Sunday, February 6, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা (পঞ্চম পর্ব )

মানুষের সমস্ত সৃজনই সময়-শাসিত। সময়ের স্বর যেমন বদলায় অভিব্যক্তির ধরনও নিশ্চিতভাবে বদলে যেতে থাকে। বাস্তব ও কল্পনার যুগলবন্দিতে সময়ের ভাষা যত রূপান্তরিত হয়, কবিতার শিল্পভাষায় তত মাত্রান্তর ঘটে। নান্দনিক বোধ তাই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিরন্তর নতুনভাবে প্রতিফলিত হয়। সেই প্রতিফলনের পরিগ্রহণ গ্রহীতার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। বাংলা কবিতার চারণভূমি যেহেতু নানা অঞ্চলে সম্প্রসারিত, পাঠকবর্গের উপলব্ধিও বহুমাত্রিক, স্থির ও বহমান সময়ের মধ্যে সেতু রচনা করতে গিয়ে কবিতা আপন প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু কতভাবে বিনির্মাণ করছে, তারই বিশ্লেষণী পাঠ আলোচনা করার প্রস্তাবে আমি কবি তিলোত্তমা বসুর কবিতার দিকে আচ্ছন্ন হলাম। তিলোত্তমার কবিতার সময়শীলিত শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের দ্বিরালাপে অনির্বচনীয় নান্দনিক আলো কীভাবে জ্বলে ওঠে, তারই হদিশ  পেতে " জার্নি" কাব্যগ্ৰন্থটির ( প্রকাশক- ধ্যানবিন্দু, ২০১৫ ) একটি কবিতার পাঠ নেওয়া জরুরি।


যদি ক্ষমার আয়না দেখ -- আমি আফ্রোদিতি।
শরীরে গোলাপ-ক্ষত।
দারুন বিরহ থেকে চুমুর স্পঞ্জই পারে
কাঁটার পাহারা মুছে দিতে!
এমন ঘোরাও তুমি নাগরদোলায়
চামচে চামচে এত প্রেমের সিরাপ
যদি ঢালো...
চলো তবে গুহাজীবনেই ফিরি--
বুনোফুল অজানা বেনামী।
বুকের চাতালে প্রেমের মজলিশ রোজ বসে
বিনুনি এলিয়ে দিয়ে বসেছি অলস
সোলাঙ্কি-কুমারীর বেশে।


ঘোরে সূর্য আমার নির্দেশে
ইচ্ছে গতিতে যেন অক্ষ ঘুরছে
তারাদের ফুলঝুরি কুড়িয়ে কুড়িয়ে
বাতাসে ছড়িয়ে যায়
বর্শা ভলকেরা স্তব্ধ মেরুদেশে...
যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস !
এসো আমার ইগলুতে...


হাওয়া মোরগেরা ভোর থেকে ডাকে।
খামার বাড়িতে ঘোড়া ছুট দেয়
সোনালী গমের ক্ষেতে...
তোমার পায়ের গোছ
আলগোছে বুকে তুলে দেখি 
শস্যের দানা লেগে আছে ,
লেগেছে দিগন্ত ধুলো
সরল সবুজ ঘাসে উপত্যকা ঢাকা।
রাত শেষে কেন
আমার স্কার্টের ঘের পেয়ে বসে
দর্জির খ্যপামি ?
স্কার্ফ যায় উড়ে... হু হু অলি মন খারাপের
তুমি কি মার্চের সাইকেলে !


জানি খেলতে এসেছ... খেলো...
দাবা হোক ক্যারম বা লুডো
নিজেকে চালিনা আর ঘুঁটি
সাদ কালো লাল পয়েন্টেরা সময়ের
কেন হারাবে আমাকে ? -- চিটিং মানি না মোটে
সবুজ ঘাসের সঙ্কেতে চুপিচুপি
উড়ে আসি...


এসে দেখি ক্ষমার আয়না !
চুমুর স্পঞ্জে সব মুছে দিলে কিনা !
লজেন্স লজেন্স গন্ধ খাতার পাতায়
বোতাম খুলতে কি অবাক--
এদেশে এখনো
ম্যাপ আঁকা বাকি !! 

( আফ্রোদিতি)


গ্রিক পুরাণের প্রেম, আনন্দ, আবেগ এবং সৌন্দর্যের দেবী হলেন আফ্রোদিতি।  হেসিওডের থিওগোনি অনুসারে আফ্রোদিতির জন্ম সমুদ্রের ফেনা থেকে। ইউরেনাসপুত্র ক্রোনোস তার পিতার লিঙ্গ কর্তন করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে সেই লিঙ্গ থেকে শুক্র সমুদ্রের জলে মিশে আফ্রোদিতির জন্ম হয়। এই আফ্রোদিতির অনুষঙ্গ আত্মস্থ করেই তিলোত্তমা কবিতাটির মুক্তি ঘটালেন। যৌনতা মৌনতা ও তারুণ্যের বোধ থেকে এই কবিতা পৌঁছে গেছে নিসর্গনিবিড় আবেশের স্নিগ্ধতায়। চন্দ্রকলার পরিবর্তনের মতো ঋতুচক্র যেন জীবনচক্রকে, বিকাশের বৃত্তে অবস্থিত সব চাপকে, সৃষ্টি ও শিল্প সৃষ্টির ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাই কবি বলেছেন, "যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস ! / এসো আমার ইগলুতে..."। কবিতাটি বৃত্তবদ্ধ পরিবর্তন এবং নিরন্ত পুনর্জননের প্রতীক হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ঊষরতা-উর্বরতার 
শরীরী অনুবর্তনে কবি ঘটিয়ে ফেলেছেন রতি ও আরতির প্রতিমান। সংযুক্তি ও বিযুক্তির নিরিখে যা একেবারেই বিপরীতমুখী ভাবনার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত শমিত হয়, "বোতাম খুলতে কি অবাক-- / এদেশে এখনো ম্যাপ আঁকা বাকি !! " অর্থাৎ একটা আকাঙ্ক্ষা। একটা প্রশ্নবোধক অতৃপ্তি। সব আছে, তবু কবি যেন জীবন অভিমুখী দূরত্ব-দ্যোতনার সঞ্চার ঘটাতে চাইছেন ! স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তিলোত্তমার কবিতার এই অর্জন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ইঙ্গিতবাহী।

সেই ইঙ্গিতের পরিকল্পিত মগ্নতা খুঁজে পাই "বন্ধু" নামের কবিতাটিতে। পরিকল্পিত মগ্নতা বললাম এই কারণেই যে, কবিতাটি আসলে একটা সেলফ
পোট্রেটের মতো। কবি নিজেকে নিজেই নিয়োজিত করেছেন।

"অথচ প্রেমের তাপ লাল শাড়ি পরায় আমাকে।
 
যাজ্ঞসেনী, হোম থেকে দেখি পাঁচ স্বামী।
আছেন যদিও ওঁরা তবু সখা তুমি কেন?
কেন যে স্মরণ করি তোমাকেই বিপদভঞ্জন!
আর শাড়ির আবেশ এসে ঢেকে দেয় নগ্ন
না পাওয়া আমার। পাঁচ স্বামী পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মতো।
তুমি তবু ষষ্ঠইন্দ্রিয় জন, পদ্মমধুতে গুন্ গুন্ ,
নীল উড়ে আসা টান চৌকাঠ ডিঙানো...
 
ফুলের বাগানে যাই। সরোবরে জ্যোৎস্নায়।
এই কি আমার কুঞ্জ? আজীবন নিজেকে শাসন, তবু,
তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"

( বন্ধু )

যজ্ঞের অগ্নি থেকে তিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে তার নাম যাজ্ঞসেনী। সে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। কবিতার শুরুতেই প্রেমের উষ্ণতা আর লাল শাড়ির দৃশ্যকল্পে আমরা একটা আশ্চর্য অনুভবের প্রান্তদেশে পৌঁছে যাই। চলে আসে যাজ্ঞসেনীর মতন এক অমর চরিত্র। কিংবা চরিত্রের অস্থিরতা। একেবারে শেষ লাইনে, "তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"এই কবিতার গভীরতা অনুধাবন না করতে পারলে পাঠক হিসেবে ব্যর্থতাই স্বীকার করে দিতে হবে। যেন সহজিয়া পথের কুঞ্জে ফুল ফোটান কবি। অতীতকে ভিতরঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসেন তিনি। অথচ আজীবন নিজেকে শাসন করেন তিনি। আমরা অদ্ভূতভাবেই খুঁজে পাই আজ্ঞাবহ নিখোঁজের পর্যাঙ্ক ! কবির আবেগ এখানে নিয়ন্ত্রিত আর চিত্রকল্প শুধু চিত্র নয়, অন্য অনেক কিছুর ভাসক।

তিলোত্তমার কবিতা প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে, গহনভাবনার ডুবুরি কবি কাব্যের আবাহনে জগৎ-সংসারের যাবতীয় অসুন্দর ও আবর্জনাকে প্রত্যাখ্যান করতে করতে বোধের উত্তুঙ্গ মহিমার দিকে এগিয়ে যান। বিশেষত তিনি আঁধি ও স্খলনের মধ্যেও ঐতিহ্যের চিরায়তনে আস্থা রাখেন।


হয়তো আস্থা রাখেন বলেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা অনতিক্রম্যতা কবিতার উপপাদ্যে প্রযুক্ত হয়। অথচ কবিতার মতো শক্তিমান অবাস্তব আর কী আছে? কয়েকটি ধ্বনি দিয়ে অথবা চিহ্ন দিয়ে পরপর সাজিয়ে তোলা একটি পরম্পরা, একান্তই আর্ত গঠন একটি, কী মায়ার খেলায় জড়িয়ে ফেলেছে মানুষকে। যেমন ইউক্লিড জ‍্যামিতির axiom-গুলি অথবা পিয়ানোর সংখ্যাসংক্রান্ত axiom গুলি। প্রথমে গুচ্ছকে ধারণ করার জন্য আছে বিন্দু, সরলরেখা ইত‍্যাদি জ‍্যামিতিক অবাস্তব বস্তগুলি। আর দ্বিতীয় গুচ্ছের জন্য বিমূর্ত পূর্ণ সংখ‍্যার দল। এইভাবেই বাস্তব বস্তু থেকে কল্পনায় এবং তার পরে সে কল্পনার বাণীরূপ। তাই কবিতা হলো নিয়মবদ্ধ সিমেট্রি থেকে মুক্ত হবার একটি রিক্ত কৌশল।

1 comment:

দিশারী মুখোপাধ্যায় said...

পড়ছি আর পড়ছি। বেশ লাগছে।