন মানসিক ও বাচনিক প্রযত্ন পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুর তোলে। 

কবি শান্তিময় মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতার বই "অপঠিত জলপাইলিপি"- র পাতায় পাতায় এরকম আরো চিত্রকল্পের আকুলিবিকুলি প্রযুক্ত করেছেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই বইটির প্রকাশক 'কবিতাপাক্ষিক'। কবি মাত্রই প্রেমিক। তাঁর প্রেম উৎসারিত হয় লালিত শব্দে,ছন্দে, অদেখাকে দেখার স্বভাবজাত বিন্যাসে। কিন্তু শান্তিময়ের দেখার ভেতর একাকিত্বের ডেলিরিয়াম আছে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যের মুন্সিয়ানায় বিচ্ছিন্নতার সুরটি তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত। 

"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে
না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে
তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল
প্রসূতিসদনের দরোজায়

শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে
কপাললিপির অস্পষ্টতা ধরা পড়বে মোটা দাগের রেখায় 

আমলকি পাতায় ফুটে ওঠা করচিহ্ন 
আজো জানল না এইসব 

মৃগশিরা নক্ষত্রের চোখে কেন একদিন
নেমে এসেছিল অন্তবর্তীকালীন ঘুম"

( পরকীয়া )

কুণ্ডলিনী জাগরণের একটি লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।
আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে।
কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই না জ্বলে ওঠা আলোটির প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি ( Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 


"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে / না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে / তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল /প্রসূতিসদনের দরোজায় / শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে "

যেন এক আশ্চর্য সংবর্তনের শৈলী। দৃশ্যমান ও বোধগম্য বাস্তবের সীমার ওপারে যার দ্বিজত্বলাভ কিংবা কপাললিপির নিয়তি। যেখানে পরাবস্থারও পরাবস্থা আছে। আছে "অন্তবর্তীকালীন ঘুম"!  অর্থাৎ অবস্থার স্থিতিলাভ। কবিতার পূর্ণ জাগরণ !  কবিতার ইউটার্ন পরিণতি।

শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতার বইটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে । এখানে সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন প্রসূতিসদনের দরজার অপেক্ষা। আশাকরি এরকম আরো বহু অপেক্ষার উৎসে পাঠক তাকিয়ে থাকবে পরবর্তী কবিতার সেমিওলজির দিকে।





1 comment:

Anonymous said...

অসাধারণ আলোচনা।