Thursday, March 24, 2022

প্রভাতহীন~শান্তিময় মুখোপাধ্যায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  শান্তিময় মুখোপাধ্যায়


প্রভাত চৌধুরী : বাংলা কবিতার এক মুকুটহীন সম্রাট

প্রায় চার দশকেরও বেশি যে মানুষটির সঙ্গে আমি সপরিবার ওতোপ্রোতো তিনি আর কেউ নন,বাংলা কবিতার আমৃত্য সৃজনকারী একক প্রতিষ্ঠান প্রভাত চৌধুরী। সেই প্রাক আশির দশক, যখন থেকে কলকাতা বইমেলা শুরু তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বা আমার বন্ধুদের যেমন প্রয়াত শুভ চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধনাতীত খুল্লামখুল্লা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হয় নি।তখন কলেজ স্ট্রিটে তিনসঙ্গী নামে একটা প্রকাশন সংস্থা ছিলো।যতদূর জানি তা ছিলো কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাতা সমীর চট্টোপাধ্যায়ের। প্রায়দিন বিকেলে প্রভাতদার সঙ্গে আমার সেখানে যাবার সুযোগ হতো।এছাড়া ময়দানে বইমেলাতেও তিনসঙ্গীর স্টল থাকতো।প্রভাতদা সেখানে বসতেন।আর লিটিলম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ানে বহরমপুর থেকে প্রকাশিত আমাদের রৌরবের টেবিল থাকতো।সেসময় বইমেলার স্টলগুলোর কোনো কোনো দুটো স্টলের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা রাখা হতো।যেখানে কতগুলোতে টয়লেট বা পানীয় জলের ব্যবস্থা আর খুব সরু ফাঁকা জায়গাগুলো খালিই থাকতো।যেগুলোকে গোদা বাংলায় আমরা বলতাম গলতা।সেগুলো ছিলো আমাদের মতো আরো অনেকের তরল আগুনে আচমন সারবার অলিখিত এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপণা।বলাবাহুল্য প্রভাতদা ছিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন। আর কলেজস্ট্রিট পাড়ার বেসামাল মহাপুরুষ  ভেটকি যার ভালো নাম প্রায় সকলেরই অজ্ঞাত সেই সিদ্ধার্থ ঘোষ অনিবার্যভাবেই সঙ্গী হতো আমাদের।বাঁকুড়ার চারণকবি বৈদ্যনাথও দুএকবার সঙ্গী হয়েছিলেন শ্রীমদ প্রভাতদার বদান্যতায়। প্রভাতদা সেসময় লেখালিখির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা  রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নে সরাসরি নেতৃত্বে থাকলেও কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে কখনো কিন্তু যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেননি। রাইটার্স বিল্ডিংসে তাঁর অফিসের টেবিলে প্রতিদিনই কোন না কোনো কবি বা গল্পকারকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। গল্পকার অনিল ঘড়াই এর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো সেখান থাকেই।কবি বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ আচার্য(একান্তর),সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, সমীরণ মজুমদার(অমৃতলোক) ছাড়াও আরো অনেককে নিয়ে সেসময় একটা বৃত্ত গড়ে উঠেছিলো প্রভাত চৌধুরীকে কেন্দ্র করেই।৩৬ডি,হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের প্রভাতদার বাড়িও ছিলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কবি যোগব্রত চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম কবিতার বই 'স্বজন বিদ্রোহ' প্রকাশের পরিকল্পনা হয়েছিলো এখান থেকে।বইটির মুখবন্ধে তারাপদ রায় লিখেছিলেন তা।আমার বিয়েও হয়েছিলো এই বাড়ি থেকেই।প্রভাতদার ইচ্ছেমতো গোধূলি লগ্নে এবং বামপন্থী পুরোহিতের যদিদং হৃদয়ং জাতীয় মন্ত্রোচ্চারণে। 
বাংলা কবিতার এরিণায় প্রভাতদার সব থেকে বড়ো কৃতিত্ব ১৯৯৩ থেকে আমৃত্যু প্রায় ২৯ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে একটা পাক্ষিক এবং পরে সাপ্তাহিক কবিতাপত্র সম্পাদন এবং প্রকাশনা।যার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ২৪ বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ(ইং ৭ মে,১৯৯৩)।কালীঘাট মিলন সমিতির সভাঘরে ঐ প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, ফাদার গাস্ত রাঁবেজ ছাড়াও কলকাতা তথা বিভিন্ন জেলার অনেক কবিরা।এই কবিতাপত্রটি প্রকাশে তাঁর যে ভাবনাটি কাজ করেছিলো প্রথম সংখ্যার প্রাক কৈফিয়তে সেই কারণটি উল্লিখিত ছিলো -- "বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী কবিতা দৈনিকের সম্পাদনা এবং পরিচালনার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলাম।পত্রিকাটির নাম 'সান্ধ্য কবিতা দৈনিক'।আমরা চাই কবিতার সেই পরিবেশ ফিরে আসুক।তাই কবিতা পাক্ষিক।"।যদিও আমি গর্বিত তবু বলা বাহুল্য প্রথম সংখ্যা থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমি এই পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।এবং প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।এছাড়া সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ছিলেন পিনাকীরঞ্জন ঘোষ ও সুজিত হালদার।আর একটা বড়ো কাজ প্রভাতদা যেটা করেছিলেন তা ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলনকে দুমলাটের মধ্যে একত্রে সংকলিত করে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া।বইটি সম্পাদনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিলো আমার উপর।
পরিশেষে বলা যায় গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার এই রাজনৈতিক শ্লোগানটিকে শতজল ঝর্ণার ধ্বনির পর প্রভাত চৌধুরীই প্রকৃত অর্থে ব্যাপক বিস্তৃতি দিতে পেরেছিলেন।উত্তর ২৪ পরগনার আবীর সিংহ,মেদিনীপুরের রোশনারা মিশ্র,মউলি মিশ্র থেকে শুরু করে পুরুলিয়ার অংশুমান কর --- নব্বইয়ের প্রায় সব কবিরই প্রথম আত্মপ্রকাশ এই কবিতা পাক্ষিক থেকেই। বাংলা কবিতার দুর্ভাগ্য এইসব কবিতাপ্রাণদের কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠান বা সরকারী তরফে কোনো পুরষ্কার জোটে না।গার্ড অফ অনার আর রাষ্ট্রীয় কাঁদুনি শুধু সেইসব তথাকথিতদের জন্যে।সফিস্টিকেশনের এই ধুলোবালি গায়ে না মেখেও বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট প্রভাত চৌধুরী, আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মতো শব্দশ্রমিকদের নিঃশব্দ স্পন্দের মধ্যে,অনুচ্চারিত শোকে ক্রমশ আরো বেশি মুহ্য হতে হতে।

No comments: