Sunday, January 30, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী  

কবিতার ডালপালা ( চতুর্থ পর্ব )

রঞ্জিত সিংহের কবিতার এই উদ্ভব, অভ্যুদয় ও পরিণতির যে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িত ধ্বনিরূপ, তার ডায়াক্রমিক স্পন্দন অনুভব করতে করতেই আমরা ভাষার সজীব রূপ-রহস্যের দিকে এগিয়ে যাই। তখন বস্তুজগতের নির্দশক অর্থ থেকে যা বিশিষ্ট। কারণ, আমরা ততক্ষণে মনের চোখে প্রত্যক্ষ করি কবিতার ক্রিয়াশীলতা।

ভাষাতাত্ত্বিক সোস্যুরের উত্তরসুরী ইরাকসন ভাষাতত্ত্বের আঙিনা থেকে কবিতার ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে তাঁর প্রাজ্ঞ অনুধাবনে জানিয়েছেন, " The poetic function projects the principal of equivalence from the axis of selection into the axis of combination" একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে গ্ৰন্থনা। শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক যখন আপতিক, দার্শনিক চার্লস স্যান্ডর্স পার্সের বিবেচনায়, তা প্রতীক। কিন্তু কিভাবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কবির অন্য একটি কবিতার দিকে মনোনিবেশ করছি।

" সময়ের কখনো পর্যঙ্ক বা কেদারা থাকে না।
পনেরো বছর কোথা দিয়ে চলে গেল---
বাঁশবন, শালবন, একর একর মহুয়ার বন।
একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল।
বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ, লাল পলাশফুল।

মণিকাকে আজকাল সেইভাবে মনে পড়ে না।
জ্যোৎস্নার জোয়ারে আড়াল দিয়ে চাঁদ যেমন
লুকিয়ে-চুরিয়ে রুপোলি হাসির ঝলক দিতে দিতে
চলে যায়, মণিকা তেমনিভাবে, ঠিক সেইভাবে,
হাসির ঝলক কখন যে জোয়ারের বেগে চলে যায়
সারারাত ইজিচেয়ারে বসে থেকেও একদিনও ঠাহর পাইনি।

চমকে উঠি। পরক্ষণে বুঝি ভুল, আমার বয়সের ভুল।
চোখ যেমন সবসময় ঠিক ঠিক দেখে না, এও তেমনি
সেই ভুল দেখা।
রাত্রে সিঙ্গল খাটে ঘুমোচ্ছি, এটা আমার আজীবনের সিঙ্গল খাট,
ওটা আমার পনেরো বছরের ইজিচেয়ার, যে-রাত্রে
ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় সফেদাগাছটাকে ঢেকে ফেলে সফেদা খায়,
আমার আর মণিকার সে-দিন জন্মান্তর হয়, দুজনেই বাদুড় হয়ে যাই।

বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি, চোখদুটো খুলতেও পারি না, বন্ধ করতেও পারি না।
লেপটা জড়িয়ে ধনুকের মতো বেঁকে শুয়ে থাকি,
পাশ ফিরলেই পিঠ থেকে লেপ সরে যায়,
একটা উষ্ণ তাপ মাঝে মাঝে অনুভব করি,
কে যেন লেপটায় পিঠ ঢেকে দেয়, রাত্রে দু-বার তিনবারও,
কে যেন লেপটা টেনে দেয়।

সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।

( মণিকা সম্ভবত বিভ্রম )

কবিতাটির নাম 'মণিকা সম্ভবত বিভ্রম'। অর্থাৎ কবি নামকরণেই জানিয়ে দিচ্ছেন মণিকা সম্ভবত বিভ্রম বি. ১. ভ্রান্তি (দৃষ্টিবিভ্রম); ২.(প্রধানত প্রণয়জনিত) মানসিক চাঞ্চল্য বা বিমূঢ়তা; ৩. লীলা; ৪.বিলাস; ৫.শোভা। [সং. বি + ভ্রম]। সুতরাং এখানে আমরা কবিতাটির চিহ্নাবলির তিনটি বিষয় খুঁজে পাচ্ছি। প্রতীক ( Symbol ) , সূচক ( Index ) , এবং প্রতিম ( Icon ) । কবিতাটির আরোপিত অভিজ্ঞানে ভাষার শব্দচিহ্নগুলোও তেমনি ধ্বনিরূপ ও ধারণার আপতিক সম্পর্ক- সঞ্জাত। সূচক ও প্রতিম মূলত বাচনিক নয়, চিত্রধর্মী। যেমন- 'বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ' থেকে লালপলাশ ফুলের ধারণা কিংবা ' একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল' অর্থাৎ অস্তগামী সূর্যের ধারণা। আর এই সমস্ত অনুভবের প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের অবকাশটি কবি নিজস্ব সূচকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। কবি তুলে ধরলেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার সিনট্যাক্স-- প্রদত্ত পুনরুক্তি ও প্রবর্তিত নতুনের মাধ্যমে নিজের ভিতরের বিবাদী ভাবনার রূপায়ণ। 

' বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি চোখদুটো খুলতেও পারি না বন্ধ করতেও পারি না' 

সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য--- এই দুয়ের মিলিত মালকোষে রঞ্জিত সিংহ বাংলা কবিতায় একটি চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় এই স্তরবহুল আকস্মিক উন্মোচনের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। শুধু অভিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না কবিতার ধ্বনি। সহসংবেদনের স্নায়ব সূত্রে তা রূপকধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন-

"সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।"

ভাষা কিভাবে অভিধেয় অর্থ থেকে দ্যোতনা অর্থে পৌঁছে যায় তার একটি মডেল দিয়েছেন রোলাঁ বার্তে। অভিধেয় প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের ছকটি তিনি এভাবে দেখিয়েছেন---

( ছবি লক্ষণীয় )


বার্তে চিহ্নকে দেখেছেন ECR- র সমবায়।

E -- an expression ( or signiffier )

C -- a content ( or signified )

R --- in relation 

আমি রঞ্জিত সিংহের কবিতার আলোচনার প্রসঙ্গে বার্তের পরিধেয় ভাবনার মডেলটি সঙ্গত ভাবেই গ্ৰহণ করেছি। কারণ, তাঁর কবিতার সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য গৃহীত ও যোজিত অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে সাবলীল। বাংলা কবিতায় এই ধরনের অভিজ্ঞান খুব একটা চোখে পড়ে না। আর পড়ে না বলেই কবিকে থেকে যেতে হয় পাঠকের সচেতন অন্তরালে। প্রাসঙ্গিক ভাবে কারণ সেই একটাই। কবিকে হত্যা করার নিহিত কৌশল। ভাবলে খারাপ লাগে বাংলা কবিতায় মনীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে যে লম্ফঝম্প, যে উচ্ছ্বাস; রঞ্জিত সিংহের কবিতা নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না। হয়তো দেখা হয় না।

কবিতার চরম ও পরম চেতনায় দশকের পর দশক ধরে এরকম উৎকণ্ঠা প্রযুক্ত করা হয়। কারা করেন এই প্রযুক্তির কাজ? তাঁরাই করেন যাঁরা 'কবিতা' বাদ দিয়ে সবকিছু করেন। তথাপি কবিতা জেগে থাকে আশাবাদের অলংকার নিয়ে। 

ফিরে দেখা-- ১
----------------
কলকাতার গনেশচন্দ্র এভিনিউতে শতাব্দী প্রাচীন পানশালা ব্রডওয়ে। বাংলা কবিতার দুজন স্বনামধন্য কবির সঙ্গে আমিও পৌঁছে গেছি সেই সন্ধার মায়াবী আলোচনার জগতে। আলো, মায়া আর নৈকট্য নিয়ে সেই ঘন্টাখানেকের আলোচনায় উঠে এসেছে কবিতার প্রকৃত প্রস্তাব। বাড়ি ফিরে একটা ঘোরের মধ্যে কিছুদিন কেটেছে।

মাসখানেক বাদে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত এক কবির বাড়িতে পৌঁছলাম। কথা প্রসঙ্গে আবার কবিতার আলোচনা।

বর্ষীয়ান কবি প্রশ্ন করলেন, ক- এর কবিতা কেমন লাগে?

আমি বললাম, ' খুবই ভালো লাগে। ওনার কবিতা পড়লে একটা পরিত্রাণ অনুভব করি।'

বর্ষীয়ান কবি বললেন, ' তুমি বাল বোঝো কবিতার!'

----' কেন দাদা ? সেইদিন আপনিও ব্রডওয়েতে বসে কত প্রশংসা করলেন ওনার কবিতার। উনি লাজুক কন্ঠে বললেন, ' আরে ছাড়ো অরিজিৎ, ও আমার বন্ধু তো, তাই আমার কবিতার প্রতি দূর্বলতা!'

--- ' দাদা সেইদিন ওরকম বললেন কেন?'

হা হা হা হা... ম্যাচিউরিটি এলো না তোমার ! ওরকম বলতে হয়। আসলে ও কিছু লিখতেই পারে না।

কেন এরকম বলতে হয় হে অগ্ৰজ? আপনি যে সব গুলিয়ে দিলেন। আসলে বাংলা কবিতায় এই গুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যুগে যুগে অব্যাহত।