Friday, March 11, 2022

নীলিমা দেব-এর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  নীলিমা দেব-এর কবিতা


জল বলে


চাঁদ রেডি
যে বেগে বৃষ্টি ছেড়ে বেড়িয়ে আসে জল

বধির আঙুলে গাঢ় হয়ে আছে বেলা
হুস করে পা দুটো রাতের ডায়ে
মাটি ও রাস্তার মধ্যে যে অংক
ভাঙচুর হতে হতেই টুপুর ও টাপুর

সবার কথায় ছায়া উঠছে
রাস্তায়

মিনিমাইজ করো জল
ছোট করা বৃষ্টি লেবুর দিকে চলে যাক…


ডুব


আমার চারদিকে ঘুরছে স্নান
জলকে টানলে আমি দূর
আমাকে টানলে স্নান নিজের বিপরীতে 0-0
না কোনো প্রশ্ন হবে না

জল এখন খালি পা

একজোড়া স্নান সংক্ষিপ্ত মাংসের মতো ছড়ানো

সারা গায়ে গাভীর স্পিড
গাভী অর্ধেক গোল
জলের নিচে অস্ত গেছে আঙুল

রাতকে আমি খুলেই রাখি …


ইশারা

বেড়াল উড়ছে
একাধিক আকাশ হাল্কা চালে নাড়াচাড়া করছে বিন্দু

চিত্র বাড়াই
লালপেড়ে আয়নায়
40 % সূর্যের নৈঞর্থক ভিড় করে আছে ঠোঙায়

¼ চাঁদ কারুর প্রচলিত ভুলে রোগা
সাইকেল কামড়ে শক্ত ছায়ারা

এবারে নিজের জল নিজেই ভাঙবে বেড়াল
মিছেই সন্ধেহ করি মাটি…


তরল পাখি

রক্ত থেকে গাছ, রুটি থেকে আকাশ

দুটোতেই পাখি লোজ্ হতে হতে দ্বিতীয়
ছায়ার মতো বন্ধ আছে মেঘের পঞ্চম

একটা শরীর
চার পাঁচটা বাতাস
একসাথে বাদামী

বিলম্বিত ঘর
যেখানে আর কোনো দরজা নেই

হয়তো পাখি কোনো তারিখ
এখান থেকেই ফোকাস করবে সিনিয়র জল


সাঁজ


কোন একটা চা যেভাবে ফুরিয়ে আসে

টুপির ভেতর ৬৪ পাখির বিরাসত
কাগজে মুড়ানো বৈঠায় আদর খুলে রাখছে পা

যত যাওয়া তত যাওয়া নয়
সমবেত জল এডিট করে করে বাতিল সারস

পায়ে নৌকো বিঁধে
উনুন খুঁজতে খুঁজতে মেঘ~বেলুন

দু’চার কথা এখনো কাপে

শুকনো চায়ে চোখের ভিড়
নীলচে

নীল বলতে পাঠ করা রাস্তার বাকিটুকু …


তুলি রায়-এর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  তুলি রায়-এর কবিতা



অগ্রদানী

ঋতুকালীন বৃষ্টির মতো এখানে শীত নামলে জোনাকিরা ঘুমোতে যায়
অথচ এই ঘরের পর্দায় যত ক্লান্তির ছাপ লেগেছিল বিগত মরশুমে
এখন তাতে সরু সরু রূপোর তার
রূপকথার রাজপথে একটাও ভিক্ষুক ছিল না
এদেশে সবাই অগ্রদানী 


পঞ্চমুখী

অথচ এমন কথা ছিল
নামতা ভোরে কুয়াশারা চাদর বিছিয়ে যাবে
কথাদের কোন গুরুত্ব থাকে না
যা থাকে তাকে ঠিক হতাশা বলা চলে না
আমি বলি সাবালকত্ব 
হাতেদেরও চোয়াল থাকে
তোমরা তাতে ডাইস এঁকে দাও
মেরুকরণ বড় একমুখী 
গাছে তখন একটাই পঞ্চমুখী ফুল


জারি থাক

খরচের খাতায় একটাও পৃষ্ঠা নেই
পৃথিবী এঁকে চলেছে আকাশ
মজুদে পোড়া কাঠকয়লা
স্থবির দৃশ্যরা জানে কতটা অন্তরাল
খেলাটা জারি থাক তবু
তুমি'র মুখে আমি
হইহই করে ঘিরে ধরে
লিখিয়ে নেয়
অথচ খরচের খাতায় একটাও পৃষ্ঠা ছিলনা


পঙ্ ক্তি

বিচ্ছেদ আসলে জুড়ে যাওয়া পঙ্ ক্তি
শব্দ সাজাতে সাজাতে
শব সাজে যেমন শেষের বেলায়!
আকাঙ্খা - তাই অপূর্ণ 
সময় গুছিয়ে রাখছে ইতিহাস
পৃথিবীর শেষতম গুহায়
বন্ধকে অনুভূতি 
যাযাবর জন্মের উঠোন-বাহির
স্থবির তুমি স্থবির আমি
মাঝখানে নাট্যালয়


দেনা

পথ তুমি পথিকের
নাকি পথিক তোমায় 
অথবা কার্যকারণ 
অর্জনের কোন হেতু হয় না
কাটাকুটির খেলায়
খেয়ালই তো
এই আছে এই নেই
যাওয়া বললেই যাওয়া হয় নাকি
উত্তরে যা বাকি থেকে গ্যালো
দেনারা দিচ্ছে তালা 
চাবিটা কিলো দরে





পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা



আকাশে রক্তের রং 

রক্ত ঝরে মেঘ থেকে, গাছ থেকে, পাতা ফুল থেকে 
পরিযায়ী পাখিরাও শেষবার দিগন্তে ডানা মেলে উড়ে চলে গেছে 
লক্ষ্মীপেঁচার মতো অনির্দেশ ছায়া অন্ধকারে। 


আজ মহাপৃথিবীর ফসলের মাঠে 
কৃষকের শেষ কান্না -- সম্মোহন বাঁশির ডাকে করুণ সে সুর 
গোসাপ চন্দ্রবোড়া বহুরূপী দুধরাজ বাঁশ জলঢোঁড়া 
লুকিয়ে পড়েছে বহুদূরে।  


জল আর নেই, নদী আজ ডুবে গেছে চাঁদের কিনারে  
অস্তাচলে শেষ লেনদেন। 
পালতোলা ধানশালি নৌকোর মতো
স্বপ্নের মতো নীল, স্বর্ণের মতো তার আভা 
গাংচিল লক্ষ্মীপেঁচা গাঙুড়ের কাব্যময় বিভা  
ইতিহাস বিবর্ণ হয় সিঁড়িভাঙা বুরুজে, মিনারে। 


মনুষ্যপ্রজাতির স্বপ্নমাখা স্বর্ণিল খড় 
মন্দির মসজিদ খেলা, যুদ্ধবাদী রাজনীতি ঝড় 
থেমে গেছে -- ফেলে যাওয়া পুরোনো প্রাচীন গ্রহতীরে। 


রেখে গেছে আকাশের নৈর্ব্যক্তিক সীমা 
ঝরে পড়া রক্তের নীরে। 


যুদ্ধ 

ওদের পাশেই ছিল বিষমাখা ছুরি। 
ওদের হাতেই ছিল বুনো কুকুরের দড়ি। 
ওদের ঘরেই ছিল পিস্তল, বোমা ও গ্রেনেড। 
জমা করে রাখা ছিল যুগ যুগ ধরে।

ওদের শেখানো ছিল,
“মারতে এলেই যেন মার খেয়ে মরে।”
ওদেরকে বলা ছিল,
“লাশের ওপরে যেন অন্য লাশ পড়ে।”

তারপর, রণক্ষেত্র। 
বাঁচার লড়াই। 

কিন্তু ওরা ছোরা বোমা পিস্তল না নিয়ে 
অদ্ভুত কৌশলে 
তুলে নিলো সংবিধান,
ঢাল বর্মের মতো এঁটে নিলো বুকের ওপরে।

রাস্তা গ্রাম নদী দেশ 
ভেসে গেলো নতুন জোয়ারে। 


বিপ্লব 

এসো, ধরো 
আঙুল বাড়াও 
বন্ধুরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

ওঠো, জাগো 
রক্তপলাশ ফোটা 
সকালের আলো 
হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে। 

নামো, সিঁড়ি বেয়ে 
তাকাও নিচের দিকে 
রাস্তার ধুলো মাখো পায়ে 
জুতো খুলে রাখো 
পবিত্রতার পথে হাঁটো। 

এসো, খেলো 
কিতকিত, চড়ুইভাতির খেলা 
কাটাকুটি, সাপলুডো, বল 
ইশারায় ফিসফিস  
ইঙ্গিত, নিষিদ্ধ সঙ্গীত গাও, 
ওদের শেখাও। 

তারপরে চলো 
ভেঙে ফেলো একসাথে 
এই ব্যর্থ অন্ধকার 
পাপিষ্ঠ অচলায়তন। 
চূর্ণ করো কারাগার,
মুক্ত করো বন্দীদের। 

হাত ধরাধরি করে সব 
একসাথে হেঁটে যাও 
দূরে নীল সমুদ্রের দিকে। 


সমুদ্র আর আকাশের গল্প 

সমুদ্র থেকেও কখনো কখনো আগুন বেরোয়। 
উৎক্ষিপ্ত হয় আগ্নেয়গিরির মতো। 
যেন সমুদ্র বলছে,
"আমাকে দেখে যদি মনে করো আমি শুধু নীল জল 
ভুল করবে। 
আমার মধ্যে লাল আছে জ্বলন্ত শিখার মতো,
আমার মধ্যে ধূসর আছে উত্তপ্ত ছাইয়ের মতো,
আমার মধ্যে হলুদ আছে লাভাস্রোতের মতো।"

সমুদ্র পাড়ি দেয় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে 
সে বয়ে নিয়ে যায় তার সমস্ত রং, উত্তাপ, আবেগ 
জঠরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ঝিনুক প্রবাল শঙ্খের মতো,
অক্টোপাস, বিষাক্ত জেলিফিশ, হিংস্র হাঙ্গরের মতো,
জাহাজ গিলে খাওয়া দৈত্যাকার তিমির মতো। 
এক এক বিশাল ঢেউতেই সমুদ্র এক একটা শহর, জনপদ 
সভ্যতা গিলে খেতে পারে। 

সমুদ্র শান্ত হয়ে থাকে সারাদিন। 
দিবানিদ্রা দেয়।  
হয়তো বা খেলা করে, 
ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় শিশুর হাসির মতো 
ছোট ছোট ধবধবে সাদা দাঁত মেলে হাসে। 
ঘোরাফেরা করে, মানুষের গন্ধ মাখে,
যুবতী প্রেমিকার মতো যুবক প্রেমিকের গায়ে 
লাস্যভরে ঢলে ঢলে পড়ে। 
মূর্খ নৌকোগুলো তার বুক চিরে চলে যায় 
অর্বাচীন ঔদ্ধত্যে। 

রাত হলে সমুদ্র চোখ খুলে চায় 
পূর্ণযৌবন পুরুষের মতো 
আকাশের বুকে অজস্র তারার দিকে চেয়ে 
তাদের সঙ্গে যেন কী একটা পরামর্শ করে 
জোনাকির মতো অদৃশ্য ব্যস্ততায়। 
তারপর বহুকাল ধরে জমে থাকা, 
বুকের ভেতরে বেঁধে রাখা 
জলকে, ঢেউকে, হাওয়াকে, রংকে 
ফুসফুসকে, অন্ত্রকে, হৃদয়কে 
খুলে দেয়। 
তার চোখে নতুন আলো জ্বলে 
তার মুখে তখন নতুন শব্দ হয়। 

সমুদ্র আকাশের দিকে চায় 
হাসে। 
চুপিচুপি কী যেন পরামর্শ করে। 
তারপর হাত ধরাধরি করে 
চোখে চোখ রেখে 
পাড়ি দেয় 
অজানা এক বিশেষ গন্তব্যের দিকে। 
 
ওদের সে রাঁদেভুর কথা 
মূর্খ নৌকোগুলো আর তার ঘুমন্ত মানুষযাত্রীগুলো  
জানতেও পারেনা। 


নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
মোমবাতি শিখার মতো 
দুহাতে আড়াল করে। 
সে আলোতে মুখ দেখি। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
অসুস্থ সন্তানের পাশে 
নিদ্রাহীন রাত্রির মতো। 
প্রহরে প্রহরে তাকে দেখি। 
হাত রাখি কপালে ও গালে। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
আকাশঘুড়ির মতো 
সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নামবার আগে 
লাটাই গুটিয়ে রাখি 
কাল ভোরে ফের খেলা হবে। 

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি 
বাংলা ভাষায় 
প্রিয় মানুষের সাথে 
একবার পরিচিত 
নির্মেঘ নির্জলা 
হৈ হৈ আড্ডা দেবো বলে।



Saturday, February 26, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা  
সপ্তম পর্ব        

কবিতার কোন আচরণই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটে না। উদ্দেশ্য মূলক আচরণের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই যে আভ্যন্তরীণ তাগিদ তাকেই আমরা কবিতাটির প্রেষণা বলব। কবি এই কার্যপদ্ধতির মধ্যে চেতনা জারিত করে। তাই প্রেষণা বাধাপ্রাপ্ত হলে প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। অথচ কবিতা দুভাবেই লেখা হয়। মূর্ত অথবা বিমূর্ত। কেউ কেউ নিজের চারপাশে খুব বিমুর্ত এক আবহের সৃষ্টি করে নিয়ে লিখতে পারেন  বা লেখেন। চেনা জগতের অনেক বাইরের কথা।পাঠক তার নাগাল বা স্পর্শ পায়না  সহজে। আবার কেউ লেখেন জীবনঘনিষ্ট কিছু পংক্তিমালা যা পাঠকচিত্তের কাছাকাছি। পাঠক চাইলেই  স্পর্শ করতে পারে, ঢুকে পড়তে পারে কবিতার আদ্যোপান্ত শরীরে। কবিতার ভাষায় ধ্বনিপ্রতীকতার কথা বলেছেন ভাষাবিদরাও। সকলেই জানেন শব্দ ও অর্থের মধ্যে অন্তর্লীন কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু কবিতায় কখনও কখনও ল্ক্ষণীয় হয়ে ওঠে শব্দ ও অর্থের মেলবন্ধন। তৈরি হয় motivated sign। আর এরকমই এক পরিত্রাণের ত্রাণ নিয়ে যখন কোন কবি অভিজ্ঞতার রূপায়ণে রূপকের ইমেজ গড়ে তোলেন তখন পরিকল্প ( schemas ) চেতনার চর্যায় একটা বিশেষ রৈখিকতা তৈরি করেন । কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের "একটি গোপন বাঘ" ( প্রকাশক- প্ল্যাটফর্ম, প্রকাশকাল- ডিসেম্বর ২০২২ )    নামের কবিতার বইটি তেমনই এক শিল্পায়নের চিহ্নায়ক।

এখানে "চিহ্নায়ক" শব্দটির লেখার পেছনে অবশ্যই আমার একটি সচেতন বিধেয় আছে। মানুষ কেন বিমূর্ত ধারণা গঠন করে রূপকার্থে? মানুষের ভাষায় বিমূর্ত ভাবনা গড়ে ওঠে কতগুলি অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে। দেখা,ধরা, দাঁড়ানো,হাঁটা প্রভৃতি দৃষ্টিগ্ৰাহ্য ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপ গুলির ভেতর মানুষ বিমূর্ত ধারণা তৈরি করে নেয়। সময় যেন চোখে দেখার বিষয়। কবি দেখছেন। "একটি গোপন বাঘ" - এর Personification বা সমাসোক্তির মাধ্যমে।


"ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি, সামনেই বসে আছেন কাফকা। না ঠিক কোনো 
পোকার মতো দেখতে নয়।চোখের তলায় কালিও নেই।শ্বাস নিতে অসুবিধে 
হচ্ছে? উত্তরে চুপ করেই থাকলেন।আমিও চুপ করেই থাকলাম। বাইরে শ্রাবণ। 
ভিতরে শ্রাবণ। আর আশ্চর্য ভয়। কাফকা বসে আছেন।আর ক্রমশ আমি রোগা 
হয়ে যাচ্ছি। এলোমেলো উড়ে যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি। চেনা, পরিচিত, ইস্কুলড্রেসের 
মতো লেখা।আর কাফকা অস্ফুটে বলছেন, আমার লেখাগুলো তোমরা পুড়িয়ে 
দিলে না কেন? আমার ভয় করছে।মেঝে, ছাত দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালগুলো 
দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ গাইতে গাইতে একটা মাঠের মধ্যে চলে এসেছি। দূরে 
দূরে পাহাড়।সেখানে আমার দেওয়ালগুলো। আমার ছাত থেকে মেঘ নেমে 
আসছে মাথার উপর। ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।ফ্রাঞ্জ কাফকা। 
আর বিড়বিড় করে বললেন," আলোই অন্ধকার, অন্ধকারই আলো"। আমার ঘর 
আর খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে 
ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

( ম্যাক্স ব্রড )

এই কবিতাটি পাঠ করতে করতে কাফকা আর তার বন্ধু মাক্স ব্রডের অবিস্মরণীয় ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর সেই বিখ্যাত উপন্যাস "ডি ফেরভান্ডলুঙ্গ"(রূপান্তর)। উপন্যাসের প্রথম লাইনটি----" এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল–সে পোকা হয়ে গেছে!' এই উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠক এই একটি লাইনে যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যাক্স ব্রড নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। যাঁর সঙ্গে কাফকার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। এদিকে প্রেমে ব্যর্থ,  স্বল্প রোজগেরে ক্ষীণজীবী মানসিক ভাবে ভঙ্গুর ও বিষাদাচ্ছন্ন কাফকা বন্ধু ম্যাক্সকে এক আশ্চর্য চিঠি লিখলেন।  প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স, আর হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও করা হয়ে উঠছে না। আমার লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলি হয়তো কালস্রোতে হারিয়ে যাবে। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলির ব্যাপারে তোমায় বলছি, সব পাণ্ডুলিপি আর নোট পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলি সংগ্রহ করেও পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ যেন সেসব পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। বলাই বাহুল্য বন্ধুকে অত্যন্ত  ভালবাসলেও এক্ষেত্রে বন্ধুর কথা রাখেননি ম্যাক্স ব্রড। বরং তিনি নিজে সেসব লেখা পড়লেন। পড়ে বিস্মিত হলেন। আর যত্ন করে সেই সব লেখা প্রকাশ করলেন।

এটি আমাদের চেনা একটি দৃষ্টান্ত মূলক কাহিনী। অথচ হিন্দোল "ম্যাক্স ব্রড" নামের কবিতাটিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাফকার সঙ্গে তার কাল্পনিক যাপনের চিত্ররূপ। এখানে ফ্রান্‌ৎস কাফকা আর হিন্দোল মিলেমিশে একাকার। তাদের মধ্যে যেন একই রকম যাপন প্রবাহের প্রেক্ষাপট। শুধু পোকাটিকে নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই।বাইরে শ্রাবণ। ভিতরে শ্রাবণ। মা কবির কল্পনা ও  অনুভবের আলোআঁধারিতে স্বতন্ত্র। এই কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্যোতনাসঞ্চারী ধারণাগত বা Conceptual রূপক। তাই কবিতাটি বহুবার পাঠ করার পরেও আবার পাঠের অপেক্ষা রাখে। কবি কবিতাটির একবারে শেষ পঙক্তিতে গিয়ে লেখেন--

"সমস্ত দেওয়াল দিগন্ত হয়ে গেছে। সব পাখি ঘরে ফিরবে মনে হয়। আমি ঘুমোব না। ছন্দ শুনব। কথা শুনব। জল দেব ঘাসে।"

আলো অন্ধকারের সঙ্গে যেমন Acute-Grave স্বলক্ষণের সম্পর্ক, তেমনি স্থিরতা-অস্থিরতার সঙ্গে Compact-Diffuse স্বলক্ষণের সহযোগ। সমস্ত কবিতার বইটি জুড়ে কবি লিখে দিয়েছেন এরকমই বহু প্রতিবর্তের আবর্তন। আসুন আমরা সেই আবর্তনের স্পন্দনে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখি---

"আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। হয়তো তোমার কথা লিখি কিংবা 
দীনু ভিখারির। যে দেহ মৃতের মতো ঠান্ডা কিংবা যে মৃত দেহের, লিখি তারও 
কথা।যে পুজো তোমার,কিংবা যে তুমি পূজার, — তুমিও তো লেখ আমাকেই । 

আমি ও লেখার মধ্যে এক আকাশ আলোকবর্ষ আছে। সাতের দশকে তিন 
ছেলেকে হারিয়ে আজও হারুর দোকানে রোজ জিলিপি ও রাজনীতি খেয়ে যান
রমেন ঘোষাল।রাতের হাঁপানিটুকু চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে হারুনচাচার।
আমি কার কথা লিখি বুঝি না মহাশ্বেতা আর। ভোররাতের বড়োবাজার শুঁকতে 
শুঁকতে বুঝি,জীবন মশলার গন্ধ। গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ। 

এ কথা ভুলিনি তবু, সে রয়েছে ঝোপের মধ্যে, গুঁড়ি মেরে, পুরোনো স্যাঙাত। 
আমিও সংগীতপ্রিয়, যার কোনো স্বরলিপি নেই। একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই 
অহঙ্কার করে।

যে-কোনো মুহূর্ত শেষ হয়ে যেতে পারে লেখা, এ জীবন অসমাপ্ত রেখে। বাসি 
মুখে নেমে পড়ি হরিদাস মোদকে। ওপাশে নেতাজি আর এপাশে মা-কালী।"

( আচমন )

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ধ্বনিকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে বিদেহ রাজের প্রশ্ন ছিল-- পৃথিবীতে যখন সূর্য থাকবে না, চন্দ্র থাকবে না, সেই অন্ধকারে কিভাবে পথ চলব? যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-- ধ্বনি। ধ্বনিই তোমাকে পথের সন্ধান দেবে। জাগতিক জীবন যেকোনো মুহুর্তেই থমকে যেতে পারে। কিন্তু তাতেই বা দুঃখ কিসের? ধ্বনি! জেগে থাকবে ধ্বনি। কবি তাঁর নিজস্ব ধ্বনিতেই জেগে থাকবেন। এরপর অন্য আর একটি চিত্রকল্পের দ্যোতনা---

"একটি বিশাল ট্রাক ভোররাতেই অহঙ্কার করে"

আমাদের অভ্যস্ত, পরিচিত জীবনের মধ্যে এই চিরকালের ছবিটির সঙ্গে কবি প্রবিষ্ট করালেন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের হরিদাস মোদক, নেতাজি, মা কালীর মন্দিরটি। অর্থাৎ কবিতাটি ব্যস্ততর পাঁচমাথার মোড়ের অনিবার্য রসায়নে শেষ হচ্ছে। কবিতাটির সংগঠনে সামাজিক-রাজনৈতিক সংবর্তন লক্ষ করা গেলেও, এরই ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেমের প্রবাহন। উজ্জ্বল অতীত আর ছায়াঘন বর্তমান নিয়ে কবির প্রশ্নকাতরতা। জীবন অভিযোজিত মেটাফর।

" একটি গোপন বাঘ" আসলে ব আ ঘ -- এই তিনটি ধ্বনির মিলিত ধ্বনিরূপ। আর আমাদের মনের চোখে বাঘ নামক প্রাণিটির যে ধারণাগত রূপ, তাই হলো চিহ্নায়িত। মনোলোকে বস্তু বা প্রাণি জগতের ধারণাগত উপস্থিতি সম্ভব হয় বলেই আমাদের পক্ষে শব্দের উদ্দীপক থেকে অর্থে পৌঁছনো সম্ভব। বাঘ কে বোঝানোর জন্য বাঘের কাছে উপস্থিত হবার প্রয়োজন ঘটছে না। ফলত ভাষার একটি নিজস্ব এলাকা আছে, যেখানে শব্দের অন্তর্গত এক একটি ধ্বনিও চিহ্নায়কের ভূমিকা নিতে পারে। গড়ে উঠতে ভাবনার সঙ্গে ভাষার পারস্পরিকতা। একে আমরা বলতে পারি phono-signifier বা স্বন-চিহ্নায়ক। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের এই কবিতার বইটির পাতায় আমরা খুঁজে পাই এই স্বন-চিহ্নায়কের ধ্বনিতরঙ্গ। আশাকরি করি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বাঁকবদলের অভিমুখে প্রতিষ্ঠা পাবে বইটি।



Wednesday, February 16, 2022

দেবশ্রী দে'র কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      দেবশ্রী দে'র কবিতাগুচ্ছ



জলাশয়টুকু

পার হয়ে বুঝি
দেখা হয়নি অনেক কিছুই

গা বাঁচিয়ে ভেসে গেলে
ছোঁয়া যায় না-
দুঃখের অণু অণু সুখ

অথচ পেরিয়ে এসেছি সব
মৃত্যুর আগে


স্বপ্নেরা উলঙ্গ হলে

দিনের আলো ফুটলেই
স্বপ্নেরা উলঙ্গ হয়ে
নেমে পড়ে রাজপথে

খুলে যায় কল্পনাপ্রসূত
আচ্ছাদন। আভরণ
চুঁয়ে পড়ে রক্ত, ঝরে স্বেদ

প্রিয় শরীরে যেমন
তারা অবাঞ্ছিত,
মনসিজ স্বপ্নেও তাই-ই

কিছু রাত স্বপ্নবিহীন হওয়া আবশ্যক।


পাখিটার

পিঠে অগুনতি পালক
আমরা চাইলেই
সেগুলোকে সাজিয়ে
কষতে পারি অসংখ্য সমীকরণ

দুঃখের কথা এই যে,
আমরা কখনোই
সেইসব সমীকরণে চেপে
উদ্দেশ্যহীন উড়ানে সামিল হই না 


রূপকথা

ডানাবিহীন, আমার নিঃশর্ত রাত

এক পা এক পা ক'রে
হেঁটে যাওয়া ছাড়া
কোনও রূপকথার গল্প নেই

তুমি শিখে নিয়েছ
উড়ানের আশ্চর্য জাদুকরী,
কুয়াশায় রেখেছ অস্তিত্ব

নির্দ্বিধায় আমি শিশির মাখছি
তোমাকে ছোঁয়ার নামে।