Tuesday, April 26, 2022

সৈকত ঘোষ-এর নির্বাচিত সিরিজ কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  সৈকত ঘোষ-এর নির্বাচিত সিরিজ কবিতা



একটা বিন্দু। এক বুদবুদ। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বিন্দু থেকে আলফা বিটা গামা পার্টিকেলস ছিটকে পড়ছে ডিমের কুসুমের মতো ফ্রায়িংপ্যানে। সেই বুদবুদ থেকে একটা বিস্ফোরণ। তীব্র মেটালিক। মস্তিষ্কের প্রতিটি গ্রন্থিকে প্রবল ভাবে নাড়িয়ে দিল...

জরাসন্ধের বিছানা 

১.

সময় পেছন দিকে হাঁটলে গ্লাসের জলে
ছায়ার প্রলেপ পড়ে
অন্ধকার আমাদের পরিভ্রমণ করে রোজ
কয়েকটা সংকেত ধরে এগিয়ে গেলে 
যুক্তাক্ষরগুলো ভাঙতে শুরু করে
দহনপর্বে আরও একবার কেন্দ্রচ্যুত ভগবান

মেঘ দিশা খোঁজে না 
চোখ থেকে গড়িয়ে নামে নীল অপরাজিতা 


২.

ভূ-ত্বকের নিচে ক্রমাগত বিস্তার পাচ্ছে অধিকারবোধ 
আমাদের জামাগুলো খুলে নিলে 
হ্যাঙারে ঝোলে হাওয়াই দ্রাঘিমা 

প্রতিটা পাথরে আমি রূপভেদ খুঁজি 
হিমাঙ্কের নিচে মৌলিক হয় নিশ্বাস 
সময়কে ধ্রুবক ধরলে প্রতি অণু নিউক্লিয়াস 
পৃথিবীর পালস রেট ধরে রাখে 

জলের আঁচলে তুলে নিই ছায়ার গ্রাফচিত্র 
নতুন শহরের মানচিত্রে তোমাদের মুখগুলো আঁকা হোক 


৩.

আগামীর যন্ত্রণা কাঁধে হামাগুড়ি দিচ্ছে বিসর্গেরা
সন্ধিবদ্ধ রুমাল জানে তার ব্যপন ক্ষমতা 

একটা ছায়াপথ থেকে খসে পড়ছে সমবাহু গান 
রুপোলি চিৎকার বর্গভেদে বৃত্ত আরও আণবিকে জল 
আনুপাতিক বিভাজন থেকে বসন্তকাল জন্ম নিলে 
সেখানে কোকিলের আনুগত্য থাকে না 

বৃষ্টিরও ঝোক থাকে শ্লীলতাহানির
প্রতি অণু দুঃখের সমীকরণ আগামীর গান শুনেছে 
রহস্য কেবল অনুমানে দানা বাঁধে তা নয় 
অনেক চিন্তাশীল মাথা এক হলে মেরুকরণ স্পষ্ট হয় 


৪.

একচোখ বন্ধ করলে জলের পৃষ্ঠটান 
দরজা সূত্র অতিক্রম করে,

গাছ মাটি পাথর ম্লান হাসে 
ছোটোবেলায় শোনা শিকারি গল্পটার মতো
সৃষ্টির আদি যুগে ফিরে যায় মানুষ 

আত্মজীবনী লিখতে বসলে 
একটার পর একটা সরলরেখা আমাকে ছেদ করে যায়
বিন্দুগুলো জুড়তে বসে সময়ের যমজ

স্মৃতিরা হাইপার সেনসিটিভ 
এডিটিং টেবিলে একটা এল ই ডি আলো
মানচিত্র থেকে ঘুম নিয়ে আসছে 


৫.

ইমেজ অনেকটা নতুন রুমালের মতো 
বুক ভরে শস্যের ঘ্রাণ নিতে নিতে 
কখন আবিষ্ট হয়ে যায় 

তোমার হাসি দেখে বোঝার উপায় নেই 
কেয়ার এবং শেয়ার শব্দদুটো আক্ষরিক অর্থে 
কতখানি ভার বহন করে 

ছাতার নিচে হাঁটলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা
কফিকাপে গিয়ে ঠেকে। এর বেশি হলে 

শহরের সমস্ত যানবাহন অবাক চোখে তাকায়
ফায়ারঅ্যালার্মে বুঝি 
আমার গালনাঙ্কে ভিজে উঠেছে পকেটের রুমাল...


৬.

বালিঘড়ি উলটে দিলে 
ভরকেন্দ্র কোমর থেকে নখে স্থানান্তরিত হয়

জোনাকি লেখে নির্ঘুম সংলাপ
স্ক্র্যাবার খুঁটে তুলছে মৃত হাসি কোষ
ঢেউ থেকে রেহাই পায়নি পতঙ্গরাও

আরশিতে রাখা ঘুম সুযোগ বুঝে ঠিক ঠোঁট ফুলিয়েছে
প্রতিটা স্ট্রোকে জলের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে কাগজ
কিছুক্ষণের জন্য সময় ও দূরত্ব গলাগলি
এটা কোনও কোটেশন নয়

প্রতি রাতে বিষণ্ণতার হাজারো এক উপকরণ
কাটা জিভের আরও গভীরে নামছে...


৭.

দেয়াল বন্ধুরা টিসার্টে উঠে এলে 
মিছিলে হাঁটা ছাতারা লজ্জা পায় 
টি আর পি যাই বলুক 
রোজকার মতো সূর্য প্রনাম ধরে রেখেছে মেগাসিরিয়াল

ধর্মের কল কি বাতাসে নড়ে ?
এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে যতই সাপ্লিমেন্ট দাও 
ভিটামিনের অভাব পুরো করতে পারেনা ক্রিয়াপদ 

জীবনে যতবার কিছু বলতে গেছি
অসঙ্গতি থেকে গেছে সে বলায়
দূরত্বের স্কেলে কোনোকিছু বিশ্লেষণ করলে 
অক্ষমতাই কেবল প্রকাশ পায় 


৮.

কার্নিশ ধরে দাঁড়াতেই আমার সামনে আসে 
সেই সুগার-ফ্রি মেম 

'ক' এ কাক 
'গ' এ গোরু 
'র' এ রুবারু...

ফ্রেমটা ব্ল্যাকআউট হতেই 
ধারাবিবরণী 

ব্যাকরণে 
        উলটো শয়নে 
                 শির্ষাসনে
                          হাই সেনসেক্স


৯.

ছায়াময়তা থেকে উঠে আসে সবুজ সন্ধে 
সোনালি চতুর্ভুজ চৌকাঠ ডিঙিয়ে শুষে নিচ্ছে উত্তাপ 
ম্যাগনেটিক স্পর্শে আকর্ষণ থাকে না 
গ্রিক পুরাণে বৃষ্টি দেবতা এতটাও স্পর্শকাতর নয় 

চৈত্র সেলে একে অপরের মেরুদণ্ড বেচে দিচ্ছে 
দাড়ি কামানো কুকুরেরা পোজ দিয়ে দাঁড়ালে
জেলিফিশের বুকে মধ্যরাত নেমে আসে 

কোথাও কোনো ঘুলঘুলি নেই, কোথাও নেই জলীয় মিছিল 
দেয়াল চিত্রে পরীক্ষামূলকভাবে আঁকা হচ্ছে যাযাবর জীবন 


১০.

পেছন দিকে দৌড় শুরু করলে আলটিমেটলি
যেখানে পৌঁছানো যায় 
যেখানে শরীরের কোনো আকার থাকে না 

আমার সামনে দপদপ করছে ফিলামেন্ট 
মাথার ভিতর থেকে গ্রে-ম্যাটারগুলো ছড়িয়ে পড়ছে 
ম্যাজেন্টা কালিতে 

প্রত্যেকটা অক্ষর থেকে চক্রাকারে বেরিয়ে আসছে 
অতিরিক্ত আলো 
অভ্যেস বসত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ শেষে 
কবিতা লিখতে বসলেই একটা প্রশ্ন বারবার 
সামনে আসে 

অনিচ্ছুক চাষিরা কি সভ্যতার ভাগ পাবে না ?


১১.

অবাধে যন্ত্রণারা চরাচর করে মস্তিষ্কে
অসময়ে বিভাজ্যতার নামতা লিখতে বসলে
মুখের চারপাশে খণ্ডে খণ্ডে ভেসে ওঠে 
জীবনের পাইগ্রাফ 

প্রায়শই আমি দিকভ্রান্ত হই
শেষ বিকেলে যখন পাখিরা ঘরে ফিরে যায়
আমার শরীরে ভিড় করে নাগরিক ধোঁয়াশা

প্রত্যেকটা ঘুম কোনও এক আণবিক স্তরে
নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে


১২.

মেঘেদের বর্ণমালা শুষে নিচ্ছে শহুরে লীনতাপ 
পরজীবী চরিত্রেরা পূর্বজন্মের ইতিহাস আঁকড়ে 
প্রজনন করবে এটাই তো স্বাভাবিক 

যেহেতু আমাদের সভ্যতা নদীমাতৃক তাই 
মেয়েদের ডেনিম থেকে শুরু হয় অ্যানাটমির ক্লাস

আলো নিভে গেলে আমি ঘ্রান নিতে থাকি 
আসেপাশের সমস্ত শূন্যপদ কী এক অজানা টেন্ডারে
লুফে নিচ্ছে খানদানি 'খ' 


Thursday, March 24, 2022

প্রভাতহীন~নীলিমা সাহা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   নীলিমা সাহা 

আমার চোখে প্রভাত-দা

চোখের আলোয় দেখেছিলেম
                চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব যখন 
               আলোক নাহিরে---

রোদ্দুরের স্বরলিপি ঢুকে পড়েছে অভিমানের দপ্তরে।তিনি এখন ঘুম স্টেশনে অপেক্ষমান।আমি শুনছি ঘুমনৌকোর ছলাৎ...

কবি অলোকবিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে  আমার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল যে প্রভাত চৌধুরী এর আগে বহুবার অসুস্থ হয়েছেন,আবার সেরেও উঠেছেন।এবারও সেরে উঠবেন,সেরে উঠে আবার আগের মতো বক্তৃতা দেবেন ।নিজের জন্মদিন পালন করবেন মহাসমারোহে ।তাই সবাই চিন্তা করো,কিন্তু দুশ্চিন্তা কোরো না।দুশ্চিন্তা 
করলে প্রভাতদা ব্যথা পাবেন।

কিন্তু না,কষ্টের, দুর্ভোগের প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবারও ফিরে এলেন না প্রভাতদা ।সহসাই উত্তর বাতাস এসে থরথর কাঁপিয়ে গেল শীতজানালা ...দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ...খুলেই ঢুকে পড়ল কথাহীন ব্যথা --হাতে বিয়োগচিহ্নের সাদা পাতা,কাঁধে নীরবক্লান্তবিষাদ অত্যাশ্চর্য না-ফেরার দেশের ঠিকানা প্রভাতদা এখন অনন্তলোকে।নিনি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় একদা একান্তেই ভালোবেসে লিখেছিলেন---

নীলিমা-কে নিয়ে লেখা কবিতা//প্রভাত চৌধুরী 

নীলিমাকে আমি পুতুল খেলতে দেখিনি,এই স্বীকারোক্তি থেকে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন--নীলিমার
পুতুল খেলার বয়স ছিল না '
এই তথ্যটিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি--তাহলে ভুল করবেন
আমি আমার সীমাবদ্ধ দ্যাখা কথাই লিখতে চাইছি

নীলিমা ভূত দেখে ভয় পায় কিনা তাও আমার জানা নেই
নীলিমা আদৌ কোনো  ভূত দেখেছে কিনা তাও আমি জানি না 
তাহলে কীভাবে ভূত এসে পড়ল অদ্ভুত ভাবে,তাও আবার পুতুল খেলার অনুষঙ্গে 

পুতুলখেলার সঙ্গে ভূতেদের কোনো সহযোগিতা আছে এমন কথা ত্রৈলোক্যনাথও
লিখে যাননি

নীলিমার কি কোনো পোষা বিড়াল আছে, তাও আমার জানার পরিধির বাইরে 
গোগোল তিতলি অদ্রিজার কাছে ম্যাও-এর মোবাইল নম্বর আছে,আজই আমাকে 
জানিয়েছে,নম্বরটা বলেছিল
গড়গড় করে, সেটাও ভুলে গেছি
নীলিমা  সম্পর্কে এত কিছু না জেনেও নীলিমাকে নিয়ে কবিতা  লিখছি,তবে কথা দিচ্ছি নীলিমাকে পুতুলখেলা
ভূত এবং পোষাবিড়াল সম্পর্কিত তথ্যগুলি সংগ্রহ করার পর আবার  নীলিমাকে
নিয়ে কবিতা লিখতে বসব,
বসলেই একটা টয়ট্রেন এগিয়ে  আসবে, আমি সেই ট্রেনে ওঠার চেষ্টা  করলেও উঠতে পারব না,নীলিমা  কি পারবে,তা নীলিমাই জানেতো,এই হচ্ছেন প্রভাতদা ,কবি প্রভাত চৌধুরী।আর তাঁর লেখনী-স্টাইল!কিভাবে কাব্যভাষায় অক্ষরমহিমা শব্দে শব্দে গড়ে তুলবে এক জাদু-বাস্তবতা ,বলা বাহুল্য যে তা কবিরই অনুপম দক্ষতা।এইভাবেই কবির কবিতার ঘর- ঘরনি এক ঘরানার আবিষ্কার করেছে যেখানে অনায়াস প্রবেশে পাঠকচিত্তের প্রাপ্তি চমকিত আমোদ...শব্দের মোহজালে তাঁর কবিতা খুব সহজেই পাঠক মনকে আকর্ষণ করতে পারে ।যেন টগরের ডালে ডালে দিগন্তের উপাচার সাজানো, যেখানে না-বলা সম্পর্কেরও ফুল তুলিতে ভুল হয় না।

তবু  আকাশের মহাপয়ার, ছন্দপতনে সহসাই জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়ের চিহ্ন যে উড়ো এক উদাস বিষাদ সম্ভাষের কাপাসের আঁশ ১৯৪৪ সালে বাঁকুড়ার হাটকেষ্টনগরে প্রভাত চৌধুরীর জন্ম।শৈশবের বেশিটাই কেটেছে কালিঘাটে,কিছুটা বাঁকুড়ায়।পরবর্তীতে পেয়েছি পটলডাঙার ঘরে।ডানাভাঙা গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন জড়িয়ে ধরে অনুভবে যিনি এখনও অনুপ্রাণিত, তিনি সর্বংসহা সারদাময়ী যূথিকা বৌদি।তাঁর সঙ্গে আছে পুত্র পুত্রবধূ ও নাতির সাহচর্য ।

৬০এর দশকে কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে কবি প্রভাত চৌধুরীর আত্মপ্রকাশ ।১৯৬৬ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শুধু প্রেমিকার জন্য '।ভাবতে অবাক লাগে যে এরপর থেকেই একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ,বেশ কিছু পত্রিকার সম্পাদনা,নূতন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ--এত্তসব কাজ কীভাবে করে উঠতেন।যদিও পরবর্তীতে প্রায় দুই দশক নিরলস চর্চার পর আনুমানিক  দশ বৎসর সাহিত্যগত থেকে
নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

পুনরায় নতুন উদ্যমে ১৯৯৩ সালে শুরু করলেন কবিতা পাক্ষিকের মতো পত্রিকা, যে পত্রিকা সকল পাঠক তথা লেখকের কাছে একটি মাইলফলক।পত্রিকা  প্রকাশের  পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ ।প্রকাশিত  হয় 'সাদাখাতা',সাক্ষাত্কার, আবার সাক্ষাত্কার, নোটবই, উত্তরপর্বের কবিতা, এইসব,হল্লাগুল্লা,সুসমাচার, কুশল সংবাদ,এবং প্রভৃতি ।কিন্তু 'কবিতা পাক্ষিক '-এর মাধ্যমেই প্রভাত দা  উত্তর আধুনিক প্রবণতাকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছেন বারেবার।অধুনান্ত কবি প্রভাত চৌধুরীর  প্রচেষ্টা ছিল  এবং চাইতেনও যে কবিতা সর্বদা আপডেট হোক।

বস্তুতপক্ষে উত্তর আধুনিক বা পোস্ট-মর্ডান বিশ্বসাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ বহুল আলোচিত একটি শব্দবন্ধ ।কবি প্রভাত চৌধুরীর  অদম্য উৎসাহে পাঠক তথা লেখকগোষ্ঠী খুঁজে পেল এমন এক প্লাটফর্ম যেখানে দিনগুজরানোর মধ্যে গচ্ছিত হতে থাকে স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ ।সাহিত্যিক অপেক্ষা তিনি পরিচিত  হয়ে উঠলেন সাহিত্য কাণ্ডারী রূপে।

নিত্য দিনের সুখদুঃখ-আনন্দক্ষোভ-ক্ষুধামোহঅনুরাগ-অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিশ্বপ্রকৃতি জনারণ্য জীবন ও বহমান উত্তাপ এবং মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের হাতছানি তাঁর লেখনীজুড়ে।দিনলিপির মলিন পৃষ্ঠায় 'আমি'-র ক্ষুদ্রত্ব উপস্থাপনেও এক অভিনব পরিবেশন সত্যি খুব আকর্ষণীয় ।

প্রভাত দা নিজেই বলেছেন, তথ্য মেনে কবিতা লেখা হয় না।কবিতা থেকে আবিষ্কৃত হয় তথ্য ।কবিতা-যাপন একটা  বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত । ২৪×৭শুধু কবিতাতেই সাঁতার কেটে চলাই হচ্ছে যাপন।যেমন তিনি বলতেন,ফুলগাছে জল দিচ্ছি, এই জল দেবার কাজটি রূপান্তরিত করতে হবে কবিতালেখার কাজে।এটা কীভাবে করতে হবে সেটাই নিজস্বতা ।প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন ঝুলবারান্দা,ভিন্ন ভিন্ন রান্নাঘর।টেনিস কোর্টও
আলাদা,পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ভিন্ন স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে হবে ।

তাঁর একটি কবিতাতেই দেখি এই বৈচিত্র্যের স্বাদ।তিনি লিখছেন---
আমার কবিতা ---আমি বর্ষবরণে কবিতা লিখতে চাইলে বর্ষাবরণের কবিতা উঠে আসতে চায় ।এখন চেষ্টা  করতে হবে বর্ষ এবং বর্ষার পালসরেট।একটা আ-কারের জন্য ব্যাঙ্কের আচরণে কী রাসায়নিক পরিবর্তন হয় কিংবা প্রস্ফুটিত ফুলের রং এবং গন্ধেরও রকমফের  হয়ে থাকে তার জন্য  কোন সূর্যোদয়ে যেতে হবে তাও জানা নেই তবু বর্ষকে তো বরণ করতেই হবে ।না হলে বঁধুয়া কী করে ঘরে ঢুকবে শাঁখ এবং বরণডালা নিয়ে  যারা অপেক্ষা করছেন ।

তাদের কথা না ভাবলে লোকে  মন্দ বলবে যে ---এভাবেই চলার স্বচ্ছন্দ তাঁর কাছে এক শিক্ষণীয় বিষয় 
বাংলা কবিতার  পরিবর্তনে কৃত্তিবাস কতটা সফল হয়েছে তার খোঁজ অমূলক।বরং বলাই বাহুল্য  যে প্রভাত চৌধুরীর কবিতা পাক্ষিক এমন  মাইলফলক,যেখানে নানান ডাইমেনশন, নানান অনুষঙ্গ এবং পরিবর্তিত discourse- এ সাবলীল চমৎকৃত চিত্রকল্পরূপী অটোমেটিক writing skill-এর ব্যাপার টা।এবং পাঠক অনায়াসে তা উপভোগ করে আনন্দ পায় ।প্রভাত দা হলেন rolling stone,তাই শ্যাওলা  জমে না।একাধারে পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তেমনি আছে তাঁর স্বয়ংক্রিয়তা।তিনি signature তৈরি করে নিজেকে ধরা দিয়েছেন এবং শপথ নিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে তোলার কাজে।আসলে তিনি  প্রকৃতই কবিতা প্রেমিক।তবে  তাঁর এই হয়ে ওঠার পিছনে যাঁর ভূমিকা  অসামান্য,তিনি হলেন আমাদের বৌদি, সর্বংসহা সারদা, যূথিকা  চৌধুরী।

বাংলা সাহিত্য জগৎ এই মুহূর্তে  অভিভাবকহীন।১৯৯৩ সালে নতুন উদ্যমে নব কলেবরে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলেও প্রভাত চৌধুরী নিজেকে পরিচিত করেছেন তাঁর পোস্ট মর্ডান টেক্সট স্বরূপ  উপন্যাস, গদ্য, এডিটরিয়াল নোটস-এ।তিনি  ভালই জানতেন কবিতা পাক্ষিক-এর ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতার  যাত্রাপথ।এবং এই কবিতা পাক্ষিক তাঁর প্রাণ।তিনি  বারেবারে  বলেছেন, কবিতা হচ্ছে  নিজের মত প্রকাশের একমাত্র জায়গা।

এটা তো ধ্রুব সত্য যে বাংলা কবিতার ভাষা বদল প্রভাত চৌধুরীর হাতেই।অক্ষরবৃত্তের মহাসমারোহে  উত্তর আধুনিক ঢঙ এমন এক রসায়নে রসসিক্ত যে রসিকমাত্রায় কবিতাপথ যেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, তেমনি বহুরৈখিক হাঁটাহাটি যেন তাঁর কাছে  অনায়াসলব্ধ।তিনি বারবার বলেছেন এর জন্য চাই আপডেট মাইন্ড ও আপডেট চোখ।শব্দের বহুল অর্থের ব্যাপক বিস্তারে ঘটে যায় আত্ম বিবর্তন ।প্রভাত-দার 'নোটবই '-এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লিখিত করতেই হয়।প্রভাত-দার এভাবেই উত্তর প্রভাতে  উত্তরণ ...যেমনটা ব্রাহ্মণ্যবাদের বহতা শব্দের উত্তরণ বুদ্ধে,বুদ্ধ থেকে  ভক্তিবাদ,সেখান থেকে রবীন্দ্র নাথ,রবীন্দ্রনাথ থেকে কল্লোল
---এভাবেই শব্দের  বিষয়মুক্তি ঘটতে থাকে।এমনটা কেবল কবিতায় নয়,উপন্যাস, এডিটোরিয়াল  নোট, গদ্য  সর্বত্র মুক্ত চিন্তনের অবকাশে একাধারে আধুনিক ও অধুনান্তপ্রাপ্ত হয়া ।ফলে পাঠক মনে এক মনকেমনিয়া স্রোত বইতে থাকে।এভাবেই  তিনি জাঢ্য ধর্ম ভেঙে শব্দের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছেন ।....(চলবে)

প্রভাত চৌধুরীর যে সকল উপন্যাস তার মধ্যে 'সতীসাবিত্রী কথা উপন্যাসে ব্যথারা সুখের মতো হৃদয়ের রাত ছিঁড়ে নামে।কালিঘাটের বেশ্যাপল্লির কাহিনি বিশুদ্ধতায় আলোকময় ।আর 'অনুপম কাহিনি 'এমন এক পোস্ট-মর্ডান টেক্সট যেখানে প্রভাত চৌধুরী ও অনুপম একে অপরের অল্টার ইগো।এরা পাশাপাশি থেকে কথা বলাবলি করে সবার অগোচরে  আবার নিজেদের দূরে সরিয়েও রাখে। আত্মজৈবনিক উপন্যাসে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ছায়ায় এইভাবে  নিজেকে ও পরবর্তী প্রজন্মকে  উপহার দিতে পারার দক্ষতায় প্রভাত দা চিরস্মরণীয় তথা চিরজীবী হয়ে থাকবেন।বলার অপেক্ষা থাকে না যে তাঁর  নিজস্ব পরিচয়ে তিনি অন্যদের থেকে  আলাদা ।

প্রভাতদার একটি স্মরণীয় কবিতা আজ খুব  মনে পড়ছে  :
যারা আমার শবযাত্রায় প্রথম সারিতে থাকবে তাদের বলে দিও--যেন চিৎকার না করে
চিৎকার আমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে

যারা আমার মৃত্যুর পরে শোকসভা করবে তাদের  বলে দিও---যেন আড়ম্বর না করে
ঐশ্বর্যের টানে আমি জেগে উঠতে  পারি

যে আমার মৃত্যুর পরে 
চোখের জল ফেলবে সে তুমি---তোমাকে চুপিচুপি 
বলে রাখি,চোখের জলে 
আমার ঘুম ভাঙবে না

প্রভাত-দাকে লিখতে হবে এভাবে কখনও ভাবিনি, যেন নিজেকে তিনি লিখিয়ে নিচ্ছেন,যেভাবে  কবিতা লিখিয়ে নিতেন আদেশের  সোহাগে
যেন চুপিচুপি  আমাকে ডেকে  বলছেন--কে বলে গো এই প্রভাতে নেই  আমি ...

হ্যাঁ, কবির তো মৃত্যু হয় না।
প্রভাত-দা আছেন, থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, আমাদের সাথে, আমরাও আছি তাঁর সঙ্গে, থাকবও।


প্রভাতহীন~শান্তিময় মুখোপাধ্যায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  শান্তিময় মুখোপাধ্যায়


প্রভাত চৌধুরী : বাংলা কবিতার এক মুকুটহীন সম্রাট

প্রায় চার দশকেরও বেশি যে মানুষটির সঙ্গে আমি সপরিবার ওতোপ্রোতো তিনি আর কেউ নন,বাংলা কবিতার আমৃত্য সৃজনকারী একক প্রতিষ্ঠান প্রভাত চৌধুরী। সেই প্রাক আশির দশক, যখন থেকে কলকাতা বইমেলা শুরু তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বা আমার বন্ধুদের যেমন প্রয়াত শুভ চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধনাতীত খুল্লামখুল্লা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হয় নি।তখন কলেজ স্ট্রিটে তিনসঙ্গী নামে একটা প্রকাশন সংস্থা ছিলো।যতদূর জানি তা ছিলো কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাতা সমীর চট্টোপাধ্যায়ের। প্রায়দিন বিকেলে প্রভাতদার সঙ্গে আমার সেখানে যাবার সুযোগ হতো।এছাড়া ময়দানে বইমেলাতেও তিনসঙ্গীর স্টল থাকতো।প্রভাতদা সেখানে বসতেন।আর লিটিলম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ানে বহরমপুর থেকে প্রকাশিত আমাদের রৌরবের টেবিল থাকতো।সেসময় বইমেলার স্টলগুলোর কোনো কোনো দুটো স্টলের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা রাখা হতো।যেখানে কতগুলোতে টয়লেট বা পানীয় জলের ব্যবস্থা আর খুব সরু ফাঁকা জায়গাগুলো খালিই থাকতো।যেগুলোকে গোদা বাংলায় আমরা বলতাম গলতা।সেগুলো ছিলো আমাদের মতো আরো অনেকের তরল আগুনে আচমন সারবার অলিখিত এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপণা।বলাবাহুল্য প্রভাতদা ছিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন। আর কলেজস্ট্রিট পাড়ার বেসামাল মহাপুরুষ  ভেটকি যার ভালো নাম প্রায় সকলেরই অজ্ঞাত সেই সিদ্ধার্থ ঘোষ অনিবার্যভাবেই সঙ্গী হতো আমাদের।বাঁকুড়ার চারণকবি বৈদ্যনাথও দুএকবার সঙ্গী হয়েছিলেন শ্রীমদ প্রভাতদার বদান্যতায়। প্রভাতদা সেসময় লেখালিখির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা  রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নে সরাসরি নেতৃত্বে থাকলেও কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে কখনো কিন্তু যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেননি। রাইটার্স বিল্ডিংসে তাঁর অফিসের টেবিলে প্রতিদিনই কোন না কোনো কবি বা গল্পকারকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। গল্পকার অনিল ঘড়াই এর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো সেখান থাকেই।কবি বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ আচার্য(একান্তর),সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, সমীরণ মজুমদার(অমৃতলোক) ছাড়াও আরো অনেককে নিয়ে সেসময় একটা বৃত্ত গড়ে উঠেছিলো প্রভাত চৌধুরীকে কেন্দ্র করেই।৩৬ডি,হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের প্রভাতদার বাড়িও ছিলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কবি যোগব্রত চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম কবিতার বই 'স্বজন বিদ্রোহ' প্রকাশের পরিকল্পনা হয়েছিলো এখান থেকে।বইটির মুখবন্ধে তারাপদ রায় লিখেছিলেন তা।আমার বিয়েও হয়েছিলো এই বাড়ি থেকেই।প্রভাতদার ইচ্ছেমতো গোধূলি লগ্নে এবং বামপন্থী পুরোহিতের যদিদং হৃদয়ং জাতীয় মন্ত্রোচ্চারণে। 
বাংলা কবিতার এরিণায় প্রভাতদার সব থেকে বড়ো কৃতিত্ব ১৯৯৩ থেকে আমৃত্যু প্রায় ২৯ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে একটা পাক্ষিক এবং পরে সাপ্তাহিক কবিতাপত্র সম্পাদন এবং প্রকাশনা।যার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ২৪ বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ(ইং ৭ মে,১৯৯৩)।কালীঘাট মিলন সমিতির সভাঘরে ঐ প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, ফাদার গাস্ত রাঁবেজ ছাড়াও কলকাতা তথা বিভিন্ন জেলার অনেক কবিরা।এই কবিতাপত্রটি প্রকাশে তাঁর যে ভাবনাটি কাজ করেছিলো প্রথম সংখ্যার প্রাক কৈফিয়তে সেই কারণটি উল্লিখিত ছিলো -- "বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী কবিতা দৈনিকের সম্পাদনা এবং পরিচালনার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলাম।পত্রিকাটির নাম 'সান্ধ্য কবিতা দৈনিক'।আমরা চাই কবিতার সেই পরিবেশ ফিরে আসুক।তাই কবিতা পাক্ষিক।"।যদিও আমি গর্বিত তবু বলা বাহুল্য প্রথম সংখ্যা থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমি এই পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।এবং প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।এছাড়া সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ছিলেন পিনাকীরঞ্জন ঘোষ ও সুজিত হালদার।আর একটা বড়ো কাজ প্রভাতদা যেটা করেছিলেন তা ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলনকে দুমলাটের মধ্যে একত্রে সংকলিত করে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া।বইটি সম্পাদনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিলো আমার উপর।
পরিশেষে বলা যায় গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার এই রাজনৈতিক শ্লোগানটিকে শতজল ঝর্ণার ধ্বনির পর প্রভাত চৌধুরীই প্রকৃত অর্থে ব্যাপক বিস্তৃতি দিতে পেরেছিলেন।উত্তর ২৪ পরগনার আবীর সিংহ,মেদিনীপুরের রোশনারা মিশ্র,মউলি মিশ্র থেকে শুরু করে পুরুলিয়ার অংশুমান কর --- নব্বইয়ের প্রায় সব কবিরই প্রথম আত্মপ্রকাশ এই কবিতা পাক্ষিক থেকেই। বাংলা কবিতার দুর্ভাগ্য এইসব কবিতাপ্রাণদের কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠান বা সরকারী তরফে কোনো পুরষ্কার জোটে না।গার্ড অফ অনার আর রাষ্ট্রীয় কাঁদুনি শুধু সেইসব তথাকথিতদের জন্যে।সফিস্টিকেশনের এই ধুলোবালি গায়ে না মেখেও বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট প্রভাত চৌধুরী, আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মতো শব্দশ্রমিকদের নিঃশব্দ স্পন্দের মধ্যে,অনুচ্চারিত শোকে ক্রমশ আরো বেশি মুহ্য হতে হতে।

প্রভাতহীন~যশোধরা রায়চৌধুরী

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   যশোধরা রায়চৌধুরী   

প্রভাত চৌধুরী এক স্টিম ইঞ্জিনের নাম

১৯৯৫ সাল। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনের এলাকায় কবিতা পাক্ষিক তখন একটা সদ্য উঠে আসা ঝলমলে নাম। পাতিরাম
থেকে একটা সংখ্যা কিনলাম, সাম্যব্রত জোয়ারদার নামে এক কবির লেখা পড়ে কেমন ছিটকে গেলাম। নিজের কিছু লেখা
খামে করে পাঠালাম ছাপান ঠিকানায়। বাস্তব অর্থে সে ঠিকানা আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথ।
কয়েকদিন পর কোন এক সকালে বাড়ির দরজায় কড়া। আমি প্রভাত চৌধুরী, কবিতা পাক্ষিকের সম্পাদক। সেই শুরু।
তারপর কত অসংখ্য সন্ধ্যা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের সেই বাড়িতে। বৌদির মধুর উপস্থিতি ও ঘন ঘন চা সাপ্লাই, রোগা ,
ধনুকের ছিলার মত টানটান, লম্বা, কোলকুঁজো, তখনো চুল না পাকা চির যুবক ভাবে ভাবুক প্রভাতদার কবিতা পাক্ষিক
করে পৃথিবী কাঁপানোর সংকল্প, আর পাশাপাশি সর্বদা স্মিত- শান্ত নাসের হোসেন, ছটফটে তরুণ রজতেন্দ্র। অসংখ্য
কবি সাহিত্যিকের আনাগোনায় জমাট সেই একতলার ঘর। সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, রবীন্দু বিশ্বাস, সৈয়দ
কওসর জামাল, কানাইলাল জানা, নিখিলকুমার সরকার, অসংখ্য আরো নাম মনে পড়বে আমার, যাদের সংগে দেখা, আলাপ
সবটাই প্রভাতদার সূত্রে....কথায় কথায় কবিতা উৎসব , বিশেষ সংখ্যা, এটা ওটা সেটা। সারাক্ষণ কিছু না কিছু আয়োজনে
থাকতেন প্রভাতদা।

আমার প্রথম বই পণ্যসংহিতা প্রভাত চৌধুরী ও কবিতা পাক্ষিকের অবদান। এটি ছিল এক রকম প্রচ্ছদে ( সাদা কমলা
রঙের আল্পনার মত পাড়) কবিতাপাক্ষিক কবিতামালা সিরিজের একটি। ১৯৯৬ তে। ১৯৯৮ তে পিশাচিনীকাব্য বের করলেন
সেও প্রভাতদা। আমার জীবনের প্রথম দুটি বইই কবিতা পাক্ষিক প্রকাশনার। পিশাচিনীকাব্যের প্রচ্ছদ নিয়ে জল্পনা,
কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে নী এর থেকে নেমে আসা প্যাঁচানো বিনুনিসহ, প্রভাতদারই সংগে বসে পরিকল্পনা, বানানো।
সেই বই গৃহীত হয়েছিল কৃত্তিবাস পুরস্কারের জন্য। প্রভাতদার সে কী আনন্দ। গর্ব।
ছোটদের সাফল্যে গর্বিত। হ্যাঁ প্রভাতদা হতে পারতেন।
কবিতা পাক্ষিক পত্রিকাটি নয়ের দশকের সময় চিহ্ন। ইতিহাসের অংশভূত হয়ে রয়ে যাবে। প্রতি পনেরো দিনে একটি চটি
কাগজ বেরুত। তখনো ডিটিপি আসেনি। টাইপ সেটিং করে সেই কাগজ বের করা হত। প্রুফ দেখা হত। প্রভাতদা আর তাঁর
লেফটেনেন্টরা সমস্ত কাজটি করতেন নিপুণ হাতে। নাসের হোসেন অন্যতম লেফটেনেন্ট। এই কদিন আগে নাসেরদা চলে
গেলেন। যাবার দুদিন আগেও কবিতাপাক্ষিকের প্রুফ দেখেছেন।
এর বাইরে ওই অসংখ্য বই করেছে কবিতা পাক্ষিক । প্রকাশনা হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা কবিতার জগতের
একটা মুভমেন্টের, সময়চিহ্নের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এর ভেতরে প্রভাতদা নিজের কবিতা লিখেছেন, নিজের গদ্য
লিখেছেন। ওয়ান ম্যান মেশিন। স্টিম ইঞ্জিনের মত কর্মময়।

২০০০ পরবর্তী সময়ে প্রভাত চৌধুরী পটলডাঙায় একটা ডেরা বানালেন। আমরা গেলাম প্রথম এক সন্ধের আড্ডায় । ছোট
খুরির চা, কাগজের ঠোঙার মুড়ি, প্রচুর কবিতা সংক্রান্ত কথা, সেই আড্ডা ছিল প্রাণচঞ্চল।


বস্তুত, এই লেখা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি, প্রভাত চৌধুরী আদতে ছিলেন লড়াইখ্যাপা লোক। একটা বিষয়, একটা ভাবনা ,
একটা বিশ্বাসকে ধরে, এগিয়ে যেতে পারতেন মাইল মাইল। সেই অসম্ভব প্রাণবন্ততাটাই ছিল ওঁর মূলধন। ফলত শত্রুও
বানিয়েছেন ও বাড়িয়েছেন বিস্তর আমাদের এই ছোট্ট কবিতাজগতে। বাংলা কবিতার জগতে যেখানে অসংখ্য দল, অসংখ্য
ছাতা, প্রভাতদা নিজস্ব বিশ্বাসের, ভাবনার বিষয়ে লড়ে গেছেন শুরু থেকে। ভাবনাটা ছিল পোস্ট মডার্ন লেখালেখি নিয়ে।
ভাববিশ্ব কে পোক্ত করার জন্য সমীর রায়চৌধুরী বা আরো কিছু তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তা, পড়াশুনো করা লোকজনের
আগমন ঘটেছিল বৃত্তে।

মুশকিল ছিল প্রভাতদা নিজে যেমন লিখতেন, সবাইকে তেমন লিখতে বলতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা "বড়" হতে থাকি ,
অনেকেই বৃত্ত থেকে সটকে পড়ি। কারণ ডিক্টেশন পছন্দ নয়। প্রভাত চৌধুরী কি তাই বলে ডিক্টেটর ছিলেন? তা নয়।
অনেক তর্ক বিতর্কের পরও , আমার চোখে প্রভাতদার বিশাল হৃদয়টাই পড়ে। প্রভাতদা বলতেনও, যশোধরা, বা অমুক,
এরা আমার চোখের সামনে কবি প্রসিদ্ধি পেল, প্রতিষ্ঠা পেল, জগত বড় হয়ে গেল... তাই পাক্ষিকের তাঁবু থেকে বেরিয়ে
গেল..। কিন্তু তা নিয়ে কোন মনোমালিন্য হল না। বইমেলার পর বইমেলায় প্রভাতদার স্টলে গিয়ে বৌদির বানানো জলখাবার
খেয়ে এলাম। আমার বেটার হাফ তৃণাঞ্জনের সম্পাদিত বড় সড় ফরাসি কবিতার অনুবাদের বই শূন্য তাপাঙ্কের নীচে , সেও
করলেন প্রভাতদা, ২০০৫ নাগাদ। সে বইতে অনুবাদ করলেন শরৎকুমার, বিজয়া, উৎপলকুমার, তুষার চৌধুরীরা।
"পুস্তানিটা দেখ তৃণাঞ্জন!" কত উত্তেজনা নতুন বই নিয়ে।

তারপর আমরা সময়ের অমোঘ নিয়মে অনেকটাই সরে এসেছিলাম। কিন্তু পাক্ষিকের ময়দানে এল আরো অসংখ্য নতুন
কবি, প্রভাতদার যে একটা ক্রমশ বড় করে চলা সতরঞ্চি ছিল। ২০১৬ থেকে কবিতা পাক্ষিক সাপ্তাহিক হয়েছিল।

মনে পড়ে ছোট ছোট অনেক স্মৃতি। আমাদের প্রথম দিকে দেশে আর কবিতা পাক্ষিকে যখন এক সঙ্গে কবিতা বেরুচ্ছে,
প্রভাতদা একবার বলেছিলেন, দেশ-কে তোমরা দেশের মত করে লিখে দাও, আর কবিতা পাক্ষিকে দাও নিজেদের
বিপজ্জনক, ভাষা ভাঙচুরের লেখাগুলো। একই সঙ্গে দু রকম লিখছ তোমরা। এই সব সময়েই , আমাদের অন্যান্য যাঁরা
অভিভাবক, অন্য কবিরা, তাঁরাও ত আমাদের ক্রমাগত বলছেন, নিজেকে শুধু পোস্ট মডার্ন ছাপ্পা দিয়ে ছেপে ফেলবে না,
যশোধরা। নিজেকে কোন খোপে আটকে দিও না। এতে ক্ষতি। হয়ত শুনছি সেইসব কথা। হয়ত নিজের নিয়মেই বেরিয়ে যাচ্ছি
সেইসব ডেসক্রিপশন, প্রেসক্রিপশন থেকেই। তবে এটা ঠিকই যে নব্বই দশকের লেখা যে ভাষা ভাঙ্গচুরের লেখালেখি,এই
বিশ্বাস থেকে আমরা এক গোছা ছেলেমেয়ে লিখেছি, আর প্রভাতদার প্রচুর ইন্ধন ছিল এতে। আমার এও মনে পড়ে
সিনেমাহলের নাম ব্যবহার করে যে সিরিজ তা কবিতা পাক্ষিকেই প্রথম বের হয়, এসব নিয়ে, উত্তরা পূরবী উজ্জ্বলা বা
মিনার বিজলি ছবিঘর এক একটা কবিতার শীর্ষ, এইটার ভেতরে যে পোস্ট মডার্ন প্রবণতা আছে তা নিয়ে প্রভাতদা
আলোচনা করছেন সর্বসমক্ষে... এই প্রশ্রয়..এই স্বীকৃতি কত অনায়াসে পেয়েছিলাম তখন। কানাইলাল জানার আলিপুর
জেলের ভেতরের কোয়ার্টারের ছাতে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সঙ্গে আলাপ, পড়তে এলেন মল্লিকা সেনগুপ্ত... এইসব
অনুষ্ঠানে নতুন কবি হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছি, প্রশ্ন করছি, আলোচনা করছি, অনেকটা খুলে দেওয়া। বহরমপুরে কবিতা

পাক্ষিকের উৎসব হয়েছিল, সেখানেও মঞ্চে ডেকে নিচ্ছেন প্রভাতদা, ঘোষণা করতে বলছেন। হয়ত "পাড়ার মেয়ে" বলেই
এতটা আপন করে নিতে পেরেছিলেন, কোথাও ছিল ওই ছোটদের কাছে টানার অমোঘ উৎসাহ, গর্ব। নব্বইয়ের অসংখ্য
নতুন কবির সঙ্গে আমার আলাপ প্রভাতদার সূত্রেই। রিমি দে, জপমালা ঘোষরায় এদের সঙ্গেও এই নব্বই দশকেই আমার
আলাপ হয়েছিল। ইন্দ্রাণী দত্ত পান্নার নাম মনে পড়ছে। সে কোথায় জানা নেই এখন।

সাম্যব্রত, জয়ন্ত ভৌমিক, প্রসূন ভৌমিক, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, পিনাকী ঠাকুর, মৌলি মিশ্র,
রোশনারা মিশ্র, সুদীপ্ত মাজি, তাপস কুমার লায়েক, এদের সঙ্গে এই ১৯৯৫-৯৬-৯৭ -৯৮ জুড়ে জুড়েই দেখা-লেখা-ঘোরাঘুরি।
এই জমজমাট সময়টা প্রভাত চৌধুরী ও তাঁর কবিতা পাক্ষিকের স্মৃতির সঙ্গেই ওতোপ্রোত।

সাংঘাতিক বড় সংগঠক ছিলেন এই মানুষটি। আজ দেখছি, নব্বইয়ের বহু কবির জীবনে প্রথমবারের জন্য কবিতাজগতের
উদ্ভাস, কবিতার সঙ্গে আজীবন লগ্ন হবার সূচনাবিন্দুতে ছিলেন প্রভাত চৌধুরী।


এখনো অব্দি সব স্মৃতিই সম্পাদক-আহবায়ক-সংগঠক প্রভাত চৌধুরীর কথা।
তবে কি কবি, গদ্যকার প্রভাত চৌধুরীর কথা বলব না আমরা? হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বইগুলি নিয়ে ফিরে পড়ব
আমরা। একেবারে প্রথম জীবনে প্রভাতদা লিখতেন না পোস্ট মডার্ন। তখনকার পর্বটি তাঁর সমসময়ের অন্যদের মতই
ছিল। পরে নিজেকেও আমূল পাল্টে নিলেন।
সম্বোধন
প্রভাত চৌধুরী
“Don’t call me poor, call me by the class-name, the working class” – Com. S. A. Dange
জন্মপত্রিকার কোনো ছত্রে, পংক্তিতে
কোথাও
দরিদ্র নামে চিহ্নিত হইনি।
শুধু আলোর দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে
দেখেছি –
আগুন, ঝলসে গ্যাছে শরীর।
চতুস্পদে হেঁটে
বৃষ্টিপাতে শরীর শীতল করতে গিয়ে
বুঝেছি –
‘এই শ্রাবণের বুকের ভিতর’
বিদ্যুৎ, ঝলসে গ্যাছে হৃদয়।

নিদারুণ অন্ধতার শ্রমে ঘামে
আর মাত্র কিছুক্ষণ বাঁচতে চেয়ে
জেনেছি –
নাম, আমার শ্রেণীর নাম
যে নাম আমার জন্মপত্রিকায় লেখা আছে।
এইটি ১৯৭২ এ লেখা প্রভাতদার। কিন্তু এই ধরণ সচেতনে ছেড়ে দেন তিনি এর পর।

৯০ দশক পরবর্তী কবিতার নমুনা রইল কয়েকটি। তাঁর লেখা নিয়ে ঘনিষ্ঠ আলোচনা এবার শুরু হোক। এতদিন ঔৎসুক্য সহ
খানিকটা কৌতূহল ছাড়া আর কীই বা জুটেছে তাঁর? এবার পাঠক তাঁকে ব্যক্তির আবরণ সরিয়ে পড়ুক।

তোমাকে আমি যে লেখা বলি, তা তুমি
এখানে কম্পোজ করো, না? যেগুলো না বলি,
সেগুলিকে কীভাবে কম্পোজ করবে?
কম্পোজ করার কথা কম্পোজিটরের। একজন কবি
যখন কম্পোজ করেন, তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে
শীতের রোদ্দুর এবং কমলালেবুর গন্ধ
যারা হাতে দস্তানা পরেন
তাঁদের জানা হয় না কমলালেবুর খোসার সঙ্গে
শীতের রোদ্দুরের গভীর বন্ধুতার কথা

আমি শীতকালের জন্য অপেক্ষা করি
শীতের রোদ্দুরের জন্য অপেক্ষা করি
কমলালেবুর গন্ধের জন্য অপেক্ষা করি

আমাকে অপেক্ষা করতেই হয়

আমি কখনই ঈশ্বরের জন্য অপেক্ষা করিনি
আমি কোনোদিন কোনো বাজিকরের জন্য অপেক্ষা করিনি
আমি অপেক্ষা করেছি শীতকালের জন্য।

শীতকালকে আমি বইকাল নামে ডাকি (শীতকাল=ব‌ইকাল – প্রভাত চৌধুরী)

( ১)

কদিন আগে যে আগরতলার মাটিতে, হাঁটাহাঁটি করেছি
আজ সকালের দিকে আগরতলার মানচিত্রে হাঁটতে গিয়ে দেখি
কোথায় গেল সেই জলাশয়, সেই ফিঙেটি
জলাশয় এবং ফিঙে না থাকলেও দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি
একটা এয়ারোড্রাম, তার ডানায় কিছু একটা লেখা আছে
আরো দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা রবার বাগান
কিন্তু আদতে মানচিত্রে তো এতসব দ্যাখা যায়না
যাঁদের চোখের ভেতরে আরো একটা চোখ থাকে, তাঁরাই
দেখতে পান
আমার ডানচোখের রেটিনায় ছিদ্র আছে, যার ডাকনাম ফুটো, আমি
বাঁচোখ দিয়েই সব দেখি
বাঁদিকের রাস্তা, ডানদিকের জলাশয়, ঊর্দ্ধ-আকাশের ফিঙে
আর রাস্তার উপর পড়ে থাকা কোনো একটা ছিপি
সবই দেখি বাঁচোখ দিয়ে
আমার বাঁচোখের ভিতরে আর কতগুলো চোখ আছে কখনও গুনে দেখিনি

(২)

অনুপম বলেছিল – আপনি তো ফেসবুকে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন
কথাটা শুনতে যতটা মধুময়
কিন্তু বাস্তবে ততটাই লৌহবৎ
কেননা ফেসবুকে হাঁটার জন্য যে কোয়ালিটির পা প্রয়োজন
আমার পা সেরকম নয়
শৈশব থেকেই আমার পা বাটা-র জন্য উৎসর্গীকৃত
বাটা থেকে চেষ্টা করে টাটা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব
কিন্তু ফেসবুক
তাছাড়া ফেসবুকের জন্য যে ফেসলুক প্রয়োজন
সেই দেখাও আমার নেই
তাহলে, দেখাব কী
(অনুপমকে যা বললাম – প্রভাত চৌধুরী)

প্রভাতহীন~দেবযানী বসু

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  দেবযানী বসু

কবি প্রভাত চৌধুরীর মূল্যায়ন ও...

স্মৃতিচারণ --১

কবি প্রভাত চৌধুরীর মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ অনেকেই করছেন করেছেন করবেন। এই প্রবহমানতা সহজে ও তাড়াতাড়ি থেমে যাবে না। আমিও সামান্য স্মৃতিচারণ করব। কারণ ওনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও একসঙ্গে কবিতার পথ চলা আমার জীবনের সামান্য শেষ অধ্যায় জুড়ে বিদ্যমান।
উনি একজন যাদুকর ছিলেন আমার কাছে। কৃত্তিবাস থেকে প্রকাশিত 'দেবযানীর স্বীকারোক্তি ' বইটি ওনাকে দেবার পর (নতুন কবি, নতুন আবেগ) উনি পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে মুচকি হেসে রেখে দিলেন। বুঝলাম ওনার কাছে সেরকম পদের হয় নি। এর আগেকার কথা হল ২০০৬ সাল নাগাদ বইমেলায় কবিতা পাক্ষিকের স্টলে ঢুকে পড়েছিলাম আচানক, হঠাৎ। কেউ চেনে না জানে না আমাকে আমিও কাউকে চিনি না। যূথিকা বৌদির সঙ্গে সামান্য পরিচয় হল। পরে যা কবিতা লিখে পাঠাই তা আর ছাপা হয় না। অতএব হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি গেলে খাতায় কলমে ওনার আদর্শ মতো কবিতা লিখতে শিখিয়ে দিলেন। বইপত্র দিলেন। আস্তে আস্তে কবিতা পাক্ষিক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ল। নাসের দার কবিতার ভক্ত ছিলাম আমি।
প্রভাত দার আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতন গেলাম সঙ্গে পাপড়ি ভট্টাচার্য ছিলেন। রঞ্জন মৈত্রকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমি আমার ধারাবাহিক কবিতাই পাঠ করেছিলাম। এখন ভাবি সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলার অসম্ভব এক শক্তি ছিল ওনার যেটাকে সাংগঠনিক শক্তিও বলা যায়। ওখানে অলোক বিশ্বাস এর সঙ্গে পরিচয় হল। এভাবে আমার বন্ধু পরিধি বেড়ে চলছিল। কবিতা পাক্ষিকে আমার সিঁড়িভাঙা কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে এর চাইতে আনন্দ আর কিছুই ছিল না।
গোপাল মল্লিক লেনে একটা ছোট্ট ঘর ছিল কবিতা পাক্ষিকের অফিস। ওখানে কবিতা নিয়ে আলোচনা কবিতা পাঠ ইত্যাদি হত। ইন্দ্রানী দত্ত পান্নাকে ওখানেই প্রথম দেখি।  মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক হতে কবিতায় মেসেজ থাকবে কি থাকবে না নিয়ে। উনি মেসেজ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। ওখানেই সোমক দাসের সঙ্গে পরিচয় হল। একান্তর পত্রিকার অরূপ। এখনকার বাংলা দৈনিক ই-পত্রিকার সৌমিত্র রায়। অথবা রাজদীপ পুরী। সভা শেষে মেট্রো করে আমি ও প্রভাত দা গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরতাম।
প্রভাত চৌধুরীর কবিতায় পেয়েছি সীমাহীন আকাশ। কল্পনার দৌড়। শিশুর কৌতুক ও কৌতূহল। প্রতিবাদী চরিত্র। ওপেন এন্ডিংয়ের যাদু। আর রাইজোমেটিক বিস্তার।  'পোস্টমডার্ন মানচিত্র' বইটি আমার মতো নতুন লিখতে আসা এক পথিকের কাছে কম্পাসের কাজ করেছিল।
শান্তিনিকেতনে কয়েকদিন থাকার সময়ে জনক ঝংকার নার্জারির সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটল আমাদের। প্রভাতদার কবিতা কবিতা খেলাটা ছিল মজার। মানে একটা লাইন উনি বলবেন তার খেই ধরে পর পর আমরা এক এক লাইন বলে কবিতাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। চমৎকার সন্ধ্যা ছিল সেটা। ছিল ঠাকুরদাস চট্টোপাধ্যায়। সবার সঙ্গে মজাদার কথাবার্তা বলে ট্রেনে মজলিসে ঘরে জমিয়ে রাখতেন।
বারবার বলতেন কবিতায় লেখায় টেকনিকটাই আসল। এটা বিজ্ঞানের যুগ। আমাদের জীবনযাত্রা যেমন পাল্টাচ্ছে কবিতা লেখার রীতিও তেমনি পাল্টাবে। ওনার কবিতায় পেয়েছি আনন্দময় এক কবিতা পুরুষকে। কবিতা পাক্ষিক থেকে অনেক বই কিনতাম। এভাবে যশোধরা রায়চৌধুরীর পিশাচিনী কাব্যটা সংগ্ৰহ করেছিলাম। যেহেতু আমি যাত্রীদলের পিছে থাকা এক পথিক আমার কাছে প্রভাত চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসা এক বিরাট ব্যাপার। পথ চলতে গিয়ে  তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন এমন অনেকের সাক্ষাৎ পেয়েছি। তবু আমার মনে হয়েছে উনি আমার চন্ডাল গুরু।
পটলডাঙার বাড়িতে মাঝে মাঝেই গেছি। ওনার জন্মদিনে ভোজনের আয়োজনে অংশ নিয়েছি স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যূথিকাবৌদি, মুরারীদার স্ত্রী, রীতা মিত্র সবাই কেমন আপন করে নিতেন।  অমিত কাশ্যপ রুদ্রর কিংশুক ছিলেন পরিচিত মুখ। পরবর্তী কালে সভাঘরে আয়োজিত জন্মদিনের উৎসবে গিয়েছিলাম। পটলডাঙার বাড়িতে কবিতাপাঠ গান বৌদির হাতের রান্না সবকিছুর ভাগ পেয়েছি । সঙ্গে শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্র  কণ্ঠে রবীন্দ্র  কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত।।। যেটা লক্ষ্যনীয় ছিল তা তাঁর  প্রাণময়তা ও ডিক্টেটরশিপ। মানে প্রভাতদার কথাই শেষ কথা। মানে নিজেকে সবসময় আপডেট করে রাখা। কবিতাকেও আপডেট করে রাখা। ওনার আমন্ত্রণে প্রথম জীবনানন্দ সভাঘরে কবিতাপাঠ করা। পটলডাঙার বাড়িতে গৃহপ্রবেশ উৎসব হয়েছিল তাতে উপস্থিত ছিলাম। আজ সে সব দিনগুলো বড় মনে পড়ছে।
আমার রক্তে বোকামি থাকার দরুন অত সমালোচনার দৃষ্টিতে ওনাকে দেখি নি, চালাক মানুষদের প্রতি স্বতন্ত্র মুগ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। একটা মানুষ তাঁর মধ্য বয়স থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন আর শত শত শিষ্য তৈরি করলেন এর চাইতে আশ্চর্যজনক আর কি। শূন্যদশক প্রথমদশকের কবিরা পর্যন্ত তাঁর  সাহচর্য লাভ করেছে। তাদের মনেও রয়ে গেল মুগ্ধতা। কতোটুকুই বা জেনেছি ওনাকে। মাত্র কয়েকটা বছর জীবনের। কবিতার জগতে যেখানে আমি হিমেল কুয়াশায় ঢাকা একটা ক্ষীণ দিগন্তরেখা। শুনেছি সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে ওনার হাওয়া ৪৯ এর সঙ্গে ওনার সখ্যকথা। দেখেছি তরুণতম প্রজন্মের সঙ্গে মত কষাকষিতে জড়িয়ে পড়া, মন নয় কিন্তু। এত দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্য্য ধরে পত্রিকা সম্পাদনা আর কবিতার নতুন রীতিতে তাদের দীক্ষিত করে তোলা এ সবই কবিতাকে নিখাদ ভালোবাসার দৃষ্টান্ত। যূথিকা বৌদির মতো কর্ম সঙ্গিনীর সাহচর্যে জীবন কোথাও স্থির সরলরেখায় দাঁড়িয়ে ছিল না হলে এ কর্ম যজ্ঞ চলতে পারত না।
পরাবাস্তবের কবি জীবনানন্দ দাশকে কবি প্রভাত চৌধুরী এলিয়টপন্থী বিষণ্ণতার কবি বলেই নামাঙ্কিত করেছেন। প্রভাত চৌধুরীর কবিতায় অন্যায়ের প্রতিবাদ আছে কিন্তু কোথাও সেই মিনমিনে অন্তর্লীন বিষণ্ণতা নেই। জীবনের অস্ত্যর্থক দিকটি সদহাস্যময় চৈতন্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।
স্মৃতি প্রচুর বিশ্বাসঘাতকতা করছে আমার সঙ্গে, আজ না বেশ কিছু বছর ধরে স্মৃতিহীনতায় ভুগছি , বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। ফেসবুকে আলগা ঝুলে আছি। তাই ধান ভাঙতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ নিজের কথাই বলে যাচ্ছি।
কবি প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে কবিতা পাক্ষিকের দল সহ বর্ধমানে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম কারা আয়োজন করেছিল আজ আর মনে নেই। গৌরাঙ্গ মিত্র নাসেরদা মুরারীদা ও আরো অনেকে ছিলেন। সারাদিন কবিতাপাঠ চলেছিল। আমার বড় মেয়ে আমার সঙ্গে গিয়েছিল। অবশ্যই আমার জীবনে আনন্দের দিন ছিল সেদিন।
এরপর ১৯১১ তে আমার পঁচিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকী উৎসব হয়েছিল। গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় , গল্প কলকাতার পাপড়ি ভট্টাচার্য, শান্তিময় মুখোপাধ্যায় অলোক বিশ্বাস  সুইন হো স্ট্রিটের কবি তাপস রায় গ্ৰাফিত্তির  শুভঙ্কর দাশ সহ আরো অনেকে নিমন্ত্রিত ছিলেন। প্রভাত চৌধুরী ও যূথিকা বৌদিও এসেছিলেন। সেই উৎসবের ছবি কবিসমূহ ফেসবুকে বহুদিন বিশেষ ভাবে প্রদর্শিত ছিল।
পোস্টমডার্ন তত্ত্বের কচকচির ভিতর ঢোকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে প্রভাত দার মুক্তমনা আকাশ টপকানো একটা চেতনা কবিতা লেখার সময়ে মাথায় কাজ করত। তাতেই বাংলা কবিতায় ব্যতিক্রমী কবিদের সংসর্গে এসে পড়ি।
সবাই বলে লেখা থেকে যাবে, আমরা থাকব না। আমরা বাংলা কবিতায় টীকা টিপ্পনী রূপে  থেকে যাই আর না যাই , এই যে লিখলাম জানলাম অক্সিজেন নিলাম এর দাম চাই না। এ অমূল্য।

স্মৃতিচারণ -২

একবার স্থির হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দর্শন করতে যাব। সবাই দল বেঁধে  জোড়াসাঁকো গেলাম। কবিতা পাক্ষিক পত্রিকার পঞ্চশততম সংখ্যার প্রকাশ উপলক্ষে। এই সংকলন দু খন্ডের ছিল। আমি সোৎসাহে এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলাম নিজেকে।  প্রভাত দা ও যূথিকা বৌদি সুন্দর ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি পৌঁছলেন। ওখানে একটা ক্লাবঘরে কবিতাপাঠের আয়োজন হয়েছিল। সোনালী বেগম , রোশনী ইসলাম এর সঙ্গে পরিচয় হল মুখোমুখি। প্রভাত দার কবিতা পাক্ষিক গোষ্ঠীর আলোয় নিখিল সরকার, নীলিমা সাহা , জ্যোতির্ময় মুখার্জি, সৌমিত্র রায়, ক্ষেপচুরিয়াস পত্রিকার জুবিন ঘোষ এদের মতো বন্ধুলাভ হয়েছে।
ইতিমধ্যে আমি বারীন ঘোষাল নতুন কবিতা অপর কবিতা ইত্যাদি নানারকম টার্মস ও জগতের সঙ্গে পরিচয় করতে শুরু করেছিলাম। দুই দিকের দুই দিকবারণের অভিঘাতে তৈরি হয়েছিল আইভরি খাতা। অভিঘাত সহ্য করার শক্তি জন্মাল। আইভরি খাতা পেয়ে বারীন দা খুশি হয়েছিলেন। প্রভাত চৌধুরী অলোক বিশ্বাস ধীমান চক্রবর্তী বারীন ঘোষাল এই চারজনের নাম উৎসর্গ পত্রে ছিল। প্রভাত দা তাতে খুশি হন নি। কি যে বলেছিলেন মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল আর এখন তা মনেও নেই। এখন শুধু ঢেউরেখা রয়ে গেছে,  আমি কোনো সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে চলে যাচ্ছিলাম সে সময়ে। ঐভাবে শব্দ ভাঙাভাঙির শব্দ গড়াগড়ির ব্যাপারটা যাস্ট ওনার ভালো লাগে নি। যাই করোনাবিচ্ছিন্নকালে সবাই যে যার মতো দূরে সরে গেছি। উনি বাংলাদেশ গেলেন। পুরস্কার পেলেন। সে সব দূরে থেকেই জেনেছি। শারীরিক ও মানসিক নানা কারণে আমি আপাতত অকর্মণ্য।
করোনার আগে পর্যন্ত পটলডাঙার বাড়িতে মাঝে মাঝে গেছি। প্রায়ই বলতেন যূথিকা বৌদির খুব ইচ্ছে করছে আমাকে দেখার। যূথিকা বৌদি চিন্তা করেন। ইত্যাদি। আমার কবিতা সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। বলতেন দেবযানী কবিতা নিয়ে গভীর চিন্তা করে।(খুব লজ্জা পেতাম) কবিতা ওর হাতে খুলবে। তবে সামান্য হলেও অভিযোগ ছিল যে আমি কবিতা ক্যাম্পাসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় কবিতা পাক্ষিকের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ইত্যাদি। যখনই গেছি আনন্দে ঝলমল করে উঠে বলেছেন এই যে বিদেশিনী এসেছ! এই বিদেশিনী সম্বোধনটা আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। বইমেলায় গেলে কবিতা পাক্ষিকের স্টলে একবার ঢুঁ মারবই।
এ ছাড়াও আমরা যে কোনো পত্রিকার বাণিজ্যিক সাফল্যের আশা করি। সে দিক দিয়ে প্রভাতদার পত্রিকা পরিচালনা সম্পাদনা  বিক্রিবাটা ইত্যাদি সম্পর্কে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল আশ্চর্যজনকভাবে প্রশংসনীয়। ব্যাপক মনোযোগ লাগে , ধৈর্য্য লাগে, টিম পরিচালনার ক্ষমতা এগুলো মাত্রাতিরিক্ত ভাবে প্রভাত চৌধুরীর মধ্যে ছিল।  কাগজ প্রিন্টিং দাম নকশা ইত্যাদি সম্পর্কে খুব জ্ঞান ছিল ও যত্ন নিতেন। এ সম্পর্কে কোনো এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন।
প্রভাত দাকে নিয়ে বিশেষ তাঁর  কবিতা লেখার রীতি নিয়ে আমার এক অনুজ কবি( বয়সে অনুজ কিন্তু কবি হিসেবে অগ্ৰজ) অতনু গাঙ্গুলি খুব সুন্দর করে লিখেছেন সেটুকু উদ্ধৃতি দিতে লোভ হল : --
সবার কবিতাই কমবেশি পড়ে বড় হয়েছি কিন্তু প্রযুক্তি উতকর্ষের সাথে, পুঁজির মুক্ত গতির সাথে শব্দবিন্যাসের যোগ আছে। কবিতাও পালটে যায়। শব্দকে তুরীয় আনন্দে ছুঁড়ে দিতে পারলে সে ফালাফালা হয়ে দিকবিদিকে ছোটে - তার প্রমাণ সমীর রায় চৌধুরী ও তার সঙ্গী প্রভাত চৌধুরী। বাকি কবিতার বচন যেমন কবিতা হবে এলোমেলো, ছেঁড়া-খোঁড়া শব্দের সমাহার। সেগুলি এই পথের ডেরিভেটিভ।প্রভাতদার নোটবই বইটি পড়লেই মালুম হবে যে সব বিষয়ের উপরই কবিতা লেখা যায় অথচ তা একরৈখিক নয়।  সরল কিন্তু মালটি-লেয়ারড। প্রিজমাটিক।অথচ শব্দের কোহিশন আর এডিহিশনের মধ্যে ফাঁক আছে। প্রভাতদা একটা কথা প্রায়ই বলতেন - আগে মানুষ যাত্রাপালার এক গল্প সারারাত ধরে দেখতেন আর এখন মানুষ আঙ্গুলের চাপে খেলা থেকে সংবাদ থেকে সিনেমা অবাধ যাতায়াত করে। কবিতা পাল্টাবে না কেন? তাই নোটবইয়ের শেষে দেখিয়েছেন একটি শব্দের কত সমাহার এবং তার মধ্যে জোড়ের ফাঁক কিভাবে থাকে। তার কবিতার একটা লক্ষ্যণীয় যে - একটি লাইনের কেন্দ্রীভূত শব্দ পরের লাইনে অপসারী দৌড়ে কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে আবার এইভাবে শব্দের খেলা গোটা কবিতা জুড়ে মেলে দ্যায়। প্রভাতদার নোটবই একটি বাংলা কবিতাকালের দিশারী।বাংলা কবিতায় এত দীর্ঘদিন ধরে একটা সমান্তরাল আলোকদীপ্ত কবিতা পত্রিকা বহন করে চলেছেন কবি প্রভাত চৌধুরী যে এর সারবত্তাকে অস্বীকার করা যায় না।

ই পত্রিকা সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোলের অভিজিৎ এর অনুরোধে একটি সাক্ষাৎকার পর্ব আমার প্রকাশিত হয়েছিল। প্রভাত দা সেই কাজটির প্রশংসা করেছিলেন।  ওনার প্রশ্রয়ে ওনার ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছি এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বারীন দা খুব কৌতুক করতেন অবাক বোধ করতেন প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তারপর প্রভাত চৌধুরী তারপর বারীন ঘোষাল তথা কবিতা ক্যাম্পাস নতুন কবিতার সঙ্গে পথ চলা, শেষে সমীর রায়চৌধুরী মলয় রায়চৌধুরীর সংস্পর্শে আসা এতগুলো কোণ ছুঁয়ে রইলাম আমি কি করে!!
কবিতা সফর আমার স্বল্পদিনের খদ্যোতসম জীবন বিস্তার , সব কবিদের যাত্রাপথের শেষেই আছি, থাকতে চাই। প্রভাত দার জ্বালানো দীপালিকাটি বহন করে চলেছি এটাই শেষ কথা। এটাই শেষ কথা যে পোস্টমডার্ন মানচিত্রের ক্যাপ্টেন হুররার একার হাতে তার আইডিয়ালিজমটা আর নেই। ছাত্রছাত্রী ও অনুগামীদের হাত থেকে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে।