Sunday, August 15, 2021

বিশেষ সংখ্যা~আলোক মণ্ডল

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||            

আন্দামানের সেলুলার জেল ও বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী

 আলোক মণ্ডল

 

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ   ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ১০০০ মাইল দূরে   "কালাপানি" পার করে আন্দামানে ১৮৫৮ সালে ৪ মার্চ ২০০ জন "সিপাহী বিদ্রোহে" বন্দী সিপাহিকে নিয়ে প্রথমে চাথাম আইল্যান্ড পরে রস আইল্যান্ডে জেলখানা গড়ে তুলতে নৌযাত্রা শুরু করে এবং রস আইলান্ডে বন্দিব্যারাক, ভাইপারে ও চাথামে জেলখানা গড়ে তোলে। ১৮৫৮ সালেই বার্মা ও ভারতের থেকে আসা জেলবন্দির সংখ্যা ১৬১০০ গিয়ে দাঁড়ায়। ফলত ভাইপার আইল্যান্ডের জেলখানায় যেখানে ভাইসরয় লেঃজেনারেল লর্ড মেঁওকে হত্যা করেছিলেন (ওয়াহবি আন্দোলনের জন্য বন্দী) শের আলি এবং তার জন্য তাকে গাছে টাঙিয়ে ফাঁসি দেয় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কিংবা পুরীর রাজা গজপতি বীর কিশোর সিং ( বৃটিশ বিরোধী হওয়ার দোষে দীপান্তরিত) নির্যাতনে মৃত্যু হয়। সেই ভাইপার জেলে বন্দিদের রাখা সম্ভব না হওয়াতে একটা বড় জেলখানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ডাঃ আলফ্রেড সোয়াইন লেথব্রীজ ও চার্লস জেমস্ ১৮৯০ এপ্রিল ২৬ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে যে আন্দামানে ৬০০ সেল যুক্ত একটি জেলখানা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে, সেই মাফিক পোর্ট ব্লেয়ারের এবারডিন এলাকায় ৬০০সেল যুক্ত জেলখানা গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেয়।  সেই মাফিক চিঠি নং ১২০১ তাং ৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩. বাস্তবায়নের নির্দেশ জারি হয়।সাব-ইঞ্জিনিয়র ডাব্লিউ  জি ম্যাককুলিন  এস্টিমেট দেন আইরন মেটিরিয়াল ছাড়া খরচ পড়বে ২,৫৯, ৭৬৪ টাকা আর বন্দিলেবার দের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ ১,৬২,৬০২ টাকা।

                   কাজ শুরু হোল সেলুলার জেলের, সমুদ্র তল থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে তারামাছের আকৃতিতে তিনতলা বিশিষ্ট ৭ টি  ব্লক বা wing প্রতি ব্লক তিন তলার।প্রথম ও দ্বিতীয়  ব্লকে সেলের ( কুঠরির) সংখ্যা ৩৫×৩= ১০৫, তৃতীয় ব্লকে সেল সংখ্যা ৫০×৩=১৫০,চতুর্থ  ব্লকে২৬×৩=৭৮, ৫ম ব্লকে ২৪×৩=৭২,৬ষ্ঠ ব্লকে ২০×৩=৬০ আর ৭ম  ব্লকে ৪২×৩=১২৬টি, সর্বমোট ৬৯৬ টি সেল।এই বিশাল জেল তৈরী করতে ২০ হাজার কিউবিক ফুট  স্টোন চিপস আর ৩০ লাখ ইট লেগেছিল,লেগেছিল ১০ বছর সময় আর ৬০০ শ্রমিক।  প্রতি সেলে ১ জন করে স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দী থাকতেন। সেলের পরিসর ১৩.৫ ফুট লম্বা ৭.৫ ফুট চওড়া। ৯ ফুট উঁচুতে পেছুনের দিকে একটি মাত্র লোহার গ্রুিল দিয়ে আটকানো ঘুলঘুলি। সামনে মোটা লোহার গেট তার লক দু'ফুট দূরে  দেওয়ালের ভেতরে কুলুঙ্গি করে তালা,বন্দির পক্ষে হাতবাড়িয়েও নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। সেলের ভিতরেই বন্দিদের প্রাতঃকৃত্য করতে হোত, পেট খারাপ হলে সারাদিন ঐ টয়লেটের নোংরা নিয়েই থাকতে হোত। সামনে ৪ ফুট চওড়া লম্বা বারান্দা, প্রতি ব্লকে প্রবেশ পথ মোটা লোহার গেট দিয়ে আটকানো।এক সেলের বন্দির সংগে অন্য সেলের বন্দির দেখা হওয়া বা কথা বলার কোন সম্ভবনা ছিল না।প্রতি ব্লকে ২১ জন করে ওয়ার্ডেন্ট ও সশস্ত্র প্রহরী দিনরাত্রি তিন ঘণ্টা করে ডিউটিতে থাকত।প্রতি ব্লকের সামনে একাধিক ঘানী থাকত বন্দিদের নারকেল তেলের ঘানী চালাতে হোত, না করলে অকথ্য অত্যাচার, তার কাহিনি বড়ই নির্মম ও পৈশাচিক।জেল বন্দীদের মাথা পিছু ঘানি টেনে শুকনো নারকেল থেকে ৩০ পাউন্ড নারকেল তেল বার করতে হত। কয়েদীদের মধ্যে কেউ জেলারের প্রতিবাদে উঁচু গলায় কথা বললে তাকে উলঙ্গ করে ফগিং স্ট্যান্ডে উল্টো করে হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। তারপর বন্দীর নিতম্বের উপর সাদা এক টুকরো কাপড় রেখে চাবুকের ঘা মারা হত। চাবুকের ঘায়ে নিতম্ব ফেটে রক্ত বের হয়ে আসত। এর ফলে সেই বন্দীর পরিনতি হতো খুব খারাপ,বন্দী ভালো করে মল ত্যাগ করার জন্য বসতে পারতেন না ফাটা চামড়ায় টান পড়তো।

বন্দিকে পাটের তৈরি কাপড় পড়তে দেওয়া হত যাকে "পানিশমেন্ট-ড্রেস" বলা হত। সেই পাটের ড্রেস পরে নিতম্বের ফাটা জায়গায় পাটের কাপড়ের ঘষা লেগে ঘা হয়ে যেত। এরকম শতশত
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বটুকেশ্বর দত্ত যেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি কত বন্দী অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেল প্রশাসন একবার এক সঙ্গে ৭৮ জন বন্দী কে এক সঙ্গে ফাঁসি দিয়েছিল। কত যে নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার হিসেব আর এক নিবন্ধের সূচনা করবে।

বর্তমানে সেলুলার জেলের মাত্র তিনটি ব্লক আছে বাকিগুলি কিছু ভূমিকম্পে এবং বেশীরভাগ ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার আঘাতে ধূলিস্মাৎ হয়েছে।ভারত সরকার দুটি ব্লক ভেঙে সেখানে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট "জে বি পন্থ হসপিটাল "গড়ে তুলেছেন পরবর্তীকালে।                                                                                                                                                             
সেলুলার জেলে  অবিভক্ত বাংলা থেকে ১৯১০ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩৭০ জন, উত্তর প্রদেশ থেকে ২০ জন, অবিভক্ত পাঞ্জাব থেকে ৮৪ জন,বিহার থেকে ১৮ জন,  দিল্লী থেকে ১ জন, মাদ্রাজ থেকে ৩ জন এবং মহারাষ্ট্র  থেকে ৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল খেটেছেন

আমাদের জেলা,বাঁকুড়া থেকে মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন বিষ্ণুপুর ডাক গাড়ি লুঠের অভিযোগের শাস্তি স্বরূপ।সাত বছরের জন্য তাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি ১৯৩৭ সালে জেলের অভ্যন্তরে আমরণ অনশনেও যুক্ত ছিলেন।১৯৩৮ সালে জেল মুক্ত হয়ে ১৯৩৯ সালে  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন এবং পরে দল ত্যাগ করে মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং জেলা সম্পাদক হন। কিন্তু সেই পার্টিই তাঁকে  দল থেকে বহিষ্কার করে স্বাধীনতা সংগ্রামীর দের সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার যে  "তাম্রপত্র'' দেয় তা গ্রহণের অপরাধে।শেষ জীবন তাঁর চরম দারিদ্র্যে কাটে অবহেলায় ও বিনাচিকিৎসায় মারা যান।


                                1৊ বিমল সরকার     
2৊ সুধাংশু দাশগুপ্ত

বন্দী ছিলেন বাঁকুড়া জেলার মালিয়াড়া গ্রামের প্রভাকর বিরুনি। পিতা শশীভূষণ বিরুনি। জন্ম- ফেব্রয়ারি ১৮৯৮,অসহযোগ আন্দোলনের(১৯৩০) সংগে যুক্ত ছিলেন অনুশীলন সমিতির  অন্যতম এই সদস্যটিকে বে-আইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগে ২৮ আগষ্ট ১৯৩৪ সালে বন্দী করে ৫ বছরের জন্য সেলুলার জেলে চালান করে দেয় বৃটিশ সরকার।তিনি জেলখানায় দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-এ অংশ নেন জুলাই ১৯৩৭,   মুক্তি পান ১৯৩৯ এ। জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তাঁর পুরুষ্ঠ গোঁফ ওয়ালা ছবি এখনও সেলুলার জেলে দৃশ্যমান। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালে।

যুগান্তর দলের সদস্য , বিষ্ণুপুর ডাকলুঠের সংগে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিমল কুমার সরকারের দীপান্তর হয়। তিনি সেলুলার জেলে বন্দী থাকেন ১৯৩৩ সালে,৫ বছরের জন্য।  তিনিও জেলে দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-র সংগে যুক্ত ছিলেন, মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। পরবর্তি সময়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং  ১৯৩৬ সালে বাঁকুড়া জেলাপার্টির প্রথম সম্পাদক হন।

বে-আইনী অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখার জন্য বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা  দীননাথ কর্মকারের  ছেলে ভবতোষ কর্মকারকে ব্রিটিশ সরকার  ১৯৩৫ সালে ৪ এপ্রিল মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে এবং পরে তাঁকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করে। তিনি  সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ এ তারপরেও তাঁকে অন্য জেলেই   থাকতে হয়।

মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় সুধাংশু দাশগুপ্তের ৯ ডিসেম্বর  ৫ বছরেরর  জেল হয় জেলবন্দি অবস্থায় সেলুলার জেলে বিমল সরকারের সাহচর্যে এসে সুধাংশু দাশগুপ্ত কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং জেল থেকে ১৯৩৫ এ মুক্তি পেয়ে বাকি জীবন বিষ্ণুপুরে সংগঠনের কাজে কাটিয়ে দেন,  সে হিসেবে তিনি এই জেলারই মানুষ।

একই ভাবে বিহার থেকে সেলুলার জেলে বন্দী প্রমথনাথ ঘোষও পরবর্তী ১৯৩৭ এর পর মুক্তি লাভ করে কর্মক্ষেত্রে হিসেবে বাঁকুড়া জেলাকেই বেছে নেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সংগে যুক্ত হন।

আমরা অনেকেই খুব আবেগ প্রবন ও গল্পবাজ তাই গল্পের গরু গাছেও চড়ে! তাই মনীষীদের নিয়ে সহজেই গল্প ছড়িয়ে পড়ে।  এমনই এক গল্প সেলুলার জেলবন্দি বীর সাভারকারকে নিয়ে। বলা হয়, তিনি সেলুলার জেল ভেঙে পাহাড় প্রমান প্রাচীর ডিঙিয়ে ১০০০ মাইল উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতের মূল ভূখন্ডে। এরকম গপ্প কিন্তু ডাহা মিথ্যা তার কোন তথ্যও নেই।আসলে,১৯০৯ সালে ১ জুলাই  মদনলাল ধিংড়া বৃটিশ প্রভু কার্জন ওয়াইলি কে লন্ডনে গুলি করে হত্যা করেন সেই সময় ভিনায়ক দামোদর সাভারকার বোমা তৈরীর মেথড নিয়ে জাহাজের কুক হয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন কিন্তু ধরা পড়ে যান। বৃটিশরা তাঁকে বন্দী করে জাহাজে  ভারতে চালান করার সময় দামোদর ১৩ মার্চ ১৯১০  এ জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ফ্রান্সের পোর্ট  মারসেল্স বন্দরে পৌছে আত্মগোপন করেন, ফ্রান্স পুলিশ তাঁকে আবার ধরে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়।১৯১১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি  কার্জন হত্যায় যুক্ত থাকার  মামলায় এবং নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে   সেলুলার জেলে বন্দি হন ৫০ বছরের জন্য।বৃটিশ সরকারের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি জেল মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন তারপর ১৯২৪ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেয়, ইতিমধ্যে কংগ্রেস দল ভারতের ৭ টি রাজ্যে ক্ষমতায় এসে গেছে,সেটা ১৯৩৭ সাল,বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া  শর্ত মেনে মুচলেখা( বৃটিশ বিরোধী কোন আন্দোলনে থাকবেন না,কোন রাজনৈতিক কাজ-কর্মে যুক্ত  থাকবেন না শুধু সমাজসেবায় যুক্ত থাকবেন এই শর্তে।) দিয়ে সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান।এই হচ্ছে  তথ্য স্বীকৃত ইতিহাস। অথচ সেলুলার জেলের সামনেই যে পার্ক, তা সেটি তাঁর নামেই উৎসর্গীকৃত , পোর্টব্লেয়ার এয়ারপোর্টের নামও"বীর সাভারকার এয়ারপোর্ট"  তাঁর নামেই  অথচ নেতাজীর ১৯৪৩ এ বৃটিশমুক্ত আন্দামানে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তার  কোন স্বীকৃতি নেই! এমনকি তিন শতাধিক বাঙালী বীর বন্দিদের নামের তালিকা যা এতোদিন সেলুলার জেলের দেওয়ালে মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ ছিল তা প্রতিদিনই কোন এক অদৃশ্য কারনে কমতে থাকছে।যেমন আমরাও ভুলে যাচ্ছি বাঁকুড়ার ঐ সমস্ত বীরদের কথা,  ক'জনই বা জানি তাঁদের সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে!





                                                                          
                                                                                                                                                          

Thursday, August 12, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২১

গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, ‘‘চরিত্রগুলোকে পাঠক সব সময়,  তাঁরা নিজেরা যেমন চান, সে ভাবে দেখতে পছন্দ করেন, নিজেদের পিসি মাসি ঠাকুরদার মতো করে। যে মুহূর্তে চরিত্রগুলো সিনেমার পর্দায় চলে আসে, পাঠকদের কল্পনাটাও সীমায় ঠেকে যায়।’’ এই কথাটাও আমার কাছে একটা ‘শক্’ ছিল, বুঝতে পেরেছিলাম কেন এত সিনেমা-প্রীতি সত্ত্বেও কোনও প্রিয় উপন্যাস থেকে বানানো ছবি আমি সহজাত প্রবৃত্তি-বশেই এড়িয়ে চলি। আসলে ভয় পাই যে আমার মনের মধ্যে যে ছবিটা, সেটা বড্ড সহজে পর্দায় ফুটে উঠে ছোট হয়ে যাবে।

১৯৪৭ সালে আন্তোন্যাঁ আর্তো লিখেছিলেন, ভ্যান গঘের ছবিতে কোনও ভূত নেই, কোনও বৃহৎ‌-এর স্বপ্ন নেই, কোনও ভ্রমকল্পনা নেই। আছে কেবল বেলা দুটোর সূর্যের সেই প্রখর তাপদাহ। জন্মপূর্ব যন্ত্রণার স্মৃতি। আছে পবিত্র, উলঙ্গ পৃথিবী। আমরা তার আরও কাছে যাওয়ার মতো জ্ঞান অর্জন করলেই যে প্রকৃতি নিজেকে লুপ্ত করে ফেলে।” গার্সিয়া মার্কেসকে ভাবতে গেলেও এই কথাটাই মনে আসে আমার।

সম্মোহ ওয়াচ টাওয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এরকম অনেক এলোমেলো ভাবনায় নিজেকে ভাবিয়ে তোলে । ভাবতে থাকে। ভাবনার কোনো পরাধীনতা নেই। সে যে বড্ড স্বাধীন! সম্মোহ তার ভাবনার মতোই স্বাধীন। দুঃখ আছে শোক আছে আবার আনন্দও আছে। আর ফেসবুকের চন্ডীমন্ডপ। পিএনপিসি। 

শিক্ষক ছাত্রীর যৌনতা। অডিও। স্কিনশর্ট। কমেন্টস। উপযুক্ত শাস্তি হোক। বিচার চাই। ছিঃ ছিঃ ভাবা যায় না। শিক্ষকের আড়ালে শয়তান। মরে যাওয়া উচিত। সবাই বয়কট করুন। সঙ্গে ফেসবুক গ্ৰুপ যাচাই- অভিযানের অন্তর তদন্ত। আরো কত কি! মজা ফূর্তি নিশিগন্ধা... ম্যাজিক রিয়েলিজিম...

এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ জীবনের জাদু-বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেন এভাবে, একদিন আমি আর আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে ছিলাম। এর মধ্যে শুনতে পেলাম কলিংবেলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে! দ্রুত আমি দরজা খুললাম এবং একজন মানুষ জানালো সে ইলেক্ট্রিক আয়রন মেশিন ঠিক করতে এসেছে! আমার স্ত্রী বেডরুম থেকেই জানালো, আমাদের আয়রন মেশিনে কোনো সমস্যা হয়নি।তারপর আগুন্তক জানতে চাইলো, "এটা কি এপার্টমেন্ট নাম্বার দুই?" আমি তাকে জানালাম, "না, নাম্বার দুই উপরের তলায়।" এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী কাপড় আয়রন করতে গিয়ে সুইচ অন করার সাথে সাথেই আয়রনের তারটি শর্ট সার্কিটে পুড়ে গেল!

দেখুন এটাই অন্যরকম কিছু! আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জানার আগেই সে এসেছিল সমস্যাটি ঠিক করতে! আমাদের জীবনে প্রায়ই এমন হয়! যদিও আমার স্ত্রী হয়তো ঘটনাটি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে।

 বিকাশ চলে যাওয়ার পর ক'দিন মনটা একেবারেই ভালো ছিল না সম্মোহের। মনে হয়েছিল বিকাশকে এখানে রেখে দিলেই হত।বিকাশেরও আরো ক'দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে এতদিন বাইরে থাকার অভ্যাস একেবারেই নেই বললে চলে। তাই বাড়ির দিকেও বিকাশের মনটা চলে যাচ্ছিল।
শেফালির কথা বলছিল বারেবারে। একদিন সকালে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিকাশ সম্মোহকে বলল, " আমার ট্রেনের টিকিটটা এবার কেটে ফেল। বাড়ি ফিরতে হবে! বদ্ধ ঘরে শেফালির দম বন্ধ হয়ে আসছে! এবার আমাকে যেতে হবে!"

সম্মোহ বিস্মিত হয়ে বিকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে টিকিট কেটে দিয়েছিল। শুধু সম্মোহের মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল, "বদ্ধ ঘরে শেফালির দম হয়ে আসছে!" এও কি এক ধরনের জাদু বাস্তবতা? 

শেফালি চলে যাওয়ার পর বিকাশ একেবারে একলা হয়ে গেছে। খুব বুড়ো হয়ে যায় নি। এই বয়সে জীবনসঙ্গীর চলে যাওয়া বড় বেদনার। কারণ প্রতিটি দাম্পত্যের এই বয়সটাই প্রকৃত মধুচন্দ্রিমার সময়! সম্পর্কের গভীরতার সময়। অনুভবের সময়। 

আর সম্মোহ এগুলোর থেকে দূরে। তার একাকিত্বের একাকারে গাছ পাখি মানুষের যাওয়া আসা। ফলে সম্মোহের ক্ষেত্রে একজন পঞ্চতপা কর্মযোগির জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

বাস্তব সমাজটা গার্সিয়া মার্কেসের মতোই সম্মোহের কাছে কাছে বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে জাদু তৈরি করত বাস্তবের ফাঁকে ফাঁকে নীরবতা ও প্রকাশের মাঝে, ক্ষমতা ও সংশয়ের মাঝে, আড়ম্বরহীনতা ও চোখ-ধাঁধানো অসামান্যের মাঝে। এবং সম্মোহ  গল্প বলতে পারত। সম্মোহ কখনো একটা গল্প বলত না। বরং একটা দুনিয়া তৈরি করে ফেলত , একটা জাতিকে বুনে দিত , সৃষ্টি করত একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহা-আলেখ্য। কী নেই সেখানে, স্মৃতি, কল্পনা, ইচ্ছে, মৃত্যু, স্বপ্ন, জীবনযাপন। অসংখ্য পরস্পর-সংযুক্ত গল্পের দুনিয়া খুলে দিত তার উপস্থিতি।

প্রথম প্রথম সুতানে আসার পর একটা ভয় কাজ করত। মৃত্যু ভয়! একদিন ভয় অতিক্রম করে অভয় এসে হাত ধরল সম্মোহের। মনে হল এই সম্পূর্ণ এলাকাটায় একজন ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান। সমস্ত অশুভ শক্তিকে আটকে দেন তিনি। মাঝরাতে মাঝে মাঝে নুপূরের শব্দ শোনা যায়। কেউ হেঁটে চলার শব্দ! তিনি কি দেবী! তাঁকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সম্মোহ সব সময় তার অস্তিত্ব অনুভব করে। সেই যেন সম্মোহকে আগলে রেখেছে।

একদিন কেউ নেই। লালুকাকা নেই, বুলির মা নেই, সম্মোহ একা! মেঘ করেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ইলেকট্রিক নেই। জেনারেটরে তেল নেই। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। অতি ক্ষীণ আলোর লন্ঠন জ্বালিয়ে সম্মোহ বসে আছে। কানে আসছে কারো হেঁটে চলার শব্দ! কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু অনুভব করা যাচ্ছে। 

                     ----- কে তুমি?

                     ------ ম্যাজিক রিয়েলিজম!

                     ------ কোথায় থাকো?

                    ------- তোমার ভেতরে!

                    -------- প্রমাণ কি?

                    --------- অনুভব করা ছাড়া এর কোনো                                 প্রমাণ হয় না!!




Tuesday, August 10, 2021

বিশেষ সংখ্যা~পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||         

উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব ও সুরের দেবী লতাজী.....
" কমবখ্ত কভী বেসুরি নহীঁ হোতী "
পুষ্পিত মুখোপাধ্যায় 



লতা মঙ্গেশকরের মতে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের মতো শিল্পী প্রতিদিন জন্মান না। 
লতাজী বলেছেন "আমার পরম সৌভাগ্য,আমি সামনে বসে উস্তাদজীর গান শুনেছি। উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। বলতেন "লতা তুম মেরী বেটি হো " ।
   উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব লতাজীর পিতা পন্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যুবার্ষিকীতে একবার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। 

লতাজী স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন "আমার মনে আছে উস্তাদজী প্যান্ডেলে সামনের সারিতে বসেছিলেন আর আমি মঞ্চে গাচ্ছিলাম। আমার কপাল ঘামে ভিজে গেছিল এবং পা কাঁপছিলো। যাইহোক,কোনো রকমে আমি গান শেষ করি,ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে। আমি গান গাওয়ার সময় কখনো নার্ভাস হতাম না। কিন্তু সেদিন ভীষণ নার্ভাস বোধ করছিলাম,'কেননা খান সাহেব সামনে বসেছিলেন। আমার পর উস্তাদজী এমন সঙ্গীত পরিবেশন করেন আকাশ বাতাস গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে। খান সাহেব প্রথমে খেয়াল গায়িকিতে একটা রাগ শোনান,তারপর অভূতপূর্ব,অকল্পনীয়  সঙ্গীত প্রদর্শন করেন। তারপর উস্তাদজী ঠুমরি পেশ করেন,ঠুমরিতে উনি সারা বিশ্বে অদ্বিতীয় ছিলেন। পন্ডিত দীনানাথজীর স্মৃতিতে আয়োজিত এই সমারোহে খান সাহেব রাগ ও ঠুমরির পর গ়জ়লও শোনান। সে এক স্মরণীয় অনুষ্ঠান ছিলো। "
  খান সাহেব লতাজী সম্পর্কে বলেছিলেন "কমবখ্ত,কভী বেসুরি নহীঁ হোতী। ওয়াহ্! ক্যায়া অল্লাহ্ কী দেন হ্যায় " ।পন্ডিত যশরাজজীকেও খান সাহেব লতাজী সম্পর্কে একথা বলেছিলেন। 

লতাজী আরো বলেছেন .."আমি পন্ডিতজীকে বলেছিলাম যে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব আমাকে ' কমবখ্ত 'বলেছিলেন। একথা শুনে পন্ডিত যশরাজজী বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন.."হ্যাঁ ,উস্তাদজী তোমাকে 'কমবখ্ত ই বলেছিলেন। "  লতাজী বলেন 'এমনিতে তো 'কমবখ্ত 'এর অর্থ ভিন্ন,কিন্তু খান সাহেবের মতো মহান শিল্পীর এটা কোড,যেটাকে আমি আমার মহা সৌভাগ্য মনে করে থাকি। সুর সঙ্গীতের এতো বড় মহান শিল্পী আমার সম্পর্কে বলেছিলেন।  আমি সুরেই গাই,সুর থেকে কখনো বিচ্যুত হই না। উস্তাদ খান সাহেবের উক্ত বাক্যটি আমার কাছে পরম আশীর্বাদ স্বরূপ। "

     
                                                   (কমবখ্ত ...সাধারণ অর্থে বলা হয় 'হতভাগী ')


Sunday, August 8, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২০

-----" তুই এখনো ফুলটো হয়ে আছিস লীমার জন্য! চোরাস্রোত বয় কেবলই চেতনাময়... হাহাহা..."

---" দাঁত না কেলিয়ে মালটা শেষ কর! শোন বর্তমানে আমার কোনো স্রোতটোত নেই ওর জন্য। সামান্য করুণা আছে। ওর কথা ভাবলে কষ্ট হয়। রাগ হয়! গালি দিতে ইচ্ছে করে। আমি এই বেশ আছি।‌নিজের মতো স্বাধীন!"

----" আহা! রাগ করিস কেন!"

---" শোন বাল, নেশাটা চটকাশ না! অন্য কথা বল।"

বিকাশ সম্মোহকে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, " মুরগির ঝোলটা বেশ ভালো রেঁধেছে। জমে গেছে বন্ধু! আমি আর মহুয়া নেব না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।"

----" ঠিক আছে। তাড়াহুড়ো করিস না। মাংস ভালো লাগলে মাংসটাই খা। একটু ভাত দিতে বলি!"

----" তা বলতে পারিস। খিদেও পাচ্ছে বেশ।"

----" ধলু, ধলু রে..." সম্মোহ ধলুকে ডাকে।

----" কত্তা বলেন।"

----" ওকে একটু ভাত আর মাংস দে।"

---" ঠিক আছে কত্তা এখুনি দিচ্ছি।"

---"বিকাশ, তুই কখনো প্রেমে পড়েছিস কারোর!"

----" হ্যাঁ, তোর প্রেমে পড়েছি বারবার!"

----" দুশশশ শালা! নায়িকাদের কথা বল। তোর কৈশোর কালের কিংবা যৌবন কালের কোনো নায়িকা! যে এখনো তোর স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে!"

---- আছে তো! আলেয়া সেন! জীবনানন্দের বনলতা সেন আর আমার আলেয়া সেন!"

----" বিকাশ আপনি নেশা করেছেন? বিকাশ, তাকে কোথায় খুঁজিয়া পেলেন!" 

--- " উনি স্বপ্নে এলেন গেলেন... "

----" বিকাশ আপনি ইহা দেখে শুধু বালগুলো ছিঁড়লেন!" 

সম্মোহ আর বিকাশ একসঙ্গে হোহোহোহো... শব্দে হেসে উঠলো। সেই হাসি যেন থামতেই চায় না!

তারপর কখন যে খাওয়াদাওয়া শেষ করে সিগারেটে সুখটান দিয়ে খুনসুটি করে দুজনে তালাইয়ের উপর শুয়ে পড়েছে, তা আর কারো হুঁসে নেই। আর হুঁসে থাকার দরকারটাই বা কি! বরং জীবনে মাঝেমধ্যে এরকম বেহুঁশ হওয়াটাই সঙ্গত! এ্যাতো হুঁশে থেকেই বা কি হলো বিকাশের! 

অন্ধকার প্রথমে পাতলা ফিনফিনে হয়ে আছে। আসলে তা সম্মোহের ঘুম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে বুঝতে পারছিল না যে চেষ্টাকৃত স্বপ্নভঙ্গ, না কোনও বাহ্যিক কারণে তার ঘুম ভেঙে আসছে।সে কি কিছু শুনেছে? কোনও শব্দ? কান্না? নিশ্চিত হতে না হতে আবার চোখ বুজে আসে অবসন্ন অবশিষ্ট ঘুমে।স্বপ্নের বাকিটুকু তখন সে দেখতে থাকে।

ব্লাউজের হুক খুলতেই শেখনি এখনো!

--- শিখিনি তো! তুমি শিখিয়ে দাও!

----অত শেখাতে টেখাতে পারব না! নাও খুলে দিলাম!

সম্মোহ বুকের ভেতর মুখটা গুঁজে দেয়। তারপর মুখের ভেতর মাংসল পিন্ডটা ঢুকিয়ে বাচ্চা ছেলের মতন চুষতে থাকে! লীমা নিজেকে আরো আলগা করে দেয়! তারপর ধীরে ধীরে নাভিতে একটা হালকা কামড় দিয়ে যোনিমুখ চুষতে থাকে। আর ঠিক তখনই লীমা নিজেকে আর সামলাতে পারে না! ... ওওও বেবী...ইইইই... লীমার এই কামোদ্দীপক উচ্চারণে সম্মোহ নিজেকে আরো ঘনীভূত করার চেষ্টা করে! আবার ভয় হয়! অতি উত্তেজনায় যদি বীর্য বেরিয়ে যায়! তাহলেই সব শেষ! হেরে যাওয়া! সম্মোহ তাই নিজেকে সব কিছুর থেকে একটু দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে! ভাবনাকে পাল্টে ফেলতে চায়! তবু একসময়  নিরুপায় যৌনতার মতো আত্মসমর্পণ করতে হয়! ঘেমো পিঠের উপর লীমার হাত আঁকিবুকি কাটে। 

---কত্তা ও কত্তা ওঠেন এবার বেরোতে হবে। আমি সঙ্গে যাব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এরপর হাতির ভয় আছে! ওঠেন কত্তা! 

ধলুর ডাকে ঘুমটা আবার ভেঙে যায়। সম্মোহ চোখ খুলে অনুভব করে লিঙ্গটা শিলনোড়ার মতো শক্ত হয়ে আছে! কিঞ্চিৎ অস্বস্তি কাটিয়ে বিকাশকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে সম্মোহ। বিকাশ ঘুমে একেবারে অচেতন। 

ধলু বাইকে উঠে বসে। মাঝে ঘুমন্ত বিকাশকে বহুকষ্টে বসিয়ে দিয়ে, সম্মোহ ঠিক পেছনেই উঠে বসে। ধলু বাইক চালিয়ে সম্মোহের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাহাড়ি বাঁকের মতন আঁকাবাঁকা রাস্তায় ধলু ছাড়া বাড়ি ফেরা প্রায় অসম্ভব ছিল। মিনিট কুড়ির মধ্যে বহু বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। বিকাশ তখনও প্রায় অচেতন। 

বিকাশকে বিছানায় শুইয়ে সম্মোহ বুলির মাকে এক বোতল জল দিয়ে যেতে বলে। বুলির মা জল নিয়ে এলে, বিকাশের চোখেমুখে জলের ছিটে দেওয়া হয়।মাথা ধুইয়ে দেয় ধলু। 

----" আজ রাতে আমার বিকাশের রান্না করার দরকার নেই। শুধু ধলুর আর তোমাদের রান্না করো। ধলু রাতে এখানেই থাকবে। কাল সকালে বাড়ি যাবে। ওকে পাশের ঘরটা খুলে দাও। ওখানেই রাতে শুয়ে পড়বে। এখন একটু কড়া করে চা বানিয়ে আমাকে আর ধলুকে দাও।

সম্মোহের কথার বুলির মা মাথা নেড়ে চলে যায়।

---" কত্তা চিন্তা করবেন না। আপনার বন্ধুর ঘুমটা ঠিক মতো হলেই চাঙ্গা হয়ে যাবে। আসলে অভ্যাস নাই তো! তাই নেশাটা ধরে লিয়েছে।"

--- " যাই বল ধলু, মহুয়াটা কিন্তু একঘর ছিল! আমাকেও ধরে লিলো!"

----" কত্তার ভালো লেগেছে এতেই আনন্দ। যাইহোক অনেকদিন পর এলেন এদিকে।"

-----" ঠিকই বলেছিস, আজকাল আর তেমন যাওয়া হয়না তোদের ওদিকটায়। বিকাশের জন্যই যাওয়া। তবে জানিস অনেকদিন পর তোদের ওখানে গিয়ে ভালোই লাগল। যা চা খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম কর। আমার কাছে একটা বিলাতি আছে, তুই আর লালুকাকা দু'জনে খেয়ে নিস। ওই তাকের ভেতর আছে, নিয়ে যা।"

---- " লালুকাকাকে দেখছি নি! কই গো?"

----" আছে আশপাশে। চলে আসবে। "

সম্মোহ ধলুকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে নিজে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে ফ্রেস হয়। তারপর আলো নিভিয়ে বিকাশের পাশে শুয়ে পড়ে।‌ শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। আজকাল বয়সের ভার এই সব বেলেল্লাপনার ধকল নিতে পারে না।

তবু অনেকদিন পর আজ সম্মোহের আবার ডাইরি লিখতে ইচ্ছে করল। সেই চিরচেনা লালরঙের ডাইরি। সম্মোহ আজকাল কালেভদ্রে লেখে।‌আজ আবার লিখল...

একটা সময় ছিল যখন আমরা সকলে ছিলাম দারিদ্রের মহিমায় পঞ্চমুখ। দারিদ্রকে অভিশাপ মনে না করে আশির্বাদ বলেই মেনে নিতাম। যেমন কাজি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, "হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান।" পূর্বে ধারণা ছিল দারিদ্র মানুষকে গুণগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা তার অন্তর্নিহিত শক্তি পূর্ণ প্রকাশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠা এনে দিত। কিন্তু বর্তমান কালে সাধারণ ধারণা দারিদ্র্য মানুষকে অমানুষ করে তোলে এবং তাঁর অন্তর্নিহিত শক্তি অঙ্কুরেই বিনাশ করে। এই দারিদ্রের পঙ্কিল আবর্ত থেকে আজকালকার সমাজবিরোধী, উগ্ৰপন্থী ও পরস্বাপহারীদের উৎপত্তি। এক সময়কার দারিদ্রের সুফল আজ সমাজঘাতী কুফলে পরিণত।

এতদূর লেখার পর সম্মোহের মনে হলো এইসব জ্ঞান চুদিয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু নিজেকে বিজ্ঞ ভাবার গাম্ভীর্য আছে! হাসি পেল নিজের প্রতি। তারপর বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, " কমরেড বিকাশ এবার উঠে পড়। আমাদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।"

Saturday, August 7, 2021

আমন্ত্রিত সংখ্যা≈অনুপ মণ্ডল

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||








অনুপ মণ্ডল


মগ্নপথ 

শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে না ফেরাটা প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে
কী আশ্চর্য!গাছের একটা পাতা পর্যন্ত নড়ল না
চাঁদের আঠায়
ঝরেপড়া হাওয়ার পাপড়িগুলো জুড়ে জুড়ে
আমি একটা শূন্যযোগ শূন্যবাসা নির্মান করে চলেছি
যেখানে জলচাঁদ আমাকে জলছাপ ভেবে নিয়ে
ডুবে যাওয়া কঞ্চির ডগায় বসে  লাফাচ্ছে
দৃশ্যের অভ্যন্তরে ঘাই মারছে বাইফোকাল দেবদারু বন

যোনিপথই মগ্নপথ।আলপথে দাঁড়িয়ে
দূরবীন ছাড়াই মাতৃভূমির দেখা মেলে
মেঠোপথ;এঁকেবেঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর দিগন্তে
বারোআনাই ফকিরি তার
ঈগলের নিরীশ্বর নখর থেকে শামুকের জিভ খসে পড়ে
শুকিয়ে আসা মজাপুকুর;মোহনায় অনৈচ্ছিক কার্লভার্ট
আমি ঝেড়েঝুড়ে কানপেতে শুয়ে থাকি,শুনি জলের প্রলাপ


 ভাষ্য 

ছায়ার মাথায় পা দিয়ে দিয়ে দিব্যি তো হেঁটে গেলে তুমি
মুক্তি নেই;ছায়া আঁকড়ে ধরছে
বখতিয়ারের ঘোড়া ও তৎসম শব্দের সাঁকো
ঢোঁড়া সাপের বুকের তলায় শুয়ে
গান গাইলে তুমি আর আমরা দুঃস্বপ্ন দেখলাম

মালতীদের উঠোনের এক কোণে চারা গাছটায়
আকাশের গান জুরিদারহীন বাতাসের গান
মিহিন খরগোস ও নালিঘাসের অতিবাহিত তানে
জল মিশে গেল খণ্ডহর জলে,হেলে পড়ল ভাঙা মই

বলো,নিজস্ব কান্নাকে কীভাবে খুঁজে পাবো আমি
বলো কীভাবে আলিঙ্গন করে নেবো নিজস্ব ঘেন্নাকে
যে আকাশ অলক্ষ্যে বয়ে যায় প্রতিনিয়ত
ফিরে সে তো আসে না
আকাশচুম্বী বৃক্ষের বাকল বেয়ে
খিলখিলিয়ে নেমে আসে খালি নক্ষত্রবাসের তরল সোহাগ


চাঁদ ঢুলুঢুলু  

প্রার্থনাহীন যাপনচিত্র থেকে বহুদূর ঘন মাত্রিক বিকেলের
অস্ফুট এক চায়ের ক্রন্দন
বিতর্কের মরুভূমি

পাশার দান সাজিয়ে বসে আছে কেউ কেউ
আমরা কেউ হারছিনা-তবু খেলা চালু রাখা হয়েছে
আমরা কেউ জিতছি না
তবু খেলা খেলাকে অতিক্রম করে বয়ে যাচ্ছে
খেলা চলছে হিপ্পোক্রিনিক এবং হিসেব বহির্ভূতভাবে

গত ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীতে কত গ্যালন বৃষ্টিপাত হলো?
কত শতাংশ ভেজালো বালিয়ারি আর 
কত শতাংশ
শুধুমাত্র ঝড়ের খেয়ায় অবিমিশ্র বিনোদন
বিনোদন প্রশ্নে বিসমিল্লা খান
শেষরাতে সানাই বন্ধ ।আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছাড়াই
চাঁদ ঢুলুঢুলু
চুপিচুপি মরুভূমি পার হয়ে গেল একটা অনাবৃত জিরাফ