Thursday, August 20, 2020

| বাংলাদেশ সংখ্যা | অলোক বিশ্বাসের আলোচনা |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||












অলোক বিশ্বাসের আলোচনা
সমর চক্রবর্তীর কবিতা যাপন 


বাংলাদেশের নয়ের দশকের অতি পরিচিত কবি সমর চক্রবর্তীর যাপন ও কবিতা আমাকে আকৃষ্ট করেছে অন্তরঙ্গভাবে। কোনো একজন কবিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কী কী ভালোবাসেন, কেউ হয়তো বলবেন, মানুষ ও প্রকৃতি। কেউ বলবেন, ছন্দের ব্যবহার। কেউ বলবেন, কবিতায় মিথ ও পুরাণের প্রয়োগ। সমর চক্রবর্তী বলবেন, জীবনের এপারে ওপারে যাকিছু আছে, ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের যাকিছু সম্পর্ক, তার সবকিছুই তিনি ভালোবাসেন। সমর চক্রবর্তী বলবেন, তিনি টোটাল কবিতায় বিশ্বাসী। অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের সমস্ত বস্তু ও প্রাণী জগতের আচরণ তিনি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতায় প্রয়োগ করতে চান, তিনি খণ্ডচেতনায় বিশ্বাসী নন। অখণ্ড নিরবতায় দিগন্তের স্বপ্নারোহী হতে চান তিনি। তাঁর 'দিগন্তের স্বপ্নারোহী' কবিতা বইয়ের প্রথম কবিতায় লিখছেন তাঁর কবিতা পথের গন্তব্য। কবিতাটির নাম 'আমার গন্তব্য'--- 'প্রাচীন একটি পথরেখা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাচ্ছি আমি অসংখ্য ডিজিটাল সড়ক রেখায়। ভেবেছিলাম, ভাষা-বিন্যাসের পাখি উড়ে যাবার পর শূন্যে যে গতিপথ এঁকে যায়, হয়তো তার কাছ থেকে পেয়ে যাব কিছু পথনির্দেশ। সহসাই বোধ হয় অনির্দেশিত ভ্রমণের কোনো গন্তব্য থাকতে নেই। আমার ভ্রামণিক পা হাঁটতে হাঁটতে তৈরি করছে অসংখ্য নতুন সড়ক। এখন পা দুটোকেই আমার ভ্রমণের গন্তব্য ভাবছি।' কবিতার শেষে যতিচিহ্ন নেই। আমি দিলাম। জিজ্ঞাসা চিহ্ন আর প্রশ্নবাচক চিহ্ন ব্যতীত কোনো কবিতায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি, একমাত্র টানাগদ্যে লেখা কবিতাগুলোর ভেতরে যতি চিহ্নের ব্যবহার ছাড়া।


কবি সমর চক্রবর্তী ফরিদপুরের বাসিন্দা। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। পেশা সাংবাদিকতা। তাঁর অজস্র কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকেই তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশ সাংবাদিকতার মাধ্যম অবলম্বনে। বারবার তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন সাংবাদিকতার পেশা সত্বেও। কবিতা ছাড়াও লেখেন ছোটোগল্প।   প্রকাশ করেছেন গল্পের বই 'রঙিন স্বপ্নের বাসিন্দারা'। দীর্ঘদিন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে থেকে প্রকাশ করেছেন 'সৈকত', 'উচ্চারণ', 'অনিকেত' এবং 'কথাশিল্প' নামে বিভিন্ন পত্রিকা। এই কবির জন্ম ১৫ ই মার্চ ১৯৭৩। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নয়টি কবিতার বই--- যে যার গন্তব্যে একা। দিগন্তের স্বপ্নারোহী। নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়। কঙ্কালে কুরচিফুল। নিসর্গ অনূদিত কণ্ঠ। অন্ধকার ডানার মানুষ। রৌদ্র ক্ষয়ে যায় তুষারে। আদিম অশ্বের পিঠে।


গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা কবি নগর জীবনে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু গ্রামজীবন রয়ে গেছে তাঁর অস্তিত্বে প্রবলভাবে। নগর জীবন তাঁকে অর্জন করতে বাধ্য করেছে নাগরিক জীবনের ভাষা। তাঁর সত্তা নগরে মিশে গেলেও তিনি নগরের চলমান জীবনে বাউল বাতাসের গন্ধরহিত নন। তাঁর কবিতা 'তোকে লিখতে গেলেই' যেন কবিতাকেই সম্বোধন করে লেখা, কিছুটা উদ্ধৃত করি--- 'বাতাসে সবুজপাতাগুলো কেঁপে ওঠে/আলিঙ্গনের উষ্ণবৃত্ত পার করে আমি নগরের বাউল বাতাসে উড়ি/তৈরি করি হৃদয়ে সহস্র অলৌকিক সেতু/তারপর কি-প্যাডে হাত রেখে/তোকে জানাই মনের সকল আকুলি- বিকুলি/#কখনো রোদের আনন্দে হারাই, অন্ধকারে হাঁটি একা/বিনীতভাবে চেনাদৃশ্য থেকে সরে থাকি দূরে/#তোকে লিখতে গেলেই ভাষাগুলো প্রেমিক হয়ে যায়'।


স্বপ্নভরা মনের কবি সমর চক্রবর্তী। স্বপ্নকে কোনো বাঁধা পথে বেঁধে রাখেননি। স্বপ্ন হোক এলোমেলো। এলোমেলো স্বপ্ন নিয়ে তাঁর ভাষাগুলো উড়ে বেড়ায় ভিড়ের মধ্যে। তিনি চলমান বাসের লুকিং মিররে চুলের ভেতর আঙুল দিয়ে নিজেকে আদর করতে করতে স্টপেজ ছাড়াই আচমকা নেমে পড়েন। তাঁর বহু কবিতায় স্বপ্নের প্রত্যক্ষণ হয়েছে আনন্দে বিষাদে উল্লাসে যন্ত্রণায়। ১.স্বপ্নহীন ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ওরা কারা হাতছানি দেয় ?(নগর নাগরী)। ২.শরীর ক্যাম্পাসে জীবন আর স্বপ্ন দাপাদাপি করে/স্বপ্নপোকাগুলো রাত জেগে লেগে থাকে চোখে(সড়ক সভ্যতা)। ৩. মধ্যবিত্ত স্বপ্নগুলো প্রাপ্তির ভঙ্গিতে অর্ধেক উলঙ্গ অর্ধেক উন্মাদ(শ্রেষ্ঠ আশ্রয়)। ৪. কেন এতো স্বপ্নব্যঞ্জনা রাতের প্লেব্যাক ?(অদৃশ্য ভ্রমণ)। ৫. বাবা স্বপ্ন দেখেন, লাল স্বপ্ন, সবুজ স্বপ্ন, হরিৎ-ঐশ্বর্য বিমূর্ত স্বপ্ন/স্বপ্নগুলো বাঘের অরণ্যে হরিণীর মতো ছুটে যায় আলেয়ার প্রান্তরে/বাবা তবু স্বপ্ন দেখেন/ফুলের বাগান থেকে দুঃস্বপ্নের সাপ তাড়াতে তাড়াতে স্বপ্ন দেখেন(বাবার স্বপ্ন)। ৬. স্বপ্ন নেই, জীবন নেই ব্যাধিখেকো সংসারে...যাদের স্বপ্ন আছে সংগ্রাম আছে--- জীবন তাদেরই আছে(স্বপ্ন নেই, জীবন নেই)। ৭. আমাদের রমণীরা খোলা বুকে তবু স্বপ্নের তাঁত বোনে (নামতা শিখি প্রতিদিন)। ৮.স্বপ্নভর্তি ঘুমের গাড়ি এক দাঁড়িয়েছে শিয়রে এসে/অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে আসছে বোকা অন্ধকারে সশস্ত্র আন্ধার (স্বপ্নভর্তি ঘুমের গাড়ি)।


কবি সমর চক্রবর্তীর কবিতায় আমরা বারবার পেয়ে যাই হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। একটা নেশায় পরিণত হয়েছে কবির হেঁটে যাওয়া। শুধু তিনি নন, তাঁর কথাও হাঁটতে থাকে। ১. হেঁটে যাই আমি সেই তেপান্তরে/সম্মোহনের সুতোয় যেন কে আমাকে টানে(সীমান্তে তোমার)। ২. আমি যতই হাঁটি বেড়ে যায় পথ(দুরতিক্রম)। ৩. কথাগুলো হাঁটতে হাঁটতে/একটি সড়কের পাশে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়(আমাদের কথাগুলো)। ৪. কত বর্ষীয়ান সড়ক হেঁটেছে সেই যুবক প্রেমিক(ঈর্ষা)। আশ্চর্য রকমভাবে ছায়ার ব্যবহার হয়ে উঠেছে মিথের মতো সমর চক্রবর্তীর কবিতায় একাধিক গ্রন্থে--- ১. আমি আমার পাশে ছায়াহীন দাঁড়িয়ে আছি/মেলে আছি সৌন্দর্য
ঐশ্বর্যডানা(ঈর্ষা)। ২. নিদ্রিত বৃক্ষের দীর্ঘ ছায়ারা নৈঃশব্দ ভেঙে/গেয়ে ওঠে উদ্বাস্তু প্রণয়ের গান(নিদ্রিত বৃক্ষের মতো)। ৩.আমি আমার ছায়ায় অসংখ্য বিপ্লব দেখতে পাচ্ছি(উঠোনে দ্বাবিংশ শতাব্দীর আয়না)। ৪. অন্ধকারে তাই পালিয়ে যায় আপন ছায়াও আলোর সাথে (টেবিলের ছাইদানি হতে ইচ্ছা করে)। এভাবেই শূন্য, মহাশূন্য, আদর, স্মৃতি, স্বপ্ন,  সংগ্রাম, পাথর, কুয়াশা, দীর্ঘশ্বাস, দুঃখ, বেদনা, বিষাদ, দারিদ্র্য, মহাকাল, যুদ্ধ, বিপ্লব, আত্মীয় অনাত্মীয়, সীমানা, নদী, পাখি, বর্ণ ইত্যাদি অসংখ্য উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে সমর চক্রবর্তীর কবিতায়।


কতো কাব্যযোগ্য নতুন শব্দ নির্মাণ করেছেন তিনি এবং সেই সব শব্দের প্রয়োগ কবিতায় কখনো আরোপিত মনে হয়নি। যেমন, শ্রমরোদ, আত্মৎসব, বহুবাহুস্বপ্ন, আলোকাত্মা, স্বপ্নব্যঞ্জনা, প্রেমবিদ, নগ্নস্বপ্ন, স্বপ্নসংগ্রাম, স্বপ্নপোকা, স্বপ্নছায়া, চিতাগ্নিফেরিওয়ালা, যন্ত্রণাবর্ণ, ব্রাত্যসারস, মৌনটিলা, চেতনাফুল, হৃদয়ান্ধ, স্বপ্নপোড়া, নৃ-নূপুর ইত্যাদি। সমর চক্রবর্তীর কবিতায় যেমন আছে চিত্রকল্পের বহুতর ব্যবহার, তেমনি আছে অজস্র মেটাফর, সিমিলি, উপমা। আছে দার্শনিকতার ভরা কবির প্রশ্ন আর মায়াময় পৃথিবীর কথা,শূন্য মহাশূন্যের কথা। তাঁর কবিতায় কখনো বেজে ওঠে রাবীন্দ্রিক গানের আবহ, বাউল দর্শনের সুর। তাঁর কবিতায় আমরা দেখছি যেমন আছে গদ্যময় পৃথিবীর ভাষারূপ, তেমনি আছে রোম্যান্সভরা গীতিধর্মিতা। তাঁর একটি অসাধারণ উদাস বাউলি পংক্তি কানে বাজে বারবার---'অমৃতের লোভে বিষ খাই, স্বপ্ন তবু থামে না, থামে না'। 'কবিতা' নামাঙ্কিত একটি দুই পংক্তির কবিতায় তিনি জানাচ্ছেন---'কবিতা এক রহস্যময় জানালা/উঁকি দিয়ে চেনা যায় অচেনা বন্দর'।

| বাংলাদেশ সংখ্যা | মাসুদার রহমান |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||












মাসুদার রহমান
হিন্দুগাছ 

এক একটি শ্বাসকষ্টের দিনে চা-এ তুলসিপাতা মিশিয়ে খাচ্ছি। আর ভাবছি, তুলসিগাছ হিন্দুবাড়ির গাছ
গাছের জগতে তাহলে তুলসিগাছ হিন্দু-ই!
এই কাঠুরে-মুলুকে সব আহম্মক কাঁ হে কাঁ! না হলে কে ভাবছে, তুলসির পুরুষাঙ্গ ছেঁটে তাকে মধ্যবর্তী বানাতে
           
জোনাকিবন
বাদাম ভাঙতে গিয়ে মনে হল, বিকেল ভেঙেছি। না হলে তো ঝুপ করে বনপথে সন্ধ্যে হতো না
পাখিরা ফিরছে ঘরে; আমিও ফিরতে চাই 
শক্ত খোসার মধ্যে বাদামের লাল লাল পাতলা বাকলগুলো বাতাসে যা উড়িয়েছি। এখন সেসব বাঁশবনে উড়ছে; হয়ে অজস্র জোনাকি
জোনাকির বনে একা বহুদূর হেঁটে যাই


| বাংলাদেশ সংখ্যা | শিহাব শাহরিয়ার |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||












শিহাব শাহরিয়ার 
যখন ভাঙে নক্ষত্র

আরও কয়েকটি ঢেউ গুনতে আমি আবারও সমুদ্রে কাছে এসেছি
ঝাউবনের আড়ালে সূর্যকে আড়াল করে বসে আছি 
হাত রেখেছি স্তব্ধ বালিদের কাঁধে

এই মুহূর্তে আমার কেন তাহলে মনে পড়ল
জন্মগ্রাম সারি সারি ছনঘরটিনঘরবৃক্ষের বিদীর্ণ চোখ
পয়ঃপ্রণালিটাউট গ্রাম্য শাসকের কর্কশ কণ্ঠস্বরকিশোরীর মলিন ফ্রক
নাপিতের ভাঙা আয়নাগাছের খোড়লে জমে থাকা বৃষ্টির টলটলে জল
উড়ন্ত ধুলার ঝাপসা রং আর আমার প্রথম চাঁদ ও জ্যোৎস্না দেখার অনুভূতি

কেন ঢেউ দেখার কালে আমার বার বার মনে পড়ছে
সর্ষের পাকা দানালাল সুরকির দীর্ঘছায়া পথনদীর ঘোমটা
রোদে দেওয়া প্রথম বাসরের প্রথম বালিশকলতলার ঘন কাদা
আর কারো কারোর অব্যক্ত বুকের হারানো চিঠির শব্দগুচ্ছপ্রেমগুচ্ছ

আমি কি আজীবন সাইকেল কাঁধে নিবো ব্রহ্মপুত্রের উচুঁ তীরে এসে

সকল বিধি-নিষেধ অমান্য করে
আমি আবারও সমুদ্রের ঢেউ গুনতে এসেছি

তাহলে কেন আমার মনে পড়ছে নক্ষত্রের নাভিকে

আমি তো কখনো আর্তনাদ’ বিষয়ে যৌথবৈঠক করিনি কারুর সাথে
কিম্বা করিনি দুঃখ’ বিষয়ক কোনো জরুরি সেমিনারসিম্পোজিয়াম

যে রেল-স্টেশন এখনও প্রেমিক-প্রেমিকার শেষ বিদায়ের স্মৃতিচিহ্ন
কথামালাকে গেথে রেখেছে প্ল্যাটফরমের প্লেটে
আমি তারও গল্প করিনি কারুর সাথে

এমন ঢেউযুক্ত পূর্ণিমার খামার থেকে
আমি কি ফিরে যেতে পারি

বলেছিÑএভিন্যুর নিয়ন আলো আমাকে দেখিও না
আমার নিমগ্ন চোখ নক্ষত্রের অন্ধকারে ডুবে আছে

আমি শেষবারের মতো সমুদ্র-ঢেউ গুনে গুনে ভ্রমণ করতে চাই
আমার স্বপ্নের ভগোল অথবা আমার বিনির্মিত পৃথিবী

গভীর সমুদ্র-জেলেদের শঙ্কাময় দুঃখ কেউ বুঝে না
স্বপ্ন কিভাবে বদল হয় কেউ কেউ তাও বুঝে না
কেউ কেউ বুঝে না ঢেউয়ের সাথে চারাবালির কি সম্পর্ক
আর তুমি জাননাতোমার সঙ্গে আমার কতটা দূরত্ব

তোমাকে তো আমি আমার জন্মগ্রাম দিতে চেয়েছিলাম
দিতে চেয়েছিলাম এই সমুদ্রের সবগুলো ঢেউ
তুমি বেছে নিয়েছিলে শনিবারের সন্ধ্যাকে
আমার আয়োজনে তুমি আসোনি
বলোনি ভালোবাসি

অথচ বুকের পাথর নামাতে গিয়ে
তুমি পড়েছো ঝড়ো-হাওয়া বজ্র-বৃষ্টির স্ফূলিঙ্গে 

কিসের ভয়ে সেদিন তোমার কথারা ঘন মেঘের রূপ নিয়েছি
বলেছিলামকাঞ্চনজঙ্ঘায় যেও নাপা ডুবাও জাফলঙের জলে
শোনোনি। অথচ শালিকের ডাকে তোমার কানকে করেছো সতেজ
আমার পছন্দ ছিল পাখার রঙ

আমি জানিএই শ্রাবণে বৃষ্টির ফোঁটা কুড়ানোর চেয়ে
তুমি স্মৃতিরদানাগুলো নেড়ে-চেড়ে দেখছো
তোমার তোনন্দিত নদী-গ্রাম নেই
বৃক্ষ চেনার চোখ নেই

মৌমাছির কামড়ে ব্যথাযুক্ত শরীরে তাদেরই মধু ঘষতে হয়
তুমি তাও জাননাজানবেই বা কি করে

আমি তোমাকে নিয়ে এই শহরকে জাগাতে চেয়েছিলাম
কারণ হায়েনারা শহরের শরীরকে বহুবার দাবানলে পুড়িয়েছে
তাদের চোখে লজ্জা থাকে না
চিলেকোঠার রোদের মর্ম তারা বোঝেনা

শহরে কতগুলো চিলেকোঠা আছে
তা কি তোমার পক্ষে জানা সম্ভব?
সম্ভব নয় বলে তুমি আমাকেও জানতে পারোনি

খননকৃত ওয়ারিবটেশ্বরের লাল মাটি স্পর্শ করে বলেছিলাম
বেদনার নয় আমি তোমার স্বপ্নের-সৌধ নির্মাণ করে দিবো

আমি আর পিছনে ফিরে তাকাবো না
দেখবো না এখন তোমার অশ্রুমাখা চিরুনি

এখন আমি চলে যাচ্ছি
আমার স্বপ্নগ্রামে জন্মগ্রামে নদীগ্রামে
একজন প্রিয় কবির ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম’ আমাকেও টানে

আমি আজ বিভোর বিপন্ন বিস্ময় এবং বেদনার্ত মনে এবং চোখে
সমুদ্রের ঢেউ গুনে গুনে আমার জন্মগ্রামের দিকে যাচ্ছি

কীর্তিনাশাকে যেমন দেখার সাধ ছিল কবির
তেমনি এ আমার আজন্মের সাধ

অদৃশ্যগুচ্ছ

১.
খড়ের রঙ তাড়া করে বিকেল
বাজপাখির পাখায় জড়িয়ে থাকে
শিকারির হাত

২.
চর্যার বালিকার নাকফুল
ঝুলে থাকে মধ্যরাতের টেবিলে...
...এরপর ফুল্লরার ঘুম 

| বাংলাদেশ সংখ্যা | শিকদার ওয়ালিউজ্জামান |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||













শিকদার ওয়ালিউজ্জামান
নি-স্বজন

দুপায়ের মিশেল ভেঙে
একপায়ে দাঁড়ানোর সূত্র শিখিয়েছিলো
শৈশবের তালগাছ
সেই থেকে সে আমার আত্মজ
মুঠো মুঠো মাটি গেঁথে যায় এক একটি কবর
একাকীত্বের নির্মম আকর...
নি-স্বজন প্রতিটি গাছ ধরে রাখে
বাবুইয়ের ঠোঁটে একটি সংসার
এখানে রাতের গহীনে তুমি জ্বলে ওঠো একটি জোনাক
কিঞ্চিৎ আলো, বাকিটা অন্ধকার...
এখানে যারা আসে, সবছেড়ে পেতে চায়-
একটিই
সুদূরের মাঠ
সময় এখানে স্থির, সকলে হাতে ধরে রাখে মহাকাল...

ঋণ

রাত্রির কাছে ঋণ রেখে আমার পিতা পাখি হলেন...
ঋণের
খাতায়
সন্ধ্যের হাওয়া জড়ো করতে থাকে আঙিনার চড়ুই
প্রতিরাতে হিসেব মিলাই
জরায়ু ছিড়ে অগনিত ভ্রুণ কথা কয়
পূর্ব দীক্ষা ভুলে-
স্কুলবেঞ্চে
শৈ
বে
ঘ্রাণ
তৃষ্ণা ছড়ায় ঘন্টার সিম্ফোনি হয়ে...
প্রতিদিন ক্রমাগত ঋণ আমাকে আহত করে
প্রতিদিন ক্ষয়ে যাওয়া মাঠ আমাকে বিদ্যে ঋণ দেয়
বঞ্চিত ভ্রুণের শব্দমালা কটাক্ষ করে রবীন্দ্রসংগীত!
পবিত্র মৃত্যু ল্যাখে বলে
প্রতিটি রাতের কাছে আরো আরো ঋণ জমতে থাকে...
অতঃপর
অনুজের কাছে ঋণ রেখে আমিও পাখি হয়ে যাই

বলপেনে আঁকা সময়ের স্কেচ

পাখির মেলায় গেলে
নীরা আমাকে কিনে দেয় একটি বলপেন
দুয়ের শরীরে অজস্র স্রোত
মাথায়
দুর্দান্ত
লাটিম
পাখিদের চোখে কেবল তামাশার ঘোর...
নীরার বলপেন কখনো বৃত্ত আঁকে
কখনো সরল আর বক্ররেখায় টেনে দেয় ধানক্ষেত
সকালের রোদ্দুরে দু'টি ছায়া সামনে দাঁড়ায়, সমান্তরাল
প্রথমা কৃশকায় হচ্ছে নিয়তদিন
দ্বিতীয়া মাথায় তুলছে পাখিদের খেজুরবাগান
একটি রেখার মগজবন্দি গীতা, বাইবেল
পবিত্র কুরআন
অন্য রেখায়
পোড়াঘাট
পাখিদের
কবরস্থান


| বাংলাদেশ সংখ্যা | মানিক বৈরাগী |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || || ১টি মাসিক স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রয়াস...||












মানিক বৈরাগী 
হীরক পদ্ম

কুহকি পান করো প্রস্ফুটিত বেদনার যারক রস।নীলাভ স্রোতে বয়ে যায় কুহেলিয়া,সেই স্রোতের উউজ্জল পদ্মটি ছল ও ছলের জালে ভাসে আর জ্বলে।
রইলোনা তার স্বাধীন স্বকীয়তা রুপ ও রূপের রুশ্নাই তার কাল হলো।জাল ও জলে জ্বলতে জ্বলতে পিঙ্গল রুপটি তাকে আর জলে থাকথে দিলোনা।
একদিন চারদিকে বড় বড় রশির জাল ও লোহার খাচা ফেলা হলো অথৈ জলে। বিস্তির্ণ জলরাশি কে ভাগ ভাগ করে ঘেরা হলো। পদ্মটি পানকৌড়ির মতো ডুব দিলো অতলে।
একদিন কুহেলিয়ার মোহনায় মাছযন্ত্র নেমে এলো সমুদ্র তলে,ওরা তন্নতন্ন করে তীব্র টর্সের আলো ফেলে শামুক ঝিনুক কোরাল সবখানে খোড়াখুড়ি শুরু করলো।
সমুদ্র তলের বুকচিরে তোলা হলো  উজ্জ্বল পোড়া কলিজা। কলিজার আলোকরঞ্জন বেদনায় মানুষের কি বিভৎস উৎসব।

মানুষ বুঝলো না পদ্মরুশ্নির আলোয়, তারা সমুদ্র পারাপার করে


শুশুক

কয়েক যুগ পরে জলকন্যারা বাপের বাড়ি নাইয়র আইছে। সেই খুশিতে তারা কতো
নাচানাচি করলো আমাদের উঠোনে। আমার নাতিনাতনি কতরকম  জলকেলি করলো
কয়েকদিন।
আমি  সকালে বিকালে তাদের হাসিঠাট্টা জলকেলি মুগ্ধ নয়নে
প্রাণভরে তাদের সাথে কতো কথা মস্করা করেছি,তাদের কতোদিনের জমানো কথা
খইফোটার মতো করে বলছে আর শুনছি।
বিদায় বেলায় কতো কান্নাকাটি করলো। আমিও বাষ্পীভূত হয়ে বিদায় বলেছিলাম।
মন বারবার অজানা আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠতো। চালাক "নর-বানরে"রা গুহায়
ঢুকলেও, কামুক বর্বর নরেরা শিকারের তাড়নায় জাহাজ ভাসালো জলে।
প্রাণের কন্যা নাতিনাতনিরা শোনেনি বারন।
বাপের বাড়ির আদর সম্ভাষণে খুশির উৎফুল্লতায় জলকেলি করতে করতে
ঘুরপথে শ্বশুর বাড়ি ফেরার কালে নর কামুকের নজর এড়াতে পারলো।
সমুদ্র শিকারী নিষাদ জাল পেতে দলবেঁধে প্রথমে অবরুদ্ধ করলো।
কামুক হাতে তাদের চুলের মুটি ধরে টানতে টানতে তুলে নিল বোটে, তারপর চরে এনে
কামুক উল্লাসে ফেটে পড়লো দলবদ্ধ ভাবে।
আমার জলকন্যারা বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করলো, বধির উম্মাদ জল-জালিক
শুনলো না।
তারা তাদের কাম চরিতার্থ করে কোপাতে কোপাতে হত্যা করলো।
আমার শুষক কন্যাদের আর্তনাদ কোন "নর-বানর "শোনেনি।
কেউ বাঁচতে এগিয়ে আসেনি। তোদের উপর নেমে আসুক লানৎ ইন্দ্র-বরুণের।
আমার শুষুক কন্যার জন্য পরাণ কাঁদে।