Sunday, November 29, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
| নভেলেট |
    







অরিজিৎ চক্রবর্তী

ডারউইনের চিঠি  ( ১৩ পর্ব )

প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার তানজানিয়ার স্যাঁদিম্যান আগ্নেয়গিরিতে ঘটেছিল এক বিস্ফোরণ। আর পুব দিক থেকে আসা ঝঞ্ঝায় লাটোলি সমভূমির উপর দিয়ে এই বিস্ফোরণের কালো ছাইয়ের ঘূর্ণি রয়ে গেল।বর্ষার শুরুও ছিল তখন। এই বৃষ্টি ঘাসের উপর ছাইয়ের আবরণ ফেলল--- ছেয়ে গেল গাছের উঁচু মগডালও। খাবারের খোঁজে আসা প্রাণীরা গেল হকচকিয়ে, আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত। হাতি,গন্ডার, জিরাফের দল পালিয়ে পথ খুঁজছে। লাফিয়ে চলছে খরগোস, অ্যান্টিলোপ আর বড় দাঁতওয়ালা বাঘ। পোকামাকড়ও হামাগুড়ি দিয়ে ছুটছে চতুর্দিকে। ঠিক তখনই আবার অগ্ন্যুৎপাতের ছাই সবকিছু দিল ঢেকে। এই ছাই-ই ভরিয়ে দিল পদচিহ্নের গহ্বর গুলো--- আমাদের আবিষ্কারের জন্য থেকে গেল এসব...

বহু পদচিহ্নের মধ্যে কয়েকটি আমাদের কল্পনাকে আলোড়িত করল। তিনটি জীব বৃষ্টির পরেই ওই সমভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে গেছে। যেন তিনজোড়া মানুষের পা! এই জীবেরা আমাদের মতো খাড়া হয়ে হাঁটত। তাদের পা-গুলো ছিল ঠিক আধুনিক মানুষেরই মতো। এরাই হলো আধুনিক মানুষের অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস, আধুনিক মানুষের সম্ভাব্য পূর্বসূরি। আদিম মানুষের বিস্ময়,আগ্ৰহ বা ভয়ের এই হঠাৎ চলা বেঁচে আছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। লক্ষ-অযুত-হাজার বছর পেরিয়ে সেই মানুষের উত্তরপুরুষ এই আমরা আজও খুঁজছি নিজেদের অস্তিত্বকে। আগ্ৰহ,বিস্ময়ে, ভয়ে,আবেগে।

কখনো কখনো হাতছানি দেয় বিগত জনম। হয়তো আগের জন্ম। হয়তো সেটা এই জন্মেরই প্রারম্ভ।সম্মোহ বুঝতে পারে না। জায়গাটা চেনা মনে হয়! যেন প্রতিটি ধূলিকণা সম্মোহ স্পর্শ করেছে। আবার পরমুহুর্তেই রাস্তাঘাট, শানবাঁধানো পুকুরপাড়, একটু দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় সেজের বাতি, একটা বারবাড়ি, বৈঠকখানার কড়ি-বরগাওলা মস্ত হলঘর, আবার কোনো অন্দরমহল,পাতকোতলা, একদম উঠোনের সঙ্গে লাগোয়া ছোট রোয়াক পেরিয়ে ব্যারাকের মতো রান্নাঘর-- এই সব কিছু আবছা লাগে, অচেনা মনে হয়। অচেনা মনে হলেও সম্মোহ বুঝতে পারে কোনো একদিন এসবের মধ্যে ছিল সে।

কখনো আবার এই স্মৃতিবিলাসকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয়। স্মৃতির যে অংশে কিছু কিছু বিস্মৃতিময় পেলবতা আছে,সম্মোহ সেই নরম ও মায়াবী সময়গুলি দু'হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিতে থাকে।

ঘুম ভেঙে যায়। সম্মোহ ভাবে স্বপ্ন আর ভাবনার কি বিচিত্র গতি! দেখে বৃষ্টি হচ্ছে। নীল ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি হাওয়ার টানে কখনও বা এদিকে যায়, কখনও বা অন্যদিকে। সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে।কালো ও ঘোলাটে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। দিনের শুরুতেই মনে হয়েছিল বেলা ছোট হয়ে আসছে। সময় চলে যাচ্ছে। অথচ এই ষাটর্দ্ধো জীবনে তার কাছে সবই অধিকন্তুর এক্তিয়ারে বলে মনে হয়। সম্মোহের কলকাতার বাড়ির এক প্রতিবেশী ভোরবেলাকার ভ্রমণটি সেরে এসে যখন চা পান করেন, তার কাছে এক কাপ চা অধিকন্তু হলেও অভ্যার্থনাযোগ্য বিবেচিত হয়।

নদীর ধারে জন্ম বলে আজীবন নদীর স্বপ্ন দেখে গেল বন্ধু দিবাকর। শুধু নদী কেন, চারপাশটা বর্ষায় মনে হতো জলছবি। সেই জলের টান রয়ে গেল। কোথাও গিয়ে নদী দেখলে মনটা ভরে যায় দিবাকরের।সে বলে, জলরাশির মধ্যে একটা প্রসারতাই শুধু নয় গভীরতা আছে। এই দুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার চিরদিনের চলা।যাকে বলি স্রোতধারা। দিবাকর এমন জীবন্ত, এমন দুরন্ত যে, তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সব বিবর্ণতার অবসান--- যেন এভাবেই জীবনের কেন্দ্র বিন্দুতে ফিরে আসা। অচলতা নয় গতি, পেছনে নয় সামনের দিকে তাকানো।উৎস থেকে মোহনায়। তারপর অপরিমেয় বারিধি।

আজ দিবাকরের জন্য মনটা ছটফট করছে। সম্মোহ ভাবলো একটা ফোন করবে। অনেকদিন কথা হয়না।

----" হ্যালো দিবাকর! দিবাকর...!"

----" শুনতে পাচ্ছি। বল। কেমন আছিস?"

--- " চলে যাচ্ছে রে! তুই? তুই কেমন..."

---"ভালো নেই রে ! বিস্ময় আর আনন্দ জীবনের মূল কথা! এদুটোই হারিয়ে ফেলেছি। কিছু ভালো লাগে না রে! কোনো কিছু আর ভালো লাগে না!"

---" কেন রে! কি এমন হলো? বুড়োদের মতো কথা বলছিস কেন রে?"

---" ফাটছে তো আমার! তুই বুঝবি কি! ছেলে বিয়ে করে বাচ্চা পায়দা করে ঘাড়ের উপর বসে বসে খাচ্ছে। আর আমার সামান্য কটা টাকা পেনশন। চলে? চালানো যায়?"

----" ছেলে প্যায়দা করে নাতি দিয়েছে। এতো ভালো কথা। এতে এ্যাতো হাহাকার কেন?"

---" তুমি কি আর বুঝবে ভায়া।বিন্দাস আছো। নদের নিমাই হয়ে।"

---" হাহাহাহা..." সম্মোহ হেসে ফেলে ‌।

----" শোন, ছেলে সঙ্গে সবসময় খিটখিট করা বন্ধ কর। ওকে কিছু টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা করে দে। তুই নিজেও ব্যবসাটা দেখ! "

----" কি ব্যবসা করবে শুনি। কোনো চেষ্টা আছে?খালি বাপের পেছন মারার ফন্দি করছে।"

---" তুই শুধু শুধু ছেলেটার ওপর রাগ করছিস। ওকে দূরে না ঠেলে ওর পাশে থাক। আর যেকোনো দিন আমার কাছে চলে আয়। তোকে নদী দেখাতে নিয়ে যাব।"

---" নদী এখন যদি হয়ে গেছে রে ভাই। তুমি মনে করে ফোন করলি, ভালো লাগলো। কেউ তো ফোন করে না! তুই করিস মাঝে মধ্যেই! যাব রে একদিন যাব। তোর কাছে কটাদিন কাটিয়ে আসবো।"

দিবাকরের সঙ্গে কথা বলে মনটা খারাপ হয়ে গেল সম্মোহের। দিবাকরের নদীতে এখন অজস্র যদির ডিঙি ভাসছে। ছেলেবেলায় যখন কার্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ দেওয়া হতো উঁচু বাঁশের ডগায়, তখন একটা অনুভুতি হতো আকাশের সঙ্গে মাটির একটা সখ্য আছে! আজ দিবাকর ওর ছেলের সঙ্গে সেই সখ্যতা হারিয়ে ফেলছে কেন? জীবনের অপূর্ণতা কোনদিন শেষ হবার নয়! জীবনের সঙ্গে গা ঘেঁষে দিবাকরকেও অনেকদূর যেতে হবে, এই কথাটা দিবাকরকে বোঝানোর খুব প্রয়োজন।

হাতির গল্প শুনিয়েছিলেন সন্ত ফ্রান্সিস। হাতি তার সঙ্গীনী কখনো বদলায় না। তার ওপর তিন বছরে মাত্র পাঁচদিনের জন্য সঙ্গিনীর সঙ্গে সহবাস করে। ষষ্ঠ দিনে পুরুষ হাতি ফের ভিনদেশে পাড়ি দেয়।দিবাকরের কথা ভাবতে ভাবতে হাতির কথাটা মাথায় এলো সম্মোহের।


Friday, November 27, 2020

||বিশেষ সংখ্যা ≈ কার্তিক ঢক্ ||

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

কার্তিক ঢক্













অনুকবিতা


১। অন্তর্দহনে ঘর পুড়লে
    জলের কোনো ভূমিকা থাকে না। 

২।পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে মাঝে মাঝে
    অবলুপ্ত মোহর কুড়ায় আমি। 

৩।একটি নদী থাকলেই জল থাকবেএমন        
    কোনো কথা নেই-প্রতিটি অপরাহ্নে
    নুড়িপাথরের গান আর খালি কলসির
    কান্না শোনা যায়।

৪।সুন্দরমনের ঝিনুকগুলির বুকে মুক্তা থাকেনা 
   দীর্ঘশ্বাস এর ধূসর আর্তনাদ খেলা করে
   আমরা তাকে কয়লা বলি...

৫।চাঁদ ভালো, না সূর্য ভালো
   এই প্রশ্নের মুখোমুখি হ'তে গেলে
   আগে খুলে রাখতে হবে মুখের থেকে মাস্ক 

৬।সবারই ইচ্ছেদের যে ডানা থাকে
    আমি তাকে মান্যতা দিই...

৭। সুতীক্ষ্ণ খঞ্জরটিকে ধারাল করেছি আমিই -
  বুকপকেটের পিছনের রাস্তায় অহরহ 
  কুচি কুচি করছে প্রহর...

৮। উপোসি চোখ পেতে রাখি
   একটু আধটু চাঁদ দেখবো বলে -
ও আকাশ মেঘের আড়াল দাও কেনো! 

৯।যতোবারই জিভ ছুলো না কেনো
ভালোবাসি বলাটা আসলে হৃদয়ের কারুকাজ...

১০।ব্যুমেরাং শব্দটি আসলে আমার জন্য নয়!

Sunday, November 22, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
| নভেলেট | 

অরিজিৎ চক্রবর্তী

ডারউইনের চিঠি ( ১২ তম পর্ব )


এরকম বহু ঘটনার চাক্ষুষ উপলব্ধি সম্মোহ করেছে, এবং আশ্চর্য হয়েছে। ভেবেছে মানুষকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, তাকে উপলব্ধি করতে হয়।  উপলব্ধির মধোও যে একটা তেপান্তর আছে! আর সেই তেপান্তরের একটা শীতলতা আছে! যে একবার ভেতরটায় ঘুরে এসেছে সে জানে! এখন সম্মোহও জানে। তার প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার পথে শীতলতার শিউলি ফুল ফোটে! জীবন সাজিতে সবটাই কুড়িয়ে নেয় সম্মোহ।

তবু পরিবেশ সৃষ্টিতেই কাহিনীর অভিনবত্ব এই কথাটিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই নন্দিনী সেনের চিঠিটা বালিশের তলা থেকে আবার বের করলো সম্মোহ। এটা কি প্রেমপত্র! নাকি একজন মধ্যবয়সীয় মহিলার জীবনের হাহাকার!

হাহাকার! কথাটা ভেবেই আবার হাসি পেল সম্মোহের। হাহাকার ছাড়া যে আমাদের জীবনটাই অর্থহীন! হাহাকার আছে বলেই ছবি, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, যৌনতা! মানুষে মানুষে মৌলিকতা! সন্ধ্যার নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে, অনেকটা সময় ধরে তাকিয়ে থাকলে কত রকম হাহাকার ধরা দেয়। আবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। তখন মনে হয় অনন্তের মুগ্ধতায় আমরা কত অসহায়! সম্মোহ চিঠিটা পড়া শুরু করলো।

সুজনেষু সম্মোহবাবু,

          আশাকরি ভালো আছেন। আপনার ওখান থেকে ফেরার পর কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল আপনাকে একটা চিঠি লিখি। একবার ভাবলাম চিঠির কথা গুলো হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠাই। কিন্তু লেখা হয়ে উঠলো না। আজ রাতে প্রায় কুড়ি বছর পর কাগজ আর পেনের মধুচন্দ্রিমায় আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। লিখেও ফেললাম। বেশ লাগছে! আপনি আমাকে যেন নতুন একটা জীবন দিলেন!

আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি একটু সাইকো আছি। আমাকে নিয়ে আপনার এই ভাবনা আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে। তোয়ার মুখে কথাগুলো শুনে প্রথমটায় কিছুটা হতাশ হলেও পরে মনে হলো আপনি আমাকে নিয়ে যে এতটা ভাবছেন এটাই আমার ফেলে আসা অতীতের স্পন্দন! চিন্তা করবেন না, আমি আবার আপনার কাছে আসবো। আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনার শরীরের গন্ধ নেব। এরকম বুনো পুরুষ গন্ধ আমাকে বড্ড বেশি ঘনীভূত করে!

শোয়ার ইচ্ছে থাকলে ভণিতা না করে সরাসরি বলবেন। আমার কোন অসুবিধা বা আপত্তি নেই। এবার থেকে অনন্ত আমাকে আপনার মুখটা দেখান। মুখোশ দেখাবেন না প্লিজ।

                                      নন্দিনী

সম্মোহ এই চিঠির কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। ভাবছে একবার তোয়াকে ফোন করবে। তাপসদাকে বিষয়টা জানিয়ে মতামত নিয়েছে।তাপসদা বলেছে ইগনোর করতে, কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। বরং এগুলোর থেকে দূরে থাকাই ভালো।

অথচ একটা অস্থিরতা কাজ করছে ক্রমাগত। বিষয়ের সঙ্গে নিজের তেমন কোন যোগসূত্র খুঁজে না পেলে যা হয়! সম্মোহের তাই হচ্ছে।অদ্ভূত মহিলা মাইরি। বাল এমন কথা বলছে যেন আমি ওর হারিয়ে যাওয়া নাঙ।না তোয়াকে একটা ফোন করা দরকার। আমি ওকে কি বলেছি সেটা জানা দরকার। সম্মোহ তোয়াকে কল করলো।

---"হ্যালো, নমস্কার আমি সম্মোহ বলছি..."

---" বলুন জামাইবাবু, কেমন আছেন?"

----" জামাইবাবু! এসব কি বলছেন! আমি বাঁকুড়া থেকে সম্মোহ বলছি..."

----" জানি তো! আপনি আমাদের সম্মোহ জামাইবাবু" কথার সঙ্গে হাসির ফোয়ারা।

----" দেখুন বিষয়টাকে আর নেওয়া যাচ্ছেনা। ফাজলামির একটা সীমা থাকে। আমি আপনার জামাইবাবু নই। নন্দিনী ম্যাডাম কি বলেছে আপনাদের!" রাগে সম্মোহ আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠছে।

---" নমস্কার। ফোন রাখছি।"

---" জামাইবাবুবুবু..."

সম্মোহ ফোন নামিয়ে রাখল। নাহ্ , এর একটা বিহিত করতে হবে! ছেলেখেলা নাকি!

হাম তুম দোনো জব মিলেঙ্গে...! মোবাইলে রিং বাজছে। আর রিং টোনের বিপরীত প্রান্তে অত্যধিক বিরক্ত হচ্ছে সম্মোহ।

---" হ্যালো, কি হচ্ছে এসব! কি চাই আপনার?"

---"সুমু সুমু শুধু তোমাকে চাই গো। ঝিঙ্কু ঝিঙে তোমাকে চাই"

--- "সুমু মানে?! কি বলছেন এসব!"

---" সুমু আমার আদরের সম্মোহ গো!"

---" আপনি ডাক্তার দেখান। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।"

---" ঠিক বলেছো সুমু। আমি তোমার জন্য পাগল।"

সম্মোহ প্রবল ক্ষেপে গিয়ে ফোনটা রেখে দিল। তারপর নন্দিনী সেনকে ব্লক লিস্টে ফেলল। তাপসদা ঠিকই বলেছে ইগনোর। ইগনোর একমাত্র ওষুধ।

কিন্তু কি এমন ঘটলো যার জন্য নন্দিনী সেন এরকম অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।সম্মোহ কোনো কূলকিনারা পেল না!

রাতে প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ফেসবুক একাউন্টটা খুলতেই দেখল "ধন্যিমেয়ে" গ্ৰুপের একটা নটিফিকেশন। নন্দিনী সেন আর তোয়া গোলপার্কের একটা ক্যাফেতে ক্লিভেজ উন্মুক্ত করে দাঁতক্যালানো কয়েকটা সেল্ফি পোস্ট করেছে। সঙ্গে লেখা " প্রতিদিন সম্মোহিত হই..." 

এটা দেখে সম্মোহের গা জ্বলে উঠল। তারপর নিজেকে নিজেই বলল, ইগনোর! কিন্তু মনের ভেতর থেকে কিছুতেই নন্দিনী নামের প্রদাহটা কাটছে না। এর আগেও কত ট্যুরিষ্ট এখানে কাটিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই সম্মোহের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে কি সেই রাতে সম্মোহ নন্দিনীর কাছে কোন বিশেষ সুযোগ নিয়ে ছিলো! সবাই নিজের নিজের রুমে চলে আসার পর, সম্মোহ খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে আসে। খানিক বাদে নন্দিনী ফোন করে সম্মোহকে ডাকে। বলে ঘুম আসছে না। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সম্মোহ নন্দিনীর রুমে গিয়ে দেখে, নন্দিনী এই ঠান্ডায়  একটা স্লিভলেস নাইটি পড়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে আছে। সম্মোহ রুমে যেতেই, বিছানায় বসতে বলে। সম্মোহ বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে।

---" আপনি এতো রাতে এলেন, ধন্যবাদ। আসলে আমার ঘুম আসছে না। তাই আপনাকে বিরক্ত করলাম।"

----" সে ঠিক আছে। আপনি ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। আমি আসি।"

----" ইশারা বোঝেন না! আপনি ন্যাকা! আমার কি কিছুই নেই। এত বুড়ি আমি!"

---" কি বলছেন এসব। আপনি নিজেকে শান্ত করুন। ঘুমিয়ে পড়ুন।'"

সম্মোহের মাথাটা নেশায় ঝিমঝিম করছে। কি বলবে আর কি করবে বুঝতে পারছে না! নন্দিনী বিছানা থেকে নেমে একেবারে সম্মোহের চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

---" নাও আমাকে নাও। এরকম সুযোগ পুরুষ মানুষ ছেড়ে দেয়! "

সম্মোহ নন্দিনীকে জাপটে ধরে বুকের উষ্ণতায় মুখ লুকিয়ে ভাবছে, লীমার কথা! মনে হচ্ছে লীমা নামের এক নিশ্চল বাতাস আবর্তময় কঠিন আঘাতে হয়তো এখনই সব এলোমেলো করে দেবে! সম্মোহ কি এই অসীমের ভার বইতে সক্ষম!


Friday, November 20, 2020

||বিশেষ সংখ্যা ≈ সায়ন রায় ||

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
সায়ন রায়









জন্ম:১৯শে আগস্ট,১৯৭৭ ,পেশা:শিক্ষকতা। বিষয়:ইংরেজি।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :

১.মহামানবের পোশাক (কবিতাপাক্ষিক,২০০০)  

২.মুহূর্তের পাশে সমগ্র (অভিযান,২০০৯)  

৩.তরঙ্গ ও ইশারা (আদম,২০১২) 

 ৪.রভস (ছোঁয়া,২০১৭)  

৫.লুকোনো জলের দাগ (শুধু বিঘে দুই,২০১৭) 

 ৬.সকল ধূসর চিহ্ন (ভাষালিপি,২০১৯)

ননসেন্স ভার্স-এর সংকলন: সুবাসিত গোলাপ,সুভাষিত প্রলাপ(ভাষালিপি,২০২০) 

গদ্যগ্রন্থ : An Endless Journey: Revisiting Goutam Ghose Cinema (OFFBEAT,2008) ,

প্রাপ্ত পুরস্কার :শব্দসিঁড়ি পত্রিকা প্রদত্ত  সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মারক সম্মান।

মেরুযাত্রীর ডায়েরি

প্রবল জ্বরের ভিতর দুর্গ।সেখানেই কয়েদ আছে মন।আমি তাকে উদ্ধারের নিষ্ফল

চেষ্টা চালাই। এবারের সপ্তম ক্রুসেড।

 

লড়াইটা বাইরে এবং ভেতরেও।বহুমুখী এ লড়াইয়ে ধুলো হয়ে ঝরে পড়ে আত্মার ছাই।

অনলুকারের হাসিটুকু ঝুলে থাকে দু-ঠোঁটের ফাঁকে। প্রি-ডেস্টিনড্।

 

অভিশপ্ত বাগানের পথগুলি সোনা দিয়ে মোড়া।কী তার ঝলক! কী তার বাহার!

অদৃশ্য দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেই ল্যাবাইরিন্থ।ঘুরে ফিরে একই জায়গা।বারবার।

কেটে যাবে একটা জীবন।

 

অশ্রু কি শরীরের বর্জ্য নির্গম করে? শরীরকে করে তোলে স্বাস্থ্যবান। ভালো।

নাহলে চোখের কোটরে ধিকিধিকি জ্বলুক আগুন। একাকী তরুণ তীব্র শীতে

সেঁকে নেবে তার হাত ও কলম যুগপৎ।

 

২.

একটা বরফ কলের ভিতর সংসার পেতেছ। হাড় কাঁপানো শীত। তুমি তবু

আদুড় গায়ে ঘোরো ফেরো। বদ্ধ উন্মাদ!

 

ফ্রোজেন ফিলিংস্ বলে কিছু আছে পৃথিবীতে? তবে তাকে উষ্ণতার পারদে

চড়াতে হবে গোটা একটা বছর।ঘন হয়ে বেঁধে আছে শ্বাস। তাকে ফুরফুরে

করে বাঁশির ভিতর ঢেলে দিলেই সুর।

 

মমির অন্ধকারে ঝাঁঝালো গন্ধের সহবাস।প্রাচীন পাথরের ফাটলে ফাটলে জমে

জল।এভাবেই জেগে থাকো সহস্র বছর।

 

ঘুম নেই রাত।ঘুম নেই দিন।নিঝুমপুরীর হাহাকার।আর অতৃপ্ত কারুবাসনা।

জ্যোৎস্নার ভিতর ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে স্তব্ধতার সংগীত।

 

৩.

সকালের রোদে নাড়কেল গাছের মাথায় কাক দম্পতির ভালবাসা। আমি তাদের

দাম্পত্য ঠেলে ঢুকে পড়ি পরাণের গহীন ভিতর। জমিন আশমান এক হয়া আসে।

ঢেউ উঠে গাঙুরের জলে।

 

বিদ্বান প্রেম জানে নি। অথবা সরস লিপির ভেতর খুঁজেছিল প্রেম।হায় বিদ্যা!

হায় জ্ঞান!এক বিপুল ঘূর্ণির ভেতর ঝাঁকে ঝাঁকে চাঁদ সূর্য তারা, রাশিরাশি

ক্ষোভ অভিমান চক্রাকারে ঘুরেই চলেছে।মুক্ত কে ? মুক্তি কি ? জানে ওই

কাক দম্পতি। সকালের নরম আলোয়।

 

প্রেমিকের প্রেম মিছে হয়ে যায়।কি তার সত্য? কি তার গোপন? এক

অজানা ঝড়ের দিকে কেবলই সে ধায়।

 

সকালের রোদে কিছু প্রশ্নমালা।উত্তরহীন আলুথালু। দূরন্ত ঘূর্ণির থেকে ছিটকে

আসা কিছু বিভা,স্বর্ণকুচি,মনের অতল হতে উঠে আসা ওম্ ক্ষণিক প্রশ্রয়ে

 

তাকে সাধ দিয়ে গেল।

 

৪.

ভিতরে ভিতরে বিষ। ভিতরে ভিতরে উষ্ণ প্রস্রবণের অবিরাম ধারাপাত।

একটু একটু করে ছিঁড়ে যাচ্ছে জলের শিকড়।ঘুমে জাগরণে কানফাটা গান।

কান্নার অশ্লীল উদযাপন।থম মেরে বসে আছে ভোরবেলা ।

 

দূর দেশের প্রাচীন ভাবুক তার পুথি খুলে দেখে নেয় ক্ষণ, কাল। একটি

উল্কার নিঃশব্দ পতনের সাথেই শুরু হয়ে যায় আমাদের সকল উৎসব।

বেজে ওঠে কাড়া-নাকাড়ার স্বঘোষিত গর্জন।

 

রাশিরাশি ফুল বেল শষ্প ও রক্তচন্দনের মাঝে একফালি হীরা। ঢাকা

পড়ে আছে তার সব দ্যুতি। শঙখ ও প্রদীপ হাতে পূজারিণী ফিরে

গেছে ঘর।

 

অতিমারির শেষে বৃষ্টি নামে। শ্বেত শুভ্র স্ফটিকের প্রায় সেইসব দানা।

সোহাগ ও শীতলতা পেয়ে রণক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস বহুদিন পর সহজ ও নরম

মাটি হয়।

 

৫.

একটা সঠিক ঝড়ের জ্ঞান পেতে চেয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় জনপদ। মাইল

মাইল পথ পাড়ি দেয় বানজারা ধুলো।

 

নীচে বৃক্ষ উপরে আশমান।পরিযায়ী পাখিদের ঢল। চমৎকার আস্তানার

খোঁজে লাগাতার দিগন্ত ভ্রমণ।অশ্রু ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিভে গেল সকল জীবন।

 

মেরুর কাছাকাছি গন্তব্যহীন ওই দিশা।লুপ্ত স্মৃতির পটচিত্রে লিখে রাখো

পথনির্দেশিকা। স্তব্ধ হয়ে আসে সব চলাচল।

 

শেষ থেকে শুরু বা শুরু থেকে শেষ।একটি রেখা সহজেই বৃত্ত হয়ে ওঠে।

সেই বৃত্তের পাড় ধরে ক্ষীণ এক পথ।সহজে কঠিনে এই যাত্রা অমলিন।













Wednesday, November 18, 2020

||বিশেষ সংখ্যা ≈ মাসুদুল হক ||

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
মাসুদুল হক 















কাঁটাতার ও অনান্য কবিতা 

কাঁটাতার 

এক. 
চশমা পরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই 

জঙ্গল ভাগ হয়েছে সীমান্তে 

সীমান্তের কাছে এসে হিন্দু পাড়ায় আটকে যাই 

কাঁটাতার বুকে চেপে বসেছে এ পাড়ায় 
সীমান্তের ওপারেও হিন্দু পাড়া 

এক‌ই পাড়া এখন সীমান্ত ভাগে 
বাংলা আর ভারত হয়ে বুক চিতিয়ে আকাশ দেখে 

আর একটা ফিঙে উড়ে যাচ্ছে এপার থেকে ওপারে! 

দুই.
জঙ্গলে হাটতে হাটতে 
পথ হারিয়ে কাঁটাতারের কাছে দাঁড়াই 

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ সন্ধ্যা নামিয়ে আনে 

সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের আজান 
অবলীলায় বাংলায় ভেসে আসে! 

লালন

ধুলো-বালি ওড়ানো রাস্তা দিয়ে চলছে গরুর গাড়ি বাতাসে আলখল্লা উড়িয়ে লোকটা চলে যাচ্ছেন 
পাখি ও পাতার  মধ্যে গুঞ্জন

সূর্য আর চন্দ্র চেনে তাকে;আসমানের তারা দেয় সাক্ষী 
লোকটা খাঁচার ভিতর অচিন পাখি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়  

মুখোসের বিনিময়ে আয়না দিয়ে 
সহজ মানুষ খোঁজেন 
জাতের পরিবর্তে মন;
ধর্মের বাইরে মানুষ!

লোকটা হেঁটে বেড়ায় মন থেকে মনে;হৃদয়ের রাস্তায় 

অথচ তার দেখা পেলাম না আজ‌ও

শহরের পাখি

শহরের পাখি, বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে ডানার শব্দ 
রোদের রংয়ে এঁকে নিচ্ছে শরীর 

ওর কণ্ঠে কয়েদীর চিৎকার। কয়লাপোড়া দিনের গন্ধে 
 শ্রমিকেররা দুপুর রোদে ভিজতে থাকে 

চিলচিৎকারের প্রতিভায়
 জেলার তাকিয়ে দেখে আকাশে
তারপর অজানা শঙ্কা নিয়ে পরিদর্শনে ছোটেন

কয়েদী থাকে ঠিক ঠাক 
শুধু কয়েকটি বিড়াল নিশ্চিতে হেঁটে বেড়ায় 
দুপুরের জেলখানায়
 
আয়না

আয়না, চলমান মুহূর্তের বিন্দুগুলো মিলিয়ে 
আমাকে অবিকল দেখায় পারদে 

আলোভরা ভোরে আমি আয়নায় জেগে উঠি 
অথচ আকাশ কালো হলে শুধু আমাতে আমি থাকি 
আয়নায় কোনো মুখ থাকে না 

 আয়নায় দেখা আমাকেই আমি 
মিলিয়ে মিলিয়ে স্মৃতি ও ছবি দিয়ে নিজেকে চিনি 

বোবা মেয়ে 

রঙ্গীন বিকেল গায়ে নিয়ে অন্ধকারে ঘুমাতে যাচ্ছে পিপুল গাছটি 
প্রতিদিন ও ঘুমায়;‌আজ দেখা হলো আমার সঙ্গে 

ওর দিনের নিঃশ্বাসে আমি স্বস্তি পাই
তাই রাতে খুব নিবিড় হলাম গাছটির কাছে 

পিপুল গাছ এক বোবা মেয়ে 
ওর সব কথা গুবরে পোকার কাছে আছে 

রাত হলেই বোবা এই মেয়ে শরীর রক্ষায় বিষ ছড়ায় 
আর গুবরে পোকাগুলো ওর কানে কানে কথা বলে 

 আমি রাতেই নিবিড় হলাম মেয়েটির কাছে 
 কানে কানে গুবরে পোকার কথা বুঝে নিতে 

শিকার

সন্ধ্যা তোমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে 
তোমার ঠোঁটে আমি এক রেশম পোকা 
অন্ধকারের আগে ধরা পড়েছি

আলোর দিকে ছুটতে ছুটতে 
আমার ঠোঁটে তোমার ঠোঁট 

চরকার সুতো দিয়ে 
আমি তোমাকে বেঁধে ফেলতে চাই 
আমার লালায় ভয় নেমে আসে 
 
তোমার শরীর থেকে এক অদৃশ্য বুনন;
একটা মাদকের ঘ্রাণ 
আমাকে ঘ্রাস করে নেয় 

তুমি সন্ধ্যার গভীরে আরো অন্ধকারে
পরিপাকতন্ত্রের প্রতিভায় 
আমাকে ধীরে ধীরে হজম করে নাও

আরেক রেশমের ছোঁয়া অনুভব করে 
আমি আলোর দিকে ফিরতে চেয়েছিলাম 

তুমি এক শিকারী ফিঙে 
লোভ ও লালায় আমাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলে! 


স্যাটায়ার

ধর্ষণলিপির মধ্যে মেয়েটি আটকে গেছে 
মেয়েটি আমাদের বোন অথবা গতজন্মের প্রেমিকা 

রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি ডানার নাম গণতন্ত্র 
সে ডানায় ধর্মান্ধ পোকাগুলো বসে আছে 

মেয়েটি কিছু বলতে চেয়েছিল... 
পূজিতন্ত্রের সমাজবিজ্ঞান কিন্তু সন্ত্রাসের ব্যাকরণ
শেখায়; 
মেয়েটির কথা তাই হাজার বছরের দূরের 
                                                       কথা হয়ে ওঠে 

ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মিছিলের মধ্যে মিছিল 
নেকাবে নারীর মুখ ঢেকে
বোরকার নিচে পুরুষের পা ধরা পড়ে যায় 

কুৎসিত সে পা রাজপথে ধর্ষণের বিচার চায়!