Thursday, April 15, 2021

১-লা বৈশাখ সংখ্যা || গল্পে~রঞ্জন মৈত্র

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || ১-লা বৈশাখ সংখ্যা ||   

রঞ্জন মৈত্র

খিদের ওপারে


দুপুরে রিকশাস্ট্যাণ্ডেও কেমন ঘুমের ভাব। আলস্যটা প্রায় দেখতে পাওয়া যায়। ধারে কাছের দেশির ঠেক, গাঁজার জমায়েত, সাট্টার পেনসিল, যেন নেই। রিকশার উপর তেড়ে বেঁকে ব'সে চালক গান শুনছে। পানের দোকান থেকে আসা মহম্মদ রফির কবেকার সব গান। পরনের পোশাক, শরীরের হাড় গোড় পেশী বেশ গরীব গরীব। একটি গল্পের জন্য আজকাল দু' হাজার টাকা পাওয়া যায়। প্লটের খোঁজে হদ্দমুদ্দ হওয়ার ফাঁকে এই স্ট্যাণ্ড, ওই রিকশাঅলা। তার বাড়িটি দরমার বেড়ার হলে ঠিক হয়। দরজা ঢেউ খেলানো টিনের। এইটুকু বাবুয়ানিই যেন। টালির চালে ফাটল থাকলে ভালো, যা পয়সার টানাটানিতে ঠিক করা যাচ্ছে না। এবার গল্পটা দু' রকম হওয়া সম্ভব। এক, সারাদিন রিকশা টেনে সন্ধ্যায় দেশি এবং জুয়া। বাড়ি ফিরে যে কোন ছুতোয় ঝামেলা পাকিয়ে বউ পেটানো। তারপর রাত বাড়ে। যেমন সম্ভব পেট ভরে। এরপর কে মারলো আর কে মার খেলো সব গুবলেট হয়ে যায় বিছানায়। পরে পরে বাচ্চা হয়। তাদের ঠিকমতো পোশাক পড়াশোনা জোটে না। তবে বাচ্চা হতেই থাকে। এবং দ্বিতীয় রকম, ক্লান্ত শরীরে রিকশাঅলা টিনের দরজার বাইরে বসে খানিকক্ষণ। হাত পাখা চালায়। মাটির উনুনের পাশ থেকে ঘামে চুবচুবে লাল রঙের বউ মাঝে মাঝে পাশে আসে। জলের গ্লাস। সস্তার চা। বিড়ি। তারপর ওই কোনরকমের পেট ভরানো। বিছানায় অল্প চাঁদের আলো ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে। বর্ষাও তার নিয়মে আসবেই। তার আগে টালি সারানোর পয়সা জোগাড় নিয়ে খানিক আলোচনা। রাত আরও বাড়ে। দুজনে টালির ফাঁক দিয়ে ভাঙা চাঁদ দেখে একটু আধটু।  ভাবে, বাচ্চাদের খুব ভালো করে বড় করবে। অনেক বড়। গাড়ি, বাড়ি। ফুলের টবে সাজানো ব্যালকনিতে বসার চেয়ার হবে নিজেদের জন্য। হাতে সুন্দর কাপে সুন্দর চা। আর সেই চায়েও কখনও জ্যোৎস্না এসে পড়বে, রোদ কখনও। 

সবজির নূন্যতম দাম ৫০টাকা কেজি। মাছের ২০০। চালের হু হু করে বাড়ছে। আটার চিনির সর্ষের তেলের দরমার বেড়ার ঢেউ টিনের, বাড়ছে। অটো এবং টোটোর পাঞ্জা কষাকষির মধ্যে রিকশাস্ট্যাণ্ডে প্রায় সারাক্ষণই মাঝদুপুর। কাস্টমার টানাটানি করতে হয়। এবং খুব পরিচিত ছাড়া বাকি অন্যদের সাথে ভাড়া নিয়ে দুগগিবাজি না করলে সবদিক সামলে বাঁচা অসম্ভব হয়ে যায়। মদ জুয়ায় ওড়ালেও যায়, না ওড়ালেও যায়। ভাঙা টালির উপর সস্তার প্লাস্টিক। কালুর ঘুগনির দোকান, বণিকের মুদী দোকান, কানাইয়ের সাইকেল সারানোর গুমটি, কোথাও একটা ঢুকিয়ে দিতে পারলে বাচ্চাটা সংসারে কিছু আনতে পারবে। একদম ভোগে চলে যাবে তার চেয়ে তো ভালো।

তো গল্পটা মোটামুটি তৈরি। দুটো রকমেরই পাঠক আছে। তারপর বর্ষা আসে, শরৎ শীত মৌরলা মাছ। পত্রিকা আসে। দু' হাজারের চেক। চড়াই ঘুঘু রিকশা এসব দেশ থেকে উঠে যাবে যে কোনদিন।  নিয়মে বসন্ত আসে, গ্রীষ্ম। কোথাও মহম্মদ রফির গান বেজে যায়, অনেক পুরোনো সব গান।



১-লা বৈশাখ সংখ্যা || ২টি-কবিতায়~প্রদীপ চক্রবর্তী

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || ১-লা বৈশাখ সংখ্যা ||   

প্রদীপ চক্রবর্তী

বেহালা বাজানো লোকটা 

এক .

অথচ সে পাগলামোয় বহতা গাছের পাতারা  নানান সবুজে বদলে গেলো | ধুলোমাখা মেঘ আকাশের দলমন্ডল ভাঙছে আর বৃষ্টি জুড়ে পাখিদের মধ্যে  হামেশা যৌথ পরিবার কেমন নিস্তরঙ্গ কাঁপছে | থেকে থেকে শুধু একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্টের গলায় নানা স্তর থেকে অস্পষ্ট ক্ষমতাসংকেতে কথা বলে যাচ্ছে ...
" ঝুটা হ্যায় ... সব ঝুটা ..." 


দু - তিনটে ধাপ নেমে টাল সামলে দেখি , ক্ষয়ে যাওয়া মেঘের অন্ধকারে বাচ্চা ছেলেটি দোকানে এসে উনুন  ধরায় | কাঁচা কাঠের ধোঁয়ায় ছেলেটার চোখে জল আসে | সফল এই বাংলার স্বত্বহীন ফুর্তির রাজনীতিতে বুদ্ধি থেকে জীবিকার জলে ছোঁঁ মেরেই আবার উড়ে বসে  
ভেন্ট্রিলোকুইস্ট | আসলে এটা তার ছদ্মবেশ |শুধু তারই চোখে পড়ে অন্ধকার যে রকম কেঁপে কেঁপে আসে | হায় হায় করে মিউটিনির পুরোনো শহর | যে হাওয়ায় গন্ধ গন্ধকেই ধরে রাখে অভেদে ...

দুই .

শরীর থেকে মন ছিঁড়ে নিয়ে 
এখনো খোদাই করে চলেছি বিজন ব্রজেশ্বরী 
রক্তে অরুচি ধরে গেছে 
তার চাই সাদা জুঁই ভাত ...

যখন বনস্থলী 
যখন মায়াবী তখন বাঁধন লাগে 
ভেজা বন্দুকের মাছিটা সোনার তারার মতো জ্বলছে 
বুকের ললন্তিকায় 

তার চিবুক বিন্দু হাতে ধরে থাকে দেশের রোদ 
সপ্তরথীর মতো পাহাড়ি পিলুতে গাওয়া 
অসহায় মনে নির্দোষ বন্য সুর সরলভাবেই ঢোকে 
ঢুকে শিউরে শিউরে ওঠে আনন্দে 

চাঁদের দূরবীন নেই 
সাদা দাড়ি নেই 
মা কাছে নেই 
নখে আঁচড়ে আঁচড়ে সুতো সুতো করে গেছে বেড়ালেরা 


মেঘের দেশ থেকে হিজিবিজি আঁকা এক খন্ড কাগজ 
হাতে নিয়ে বসে থাকে চন্দ্রাহত 
বৃদ্ধ বাবার মতো ... বনবীথিকার মতো ...




১-লা বৈশাখ সংখ্যা || কবিতায়~অলোক বিশ্বাস

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || ১-লা বৈশাখ সংখ্যা || 

অলোক বিশ্বাস

নারীবন্দনা : ২ 

ঝড়ের গতিতে বহু সত্যকে মিথ্যা, বহু মিথ্যাকে 
সত্য করা যায় নারী বন্দনায়। ভূগোল, ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার পাঠক্রমে নারী বন্দনার উৎকর্ষ  আছে বজ্রবিদ্যুৎভরা অমরতায়। ভূতের গল্পে বা জাদুবাস্তবতায় নারীদের শোভা সদ্যজাত শিশুর মতোই। আমি হাজার সেলাম জানাই নারীদের, প্রাকৃতিক সকল বস্তুকে চিরতরে অস্থির রেখেছে ব'লে। জাগতিক পরাজাগতিক নারীরা পৃথিবীকে নতুন কোরে জন্ম দেয় প্রতিদিন। দেখছি নদী ও সমুদ্র থেকে উঠে আসছে অগ্নিহোত্রী নারী। কিভাবে প্রকৃত নারীর জন্ম হয় রোজ একথা কেউ কেউ জানে। আমি যখন দুগ্ধাদি পান কোরি, যখন সাঁতার কাটি, যখন জ্যোতিষ্ক স্পর্শ কোরে বীর্য পূর্ণ কোরি, যখন বনস্পতির সমীপে প্রশান্ত বৃষ্টি প্রার্থনা কোরি, গায়ত্রী মন্ত্র সমেত, সকল ঈপ্সিত বস্তু সমেত, হারিয়ে যাওয়া পরিশ্রুত জল সমেত, শুদ্ধসত্ত্ব স্বর্গীয় অভিপ্রায় সমেত নারীরা আমার সম্মুখে এসে দন্ডায়মান হয়। আমি তাহাদের নির্মল প্রভায় বসে নীরবে নারীবন্দনা কোরে যাই।



১-লা বৈশাখ সংখ্যা || কবিতায়~হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || ১-লা বৈশাখ সংখ্যা ||    

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

উলের সুতো

আমার দিদিমা খুব ধীর স্থির হয়ে
উল নিয়ে চারঘর এগিয়ে গিয়ে
কিছুক্ষণ পরেই আবার চারঘর পিছিয়ে আসত 

উল বুনছ ?
সোয়েটার বুনছ ? 
এসব কানে গেলেই দিদিমা খুব জোরে হেসে উঠত

শুনেছি কোনো এক শীতের দেশ থেকে বুড়ি উঠে আসে
সোয়েটার মানে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া একটা শরীর
যাবতীয় যুদ্ধের শেষ

উলের সুতো হাতে যুদ্ধ চলুক 
ঠাণ্ডার সঙ্গে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে
ঠাণ্ডার সঙ্গে পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে
সর্বক্ষণ সারাটা পথ মাছরাঙার দৃষ্টিতে

পরিধি ধরে ছড়িয়ে পড়ুক দিগন্ত পর্যন্ত
পথে পথে গোপন গুহায় কিছু উলের সুতো
ঠাণ্ডার মস্তিষ্কে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার তোড়জোড় চালাচ্ছে ।




১-লা বৈশাখ সংখ্যা || ২টি-কবিতায়~গোবিন্দ ব্যানার্জী

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  ১-লা বৈশাখ সংখ্যা ||    

গোবিন্দ ব্যানার্জী

ছায়া ফিরে যাবে গাছেদের কাছে

এমনি ভাবে নয়, মেঝে থেকে চোখদু'টো
প্রতিবিম্বিত হয়ে ঝুঁকে পড়া পাতার ঝোপ... 
প্রেসারে হাওয়া দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠার আগে 
তার পরিশুদ্ধ ছায়া আয়েশ ক'রে বসে
স্নিগ্ধতা মুড়ে... মা যেভাবে চেয়ে থাকতেন,
সন্ধ্যা বাগানের দিকে উদাসীনতা দেখালে...
সেইখান থেকে দীর্ঘায়িত পথের টানাপোড়েন 

আর এক পত্রাবলী স্নেহের কাঁধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে 
সে সময় নাড়কেল গাছ মাথা দোলানো থামায়
প্রেসার শাসন করে হাওয়াদের... আসলে দৃশ্যত 
চোখদু'টো বাতাসের সাথে লুকিয়ে দেখে
ফিরে যাওয়া প্রতিধ্বনিদের... আসলেই যারা 
ছোপের মত আটকে থাকতে না পেরে
ফিরে যাচ্ছিল ভাঙা ঢেউ নকল ক'রে ক'রে... 
তাদেরও বসে থাকতে হয়েছিল সেই দীর্ঘাঙ্গীর পাশে

পরিপাটি গাছটি একদিন হেসে উঠবে খুব... 
সেদিন চোখদু'টো নাই থাকতে পারে
সেদিন ছায়াগুলো আরো নিস্তেজ হয়ে যাবে
হয়তো সন্তানেরাও বেড়ে উঠবে বাতাস ছুঁতে...
মেঝে থেকে তারও বহুদিন পরে
ছায়া ফিরে যাবে গাছেদের কাছে.... 

আলোময় করো হে

সে তো প্রজন্মের কারসাজি 
হাতের ছোঁয়ায় হাত যে আশ্বাসটুকু 
গেঁথে রাখে উজানে
তার রং বিপন্ন হয়েছে কবে...?
এই যে মেঘগুলোকে 
সোহাগ ক'রে পাশে বসিয়ে রাখো
ছাদতারাদের খৈ ছড়িয়ে দাও নিটোল গালে
পথের ভিতর রাতচরাদের ক্লান্তি ঝুঁকে পড়লে
তুমি নিজেকে নিয়ে আড্ডায় বসে যাও...
তারপর মানেগুলো টুকে রাখো কোড়া পাতায়

এসবের ঢেউ বড় হয়, যাত্রীরা ভীড় করলেই
হুইসেলের শব্দ আছড়ে পড়ে 
খুব দ্রুত একটা চিত্রনাট্য লেখা হয় চশমার কাঁচে
হ'লো না হয়তো ক্যামেরার আলোর হৈ চৈ
তবু তো টালির চালে লাউডগা উসকে উঠলো
ডায়েরীর গোটাকয় পাতা সূর্য মেখে নিল

যাবতীয় ঝাড়পোঁছ সেরে নিয়ো তুমি
তারপর... তারপর... আগামীকাল সূর্য উঠবে... 
প্রার্থণার মন্ত্রগুলো আউড়ে নিয়ো ঘুমের ঘোরে 
আহা, সূর্য...আলোময় করো হে...