Friday, February 4, 2022

সৌমী আচার্য্যের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||       সৌমী আচার্য্যের কবিতাগুচ্ছ 



ধরতে গেলে ধরা দেয় না

উত্তাপ পেরিয়ে নড়বড়ে সাঁকোর গাঁয়ে 
চুপ করে দাঁড়াতেই সে এল
আক্ষেপে চোখ রাঙিয়ে ফিসফিস করল সময়, ব্যর্থতার মতো
সে আমার হাত ধরে পথ দেখাল 
যতদূর চোখ যায় শুধু জল 
তার গভীরে ছায়া চিরকেলে বসতের
ঈশ্বর হেঁটে গেলেন কাদা মেখে
সে রয়ে গেল আমার ভেতর অলৌকিক সুতো হয়ে 
আমি জানতাম আজীবন বইব কখনো বলতে পারব না সে আমার 
তেমন যুতসই অক্ষর ছেদ যতি কোনদিন জোগালোনা বলেই
পথ ফুরালো বলতে পারলাম না 'কবিতা আমার'

হারিয়েছে পথ 

নীল সন্ধ্যার বুকের ওপর শেষ হাত রেখে আমি সে ও আমরা চলে গিয়েছিলাম।তখনো ঠোঁটের কষে কথারা আলাপে মত্ত ছিল আর অকারণে একটা লম্বা লেজওলা ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হয়েছিল। বিস্ময়ে বড় বড় চোখে আকাশ,ঘুড়ি আর মায়া কিশোরকে নাগালের বাইরে যেতে দেখেছিলাম।বুকের ভেতর ঢাক বাজলে ভায়োলিন সঙ্গত করে,কোন সংগত কারণে জানিনা।তবে আরও বহু বার তার বদলে যাওয়া ঠিকানায় হেঁটেছি― স্বপ্নে।

এখন গাঢ় কালো রাতের দাপট।হাসনুহানার গন্ধে সাপ আসে।বাস্তু ঘুঘু টিকিট কাটে ট্রাভেল এজেন্সির।ঠোঁটের কোণে জটিল হিসেব। 'একটু আস্তে অপরের স্বার্থ বুঝে চলুন' ক্যাকোফোনি।বোকা কিশোর সাইকেলের ট্রিংট্রিং শুনিয়ে ডাকে আজো।পা বাড়াতে পারলেই পৌঁছাতে পারি।তবু...


অনিবার্য সংঘাত ও আত্মপ্রচার

আমার আবেগে বাবার রাগী চামড়ার বেত বা 
মায়ের ঝাঁজালো অভাবী গলা নেই 
আছে বটের মত ছড়ানো জড়ানো বুড়ি মায়া
আমার ভেতরেই লুকনো ঘরটায় 
তবু রোজ খিটখিটে অভ্যাস হয়ে মরি বাঁচি
                             মাথাভর্তি কিলবিলে পোকা

এক দুই পাঁচটা করে পিষে মারি বেছে বেছে
                                                        মনে মনে 
পিছল ঘর বারে হনুমান হয়ে যাই 
ডুগডুগি হাতে দাঁড়িয়ে যারা 
তারাও আমার আবেগে নেই 
আছে হাসিমুখে নোনা জল সাঁতরে যাওয়া একটা মানুষ আমার ভেতরে খোলা বারান্দায়


অপেক্ষায় নেই কেউ 

দীর্ঘ সময় বসে থেকেছি চুপ করে
পাটাতন নামানো 
কাদা পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় সফল পথের ভেতর 
তবু বসে আছি 
একরোখা কথাগুলো যায় আসে 
আয়নার ভেতর দেখি সত‍্যের মত নিষ্ঠুর ছবি
মুখোশের রং গলে ছেঁড়া খোঁড়া মুখ 
বাঁশি বেজে ওঠে ডেকে যায় 'ওগো পার করো'
চেয়ে থাকি ভ্রম ওঠে ধীরলয়ে 
আমি বসে থাকি,কুয়াশার মত
দেখি কাদাজল ধুলো নিয়ে ঘুমিয়ে আছি
আর ফেরা হবেনা বলেই শুয়ে থাকি একেবারে চুপ 

অভিসার সেই পথেই

সুচেতনের বাড়ির পাশ দিয়ে যে নদী গান শোনায়
আমার ঘাটে এলেই কেবল গুমড়ায়
ঢোঁক গিলে খাওয়া শব্দের হাহাকারের মত
না ফেরা অতীতের হাওয়ার খসখস শুনি নুড়িতে নুড়িতে
সে পথ ধরেই হেঁটেছি,সুচতেনের দিকে
স্হায়ী আবাসে পৌঁছাতে কতদিন লাগে
দশ বিশ অথবা হাজার বছর 
নীচের দিকে গড়িয়ে দিয়েছে সম্ভাবনার আলো
তবু মাথা বিকোয়নি,যে মাথার দাম শূন‍্য
তার বাঁচা মরা সবটাই ভাঁওতা
নদীর রঙ বদলালেই মাথা তুলে 
সুচেতনের পাশেই রয়ে যাব
হতে পারে মুক্তির মত রঙ থাকবে সেই ঠিকানায়



পিনাকী রায় (কনিষ্ক)-র কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   পিনাকী রায় (কনিষ্ক)-র কবিতাগুচ্ছ


পুতুল পুতুল জীবন খেলা

দুর্গাকে গলিয়ে বানিয়েছে কালী
কালীকে গলিয়ে জীবিকা
রেলিং পেরোলে আমার জমি
কাঁটাতার পেরোলে দেশটা।

বই-খাতা জ্বালিয়ে মিড ডে মিল
পায়ে পায়ে জমা অভিজ্ঞতা
রং তুলিতে জীবন আঁকি
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
এঘর ওঘর বিবেক শূন্য
ফুটপাত জুড়ে স্রষ্টা।

পুতুল পুতুল জীবন খেলা
জীবন জনম চেষ্টা

অনন্তকাল বাঁচার আশা
দেখি কি হয় শেষটা।


চালচিত্র

জীবনের সাদা ক্যানভাসে
ভালোবাসা প্রাণ এঁকে দেয়,
প্রেম আঁকে নীল জোছনা।
গহীন গাছের ছায়া
আবেগ আঁকে প্রেমে ডুবে থাকা
সাময়িক অবয়ব।
হাবুডুবু সাদাকালো যৌবন
বেঁচে আছি ভালোবেসে,
জীবন আঁকে ভালোবাসার আশায়।
সূর্য পরবাসে গেলে
চারিদিকে জোছনা থৈথৈ।

গভীর নিম্নচাপ

শহুরে অভিজাত্যে "তিনটে কিনলে একটা ফ্রী"।
অন্যদিকে প্রকৃতির রোষে
দুর্দশা, লাঞ্ছনা আর ত্রাণের খিচুড়ি।

স্বপ্নের ঘোর কেটে চোখের পিচুটি সরিয়ে অন্তকঙ্কাল নাচে।

আমার কি এখানেই থাকার কথা ছিল?
কিন্তু ওরা যে অপেক্ষারত
হাতে কাশফুল শিউলির সাজি।

কাদামাখা রাস্তায় আলতা পায়ের ছাপ
রক্তের মতো থকথকে জমাট,
সাদা খোল লাল পেড়ে শাড়িটাও কাদায় লুটোয়।

 নদীর চরে মুখ থুবড়ে বিবস্ত্র শরৎকাল।
বিষ্ণুর নাভিমূল থেকে
ভেসে আসছে গোঙানির আওয়াজ।

আগামী দুদিন গভীর নিম্নচাপ।

রূপকথা

তুমি যাকে ভাতের সংস্থান করে দিয়েছিলে
সে আজ তোমার মুর্তির নিচে
প্রস্রাব করে গেল।

তুমি এখন চকচকে মিনার, হত প্রাণ নাগালের বাইরে।

জাগো আধা শহর
জাগো এক ডানাওয়ালা পরীরা
জাগো মানুষের চিন্তার স্রোত
নাভি থেকে উঠে আসুক কুচকাওয়াজ।

আকাঙ্ক্ষা ও ভয়ে স্নায়ু আর রক্তের বাক্যালাপ বন্ধ।

সিংহ রাশি কপর্দকশূন্য ভাষাহীন মানুষটা
আজও শুয়ে আছে
রূপকথা জন্ম নেবে বলে।


পবিত্র নগ্নতা

শিরদাঁড়া বরাবর স্রোতস্বিনী
গিরিখাত হয়ে উপচে পড়ে যৌবন প্রান্তে।
আবির রঙা স্তনে সূর্যমুখীর উদ্ভাস,
স্বচ্ছ মসলিনে আবৃত বিবেক থেকে
উঁকি দেয় চিহ্নিত মনুষ্যত্ব।

মুক্তির পথ ধরে যোনিদ্বর খুলে
 নেমে আসে প্রাণের অনর্গল ধারা।
না, ওই শরীর স্পর্শের নয় অনুভবের
পার্থিব  মায়া কাটিয়ে আত্মার অধীনে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রতিটি রোমকূপে।
কামাগ্নির কবলে কূপ খনন করে
সভ্যতার আলিঙ্গনে সযত্নে লালিত হয়
মরমী সত্য।


Tuesday, February 1, 2022

মোহনা মজুমদারের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   মোহনা মজুমদারের কবিতাগুচ্ছ



আবছায়া

ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে যতি চিহ্ন !
আলপথ বরাবর ভেসে যায় সমান্তরাল আবেশ ।

ফেরিঘাটে আলটপকা মেঘ 
          ঢাক্কা মারে , কুঁকড়ে আসে -
               আবার ফিরে যায় শূন্য গর্ভে ।

চৌকাঠে গচ্ছিত রেখেছি হিরন্ময় মূহুর্ত ,
পাটিসাপটার মতো দলা-পাকানো ।
বাঁধ ফেটে রক্ত ঝড়ছে !
        বেগুনী কিংবা নীলচে সবুজ ।

তুমিও কি কখনো ফিরবে বলে 
খাদের কিনারায় এসেছিলে ?
মায়াবী ছায়াতপে জড়িয়ে নিয়েছিলে 
নিরাশক্ত শীতলতা ।

ছায়ার গা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে  উপাস্য হোমগন্ধ !
অসম্পৃক্ত রক্তাক্ত ।


কলঙ্করেখা


এইটুকু বরাদ্দ থাক !
সেই কোন জন্মে এক টুকরো আকাশ
     পাহাড়ের বুকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম ।

পাহাড়তলি জুড়ে বর্নিল প্রহেলিকা -
বড্ড অভিমানী ! নাকি সংযমী !
বুজতে পারিনা ঠিক ।
তাই ক্যালকুলাসে আয়ুর হিসেব কষি ।

কিছুটা রশ্মি ঢোক গেলার মতো স্যাচুরেটেড হয় ,
প্রতিফলন আর প্রতিসরনের মাঝামাঝি 
এইটুকুই ফারাক দৃশ্যমানতায় ।
ভিজিয়ে দেয় গোটা একটা পরিসর ! তারপর ? 

কৌমার্য টুকু নিংড়ে আবাহন করি 
                           একটুকরো কলঙ্করেখা ।


প্রহেলিকা

আলোর ভেতর একাত্ম হবো ভেবে 
একমুঠো জোনাকী পুড়েছি শোকভষ্মে ।

ইলিউশন ! ইলিউশন ! 
তারপর এ্যাক্রিলিকে আশ্রয়হীন সমাবেশ ।
পেলব স্বপ্নের মতো ।

শিকড়ের কাছাকাছি থাকার প্রবনতা 
ক্রমশ গতি পরিবর্তন করে চলেছে ।

অন্ধকার গুলে স্যাচুরেটেড ছায়ার ভীড় !
তুমি কি ছদ্মবেশী গুটিপোকা ? নাকি দাহ্য ?
এসো , গুড়ো গুড়ো রৌদ্র জড়ো করে 
ক্যালোরিমিটারে উষ্ণতা মাপি ।


প্রতিবিম্বের ঠোঁট

অতঃপর 
হুসস করে উড়ে যায় রামধনু রঙ ।

অ‌্যাবস্ট্রাক্ট আর্টে অনুরাগ আঁকবো ভেবে
একবার আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই ।
আকাশে উড়ছে প্রতিবিম্বের ঠোঁট !

তুমি কি জানো ভালোবাসি বলতে
কতোটা গোলাপি প্রলেপ প্রয়োজন ?

 খোলস খুলে দি -
ভেতরে ঘুমোচ্ছে অন্ধ ক্লিওপেট্রা  ।
তার বিছানার পাশে স্তব্ধ আয়ু 
                               গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ।

রঙেদের কান্না পায় ।

কবিতার গা জ্বরে পুড়ে যায় ।
সঙ্গে পোড়ে রঙিন খড়কুটো ।

শূন্য ঝিনুকে তখন মুক্তো সোহাগের গন্ধ লেগে..


আধপোড়া চোখ

কুয়াশার ওপর ড্যাম্প পড়ে -
স্যাতস্যাতে বৃষ্টিস্নাত চোখে 
স্ক্রল করে করে ঢেকে রাখা ইরোশন এবং 
শূন্যতার মেটামরফসিস , অথচ কী শান্ত ভঙ্গিমায় 
ঢেলে দিয়েছো সম্মোহন ।
একেই কি বিকেন্দ্রীকরণ বলে ?

ভাতের থালায় ক্ষুধার্ত জিভের প্রতিবিম্ব !
তথাগত নাকি ভ্রম ?
গুড় চেটে খাই ।
মধ্যবিত্ত সন্ধ্যায় সিরিয়ালে মুখ লুকানো রাজনীতি 
থম মেরে আছে ।
আর তুমি গলা ফাটিয়ে শূন্য মঞ্চে 
ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতা পাঠ করো ।


Sunday, January 30, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী  

কবিতার ডালপালা ( চতুর্থ পর্ব )

রঞ্জিত সিংহের কবিতার এই উদ্ভব, অভ্যুদয় ও পরিণতির যে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িত ধ্বনিরূপ, তার ডায়াক্রমিক স্পন্দন অনুভব করতে করতেই আমরা ভাষার সজীব রূপ-রহস্যের দিকে এগিয়ে যাই। তখন বস্তুজগতের নির্দশক অর্থ থেকে যা বিশিষ্ট। কারণ, আমরা ততক্ষণে মনের চোখে প্রত্যক্ষ করি কবিতার ক্রিয়াশীলতা।

ভাষাতাত্ত্বিক সোস্যুরের উত্তরসুরী ইরাকসন ভাষাতত্ত্বের আঙিনা থেকে কবিতার ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে তাঁর প্রাজ্ঞ অনুধাবনে জানিয়েছেন, " The poetic function projects the principal of equivalence from the axis of selection into the axis of combination" একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে গ্ৰন্থনা। শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক যখন আপতিক, দার্শনিক চার্লস স্যান্ডর্স পার্সের বিবেচনায়, তা প্রতীক। কিন্তু কিভাবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কবির অন্য একটি কবিতার দিকে মনোনিবেশ করছি।

" সময়ের কখনো পর্যঙ্ক বা কেদারা থাকে না।
পনেরো বছর কোথা দিয়ে চলে গেল---
বাঁশবন, শালবন, একর একর মহুয়ার বন।
একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল।
বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ, লাল পলাশফুল।

মণিকাকে আজকাল সেইভাবে মনে পড়ে না।
জ্যোৎস্নার জোয়ারে আড়াল দিয়ে চাঁদ যেমন
লুকিয়ে-চুরিয়ে রুপোলি হাসির ঝলক দিতে দিতে
চলে যায়, মণিকা তেমনিভাবে, ঠিক সেইভাবে,
হাসির ঝলক কখন যে জোয়ারের বেগে চলে যায়
সারারাত ইজিচেয়ারে বসে থেকেও একদিনও ঠাহর পাইনি।

চমকে উঠি। পরক্ষণে বুঝি ভুল, আমার বয়সের ভুল।
চোখ যেমন সবসময় ঠিক ঠিক দেখে না, এও তেমনি
সেই ভুল দেখা।
রাত্রে সিঙ্গল খাটে ঘুমোচ্ছি, এটা আমার আজীবনের সিঙ্গল খাট,
ওটা আমার পনেরো বছরের ইজিচেয়ার, যে-রাত্রে
ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় সফেদাগাছটাকে ঢেকে ফেলে সফেদা খায়,
আমার আর মণিকার সে-দিন জন্মান্তর হয়, দুজনেই বাদুড় হয়ে যাই।

বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি, চোখদুটো খুলতেও পারি না, বন্ধ করতেও পারি না।
লেপটা জড়িয়ে ধনুকের মতো বেঁকে শুয়ে থাকি,
পাশ ফিরলেই পিঠ থেকে লেপ সরে যায়,
একটা উষ্ণ তাপ মাঝে মাঝে অনুভব করি,
কে যেন লেপটায় পিঠ ঢেকে দেয়, রাত্রে দু-বার তিনবারও,
কে যেন লেপটা টেনে দেয়।

সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।

( মণিকা সম্ভবত বিভ্রম )

কবিতাটির নাম 'মণিকা সম্ভবত বিভ্রম'। অর্থাৎ কবি নামকরণেই জানিয়ে দিচ্ছেন মণিকা সম্ভবত বিভ্রম বি. ১. ভ্রান্তি (দৃষ্টিবিভ্রম); ২.(প্রধানত প্রণয়জনিত) মানসিক চাঞ্চল্য বা বিমূঢ়তা; ৩. লীলা; ৪.বিলাস; ৫.শোভা। [সং. বি + ভ্রম]। সুতরাং এখানে আমরা কবিতাটির চিহ্নাবলির তিনটি বিষয় খুঁজে পাচ্ছি। প্রতীক ( Symbol ) , সূচক ( Index ) , এবং প্রতিম ( Icon ) । কবিতাটির আরোপিত অভিজ্ঞানে ভাষার শব্দচিহ্নগুলোও তেমনি ধ্বনিরূপ ও ধারণার আপতিক সম্পর্ক- সঞ্জাত। সূচক ও প্রতিম মূলত বাচনিক নয়, চিত্রধর্মী। যেমন- 'বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ' থেকে লালপলাশ ফুলের ধারণা কিংবা ' একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল' অর্থাৎ অস্তগামী সূর্যের ধারণা। আর এই সমস্ত অনুভবের প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের অবকাশটি কবি নিজস্ব সূচকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। কবি তুলে ধরলেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার সিনট্যাক্স-- প্রদত্ত পুনরুক্তি ও প্রবর্তিত নতুনের মাধ্যমে নিজের ভিতরের বিবাদী ভাবনার রূপায়ণ। 

' বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি চোখদুটো খুলতেও পারি না বন্ধ করতেও পারি না' 

সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য--- এই দুয়ের মিলিত মালকোষে রঞ্জিত সিংহ বাংলা কবিতায় একটি চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় এই স্তরবহুল আকস্মিক উন্মোচনের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। শুধু অভিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না কবিতার ধ্বনি। সহসংবেদনের স্নায়ব সূত্রে তা রূপকধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন-

"সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।"

ভাষা কিভাবে অভিধেয় অর্থ থেকে দ্যোতনা অর্থে পৌঁছে যায় তার একটি মডেল দিয়েছেন রোলাঁ বার্তে। অভিধেয় প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের ছকটি তিনি এভাবে দেখিয়েছেন---

( ছবি লক্ষণীয় )


বার্তে চিহ্নকে দেখেছেন ECR- র সমবায়।

E -- an expression ( or signiffier )

C -- a content ( or signified )

R --- in relation 

আমি রঞ্জিত সিংহের কবিতার আলোচনার প্রসঙ্গে বার্তের পরিধেয় ভাবনার মডেলটি সঙ্গত ভাবেই গ্ৰহণ করেছি। কারণ, তাঁর কবিতার সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য গৃহীত ও যোজিত অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে সাবলীল। বাংলা কবিতায় এই ধরনের অভিজ্ঞান খুব একটা চোখে পড়ে না। আর পড়ে না বলেই কবিকে থেকে যেতে হয় পাঠকের সচেতন অন্তরালে। প্রাসঙ্গিক ভাবে কারণ সেই একটাই। কবিকে হত্যা করার নিহিত কৌশল। ভাবলে খারাপ লাগে বাংলা কবিতায় মনীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে যে লম্ফঝম্প, যে উচ্ছ্বাস; রঞ্জিত সিংহের কবিতা নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না। হয়তো দেখা হয় না।

কবিতার চরম ও পরম চেতনায় দশকের পর দশক ধরে এরকম উৎকণ্ঠা প্রযুক্ত করা হয়। কারা করেন এই প্রযুক্তির কাজ? তাঁরাই করেন যাঁরা 'কবিতা' বাদ দিয়ে সবকিছু করেন। তথাপি কবিতা জেগে থাকে আশাবাদের অলংকার নিয়ে। 

ফিরে দেখা-- ১
----------------
কলকাতার গনেশচন্দ্র এভিনিউতে শতাব্দী প্রাচীন পানশালা ব্রডওয়ে। বাংলা কবিতার দুজন স্বনামধন্য কবির সঙ্গে আমিও পৌঁছে গেছি সেই সন্ধার মায়াবী আলোচনার জগতে। আলো, মায়া আর নৈকট্য নিয়ে সেই ঘন্টাখানেকের আলোচনায় উঠে এসেছে কবিতার প্রকৃত প্রস্তাব। বাড়ি ফিরে একটা ঘোরের মধ্যে কিছুদিন কেটেছে।

মাসখানেক বাদে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত এক কবির বাড়িতে পৌঁছলাম। কথা প্রসঙ্গে আবার কবিতার আলোচনা।

বর্ষীয়ান কবি প্রশ্ন করলেন, ক- এর কবিতা কেমন লাগে?

আমি বললাম, ' খুবই ভালো লাগে। ওনার কবিতা পড়লে একটা পরিত্রাণ অনুভব করি।'

বর্ষীয়ান কবি বললেন, ' তুমি বাল বোঝো কবিতার!'

----' কেন দাদা ? সেইদিন আপনিও ব্রডওয়েতে বসে কত প্রশংসা করলেন ওনার কবিতার। উনি লাজুক কন্ঠে বললেন, ' আরে ছাড়ো অরিজিৎ, ও আমার বন্ধু তো, তাই আমার কবিতার প্রতি দূর্বলতা!'

--- ' দাদা সেইদিন ওরকম বললেন কেন?'

হা হা হা হা... ম্যাচিউরিটি এলো না তোমার ! ওরকম বলতে হয়। আসলে ও কিছু লিখতেই পারে না।

কেন এরকম বলতে হয় হে অগ্ৰজ? আপনি যে সব গুলিয়ে দিলেন। আসলে বাংলা কবিতায় এই গুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যুগে যুগে অব্যাহত।



Friday, January 28, 2022

গার্গী সেনগুপ্তের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     গার্গী সেনগুপ্তের কবিতাগুচ্ছ


অনাময়


নিস্তব্ধতা প্রেমিকের ডাক নাম
বিষণ্ণতাই মেঘেদের  প্রিয় মুখ
বেখেয়ালে যদি দিন যায় কার ক্ষতি
অনাময় পেতে জেগে থাকি উৎসুক।

আকাশের বুকে নীলখামে লেখা চিঠি
বৃষ্টিরা জানে ঝরা পাতাদের মন
সূর্যের আলো সব মানুষের ঘরে
উষ্ণতা দেয় আজীবন, অনুখন।

দুর্বোধ্যতা মনোযোগ ভালো বাসে
শূন্যতা গায় সকালের শিসপাখি
সব স্থলভাগ ভাইরাসে আঁকলেও
পৃথিবীর গায়ে শুশ্রূষা লিখে রাখি।।


বিভাস

১.

ধূ ধূ ওড়ে বালি
চর জাগে অনন্তের
চাবি পড়ে আছে
চির গহনের কাছে
মুখ তুলে দ্যাখো
ও আকাশ,ভাঁটিফুল
বলো ভুলে গেলে কেন?

২.

সোহাগী দোতারা
লালমাটি, পথ জানো?
কদমের পায়ে
বাঁশিও আছড়ে পড়ে
পার্বতী নূপুরে-
বিভঙ্গে অনঙ্গ সুর
অষ্টরতি কেঁদে যায়।

৩.

মেঘের শ্রাবণ
নীল চায়, জল চায়
পুড়ে যায় বায়ু-
স্পর্শহীন ধোঁয়া ওঠে
চরাচর ঢাকে
ভুল পথ ভ্রম শিলা -
তবে এসেছিলে কেন!

৪.

পথ, রেখা দাও
দাও পল্লবে বিদ্যুৎ
তারারাও চুপ
হিসেব জানেনা কোনো
ছায়াপথে ফুল-
শোনো, আলো জ্বেলে রেখো।


প্রাণ বাড়ন্ত

সিলিন্ডার প্রতি
এক জীবন আশা -আকাঙ্ক্ষা
ই এম আই এ মূল্য চোকাব।

দুহাতে ছড়িয়েছি গুণিতকে পাপ
সবুজ মুড়িয়ে হাইরাইজের ব্যস্তবাস,
বনজ কঙ্কালে
ভরে দিয়েছি মাটির গর্ভ।

বেলাইনে ঢুকে পড়ছে কার্বন মনোক্সাইড
পাপমুক্তির টীকা ফীকা থাকলে গুঁজে দাও ।

চোখের কর্ণিয়া পুড়ে বোবা বেগুনি রঙ
ফুসফুস হাপর টানা ফ্যাকাশে
এক ছিলিম ও -টু দে  মা গো
সুখটান দিই।


বেঁচে যাই যদি,
সবুজ বুনে নেব বুকের ওড়নায়
শিমুলের পায়ে নিঃশর্ত  ক্ষমা লিখে দেব
অনাচারী লজ্জিত মানুষ।

লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, মা গো, ইট পেতে...


রোগ শয্যা

প্রতিটি শয্যার পাশে
অমেয় প্রেরণা লিখে দিও।
ঘুমহীন কালরাত্রি-
লৌহচূর গেঁথে গেঁথে স্থবির।
সে সব রাত্রির পাশে
     জোনাকি- অক্ষয় এঁকে দিও,
শব্দফুল ফুটে থেকো
প্রতিটি ক্ষয়ে যাওয়া নগরকীর্তনে....