Saturday, February 26, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
সপ্তম পর্ব        

কবিতার কোন আচরণই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটে না। উদ্দেশ্য মূলক আচরণের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই যে আভ্যন্তরীণ তাগিদ তাকেই আমরা কবিতাটির প্রেষণা বলব। কবি এই কার্যপদ্ধতির মধ্যে চেতনা জারিত করে। তাই প্রেষণা বাধাপ্রাপ্ত হলে প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। অথচ কবিতা দুভাবেই লেখা হয়। মূর্ত অথবা বিমূর্ত। কেউ কেউ নিজের চারপাশে খুব বিমুর্ত এক আবহের সৃষ্টি করে নিয়ে লিখতে পারেন  বা লেখেন। চেনা জগতের অনেক বাইরের কথা।পাঠক তার নাগাল বা স্পর্শ পায়না  সহজে। আবার কেউ লেখেন জীবনঘনিষ্ট কিছু পংক্তিমালা যা পাঠকচিত্তের কাছাকাছি। পাঠক চাইলেই  স্পর্শ করতে পারে, ঢুকে পড়তে পারে কবিতার আদ্যোপান্ত শরীরে। কবিতার ভাষায় ধ্বনিপ্রতীকতার কথা বলেছেন ভাষাবিদরাও। সকলেই জানেন শব্দ ও অর্থের মধ্যে অন্তর্লীন কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু কবিতায় কখনও কখনও ল্ক্ষণীয় হয়ে ওঠে শব্দ ও অর্থের মেলবন্ধন। তৈরি হয় motivated sign। আর এরকমই এক পরিত্রাণের ত্রাণ নিয়ে যখন কোন কবি অভিজ্ঞতার রূপায়ণে রূপকের ইমেজ গড়ে তোলেন তখন পরিকল্প ( schemas ) চেতনার চর্যায় একটা বিশেষ রৈখিকতা তৈরি করেন । কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের "একটি গোপন বাঘ" ( প্রকাশক- প্ল্যাটফর্ম, প্রকাশকাল- ডিসেম্বর ২০২২ )    নামের কবিতার বইটি তেমনই এক শিল্পায়নের চিহ্নায়ক।

এখানে "চিহ্নায়ক" শব্দটির লেখার পেছনে অবশ্যই আমার একটি সচেতন বিধেয় আছে। মানুষ কেন বিমূর্ত ধারণা গঠন করে রূপকার্থে? মানুষের ভাষায় বিমূর্ত ভাবনা গড়ে ওঠে কতগুলি অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে। দেখা,ধরা, দাঁড়ানো,হাঁটা প্রভৃতি দৃষ্টিগ্ৰাহ্য ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপ গুলির ভেতর মানুষ বিমূর্ত ধারণা তৈরি করে নেয়। সময় যেন চোখে দেখার বিষয়। কবি দেখছেন। "একটি গোপন বাঘ" - এর Personification বা সমাসোক্তির মাধ্যমে।


"ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি, সামনেই বসে আছেন কাফকা। না ঠিক কোনো 
পোকার মতো দেখতে নয়।চোখের তলায় কালিও নেই।শ্বাস নিতে অসুবিধে 
হচ্ছে? উত্তরে চুপ করেই থাকলেন।আমিও চুপ করেই থাকলাম। বাইরে শ্রাবণ। 
ভিতরে শ্রাবণ। আর আশ্চর্য ভয়। কাফকা বসে আছেন।আর ক্রমশ আমি রোগা 
হয়ে যাচ্ছি। এলোমেলো উড়ে যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি। চেনা, পরিচিত, ইস্কুলড্রেসের 
মতো লেখা।আর কাফকা অস্ফুটে বলছেন, আমার লেখাগুলো তোমরা পুড়িয়ে 
দিলে না কেন? আমার ভয় করছে।মেঝে, ছাত দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালগুলো 
দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ গাইতে গাইতে একটা মাঠের মধ্যে চলে এসেছি। দূরে 
দূরে পাহাড়।সেখানে আমার দেওয়ালগুলো। আমার ছাত থেকে মেঘ নেমে 
আসছে মাথার উপর। ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।ফ্রাঞ্জ কাফকা। 
আর বিড়বিড় করে বললেন," আলোই অন্ধকার, অন্ধকারই আলো"। আমার ঘর 
আর খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে 
ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

( ম্যাক্স ব্রড )

এই কবিতাটি পাঠ করতে করতে কাফকা আর তার বন্ধু মাক্স ব্রডের অবিস্মরণীয় ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর সেই বিখ্যাত উপন্যাস "ডি ফেরভান্ডলুঙ্গ"(রূপান্তর)। উপন্যাসের প্রথম লাইনটি----" এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল–সে পোকা হয়ে গেছে!' এই উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠক এই একটি লাইনে যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যাক্স ব্রড নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। যাঁর সঙ্গে কাফকার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। এদিকে প্রেমে ব্যর্থ,  স্বল্প রোজগেরে ক্ষীণজীবী মানসিক ভাবে ভঙ্গুর ও বিষাদাচ্ছন্ন কাফকা বন্ধু ম্যাক্সকে এক আশ্চর্য চিঠি লিখলেন।  প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স, আর হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও করা হয়ে উঠছে না। আমার লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলি হয়তো কালস্রোতে হারিয়ে যাবে। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় বলছি, সব পাণ্ডুলিপি আর নোট পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলি সংগ্রহ করেও পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ যেন সেসব পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। বলাই বাহুল্য বন্ধুকে অত্যন্ত  ভালবাসলেও এক্ষেত্রে বন্ধুর কথা রাখেননি ম্যাক্স ব্রড। বরং তিনি নিজে সেসব লেখা পড়লেন। পড়ে বিস্মিত হলেন। আর যত্ন করে সেই সব লেখা প্রকাশ করলেন।

এটি আমাদের চেনা একটি দৃষ্টান্ত মূলক কাহিনী। অথচ হিন্দোল "ম্যাক্স ব্রড" নামের কবিতাটিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাফকার সঙ্গে তার কাল্পনিক যাপনের চিত্ররূপ। এখানে ফ্রান্‌ৎস কাফকা আর হিন্দোল মিলেমিশে একাকার। তাদের মধ্যে যেন একই রকম যাপন প্রবাহের প্রেক্ষাপট। শুধু পোকাটিকে নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই।বাইরে শ্রাবণ। ভিতরে শ্রাবণ। মা কবির কল্পনা ও  অনুভবের আলোআঁধারিতে স্বতন্ত্র। এই কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্যোতনাসঞ্চারী ধারণাগত বা Conceptual রূপক। তাই কবিতাটি বহুবার পাঠ করার পরেও আবার পাঠের অপেক্ষা রাখে। কবি কবিতাটির একবারে শেষ পঙক্তিতে গিয়ে লেখেন--

"সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

আলো অন্ধকারের সঙ্গে যেমন Acute-Grave স্বলক্ষণের সম্পর্ক, তেমনি স্থিরতা-অস্থিরতার সঙ্গে Compact-Diffuse স্বলক্ষণের সহযোগ। সমস্ত কবিতার বইটি জুড়ে কবি লিখে দিয়েছেন এরকমই বহু প্রতিবর্তের আবর্তন। আসুন আমরা সেই আবর্তনের স্পন্দনে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখি---

"আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। হয়তো তোমার কথা লিখি কিংবা 
দীনু ভিখারির। যে দেহ মৃতের মতো ঠান্ডা কিংবা যে মৃত দেহের, লিখি তারও 
কথা।যে পুজো তোমার,কিংবা যে তুমি পূজার, — তুমিও তো লেখ আমাকেই । 

আমি ও লেখার মধ্যে এক আকাশ আলোকবর্ষ আছে। সাতের দশকে তিন 
ছেলেকে হারিয়ে আজও হারুর দোকানে রোজ জিলিপি ও রাজনীতি খেয়ে যান
রমেন ঘোষাল।রাতের হাঁপানিটুকু চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে হারুনচাচার।
আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। ভোররাতের বড়োবাজার শুঁকতে 
শুঁকতে বুঝি,জীবন মশলার গন্ধ। গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ। 

এ কথা ভুলিনি তবু, সে রয়েছে ঝোপের মধ্যে, গুঁড়ি মেরে, পুরোনো স্যাঙাত। 
আমিও সংগীতপ্রিয়, যার কোনো স্বরলিপি নেই। একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই 
অহঙ্কার করে।

যে-কোনো মুহূর্ত শেষ হয়ে যেতে পারে লেখা, এ জীবন অসমাপ্ত রেখে। বাসি 
মুখে নেমে পড়ি হরিদাস মোদকে। ওপাশে নেতাজি আর এপাশে মা-কালী।"

( আচমন )

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ধ্বনিকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে বিদেহ রাজের প্রশ্ন ছিল-- পৃথিবীতে যখন সূর্য থাকবে না, চন্দ্র থাকবে না, সেই অন্ধকারে কিভাবে পথ চলব? যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-- ধ্বনি। ধ্বনিই তোমাকে পথের সন্ধান দেবে। জাগতিক জীবন যেকোনো মুহুর্তেই থমকে যেতে পারে। কিন্তু তাতেই বা দুঃখ কিসের? ধ্বনি! জেগে থাকবে ধ্বনি। কবি তাঁর নিজস্ব ধ্বনিতেই জেগে থাকবেন। এরপর অন্য আর একটি চিত্রকল্পের দ্যোতনা---

"একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই অহঙ্কার করে"

আমাদের অভ্যস্ত, পরিচিত জীবনের মধ্যে এই চিরকালের ছবিটির সঙ্গে কবি প্রবিষ্ট করালেন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের হরিদাস মোদক, নেতাজি, মা কালীর মন্দিরটি। অর্থাৎ কবিতাটি ব্যস্ততর পাঁচমাথার মোড়ের অনিবার্য রসায়নে শেষ হচ্ছে। কবিতাটির সংগঠনে সামাজিক-রাজনৈতিক সংবর্তন লক্ষ করা গেলেও, এরই ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেমের প্রবাহন। উজ্জ্বল অতীত আর ছায়াঘন বর্তমান নিয়ে কবির প্রশ্নকাতরতা। জীবন অভিযোজিত মেটাফর।

" একটি গোপন বাঘ" আসলে ব আ ঘ -- এই তিনটি ধ্বনির মিলিত ধ্বনিরূপ। আর আমাদের মনের চোখে বাঘ নামক প্রাণিটির যে ধারণাগত রূপ, তাই হলো চিহ্নায়িত। মনোলোকে বস্তু বা প্রাণি জগতের ধারণাগত উপস্থিতি সম্ভব হয় বলেই আমাদের পক্ষে শব্দের উদ্দীপক থেকে অর্থে পৌঁছনো সম্ভব। বাঘ কে বোঝানোর জন্য বাঘের কাছে উপস্থিত হবার প্রয়োজন ঘটছে না। ফলত ভাষার একটি নিজস্ব এলাকা আছে, যেখানে শব্দের অন্তর্গত এক একটি ধ্বনিও চিহ্নায়কের ভূমিকা নিতে পারে। গড়ে উঠতে ভাবনার সঙ্গে ভাষার পারস্পরিকতা। একে আমরা বলতে পারি phono-signifier বা স্বন-চিহ্নায়ক। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের এই কবিতার বইটির পাতায় আমরা খুঁজে পাই এই স্বন-চিহ্নায়কের ধ্বনিতরঙ্গ। আশাকরি করি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বাঁকবদলের অভিমুখে প্রতিষ্ঠা পাবে বইটি।



Wednesday, February 16, 2022

দেবশ্রী দে'র কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      দেবশ্রী দে'র কবিতাগুচ্ছ



জলাশয়টুকু

পার হয়ে বুঝি
দেখা হয়নি অনেক কিছুই

গা বাঁচিয়ে ভেসে গেলে
ছোঁয়া যায় না-
দুঃখের অণু অণু সুখ

অথচ পেরিয়ে এসেছি সব
মৃত্যুর আগে


স্বপ্নেরা উলঙ্গ হলে

দিনের আলো ফুটলেই
স্বপ্নেরা উলঙ্গ হয়ে
নেমে পড়ে রাজপথে

খুলে যায় কল্পনাপ্রসূত
আচ্ছাদন। আভরণ
চুঁয়ে পড়ে রক্ত, ঝরে স্বেদ

প্রিয় শরীরে যেমন
তারা অবাঞ্ছিত,
মনসিজ স্বপ্নেও তাই-ই

কিছু রাত স্বপ্নবিহীন হওয়া আবশ্যক।


পাখিটার

পিঠে অগুনতি পালক
আমরা চাইলেই
সেগুলোকে সাজিয়ে
কষতে পারি অসংখ্য সমীকরণ

দুঃখের কথা এই যে,
আমরা কখনোই
সেইসব সমীকরণে চেপে
উদ্দেশ্যহীন উড়ানে সামিল হই না 


রূপকথা

ডানাবিহীন, আমার নিঃশর্ত রাত

এক পা এক পা ক'রে
হেঁটে যাওয়া ছাড়া
কোনও রূপকথার গল্প নেই

তুমি শিখে নিয়েছ
উড়ানের আশ্চর্য জাদুকরী,
কুয়াশায় রেখেছ অস্তিত্ব

নির্দ্বিধায় আমি শিশির মাখছি
তোমাকে ছোঁয়ার নামে।

Sunday, February 13, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
[ ষষ্ঠ পর্ব ]

আমরা কি কবিতাকে শিকড়ের সমসাময়িক অনুসন্ধান বলে মনে করতে পারি? কবিতায় সমসাময়িকতার কি কোন নিজস্ব সত্তা আছে? অথবা শিকড় অনপেক্ষ হয়ে সাম্প্রতিক কি কখনো দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কবি যেহেতু একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তি যেহেতু একটি সমাজ ও ঐতিহ্যের অংশ,  ফলত সময় এবং স্থান এই দুইয়ের মিলিত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই সামাজিক এবং ঐতিহ্যগত স্বারায়নের প্রভাব তার অভিজ্ঞতাকে পরিবর্তিত করে, যে পরিবর্তন কবি তার ঘনিষ্ঠ পৃথিবীর বোধ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গ্ৰহণ বা বর্জন করতে পারেন।
এখানে শিকড় খোঁজার চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। আমরা অনন্যপায় হয়ে কবির মানস জগতে অনুসন্ধান করি। প্রতিমা ও প্রতীকগুলিকে বিশ্লেষণ করি কোন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বা অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য।


"অতিদ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি বনসাই শহরে। তোমার শরীর থেকে 
নেমে আসা সহজ গোধূলি আজ আর কোন জেব্রা পারাপার করল না
পুরোনো গ্রামাফোনে ঘাড় কাৎ করে থাকা বেহালার ছড়টাও
একটানা বেজে বেজে ঘুমিয়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের ভেতর

যে সাঁকোর পার বরাবর সূর্যাস্ত  হারিয়ে যায় তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে 
কাঁটা-চামচেরা একটা তদন্ত শুরু করুক
প্যালেটের কিনারে লেগে থাকা ছইনামচা অন্তত সে কথাই বলছে

ল্যান্ডস্কেপের মৃদু শিথিলতাও

পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল 
ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক

পাড়াতুতোদের চোখ এড়িয়ে অডিটোরিয়ামের গলায়
কয়েকশো মেগাবাইট চুপ করে থাকা যতিচিহ্নের দিনযাপন গাইছে"

( সিম্ফনি )

এই কবিতাটি বহুমাত্রিক পাঠের দাবিদার হয়ে আমাকে কবিকৃত "ডেলিরিয়াম" শব্দটির প্রয়োগ দক্ষতায় উপমেয় আর উপমানের পরস্পর অভেদ কল্পিত সাঙ্গ রূপকের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। কারণ ইংরেজি শব্দ "ডেলিরিয়াম"- এর বাংলা অর্থ "ভুল বকা"। অর্থাৎ ডেলিরিয়াম হল মস্তিষ্কের ক্রিয়ার হঠাৎ অবক্ষয় যা মানসিক কর্মহীনতা সৃষ্টি করে। ডেলিরিয়ামের অবস্থায় একজন মানুষ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অনুভব করেন। অথচ কবি লিখে ফেলেন " পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল / ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেঙে অন্যমনস্ক"! আমরা রূপকের অভিপ্রায়কে অতিক্রম করে একটা প্রার্থিত স্পর্ধার দিকে এগিয়ে যাই। কবি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান। সমগ্ৰ কবিতাটি তাই উৎপ্রেক্ষার ঘনঘটায় ঘটমান। বর্তমানকে লুকিয়ে রেখে কবি তাঁর পাঠককে চিনিয়ে দেন কিভাবে শব্দপ্রগতির অবগাহন মানসিক ও বাচনিক প্রযত্ন পুড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুর তোলে। 

কবি শান্তিময় মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতার বই "অপঠিত জলপাইলিপি"- র পাতায় পাতায় এরকম আরো চিত্রকল্পের আকুলিবিকুলি প্রযুক্ত করেছেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই বইটির প্রকাশক 'কবিতাপাক্ষিক'। কবি মাত্রই প্রেমিক। তাঁর প্রেম উৎসারিত হয় লালিত শব্দে,ছন্দে, অদেখাকে দেখার স্বভাবজাত বিন্যাসে। কিন্তু শান্তিময়ের দেখার ভেতর একাকিত্বের ডেলিরিয়াম আছে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যের মুন্সিয়ানায় বিচ্ছিন্নতার সুরটি তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত। 

"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে
না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে
তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল
প্রসূতিসদনের দরোজায়

শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে
কপাললিপির অস্পষ্টতা ধরা পড়বে মোটা দাগের রেখায় 

আমলকি পাতায় ফুটে ওঠা করচিহ্ন 
আজো জানল না এইসব 

মৃগশিরা নক্ষত্রের চোখে কেন একদিন
নেমে এসেছিল অন্তবর্তীকালীন ঘুম"

( পরকীয়া )

কুণ্ডলিনী জাগরণের একটি লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।
আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে।
কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই না জ্বলে ওঠা আলোটির প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি ( Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 


"এই যে বহুদূর চলে যাওয়া গরাদের মোটা শিক ভেঙে / না জ্বলে ওঠা আলোটির দিকে / তার মান নির্ণয় করতে আবার ইউটার্ন নিতে হল /প্রসূতিসদনের দরোজায় / শুনলে হয়ত মহানির্বাণ তন্ত্রের কথা মনে হবে "

যেন এক আশ্চর্য সংবর্তনের শৈলী। দৃশ্যমান ও বোধগম্য বাস্তবের সীমার ওপারে যার দ্বিজত্বলাভ কিংবা কপাললিপির নিয়তি। যেখানে পরাবস্থারও পরাবস্থা আছে। আছে "অন্তবর্তীকালীন ঘুম"!  অর্থাৎ অবস্থার স্থিতিলাভ। কবিতার পূর্ণ জাগরণ !  কবিতার ইউটার্ন পরিণতি।

শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতার বইটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে । এখানে সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন প্রসূতিসদনের দরজার অপেক্ষা। আশাকরি এরকম আরো বহু অপেক্ষার উৎসে পাঠক তাকিয়ে থাকবে পরবর্তী কবিতার সেমিওলজির দিকে।





Thursday, February 10, 2022

অনুবাদ কবিতায় কবি দেবলীনা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  

অঙ্কিতা আনন্দের কবিতাগুচ্ছ অনুবাদ করলেন কবি দেবলীনা

অঙ্কিতা আনন্দ ২ আগস্ট ১৯৮৫ সালে বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মূলত হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন এবং সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। 
নতুন প্রজন্মের নারীবাদী কবিয়েত্রী অঙ্কিতা আনন্দ আজ সুপরিচিত। আজ তাঁর কয়েকটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি আমি দেবলীনা । 



खाई 
 
तुम्हारी आँखों में तैरते दर्द के रेशे 
दग़ा देते हैं तुम्हारी हँसी के रेशम को,
और प्रश्नचिन्ह लगाते हैं 
हमारे प्यार पर. 

 
 খাদ

তোমার চোখে ভাসমান বিষণ্ণ পলক
আঘাত করে তোমারই মুলায়ম হাসিকে
আর প্রশ্ন চিন্হ নির্দেশ করে
আমাদের ভালোবাসার ওপর


खोज 

ख़ुद को ढूंढ़ने की व्यस्तता में 
शामिल एक इंतज़ार है 
किसी का 
जो हमें ढूँढ़ निकाले.


খোঁজ

নিজেকে খোঁজার ব্যাস্ততার 
মধ্যে আছে এক নিরন্তর 
অপেক্ষা 
যে আমাকে খুঁজে বের করে।


ईश्वर 

हमें कई ग़लत आदतें सिखाता है,
जैसे 
किसी से बातें करना 
बिना ये जाने कि वो सुन भी रहा है या नहीं. 


ঈশ্বর

আমাদের সেই ভুল অভ্যাস শেখানো 
যেমন 
কারুর সাথে কথা বলছো 
অথচ তুমি জানোই না যে কিছুই শুনছে না।



सकारात्मक


अपने व्यक्तिगत शोक के उत्तरदायी आप स्वयं हैं। 

लज्जाजनक कुछ नहीं— 

इस दुर्बलता में भी 

सेल्फ़-हेल्प उद्योग के सक्षम निवेशक हैं आप। 

कश्मीर से लेकर कुमारी 

कन्याओं तक की कहानियाँ 

अगर निजी तौर पर आपकी छाती में बर्फ़ जमाने लगें, 

तो बदलाव की ज़रूरत व्यवस्था को नहीं 

आपके नज़रिए को है 

और यही है 

आपकी हैसियत के भीतर।


 
ইতিবাচক

আপনার ব্যক্তিগত শোকের জবাবদিহির জন্য আপনিই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ 

লজ্জাজনক কিছুই নয়
এই দুর্বল সময়েও 
স্বয়ংক্রিয় উদ্যোগের ইচ্ছাধীন আপনি 

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত গল্পরা
যদি নিজের মতো করে আপনার বুকের ওপর 
বরফ জমাতে চায় 
তাহলে পরিবর্তন প্রয়োজনীয় 
কিন্তু সেটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির,অবস্থার নয়

আর এটাই আপনার অন্তরাবস্তা।


चाय पर चर्चा


बच्चे 

एक स्तब्ध चुप्पी में 

मेज़ पर चाय रख चले जाते हैं। 

उनके नेता कहते हैं 

बच्चों को ‘घर’ के कामों में 

हाथ बँटाना चाहिए ....


चाय बेचने वाले बच्चे बड़े बन सकते हैं 

पर पहले ‘चाय-चाय’ 

चिल्लाना पड़ता है।



চা'য় পে চর্চা 

বাচ্চাটি
এক স্তব্ধ নৈঃশব্দের মাঝে
 মেঝেতে চা রেখে চলে যেতেই

নেতা'জি বলে ওঠেন 
বাচ্চাদের ঘরের কাজে 
সাহায্য করা উচিত 

এই চা বিক্রি করা বাচ্চাটিও একদিন বড় হতে পারে
কিন্তু তার জন্য প্রথমে তাকে 
"চা'য় - চা'য়" হাঁক দিতে হবে 


दु:ख की जगह


दु:ख कहीं भी आपको दबोच सकता है 

एक से एक असुविधाजनक मौक़ों पर 

मीटिंग के बीच 

ठीक आपके बोलने की बारी से पहले 

निवाले में लिपट 

अटक सकता है गले में 

हँसी की पीठ से निकल 

धप्पा कर सकता है 

उसे सोचना, सीखना चाहिए 

संवेदनशील, शांत होना, 

दबे क़दमों से आना 

बस तभी जब सही वक़्त हो 

पर कब? 

कौन-सा समय हमने सुनिश्चित किया है? 

कौन-सी जगह, 

जहाँ उसे मान से बिठा पूछा जाए 

कैसा है वह?


দুঃখের জায়গা 

দুঃখ যখন খুশি তোমাকে আঁকড়ে ধরতে পারে
যেকোন অসুবিধেজনক পরিস্থিতিতে

মিটিংয়ের মাঝখানে 

ঠিক তোমার বক্তব্য রাখার আগে 

গলার কাছে জট পাকিয়ে
তোমার স্বর আটকে দিতে পারে

হাসির পিঠ থেকে বেরিয়ে 
আচমকা ধাপ্পা দিতে পারে

তার শেখা ও ভাবা উচিত 
সংবেদনশীল ও শান্ত থাকা
ধীর পায়ে আসা
ঠিক তখন যখন তার আসার সময় হবে 

কিন্তু কখন ?
ঠিক কোন সময় আমরা সুনিশ্চিত করেছি ?
সে কোন স্থান 
যেখানে তাকে সম্মানের সাথে বসিয়ে
জিজ্ঞেস করব 
যে কেমন আছে সে ?



Wednesday, February 9, 2022

ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা কবিতা



দোঁহা

 
৩২২

এ কেমন ছাই এ কেমন ধোঁয়া, বাতাসে ভাসে না মন্ত্রণা!
জানা হলো শেষে এই চিতা ভস্ম তোর মন-পোড়া যন্ত্রণা।

৩২৩

যেখানে সোমত্ত নদী সেখানে জন্মের নতুন বাগান,
মহাজীবনের ডাকে জেগেছে উত্থান পতনের গান।

৩২৪

আয়না ভেঙে পেলাম দারুর লুপ্ত-গোপন- রূপনগরের চাবি
আদম ছুঁলো ঠোঁটের দানা, হারানো সুর ভাজতে যাবো, যাবি?

৩২৫

চণ্ডীদাসের প্রেমের বয়ানে
দুপুর ঝরায় কোন্ আষাঢ়ের ফুল!
ফলের খোসায় সুফি কী দেখিলো
ঠোঁটের তুলিতে আঁকা আদমের ভুল?

৩২৬

রিপু-’র জালে সংজ্ঞা হারিয়ে মানুষ হলো কলঙ্কিত
নিঃসরণের পাপের খাতায় ঈশ্বরেরও নামাঙ্কিত

৩২৭

ঈশ্বর আজ বৃন্তচ্যুতির পাপ-পুণ্যে- যাদব বাবুর গণিত খাতার ডট
ঘর ছেড়ে যায় পরের পাখি যাক না, তবে হুরের নেশা কেমন যে উদ্ভট।

৩২৮

বাঁশের চোঙায় কে সাধে ভৈরবী, মহাসাগরের ঢেউ উতলায়
পাগলের মন ঘোর চঞ্চল সুর-মুলতানে,
পরমেশ্বর- অহুর-মাজদা, বুদ্ধ-কৃষ্ণ, ইসা নবি মুসা ও মোহাম্মদ
সকল হৃদয় এক সুরে বাঁধা ভোরের বাগানে।

৩২৯

কাদার নাভিতে খুঁজতে গিয়েছো জনমের অনুরাগ,
তোমার পিরানে, প্রণত খড়িতে কালান্তরের দাগ।

৩৩০

স্পর্শের বাইরে বসে কে আমার পাঁজরের তারে বাজায় ভৈরবী
অন্তর্গত সুরে বান, প্রেমকথা কে শোনায়- কোন্ মনচারী কবি!


নীপবীথি ভৌমিকের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||    নীপবীথি ভৌমিকের কবিতাগুচ্ছ


তরঙ্গ    

গভীর অরণ্য। চোখ ফেরানো দায়।
 যতদূর দেখা যায়, আলো আর আলোর উথালপাথাল তরঙ্গ

    কেউ কি তবে চিনে ফেলেছিল নিজেকে?
      হত্যা করেছিল স্বহস্তে নিজের মৃত্যু আর জন্মকে?

   চোখ বেঁধে রাখা তাই আমার।
     যাতে করে অন্ধ হওয়া যায় !

    গান্ধারী জন্ম নিয়ে বসে থাকা দিনগুলো
     আলোই চিনেছে শুধু
      আঁধার চেনা কি এত সহজ?

কাহিনী

 এ সমস্ত জীবনের গল্পে চরিত্রগুলো 
   বেশিরভাগ কাল্পনিক
  কাল্পনিক স্নান সারে
    রোদে ভিজিয়ে নেয় সময়ের যাঁতাকলে

      একটা পাখি হঠাৎ উড়ে  গেল
    কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের গোপন 
      কুঠুরি থেকে ,
      একমাত্র পাখিটিই বাস্তব। 
        
       সন্ধ্যে নামলে মাটি রঙের
      পৃথিবীটা আবার কালো হয়ে ওঠে
         গ্লাস আর তরলের আদরে

   চুমুকে চুমুকে সুরাও অনিবার্য হয়ে
    যায় কখনো দিনশেষে।


যা কিছু দৃশ্যে থাকে
    
  প্রতিটি মৃত্যুই আসলে হারিয়ে যাওয়া অতীত, যেখানে 
শিশু গাছেরা ঘুমিয়ে থাকে এক একটা জন্মের হাতে

    ছায়া আসে, 
     হারিয়ে যায় বৈকালিক স্রোতের গান
      খইফুল হাতে নিয়ে 
    আমরাও হারাই এভাবে স্রোত আর 
         সাঁতারের মাঝ বরাবর

   ঢেউ থেমে যায় জীবন পারে, নদী- জল- কোলাহল...

 পাহাড়ী রঙের মেয়ে       
       
      রঙচটা সন্ধ্যা নেমে আসে আজকাল 
    এ শহরে!
  নক্ষত্র চ্যুত আকাশ বাঁশি বাজায়
  বিষাদ- আঙুলে

    ধুন ওঠে আলি আকবরের সরোদে
     পাহাড়ী মেয়ে রঙের রাগে

       জ্বর থামলে আবার যাব ভেবেছি ওদেশে;
      মিথ্যে তাপমাত্রা আর মুখোশ ছেড়া
        রোগের পথ ডিঙিয়ে।

 
ঘর
  
  প্রতিটি দুঃখের পাশে আমি
  সুর বেঁধে রাখি।
   তানপুরার সা'কে ছুঁয়ে পঞ্চম বেজে 
        ওঠে  মর্মরে
      কখনো পরজে কখনোও বা বসন্তে...

     আমি সুর সাধিনি। জানি না তাকে
     একান্ত ‌গভীরে,
     তবু কেন যে মনে হয় বিষাদ প্রিয় হলে
   মাড়োয়া বয়ে যায় আমার নদী-জন্ম ঘিরে !

      প্রতিটি বিষাদের পাশেই আমার 
   ঘর বাঁধা থাকে সুর পঞ্চম ছুঁয়ে।


Tuesday, February 8, 2022

পিয়ালী বসুর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  পিয়ালী বসুর কবিতা




স্মৃতি

ফেলে আসা সময়ের জলপ্রপাত জুড়ে 
এখন নিভৃত মনখারাপিয়া মনোটনি |


একা

দেশভাগ, দ্বি -জাতি তত্ত্ব পেরোনোর পর
স্বাভাবিক প্রাত‍্যহিক জীবনে চিহ্নিত হওয়া |



উপেক্ষা

চারপাশে একরাশ দূরত্ব ভেঙে পড়ার পর
পরস্পরের হাত ধরে ক্রমশ নিভে আসা |


দোসর 

যৌথ চাদরের মধ‍্যে 
নিরাময়ের একটি আলোক সেতু জেগে থাকে |


নিয়তি

জীবন যখন উন্মুখ ক্ষরণ
আর, অনির্দিষ্ট যন্ত্রণার অভিমুখে এগিয়ে চলে |


Sunday, February 6, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা (পঞ্চম পর্ব )

মানুষের সমস্ত সৃজনই সময়-শাসিত। সময়ের স্বর যেমন বদলায় অভিব্যক্তির ধরনও নিশ্চিতভাবে বদলে যেতে থাকে। বাস্তব ও কল্পনার যুগলবন্দিতে সময়ের ভাষা যত রূপান্তরিত হয়, কবিতার শিল্পভাষায় তত মাত্রান্তর ঘটে। নান্দনিক বোধ তাই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিরন্তর নতুনভাবে প্রতিফলিত হয়। সেই প্রতিফলনের পরিগ্রহণ গ্রহীতার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। বাংলা কবিতার চারণভূমি যেহেতু নানা অঞ্চলে সম্প্রসারিত, পাঠকবর্গের উপলব্ধিও বহুমাত্রিক, স্থির ও বহমান সময়ের মধ্যে সেতু রচনা করতে গিয়ে কবিতা আপন প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু কতভাবে বিনির্মাণ করছে, তারই বিশ্লেষণী পাঠ আলোচনা করার প্রস্তাবে আমি কবি তিলোত্তমা বসুর কবিতার দিকে আচ্ছন্ন হলাম। তিলোত্তমার কবিতার সময়শীলিত শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের দ্বিরালাপে অনির্বচনীয় নান্দনিক আলো কীভাবে জ্বলে ওঠে, তারই হদিশ  পেতে " জার্নি" কাব্যগ্ৰন্থটির ( প্রকাশক- ধ্যানবিন্দু, ২০১৫ ) একটি কবিতার পাঠ নেওয়া জরুরি।


যদি ক্ষমার আয়না দেখ -- আমি আফ্রোদিতি।
শরীরে গোলাপ-ক্ষত।
দারুন বিরহ থেকে চুমুর স্পঞ্জই পারে
কাঁটার পাহারা মুছে দিতে!
এমন ঘোরাও তুমি নাগরদোলায়
চামচে চামচে এত প্রেমের সিরাপ
যদি ঢালো...
চলো তবে গুহাজীবনেই ফিরি--
বুনোফুল অজানা বেনামী।
বুকের চাতালে প্রেমের মজলিশ রোজ বসে
বিনুনি এলিয়ে দিয়ে বসেছি অলস
সোলাঙ্কি-কুমারীর বেশে।


ঘোরে সূর্য আমার নির্দেশে
ইচ্ছে গতিতে যেন অক্ষ ঘুরছে
তারাদের ফুলঝুরি কুড়িয়ে কুড়িয়ে
বাতাসে ছড়িয়ে যায়
বর্শা ভলকেরা স্তব্ধ মেরুদেশে...
যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস !
এসো আমার ইগলুতে...


হাওয়া মোরগেরা ভোর থেকে ডাকে।
খামার বাড়িতে ঘোড়া ছুট দেয়
সোনালী গমের ক্ষেতে...
তোমার পায়ের গোছ
আলগোছে বুকে তুলে দেখি 
শস্যের দানা লেগে আছে ,
লেগেছে দিগন্ত ধুলো
সরল সবুজ ঘাসে উপত্যকা ঢাকা।
রাত শেষে কেন
আমার স্কার্টের ঘের পেয়ে বসে
দর্জির খ্যপামি ?
স্কার্ফ যায় উড়ে... হু হু অলি মন খারাপের
তুমি কি মার্চের সাইকেলে !


জানি খেলতে এসেছ... খেলো...
দাবা হোক ক্যারম বা লুডো
নিজেকে চালিনা আর ঘুঁটি
সাদ কালো লাল পয়েন্টেরা সময়ের
কেন হারাবে আমাকে ? -- চিটিং মানি না মোটে
সবুজ ঘাসের সঙ্কেতে চুপিচুপি
উড়ে আসি...


এসে দেখি ক্ষমার আয়না !
চুমুর স্পঞ্জে সব মুছে দিলে কিনা !
লজেন্স লজেন্স গন্ধ খাতার পাতায়
বোতাম খুলতে কি অবাক--
এদেশে এখনো
ম্যাপ আঁকা বাকি !! 

( আফ্রোদিতি)


গ্রিক পুরাণের প্রেম, আনন্দ, আবেগ এবং সৌন্দর্যের দেবী হলেন আফ্রোদিতি।  হেসিওডের থিওগোনি অনুসারে আফ্রোদিতির জন্ম সমুদ্রের ফেনা থেকে। ইউরেনাসপুত্র ক্রোনোস তার পিতার লিঙ্গ কর্তন করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে সেই লিঙ্গ থেকে শুক্র সমুদ্রের জলে মিশে আফ্রোদিতির জন্ম হয়। এই আফ্রোদিতির অনুষঙ্গ আত্মস্থ করেই তিলোত্তমা কবিতাটির মুক্তি ঘটালেন। যৌনতা মৌনতা ও তারুণ্যের বোধ থেকে এই কবিতা পৌঁছে গেছে নিসর্গনিবিড় আবেশের স্নিগ্ধতায়। চন্দ্রকলার পরিবর্তনের মতো ঋতুচক্র যেন জীবনচক্রকে, বিকাশের বৃত্তে অবস্থিত সব চাপকে, সৃষ্টি ও শিল্প সৃষ্টির ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাই কবি বলেছেন, "যেন ছমাস ঘোষিত চাঁদ, তার লুকোনো জ্যোৎস্না বারোমাস ! / এসো আমার ইগলুতে..."। কবিতাটি বৃত্তবদ্ধ পরিবর্তন এবং নিরন্ত পুনর্জননের প্রতীক হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ঊষরতা-উর্বরতার 
শরীরী অনুবর্তনে কবি ঘটিয়ে ফেলেছেন রতি ও আরতির প্রতিমান। সংযুক্তি ও বিযুক্তির নিরিখে যা একেবারেই বিপরীতমুখী ভাবনার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত শমিত হয়, "বোতাম খুলতে কি অবাক-- / এদেশে এখনো ম্যাপ আঁকা বাকি !! " অর্থাৎ একটা আকাঙ্ক্ষা। একটা প্রশ্নবোধক অতৃপ্তি। সব আছে, তবু কবি যেন জীবন অভিমুখী দূরত্ব-দ্যোতনার সঞ্চার ঘটাতে চাইছেন ! স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তিলোত্তমার কবিতার এই অর্জন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ইঙ্গিতবাহী।

সেই ইঙ্গিতের পরিকল্পিত মগ্নতা খুঁজে পাই "বন্ধু" নামের কবিতাটিতে। পরিকল্পিত মগ্নতা বললাম এই কারণেই যে, কবিতাটি আসলে একটা সেলফ
পোট্রেটের মতো। কবি নিজেকে নিজেই নিয়োজিত করেছেন।

"অথচ প্রেমের তাপ লাল শাড়ি পরায় আমাকে।
 
যাজ্ঞসেনী, হোম থেকে দেখি পাঁচ স্বামী।
আছেন যদিও ওঁরা তবু সখা তুমি কেন?
কেন যে স্মরণ করি তোমাকেই বিপদভঞ্জন!
আর শাড়ির আবেশ এসে ঢেকে দেয় নগ্ন
না পাওয়া আমার। পাঁচ স্বামী পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মতো।
তুমি তবু ষষ্ঠইন্দ্রিয় জন, পদ্মমধুতে গুন্ গুন্ ,
নীল উড়ে আসা টান চৌকাঠ ডিঙানো...
 
ফুলের বাগানে যাই। সরোবরে জ্যোৎস্নায়।
এই কি আমার কুঞ্জ? আজীবন নিজেকে শাসন, তবু,
তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"

( বন্ধু )

যজ্ঞের অগ্নি থেকে তিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে তার নাম যাজ্ঞসেনী। সে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। কবিতার শুরুতেই প্রেমের উষ্ণতা আর লাল শাড়ির দৃশ্যকল্পে আমরা একটা আশ্চর্য অনুভবের প্রান্তদেশে পৌঁছে যাই। চলে আসে যাজ্ঞসেনীর মতন এক অমর চরিত্র। কিংবা চরিত্রের অস্থিরতা। একেবারে শেষ লাইনে, "তুমি বন্ধু কতটা আপন কেউ তা জানে না।"এই কবিতার গভীরতা অনুধাবন না করতে পারলে পাঠক হিসেবে ব্যর্থতাই স্বীকার করে দিতে হবে। যেন সহজিয়া পথের কুঞ্জে ফুল ফোটান কবি। অতীতকে ভিতরঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসেন তিনি। অথচ আজীবন নিজেকে শাসন করেন তিনি। আমরা অদ্ভূতভাবেই খুঁজে পাই আজ্ঞাবহ নিখোঁজের পর্যাঙ্ক ! কবির আবেগ এখানে নিয়ন্ত্রিত আর চিত্রকল্প শুধু চিত্র নয়, অন্য অনেক কিছুর ভাসক।

তিলোত্তমার কবিতা প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে, গহনভাবনার ডুবুরি কবি কাব্যের আবাহনে জগৎ-সংসারের যাবতীয় অসুন্দর ও আবর্জনাকে প্রত্যাখ্যান করতে করতে বোধের উত্তুঙ্গ মহিমার দিকে এগিয়ে যান। বিশেষত তিনি আঁধি ও স্খলনের মধ্যেও ঐতিহ্যের চিরায়তনে আস্থা রাখেন।


হয়তো আস্থা রাখেন বলেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা অনতিক্রম্যতা কবিতার উপপাদ্যে প্রযুক্ত হয়। অথচ কবিতার মতো শক্তিমান অবাস্তব আর কী আছে? কয়েকটি ধ্বনি দিয়ে অথবা চিহ্ন দিয়ে পরপর সাজিয়ে তোলা একটি পরম্পরা, একান্তই আর্ত গঠন একটি, কী মায়ার খেলায় জড়িয়ে ফেলেছে মানুষকে। যেমন ইউক্লিড জ‍্যামিতির axiom-গুলি অথবা পিয়ানোর সংখ্যাসংক্রান্ত axiom গুলি। প্রথমে গুচ্ছকে ধারণ করার জন্য আছে বিন্দু, সরলরেখা ইত‍্যাদি জ‍্যামিতিক অবাস্তব বস্তগুলি। আর দ্বিতীয় গুচ্ছের জন্য বিমূর্ত পূর্ণ সংখ‍্যার দল। এইভাবেই বাস্তব বস্তু থেকে কল্পনায় এবং তার পরে সে কল্পনার বাণীরূপ। তাই কবিতা হলো নিয়মবদ্ধ সিমেট্রি থেকে মুক্ত হবার একটি রিক্ত কৌশল।